ভ্রমণ বৃত্তান্ত
চৈত্রের শেষের দিকের ঘটনা। সালটা সম্ভবত ১৯৮৯ হবে! এই কথা শুনতেই বলে উঠলাম, ঠিক মনে পড়ছেনা নাকি? উত্তর এলো না না সম্ভাব্যতা নয় একেবারে ১৯৮৯ সালেই। সেই সালে মাধ্যামিক পরীক্ষা চলছিলো। আমিও পরীক্ষা দিতে ছিলাম। আগে থেকেই মনে মনে ঠিক করিয়াছি আমি বাংলাদেশ যাইবো। কিন্তু সুযোগ পাই নাই, পড়াশোনা আর অন্য কাজে কাজে ব্যস্তই থাকিতাম। ইতিমধ্যে পরীক্ষাও শেষ হইয়াছে, কাজও তেমন নাই। মিলিয়া গেলো সুযোগ! আমি কেবল একাই যাইবো না, সঙ্গে আরও দুই জন মিলিয়া তিনজন যাইবো। আমি কোন ছোটো কালে গিয়াছিলাম, এখন সেই রাস্তা ভুলিয়াছি, সঙ্গে আছে কাকাতো ভাই ‘মজিবুর’।
তার নাকি সব চেনাজানাই আছে। তাকে সঙ্গে লইয়া যাবো। সঙ্গে আরও একজন, তার বাড়ি আমাদের বাড়ি হইতে কিছুটা দূরে ছিলো, সেও সম্পর্কে ভাই হইতো। তার নাম ‘সোফিকুল’। একদিন ভোর ভোর তিনজন মিলে বাহির হইনু। তখন যা অবস্থা ছিলো তা আর কী কহিবো ….। কেন্ কেমন ছিলো? শুন বলিতেছি তোকে। … বিশাল মাঠ, মাঠ ধরেই যাইতে হইবে, সরু রাস্তা, রাস্তায় ধারে কোনো গাছ গাছালী নাই, গাড়িরও কোনো ব্যবস্থা নাই। কেন্ গাড়ি নেই? তোকে কী আর কহিব! তখন সব খানে গাড়ি চলিতো না, কেবলি শহরেই চলিতো গাড়ি তাও আবার কয়েকটা। তাই আমরা যেথা সেথা হাঁটিয়াই গিয়াছি এখানেও তাহার ব্যতিক্রম নয়। ও হো আচ্ছা তার পর? শুন হাঁটিতে হইবে, হাঁটিয়াই যাইতে হইবে প্রায় ‘বিশ-বাইশ ক্রোশ’ পথ। ভোরের বেলা কেবলি বাসি ভাত খাইয়া হাঁটিয়া চলিয়াছি এই পথ। হাঁটিয়া যাই, হাঁটিয়া যাই কোনো গাঁয়ের সন্ধান পাইছি না।
সূর্য ক্রমে ক্রমে ঢোলে পড়িতেছে পশ্চিম আকাশে। এমন সময় পৌঁছাইয়াছি ভারতের সীমানায়, এদিক ওদিক সব সীমানা রক্ষী পাহারা দিতেছে। ভারতের কাউকে পার হইতে দিবে না, আমরা একটু কৌশল করিয়া এদিক ওদিক তাকিয়া এক পলকে পার হইয়া গেলাম! আর পৌঁছাইয়া গেলাম বাংলাদেশ সীমানায়। “সেখানে সীমানা রক্ষীদের লইয়া কোনো সমস্যায় হইল না, সেখানে হলো তো হলো পথ লইয়া!” __এতক্ষণে ‘ষোলো সতেরো ক্রোশ ‘পথ অতিক্রম করিয়াছি। পা ফুলিয়া মোটা মোটা হইয়াছে। হাঁটার আর শক্তি নাই, ক্ষিদের জ্বালায় পেট জ্বলিয়াছে পৌঁছেছি একটা মোড়ে। ডানে বামে পথ কোনটায় যাইতে হইবে আমি কহিনু? মজিবুর বাঁধাইল ঝামেলা! সেও নাকি পথ ভুলিয়াছে। আমি কহিনু চল কাউকে কহিয়া দেখি। ঠিক আছে চল … চল। আমারা আগাইলাম একটা লিচুর বাগানের দিকে। কিছু দূরে আমাদের চোখে পড়লো পাঁচ সাতটা ছেলে বসে আছে। তাহাদের পথের কথা কহিব মনে করিয়া আগইলাম। তারা কি করিতেছিলো তা বুঝিতে পারিতেছিলাম না। “কাছা কাছি আসতই এক অদ্ভুত কাণ্ড!” আমাদের দেখিয়া ছেলেপুলেটি দিইলো দোড়। আমরাও হতভম্ব হইয়া গেলাম! কাকে এবার কহি কোন পথে যাইবো!
