জলে জলাঞ্জলি

2782

০১
বিকেলটা জলে দেব ঠিক করেই বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু এমনিভাবে জলাঞ্জলি হবে কোনোদিন ভাবিনি। ভাবতে পারিনি। আজকাল মাঝেমাঝেই ব্রহ্মপুত্র দেখতে যাই। যদিও সে এখন আর দেখার মতোন কেউ নেই। হাতি ছোট হতে হতে চামচিকা হলে যেমন কদাকার দেখায়; ব্রহ্মপুত্রকেও এখন তেমনি দেখায়। এর না আছে গুণ, আর না আছে রুপ। তবুও ব্রহ্মপুত্রের মায়া কাটাতে পারিনা। তবুও পৈতৃক বাড়ির মতো সে আমাকে বারবার কাছে টানে। এখানে আকাশ যতোটা কাছে পৃথিবীর অন্য কোথাও ততোটা না। ব্রহ্মপুত্রের বাতাস যতোটা খানদানী ততোটা পৃথিবীর আর কোনোখানে নেই। দুই পড়ের কাশফুলগুলো যেন অষ্টাদশী নর্তকীর মতো আমার হৃদয়ে চোরাগোপ্তা ঝড় তুলে। কানের কাছে আনত মুখে ফিসফিসিয়ে জীবনের কথা বলে। যদিও আমার জীবন এখন বেশির ভাগ সময় মেঘলা আকাশের সাথে মিতালি পাতাতে ব্যস্ত থাকে।

আমার প্রিয়তমা ময়মনসিংহ শহরে একটু জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতোন জায়গা খুব একটা নেই। তবুও পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের দুই ধার বেশ লাবণ্যময়। এখানে প্রতিদিনই অতিথি পাখির মতো হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। তাদের পায়ের ধূলিতে যেমন সাইমুম সৃষ্টি হয়; তেমনি তাদের কথার কাকলিতে নিষ্প্রাণ ব্রহ্মপুত্র সেও ধন্য হয়। বিশেষ করে গাঙের পানিতে যাদের নতুন পানির জোয়ার এসেছে তাদের কথা না বললেই নয়। শ্রুতি আর প্রতিশ্রুতির মেঘ ডাকে, মুষলধারে বৃষ্টি সেও বসে থাকে না। এমনি পাগলা হাওয়া কার না ভালো লাগে? আর আমার মতোন আলো-আঁধারির আধামানুষ হলে তো কোনো কথাই নেই!

ব্রহ্মপুত্রে যদিও এখন মন ভরানো জল নেই; তবুও পায়ে হেঁটে ওপারে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থাও নেই। অনেকদিন ধরে যে ব্রীজটি হওয়ার কথা আকাশে-বাতাসে ভাসছে; তারও কোনো সুগন্ধ নেই। যা আছে সেটা সেই সনাতনী পদ্ধতি! খেয়া করে একবার ওপারে যাও; আরেকবার এপারে আসো। অবশ্য এই পদ্ধতিটা ভ্রমণ বিলাসী মানুষের জন্য মন্দ নয়। মোটামুটি একটা নৌ-এ্যাডভেঞ্চার হয়ে যায়। বাকি থাকে কেবল দুই পাড়ের অগণিত আমজনতা। অবশ্য তাদের কষ্টের নামতা শোনার মতো মানুষের অভাব এই দুনিয়ায় নেই; কেবল কষ্ট দূর করার তেমন কোনো মানুষ নেই। এ নিয়ে দুই পাড়ের মানুষের যেমন হতাশা আছে, তেমনি বুক ভরা আশাও আছে। দু’চোখ উপচানো স্বপ্ন আছে। আর সেই স্বপ্ন যেমন-তেমন স্বপ্ন নয়। একদিন তারা ব্রহ্মপুত্রের বুকের উপর দিয়ে জুতা পায়ে মচমচ করে হেঁটে এপার-ওপার করবে! মস্তবড় জলহস্তীর মতোন বড় সেই জলজ্যান্ত স্বপ্ন! শত হতাশার মাঝেও আমার তালগাছ সমান বিশ্বাস আছে- আজ হোক, কাল হোক কিংবা পরশু হোক একদিন না একদিন তাদের সেই স্বপ্নের পাখা গজাবেই!

