কুরবানি/০৪

.
হয়তো মহাবিশ্বের সীমানা আছে, কিন্তু মূর্খামির কোনো সীমানা নেই। এই কথাটি আমার না। কে বলেছে তাও এই মুহুর্তে মনে করতে পারছি না। তবে যে-ই বলুক না কেনো, কথাটা কিন্তু মন্দ না। আরো একটি বিষয় আছে, আমি খালি চোখে ঝাঁপসা দেখি না, চশমা পড়লেই ঝাঁপসা দেখি। আমি জানি, মূর্খদের এই দলে কে কে আছে, ইতিহাস সে কথা কোনোদিন ঘাটতে যাবে না। তবুও আমি নীলুর সাথে এক চিমটি কথা না বলে থাকতে পারছি না। এখানেও সমস্যা কম না। পাড়ার মেয়েরা জোঁকের মতো ওর পেছনে লেগে আছে। তারা কেউ কোনোদিন নতুন বউ দেখেনি।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পরিকল্পনা ঠিক করতে চাইলাম। মাথায় কিছু কাজ করছে না। কিন্তু অনবরত সংকেত পাঠাচ্ছে। বুঝতে পারলাম মাথা কাজ না করার মানে দুইটি। এক, সুযোগের অপেক্ষা করা। দুই, রিক্স নেওয়া। নেকড়ের মতো শিকার ধরার জন্য ওত পেতে বসে থাকার মতো সময় আমার হাতে নেই। সুইয়ের মতোন চিকন ছিদ্র দিয়েই আমাকে ঢুকতে হবে। অত:পর সুযোগ পেলে ফাল হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। অন্ধকারেরও আলাদা একটি রুপেমা আছে। সেই রুপেমা কয়জন দেখতে পারে?

হঠাৎ শিয়াল দৌড়ের কথা মনে পড়লো। মানুষ দেখলেই সে লেজ গুটিয়ে ভোঁ দৌড় দেয়। সামনে- পেছনে তাকায় না। আমিও এমনি একটা দৌড় দিয়ে যে ঘরের মাঝখানে নীলু স্নায়ুর মতো বসে আছে, সেখানে গিয়ে পোঁছলাম। আমাকে দেখেই মুখরা রমণী দল সমানে শব্দ ও বাক্যবান ছুঁড়তে লাগলো। আমি একটাও ফিরানোর চিন্তা মাথায় ঠাই দিলাম না। বীরের মতো সদর্পে বললাম, নীলু তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে। পেছন থেকে কে জানি বলল, কি কথা?
আমি মুখ না ঘুরিয়েই বললাম, যে কথার কোনো আগা মাথা নেই সেই কথা। নীলু পাথরের মূর্তির মতো আমাকে অনুসরণ করলো।