মাথায় হাত কী অবাক কাণ্ড! আমরা তিনজনই ফুলপ্যান্ট পড়িয়াছিলাম আর শার্ট ও ছিলো ভালোই। আমরা গাছের তলায় গেলাম। গাছের তলায় দেখিতে পাইলাম কিছুটা তাশ ছড়াইয়া আছে। এবার বুঝতে পারিনু কেন তারা পালাইয়া গেলো। তারা আমাদের পুলিশ ভাবিয়া দিইয়াছে দোড়। একটু পরে মজিবুর কহিলো চলোনা এট্যাই রাস্তা হইবে। ফের হাঁটিতে লাগিনু। হাঁটিতে হাঁটিতে একটা গাঁয়ের মধ্যে ঢুকিনু। গাঁয়ের মধ্যে বিশাল একটা নিমের গাছ! বিশাল মানে একেবারে বিশাল! এতবড়ো নিম গাছ এই প্রথম দেখিনু! তার তলায় কত গোরুমোষ বাঁধা, সাত আটটা গোরুর গাড়ি, কত লোক আরাম করিতেছে তার তলায়। আমরাও ওই গাছের তলায় যাইয়া গোরুর গাড়িতে বসিনু। ক্লান্তিতে ঢুলিতে লাগলাম, ঢুলিতে ঢুলিতে কখন ঘুমাইয়া গেছি। হটাৎ করিয়া ঘুম ভাঙিলে তখন দেখি সন্ধে হয় হয়। চোখ কচলাতে কচলাতে তাকাইয়া কয়েকজন কে দেখিতে পাই। হ্যাঁ গো তোমরা ঘুমানোর আগে সেখানে কাওকে জিজ্ঞাসা করনি?জিজ্ঞাসা করিবো কেমন করে, কেউ তো আমাদের কাছে আসিতেই চায় না! ……. কেন্?
আমরা তো তাহাদের মতো নয়, অজানা, অদেখা, কেহ কেহ আমাদের পুলিশই ভাবিয়াছে, ভয়ে কাছে ঘেঁষে না। একজন কে কাছে ডাকিয়া বলিলে … কী কন বাবু? আরে আমরা তো বাবু নয়, তোমাদের মতো লোক, এইদিকে আইসো। ..
… বলেন? পানি কোথায় পাবো … বলিতেই সে দুএকজন ছেলেপিলে কে চটভট বলে’ “এই ওই তোরা জলদি কইরা পানি আইনা দে”। তাহার কথা শুনিয়া ছেলেগুলো আমাদের তাড়াতাড়ি করিয়া পানি আনিয়া দিলো। তিনজন মুখ হাত ধুইনু ও কিছুটা খাইনু। এরপর তাহাদের কহিনু
আচ্ছা ভোলাহাট আর কত দূর? তার উত্তর দিইলো “বাবু আপনারা তো ভুল পথ আইছেন,
ভোলাহাট এই দিকে না। তাহলে কোন্ দিকে? “আছার পথে একটা মোড় পাইছেন নি ওই মোড় থাইকা বাম দিকে যে পথ যাইছে সেটাই ভোলাহাটের পথ। “সেই কথা শুনিয়া মাথা হেঁট।”
সোফিকুলের পা ফুলে ঢোল, সে কাঁনো কাঁনো মুখে কহিল আমি আর যাইতে পারবো না। আসিয়াছি যখন কস্ট করে চল আমি কহিনু। আচ্ছা তুমি বললে ভোলাহাটের কথা কেন্? আরে তোকে তো কহায় হয়নি। কী বলা হয়নি?