আমি সেই ব্রহ্মপুত্র নদের যে পাড়ে ঈশ্বর আছেন; সেই পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার আশেপাশে ছেলেবেলার দেখা আখড়ার মেলার মতোন এলোপাথাড়ি মানুষের খেলা। কেউ হাসছে। কেউ হাসতে হাসতে কাঁদছে। আর কেউ কারো হাত থেকে উষ্ণতা ছিনিয়ে নিচ্ছে। মশা তাড়ানোর ছল করে গাল লাল করে দিচ্ছে। আর আমি একজন নিতান্ত আলাভোলা আধাআধি মানুষের মতোন প্রিয়তমা ব্রহ্মপুত্রের দিকে দুই চোখ মেলে উদাস চেয়ে আছি। আমার সেই চোখ যখন ব্রহ্মপুত্রের হারানো যৌবন খুঁজে ফিরছে; ঠিক তখনই কাউনের মিহি দানার মতোন সরু একটি অচেনা কণ্ঠস্বর আমার দিকে ধেয়ে আসলো। স্যার ওই পাড়ে যাবেন নাকি?

০২
যেই জল আমাকে সবসময় সতেজ ঘাসের মতোন সুতীব্র আকর্ষণ করে, সেই জলই হল এই আহবানের উৎসমুখ। সাধারণতঃ মেয়েদের কণ্ঠ এমন মিহি হয়। কিন্তু এ যে দেখছি সাক্ষাৎ খেয়া পাড়ের মাঝি! ব্রহ্মপুত্রের সমাহিত জলের উপর শান্ত, সৌম্য, মোলায়েম এক চেহারার সুঠামদেহী তরুণ। চোখে, মুখে নগদ দীপ্তির ছাপ মুদ্রিত অক্ষরের মতো শোভা পাচ্ছে। প্রথম দর্শনেই আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা হোঁচট খেলাম। ছেলেটিকে মাঝি ভাবতে কিছুতেই আমার মন সায় দিচ্ছে না। কেবলই মনে হচ্ছে কিছু একটা গণ্ডগোল তো অবশ্যই আছে। যা আমাকে জানতে হবে। জানতেই হবে।

মাঝির প্রশ্নের জবাব মুখে না দিয়ে নৌকায় আরোহন করলাম। নৌকাটি মাঝারি গোছের। না ছোট। না বড়। তবে ভ্রমণ পিয়াসী মানুষদের জন্য চমত্কার উপযোগী। দুই পাশে পাটাতন দিয়ে বসার সুব্যবস্থা আছে। রঙিন পাল বাতাসে উড়ছে। এতোসব আয়োজনের মাঝেও আমাদের দু’জনের মধ্যে অস্বাভাবিক নিরবতার কাফন মুচকি মুচকি হাসছে। এই অবস্থার অবসান কল্পে আমি যেই মুখের লাগাম খুলে দিতে উদ্যত হলাম, তখনই আমাকে হারিয়ে দিয়ে মাঝি ছেলেটি বলে উঠল, আপনাকে আমি চিনি স্যার। আপনার নাম অচল। আপনি খুব ভালো কবিতা লিখেন। আমি মন ভালো করার জন্য আপনার কবিতা সবসময় পড়ি। আপনার কবিতায় হতাশা আর আশা সমান তালে পথ চললেও জীবনের সুগন্ধ পাই; দিক-নির্দেশনা পাই। মাঝ নদী থেকে কীভাবে তীরে ভিড়তে হয়, ভিড়তে হবে, সেই অনুপ্রেরণা পাই।

পৃথিবী থেকে একলাফে চাঁদে পৌঁছে গেলে একজন সাধারণ মানুষ যতটা আনন্দিত হবে, মাঝির কথা শুনে আমি ঠিক ততোটাই পুলকিত হলাম। এরচেয়ে এক আঙুল কমও না; আবার বেশিও না। তবুও এতো খুশি ধরে রাখার কোনো বন্দোবস্ত আপাতত আমার কাছে নেই। জামার বুক প্যাকেট, বুকের ইন পকেট, প্যান্টের সামনে-পেছনে, ডানে-বামে সব পকেটে কেবল খুশি আর খুশি। অতঃপর কিছু খুশি চোখে, কিছু মুখে মাখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী উদাস মাঝি?