কিছুক্ষণ শামুক নীরবতা। কেউ কথা বলছি না। না আমি। না নীলু। নীলু পাখির ছানার মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি–? একবার আকাশে যাই। আরেকবার যাই পাতালে। যেনো পৃথিবীতে আমি নাই। কথা বলি আর নাই বলি, আমি জানি দু’জনের হৃদয়েই এখন অশান্ত সাগরের ঢেউ। আমি স্বীকার করছি, এ আমার দুর্বলতা বই কিছু নয়। অবশেষে নীলুই প্রথম মুখের তালা খুললো। যেনো মাটির কাছে জানতে চাইলো, কিছু বলবেন ভাইয়া? আমিও চোখের পলক ফেলার আগেই পৃথিবীতে ফিরে আসলাম। গলার স্বর খাদের কিনারে নামিয়ে এনে বললাম, তুমি সকালকে চেন?
জী ভাইয়া চিনি।
কতোটা চেন?
কেজিতে বলবো নাকি সের দরে বলবো?
তোমার যা মর্জি হয়।
এরপর নীলু আর নিজে আটকে রাখতে পারেনি। কেটে দেওয়া বাঁধের জলের মতো হুড়মুড় করে ভেংগে পড়লো। এরপরের ঘটনাটি আরও আশ্চর্য, ধনুকে তীর দিতে যতোক্ষণ ঠিক ততোক্ষণ সময়ে সে নিজেকে ফিরে পেলো। কে বলবে এক বিজলি সময় আগেই এই মেয়ের চোখে জলপ্রপাত ছিলো। অত:পর কোনো রাখঢাক না করেই সে বললো,
আপনি যা জানতে চেয়েছেন, আমি তা বুঝতে পেরেছি ভাইয়া। শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট করে প্রশ্ন করতে হবে না। আমিই বলছি। শুনুন ভাইয়া, রাত যেমন সত্য, দিন যেমন সত্য; তেমনি সকাল আর আমার ভালোবাসাও সত্য। তবে সকাল আমাকে এ বিষয়ে কিছু বলেনি অথবা আমিও সকালকে কিছু বলিনি। তবে আমাদের কোনো কথা হয়নি, দেখা হয়নি বিষয়টি এমনও নয়। নানা বাড়িতে অসংখ্যবার দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে। আমাদের প্রতিটি সাক্ষাৎ কবিতার চেয়ে কম লাবণ্যময় নয়।

এতোটুকু বলেই নীলু থামলো। তার চোখে এক বিন্দু অশ্রু নেই। কেবল ভালোবাসা নিয়ে গৌরব আছে। হিমালয়ের মতো অহংকার আছে। ওদের কাছে হয়ত আমার ভালোবাসা শেখার আছে। মন তো সবারই আছে। কিন্তু এমন ভালোবাসার মন কয়জনের আছে? কেনো জানি আমার মনের ভেতরে খচখচ করছে। এ কেমন কথা, জমিতে ধান বপন করা হয়েছে। আগাছা পরিষ্কার করা হয়েছে। অতিশয় খাতির যত্ন করে এদের বড়ো করা হয়েছে; অথচ ফসল ঘরে তুলবে না! নবান্নের পিঠালির স্বাদ আস্বাদন করবে না? এসব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে এখনো অধরা। তবে আশার কথা, আমার আগ্রহে এখনো ভাটা পড়েনি। নীলুকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি বললে না কেনো?
ভাইয়া, আপনি বুঝতে পারছেন না কেনো…বলার তো কিছু নেই। সকাল সব জানে। আমিও সব জানি। হৃদয়ের চেয়ে কি মুখ কোনোদিন বড়ো হয়?
মাত্র আটটি ক্লাস পাড়ি দেওয়া একটি পুঁচকে মেয়ের মুখে এসব কথা আমার বেমানান লাগছে। তাও হজম করা ছাড়া আমার অন্য উপায় কি? স্বেচ্ছায় যেই কাঁটা গিলছি; সেই কাঁটার বিষ আমাকেই সইতে হবে। আবার বললাম, এখন তাহলে কি হবে?
আমার প্রশ্ন শুনে নীলু যেনো সাত সমুদ্রের অতল থেকে ফিরে আসলো। অতঃপর জলদ গম্ভীর স্বরে বললো, এই বিয়ে আমি করবো না ভাইয়া। কিছুতেই করবো না।
নীলুর কথা শুনে আমি আমার প্রিয় উচ্চাঙ্গ সংগীতের সুর ভুলে গেলাম। তবে প্রায় নিবু নিবু আমার আশার প্রদীপটি যেনো হঠাৎ করেই জ্বলে উঠলো।। আমার মন আছে কিনা আমি সঠিক জানি না। তবুও মনে মনে বললাম, তাই যেনো হয়। তাই যেনো হয়।।

(চলবে)

2 thoughts on “কুরবানি/০৪

  1. অসাধারণ এবং অনবদ্য এই ধারাবাহিক। অভিনন্দন প্রিয় শব্দযোদ্ধা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।