তোকে তো কেবলি বাংলাদেশ যাইবো কহিয়াছি। হ্যাঁ তো কী হয়েছে? বাংলাদেশ কার বাড়ি যাইবো সে কথাতো কহিনি। বলনিতো কার বাড়ি যাবা। শুন আমি যাইবো ভোলাহাট ফুফুর বাড়ি আর মজিবুরও ওইখানেই। আর সোফিকুল? সোফিকুল তো যাইবে তার নানির বাড়ি, ভোলাহাট থেকে আরও দূর বরিশাল শহরের কাছা কাছি।
আমি তাহাদের কে কহিনু কতদূর হইবে?
তাহারা কহিল ‘আপুনারাতো এইদিকেই তিন ক্রোশ পথ বেশি আইছেন, ওই মোড় থ্যাইকা আরও তিন ক্রোশের মতো যাইতে হইবে তাহলেই ভোলাহাট পাইবেন। আমরা আবার হাঁটিতে লাগিলাম। ওই মোড়ে পৌঁছাইয়া বাম দিকের পথ ধরিয়া হাঁটিলাম। একটু দূরে ভোলাহাটের কাছাকাছি পথেই দেখা হলো এক দূরসম্পর্কের ফুফুর। “তোরা কোনে যাবিরে বা?” সে চিন্তে পেরে কহিল। তার সেরকম ধন সম্পত্তি ছিল না। তার কাঁঙ্খে ছিলো এক কিসের বস্তা। তার পর সে চলিয়া গেলো। আমাদের আর পেট মানছিল না। এতক্ষণ পর্যন্ত কোনো দোকান পাসারও পাইনায়। কিছু না খাইলে চলবেনা। হাঁটিত হাঁটিত একটা ছোট্ট বাজার পাইলাম। সে বাজারে একটা মিস্টির দোকানে যাইনু। মিস্টির দাম শুধাইলাম, মিস্টি কত করে? “দোকানদার কহিল চব্বিশ ট্যাকা স্যার।” আমরাকে এক স্যার করে দাও আর তিন স্যার প্যাকেট করে দাও। দোকানদার কহিল ‘বয়েন দিইছি’। আমি কহিনু চল চল বস, বস আগে তো খাই, তার পর না হয় যাইব। তিন পাত্রে ময়রা মিস্টি দিল। আর তিন স্যার এক পাত্রে প্যাকেট করিয়া দিলো। খাওয়া শেষ হইলে হাত মুখ ধুইয়া পানি টানি খাইনু পেট একুটু শান্তি হইলে উঠিয়া পড়ি আমাদের মুল উদ্দেশ্যে। একটু হাঁটলে পৌঁছাইয়া যায় সেই রাস্তায় দেখা হওয়া ফুফুর বাড়ি। তখন সন্ধে ছয়টার উপরে। আমাকে আর সোফিকুলকে বাড়ির লোকেরা চিনিতে পারিতেছে না। কেবলি মজিবুর কে চিনিতে পারিতেছে। এর পিছনে ছোট্ট একটা গল্প আছে। তার পর লোটা ভর্তি পানি আনিয়া দিলে পা হাত মুখ ধুইয়া খাট ওপর শুইয়া পড়ি।
সারাদিনের ক্লান্তি চেপে ধরিয়াছে।”হইয়াছি গভীর তন্দ্রায় মগ্নচৈতন্য”। এমনি অবস্থায় বাড়ির কেউ এসে ওঠো ওঠো কথায় চোখ খুললাম। দেয়ালে চোখ পড়তিই দেখি ঘন্টার কাঁটা রাত্রি নয়টা অতিক্রম করিয়াছে। বলে খাইবেননা। এই কথা শুনিয়া তড়িঘড়ি উঠিয়া পড়ি। খাইতে যাইয়া দেখি থালাতে রুটি। দেখিয়া মাথা খারাপ, সারাদিন কিছু খাইনায় আবার দেখি থালাতে শুকনো রুটি। “তোরা কি দ্বীপ্রহারে ভাত রাঁধনাই আমি মনে মনে কহিনু।” বৈকাল বেলার শেষে তো খাইনু মিস্টি, তাতে তো হালকা পাতলা পেট ভরিয়াই আছে। তাও কি করিবো একটু খাইনু। আর একটা কথা তোকে বলি। হ্যাঁ হ্যাঁ বলো, সে দিন টা ছিলো রামযান মাসের প্রথম। আমি রামযান মাসে রোজা প্রতিদিনই করি।” কিন্তুু এক আজব কাণ্ড!”