কবিতার প্রসঙ্গ না টেনে নাম জিজ্ঞেস করায় মাঝি কিছুটা না হতাশ হয়েছে, আমি তার নাম বলে দেওয়ায় এরচেয়ে কয়েক কোটি গুণ বেশি অবাক হয়েছে। আমতা আমতা করে বলল, জী স্যার আমার নাম উদাস। কিন্তু আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?

আমি উদাসের প্রশ্নের জবাব দিলাম না। জবাব দেওয়ার জন্য ভেতর থেকে তাড়া অনুভব করলাম না। উদাস নামটি কিছুটা মেঘাচ্ছন্ন মনে হলেও আমার কাছে খুব লাবণ্যময়। আমি বিশ্বাস করি, শিল্পের যেখানে শেষ হয়, লাবণ্যের সেখান থেকে শুরু হয়। মনের ভাবনা মনের ভেতরেই তালা মেরে মুখে বললাম, পড়াশোনা কর বুঝি?

আমি জানি, একজন মাঝিকে করা আমার এই প্রশ্নটা কোনো প্রশ্ন নয়। বলা চলে হালের আধমরা বলদের মতোন জীর্ণ-শীর্ণ একটি প্রশ্ন। উদাসও আমার প্রশ্নের নগদ কোনো জবাব দিলো না। কেবল সুপারি গাছের মতো সুদীর্ঘ একটি দীর্ঘশ্বাস ব্রহ্মপুত্রের জলের সাথে মিশিয়ে দিয়ে বলল, স্যার ঐ পাড়ে যাবেন? নাকি….

আমি বললাম, না। আমি কোন পাড়ে-টারে যাব না। দিনমণি ডোবার যতক্ষণ সময় বাকি আছে, ততক্ষণ তোমার যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে যাও। তাছাড়া তুমি এটাও করতে পার যে, ব্রহ্মপুত্রের ঠিক বুক বরাবর নৌকাটি নিয়ে যাও। অতঃপর বৈঠা নৌকার উপর রেখে দাও। নৌকা তার ইচ্ছে মত চলবে। চলুক। যে পৃথিবীতে সবাই স্বাধীনতা প্রিয়; তাই আমি মনে করি তোমার নৌকারও কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করার অধিকার আছে। তুমি কি বল উদাস? উদাস বলল, অবশ্যই স্যার।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, এজন্য তোমাকে কত টাকা দিতে হবে উদাস?
আমার কথা শোনে উদাস যেন লজ্জাবতী লতার মতো মাটিতে মিইয়ে গেলো। কিন্তু উদাসের মুখ বসে থাকলো না। সে সাফ জবাব দিল, মাফ করবেন স্যার। আপনার কাছে আমি কোনো টাকা-পয়সা নিতে পারব না।
এবার আমি নিশ্চিত না হয়ে পারলাম যে, উদাস কোনো সাধারণ মাঝি নয়। একজন সাধারণ মানুষের হৃদয়ের যতটা বিশালতা থাকা দরকার এই ছেলের এরচেয়ে ঢের বেশি আছে। প্রকৃত পক্ষে ধন থাকলেই যে মানুষ ধনী হয় না, মন থাকতে হয়—এই কথার সত্যতা আবারও আমার কাছে দিবালাকের মতো স্পষ্ট হল।

০৩
আমি জানি, আবেগের জায়গায় খোঁচা পড়লে মানুষ এমন কিছু বলে যা স্বাভাবিক অবস্থায় বলে না। বলতে পারে না। তাই আমি উদাসের এই জায়গাটিতে খোঁচা দিয়ে বললাম,
এমন রাজপুত্রের মতো চেহারা ছবি এবং প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এই তোমাকে আর যাই কিছু হোক মাঝি হিসাবে একেবারেই বেমানান উদাস।