সেইদিন রাত্রে সেই ফুফুর বাড়িতে সব চুপ চাপ। এমনিই তাহাদের হাব ভাব রোজা বলে কোনো খেয়ালিই নাই। ভোর রাতের সময় একটু একটু হাঁড়ি বাসনের আওয়াজ। আমার ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছে। আমি একটু চোখ চেঁড়ে দেখি সেই ফুফু আর তাহারই এক মেয়ে, তাহারা দুজনে ভাত রাঁধিয়া কেমন যেন গোপনে গোপনে খায়তেছে। আর সারা বাড়ির লোক নিঃশাড়।
আমি রোজা ধরার জন্যে কাঙ্খিত হইয়া আছি। কিন্তু কোনো উপায় নাই, কেননা সেইটা তো আর নিজের বাড়ি নই যে সড়সড় করিয়া উঠিয়া যাইব ভাত খাউনের লায়গা। “মাথার ওপর যেন পাহাড় লইয়া শুইয়াই থাকিনু। তাহারা খাইয়া দাইায়া শুনশান হইয়া গেলো। কিছু কইলোও না আর। আমি কিছু কইতে পারিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যে ভোর হইয়া গেলো। এবার বিছানা ছাড়িয়া ওঠিলে সামনে পানির লোটা আইনা দ্যাই। চোখ মুখ ধুয়া শেষ হলে সামনে আগাইয়া দ্যাই ভাতের থালা। ভাতে থালা দেখে মাথা গরম হইয়া গেলো। আমি রাগের সহিত কহিনু তোমরা কেমন লোক গো জান না আজিকে প্রথম রোজা।” তা তো জানিরে বা। মুইতো রোজা আছিরে বা।” তাহলে আমাদের কহিলানা কেন্? “মুইতো জানিনারে বা তোরা রোজ কোরস।” কেন্? “মুইয়ের বাড়িতে তো কোনো পোলাপানরা রোজা করেনাই। তাই ভ্যাইবাছি তোরও রোজা করবিনা। “সেই ল্যাইগাই তোরা কে রোজা ধরবার ল্যাইগা ঘুম থ্যাইকা উঠায়নি রে বা”। রাগ করিসন্যা রে বা খাইলে! না না খাইবো না। খাইলে রে বা খাইলে! কোনো রকম রাগ মানিয়া লইয়া অল্প কিছুটা খাইনু। এবারে যাইতে হইবে ভোলাহাট। ফুফুর ছেলে কাল সারাদিন পথ চাইয়া কি জানি কী মন লইয়া বইসা রইছে। সেই স্থান ত্যাগ করিয়া ভোলাহাটের দিকে পা বাড়াইতেই মজার কাণ্ড! “কুড় একুশ হইবে এমনই এক কুমারী আসিয়া ঘিরিয়া লইলো আমাদের যাইবার পথ।” আমি তো আশ্চর্য হইয়া গেইনু! না জানি কি কাণ্ড করিয়া দ্যায়! কিন্তু না, তেমন কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। মেয়েটি মজিবুরকে চিনে, মজিবুরও তাহাকে চিনে, তাহার নাম “রুমেলা” তাহার বাড়ি ওই খানেই। মজিবুর এরআগের বার যখন আসিয়াছিল, সেই সময়ে মেয়েটিকে ধোকা দিয়া গিয়াছে।
কীসের ধোকা গো? শুন কহিছ তোকে। বেশ তাহলে শুনি! মজিবুর মেয়েটির সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়া বিয়ে করার কথা দিয়াছিল। সেই মোহে মেয়ে টি মজিবুরকে সাত শো টাকা দিয়াছিল। তার পর বিয়ে না করিয়াই মজিবুর সেইস্থান ত্যাগ করিয়াছিল। এখন পড়িয়াছে ধরা কি করিবে! আমি তখন কোনো রকম বাহানা করিয়া সেই খান থেকে পালায়। ভোলাহাটের দিকে যাইতে যাইতে সামনে পড়িল ছোট্ট একটা নদী। সেইটা ঠিক নদী নয় জলাশয়ই হইবে। পারা পারের জন্যে ডিঙি ও রইয়াছে। পার হইতে নিতেছে পাঁচ টাকা করিয়া। সেখানে কেহ কেহ মাস্তানি করিতেছে। আমরা কহিনু ভাই আমরা যাইবো “সাদেকের” বাড়ি। কহিতেই চটভট ওপারে পৌঁছাইয়া দিলো। টাকা বাহির করিয়া দিতে গেইনু কিন্তু তাহারা টাকা লইল না। বুঝিতে পারিলাম সাদেকের নাম শুনিয়ায় টাকা লইল না।
ওপারে যাইতেই দেখিতে একখানি বাজার। বাজারে চায়ের দোকানে ভিড়। একটু আগাইলাম। ভিড়ের মধ্যে সাদেক, চলিতেছে জমজমাট আড্ডা। চা চলিতেছে হাতে হাতে। কেহ পয়সা দিবে না। পয়সা দিবে সাদেক। বড়ো দিল দার লোক। আমাদের দেখিয়া হাসিয়া উঠিল। আরে বা! কখন আইলি রে বা। আয় চা খাইলে। হইলো চায়ের অর্ডার। চা খাইতে খাইতে হইল হাসি মজার গল্প। ম্যালা গল্প হলো রে বা চল…বাড়ি চল। না ভাই এখন যাইতে পারিবো না। ম্যালায় পথ হাঁটিয়াছি পা চলে না।
খুব ধরাধরি করিতে লাগিল। শেষপর্যন্ত যাইলাম তাহার বাড়ি। বিশাল বাড়ি, আঙিনা ও বিশাল। বাড়ি কিন্তু মাটির দেয়াল আর ওপরে টিন। মাঠে তাহার অনেক জমি! বাড়িতে বড়ো বড়ো ধানের গোলা। সারা মাঠ ধানে পূরণ হইয়া আছে। মাঠের সব ধান যেন তাহারি। আরও কত কী………। বাড়িতে নইও হাস মুরগীর অভাব। সে বাড়ি যাইয়ায় মুরগা কাটিল। আমরা একটু আরামে বসিলাম। দেখতে দেখতে খাওয়ার হাজির হইয়া গেল।বলে খাইলে রে বা। খাওয়ার ইচ্ছে ছিলো বটে কিন্তু মাংস দেখিয়া আর মন মানলনা খাইতে লাগলাম। গল গল করিয়া খাইনু। এবার, সাদেক ভাই কই? সাদেক ভাই যায়। মুই তো যাইতে দিমু না রে। না সাদেক ভাই তাহারা পথ চাইতেছে। যাইবি যখন আর কী কমু। তো এত রাইতে যাইবি ক্যামনে? খাড়া য্যাইস। কহিয়া বাহির হইতে দুতিনজন লোককে ডাকিয়া আনিল এবং আমাদের সঙ্গে পাঠাইল। তাহাদের কাছে আছে লাঠি আর একটা করে লাইট।আমরা আবার আগের বাড়িতে ফিরিয়া আসিলাম। তাহারা থালাতে ভাত লইয়া বসিয়া আছে। বলিলাম আমরা তো সাদেক ভায়ের বাড়ি হইতে খাইয়ায় আসিতেছি, থাক এখন আরর খাইবো না। এই কথায় কহিনু।
পরদিন সকালে ধরিলাম ভোলাহাটের রাস্তা। রাস্তায় হাঁটিতে শুরু করিয়াছি, পা ফুলা একটু কমেছে। আবার তিন ক্রোশ হাঁটিতে হইবে। হাঁটিতে হাঁটিতে ভোলাহাটের নিকট পৌঁছাইয়া গেলাম। রাস্তা এক মানুষ নিচা। উপরে আমের বাগান। বাগানের এক কোণে একটা ঘর চোখে পড়ল। ঘরের কাছে কোনো রকম গেলাম। ফুফার নাম সলিমুদ্দিন। লোকে সলিমুদ্দিন ডাকাত কয়। আশ্চর্য! লোকে ডাকাত কয় কেন্? কোনো সাধারন লোক ছিলো না অবশ্যই? হ্যাঁ, সে সেই সময় কার নাম করা ডাকাতই ছিলো। একজন কে কাছে পাইলাম। তাকে কহিনু ওই ভাই সলিমুদ্দিনের বাড়ি কোনটা? সলিমুদ্দিন ডাক্যাইত নাকি? হ্যাঁ,,,, হ্যাঁ