উদাস আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দুই, তিন চিমটি মাত্র সময় নিল। অতঃপর কী মনে করে জানি না একবার আকাশের দিকে মুখ তুলে সাথে সাথেই একটা গভীর অনুশ্বাস সংগোপনে গোপন করে বলল, দুঃখের কথা কী বলব স্যার, আমি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স, মাস্টার্স পাশ করেছি। দুটোতেই প্রথম শ্রেণি। আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমারও দু’চোখে হাজার চোখের স্বপ্ন ছিল। আমাকে ঘিরে বাবা-মায়ের আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা ছিল। দরিদ্র পিতামাতার একমাত্র ছেলে সন্তান হিসাবে একটি চাকুরির জন্য কম চেষ্টা করিনি স্যার। কিন্তু কিছুতেই আমার ভাগ্যের ছেঁড়া শিঁকে জোড়া লাগেনি। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইনি এমন কোন রেকর্ড আমার অভিধানে নেই। আমার জানা এবং বিশ্বাস মতে, প্রতিটি ভাইভা যেভাবে ফেস করা উচিত, আমিও ঠিক সেভাবেই ফেস করেছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। রাগে দুঃখে, অপমানে একদিন আমি কী করেছি জানেন স্যার?

যৎসামান্য ঔষধেই এমন ভালো কাজ হবে আমি ভাবতেই পারিনি। তবুও আমি মুখে কিছু না বলে উদাসের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সে বলতে থাকলো, একদিন হঠাৎ রাত্রিবেলা বাবা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন।

পরদিন সংসার চালানোর মত ঘরে তেমন কিছুই নেই। বাবা খুব কাঁদছিলেন। অবশ্য বাবার চেয়ে মা আরও বেশি কাঁদছিলেন। অতঃপর আমি বাবা-মাকে না জানিয়েই বৈঠা হাতে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবা, মা, ছোটবোন দুটি না খেয়ে থাকবে এটা আমার পক্ষে মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না স্যার। অবশ্য আগের দিন আমার সরকারী চাকুরির বয়সও শেষ হয়েছিল। সেদিন আমি সারারাত কেঁদেছি। একফোঁটাও ঘুমাইনি। অতঃপর সমস্ত রাত্রি অন্ধকার ভেলায় ভাসতে ভাসতে আমি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। ভোর বেলায় সমস্ত জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের ঠিক মাঝখানে আসলাম। তারপর চোখের জলে ভিজতে ভিজতে সবগুলো সার্টিফিকেট কুটিকুটি করে ব্রহ্মপুত্রের জলে ভাসিয়ে দিলাম। সেই থেকে আমি ব্রহ্মপুত্রের মায়া কাটাতে পারি না স্যার। যেই জলে আমি আমার সমস্ত জীবনের অর্জন জলাঞ্জলি দিয়েছি, বাবা, মা এবং আত্মীয়-স্বজনের স্বপ্ন যেই জলে সমাহিত করেছি; আপনিই বলুন স্যার সেই জল আমি কীভাবে ছাড়তে পারি?

এরপর উদাস আর কিছুই বলল না। বলতে পারলো না। ঘামে ভেজা হাত দিয়ে বারবার কেবল চোখের জল মুছতে লাগল। আর আমি জীবনে এই প্রথমবারের মত নিজের কাছে নিজেই হেরে গেলাম। আমাদের দেশে যেভাবে হাটে-বাজারের মতোন যেখানে-সেখানে পাত্র-অপাত্র না দেখে ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা হচ্ছে, আমি জানি না পরিকল্পনা বিহীন এই উচ্চ শিক্ষার বিড়ম্বনা আদৌ হালে পানি পাবে কিনা! এই হতাশার বোঝা জাতি বইতে পারবে কিনা? প্রকৃত মেধাবিরা যেখানে চাকুরি পাচ্ছে না; সেখানে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা এমনকি শিক্ষকের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ভয়ে যে ছাত্রটি সারা ছাত্রজীবন ক্লাসের লাস্ট বেঞ্চে মুখ লুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো, পেছনের দরজা দিয়ে সে-ই আজ দেখা পেয়ে যাচ্ছে চাকুরি নামের সোনার হরিণটির। আমি জানি না, এর মাশুল আমাদের আরও কত প্রকারে গোনতে হবে!