আমি কহিনু। আপুনারা তো আয়্যাই পড়সেন, এইটাই তো।কহিয়া সে চলিয়া গেলো। আমরা বাগানের দিকে একটু তাকাইলাম বিশাল বাগান। বাগানে কয়েকজন লোক, আম গাছ ধুইতেছে। গাছে ছোটো ছোটো গুটি, কেবলিই মুকুল ছেড়েছে। বাগানে লোক গুলো আর কেহ নয় তাহারা ছিলো আমার ফুফাতো ভাই আর তার লেবার। সেই বাগানটা আমার ফুফারই। আমার ফুফাতো ভাই সামশুদ্দিন ওই বাগানটা ভাগে পাইয়াছে। সামশুদ্দিনের আমাদের দিকে চোখ পড়িলে সে হাসতে হাসতে কাছে আসিয়া ‘কী রে তোরা এখনি আইলি যে, তোদের কাইলকা আসার কথা ছিলো না……………। কোনো কাজ না কইরে তোদেরি পথ চ্যাইয়া ছিনুরে, তোরা তো অ্যাইলি না তখন অ্যাইজ লেবার নিয়া কাজে লাইগাছি ….। তো এখন বাড়ি চল, বাড়িতে বইস্যা গল্প কইরবো চল … চল চল। ঘরের দিকে যাইতে যাইতে আমরা তো কাইলি আইসি। তোরা কাইল আইসিস! তোরা ছিলিস কোথে? ওইতো ওই ফুফুর বাড়িতে। কেইনেরে?
আর কহিস না… এইসব ম্যালায় কথা। সেই আগের ঘটনা শুনাইনু। এইযে বস ম্যালাকথা কলি। এই কথা কহিয়া সে ছোটো এক গামলা মুড়ি চানাচুর তেল এইসব দিয়া মাখিয়ে দিয়া দিলো। “এইযে খা, সে কহিলো। এখনি ‘পাক্’ কইরবে! ” কহিয়া সে বাহিরে গেলো। আমাদের মাথায় হাত নতুন করিয়া শুনিলাম ‘পাক্ করা’ এইটার মানে আবার কী?তিনজনেরই মনে প্রশ্ন, কিন্তু অতো অবাক হওয়ার কিছু নাই। একটু মাথাই শুধু চুলকাইলাম! ‘পাক্ করা’ মানে জানিতে পারিলাম। তার মানে হইলো ‘রান্নাকরা ‘। গল্প করিতে করিতেই ভাতের থালা সামনে আইসা হাজির, ভাতের সঙ্গে মাছ আরও কত কী। একটা আশ্চর্য ব্যাপার! “তাহার একদিনও মাছ ছাড়া ভাত খায়না!” এর ও একটা কারণ আছে ‘সামশুদ্দিন ছিলো জেদালো ধরনের। তার বাপ মনে ফুফা সলিমুদ্দিন তার বিশাল সম্পত্তি কিন্তু সে ডাকাত।
স্বভাব টাও খুব ভালো ছিলো না। সেই কারণেই তার বাড়ি ও একেবারে গ্রাম ছাড়া বাগানের ভিতরে। সে হঠাৎ একদিন এক ভিক্ষাকরানিকে বিয়ে করিয়া ঘরে তুলে। তাহাতে তাহার বাপের সহিত সামশুদ্দিনের তুমুল ঝগড়া বাধিয়া যায়। সেই দিন হইতেই সামশুদ্দিন আর তাহার মা, মানে আমার ফুফু তাহারা ভিন্ন হইয়া যায়। আর আলাদা হইয়া দিন কাটাই। সেই দিনই তাহার বাপকে কথা দিয়াছিল যে মাকে সে সুখে রাখবে কোন কষ্ট অনুভব করতে দিবে না। আরও বলে যে সে বিনা মাছে এক দিনও মাকে ভাত খাওয়াইবে না। সেদিন হইতে ফুরায় না মাছ তাহার ভাতেরই থালাতে। মাছ যে প্রত্যহ পাইবে সামশুদ্দিন। তাওতো ভাবারই কর্মকলাপ! কিন্তু সেটা ওতো সহজই হইয়া যায় তাহার কাছে। উঁচু উঁচু ভিটা সবই। রাস্তা ছোটো ডাড়ার মতো। তাহারই দুই পাশে, হালকা হালকা পানি আসে। তাহাতে মাছ শিঙি,মাগুর, আরও পুটি, গুটি যতো। তাহাতে তার ধরা আছে, কলসি ভর্তি কত। কলসি হইতে প্রতিদিন একটা দুটা রান্না করিয়া খাওয়াই তাহার মাকে। আমাদেরও চললো মাছ ভাত খাওয়া সেই দিন দুপুরে।