০৪
আমি জানি, উদাসের এই প্রশ্নের জবাব দেওয়ার কোনো জ্ঞান-বুদ্ধি এই মুহূর্তে আমার নেই। আমি এখন কালিহীন কলমের মত হতবুদ্ধি। তবুও কথার পিঠে কথা ছাড়া যেমন প্রেম হয় না, প্রেম ছাড়া যেমন বৃষ্টি হয় না; তেমনি এই উদগীরিত লাভার অবস্থান থেকে আমাদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। অংশুমালি পশ্চিম দিকে যাত্রার আয়োজন যথারীতি প্রায় সুসম্পন্ন করে নিয়ে নিয়েছে। আমি বিদায়ের আয়োজন করার জন্য উদাসকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার বাবা কেমন আছেন?

উদাস বলল, স্যার আপনি যেভাবে বাবার কথা বললেন, মনে হচ্ছে আপনি আমার বাবাকে চিনেন। জানেন। আসলেই কি তাই স্যার?

আমি বললাম, না উদাস। তুমি বলছিলে তোমার বাবা অসুস্থ। তাই আমার এই জিজ্ঞেস করা। উদাস বলল, বাবার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ স্যার। বিছানা ছেড়ে একেবারেই উঠতে পারেন না। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না। কাউকে তেমন চিনতে পারেন না। সবকিছু গুলিয়ে ফেলেন।

উদাসের কথা শুনতে শুনতে বুঝতে পারছিলাম আমার ভেতরে হিমালয় হিমালয় ভাব জেগে উঠছে। আমি জানি, এই অবস্থায় আমি যা বলব, তাই ফলে পরিণত হবে। এই আমি মূলত আমি না। আমার মাঝে অন্য কেউ। এখন আমার সব কথার উড়ন্ত ডানা থাকবে। আমার কথারা দোয়েল পাখির মতোন গান গাইবে। ব্রহ্মপুত্রের হারানো স্রোতের মতো অব্যর্থ হবে। বললাম, তোমার বাবা বিগত তিন বছর তের দিন ধরে প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় আছেন। তাই না উদাস?

চোখের সামনে প্রেতাত্মা দেখলেও উদাস এতোটা হতবাক হতো কিনা আমি জানি না। হাতের বৈঠা গলুইয়ে রেখে তাড়াতাড়ি করে আমার দু’পা ছুঁয়ে সালাম করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। নৌকা তার নিজের মতো করে যেদিকে খুশি চলছে। আর এমনি এক মোবারক সময়ে আমার মুখ থেকে একটি আচানক তাঁরছেঁড়া কথা বের হয়ে আসলো। আমি বললাম,
”উদাস, তুমি বাড়িতে ফিরে দেখবে তোমার বাবা উঠানে পায়চারি করছেন। আর এক আঙুল সময় দেরি না করে তুমি ঝটপট বাবার কাছে চলে যাও। এই নাও পাঁচশত টাকা। এই টাকা দিয়ে তোমার বাবার জন্য এক প্যাকেট মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও। তোমার বাবা মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করেন।‘’

কিংকর্তব্যবিমূঢ় উদাস কী করবে আর কী করবে না— তেমনি এক সিদ্ধান্ত সাগরে হাবুডাবু খাচ্ছিলো। আমি বললাম, তাড়াতাড়ি যাও উদাস। তাড়াতাড়ি যাও…. তোমার বাবা তোমাকে খুঁজছেন…..। সাথে সাথে উদাস নিজেকে ফিরে পেলো। দৌড়ের নৌকার মতোন বাড়ির দিকে প্রাণপণে ছুটতে লাগলো!!

2 thoughts on “জলে জলাঞ্জলি

  1. গল্পটি কয়েকবার করে পড়ার চেষ্টা নিলাম প্রিয় কবি। এককথায় মুগ্ধ পাঠ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।