এক দিন কাটাইলাম ফুফাতো ভাই সামশুদ্দিনের বাড়িতে। মাথায় একটা বোঝা আছে। সোফিকুলকে পৌঁছাইতে হবে তার নানির বাড়ি সদরগঞ্জ। বরিশালবিভাগ, অনেক দূরের রাস্তা, ট্রেন আছে, কিন্তু আধেকটা,বাকি পথ সেই পায়ে হাঁটা। একটু হাঁটিয়া গেলাম, তার পর স্টেশন। ট্রেনে উঠিয়া পড়িলাম।ট্রেনে উঠতেনা উঠতেই, পৌঁছাইতে হইলো পরের স্টেশন। এই স্টেশনেই নামিতে হইবে। কী আর করবো নামিয়াই পড়লাম তিনজনে। আবার শুরু হইলো হাঁটা পথ। বেলা তখন তিনটে। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। তবুও তার তেজ কমে নাই। মাঠের পথ আরও এক দু কিলোমিটার বাকি আছে। আমি কহিনু একটু আরাম করি তারপর না হয় যাইবো। আচ্ছা বেশ তাই করি। বসিলাম এক গাছ তলায়। সেখানে আছে চায়ের দোকান তারই মাচাতে। চোখ আর থামলো না বসিতে বসিতেই ঘুমে ঢলেছি। হঠাৎই একজন লোক এসে ওঠো ওঠো তাহাতে ঘুম ভাঙিল। তখন বাজে প্রায় পাঁচটা। তিনজনই রোজা করিয়াছিলাম। রোজা ইফতারের আর বেশি সময় নাই। এই কথা ভাবিয়া দোকান হইতে কিছু খাবার লইয়া মাঠের পথ ধরিয়া লইলাম। তিনজনই হাঁটিতেছি আর বেশি পথ বাকি নাই। সন্ধে হয় হয় রোজা ইফতারের আর বেশি সময় নাই, এমন সময়ই বাড়ি ঘরের হদিস পাই। সামনেই একটা বিশাল বাড়ি, আশেপাশে দুতিনটে গোরুর গাড়ি, সেখানেই একজন ওজু করছে, সে আর কেউ নয়, সোফিকুলের মামা, সে চিনিয়া লইছে। চোখ পড়তেই তার মামাও তাকে চিনিয়াছে। সে হাতের লোটাটা ফেলিয়া দ্রুত কাছে এসে আমরা তিনজনকেই বাড়ির ভিতর নিয়া গেল। পানির লোটা দিয়া বলে তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুইয়া লে রোজা ইফতারের সময় হইয়াছে।
তারপর সামনে অনেক খাওয়ার দিয়া দিলো। ওই সব খাওয়ার খাইয়া রোজা ইফতার করিলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে তিনজনেই শুইয়া গেলাম। তাহাদের বাড়িতে মুরগা মুরগির অভাব নাই, রাতেই হল মুরগার মাংস। সেখানে তাহারা ভালোই সেবা করল।পরদিন সকালে সোফিকুলকে রাখিয়া আমরা আবার ফুফুর বাড়িতে আসিলাম। তাকে কহিয়াই আসিলাম যে তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস চলিয়া আসিস, তুই আসিলেই আমরা বাড়ি ফিরিয়া যাইবো। আর একটা কথা আমরাকে ছেড়ে সোফিকুল তার নানির বাড়িতে থাকার ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু নানির বাড়ির খাওয়ারে ওই বাড়ির কথা ভুলে গিয়াছিল। কারণ তার তিন চার দিন থাকার কথা ছিল কিন্তু পাঁচ ছয় দিন রাস্তা দেখিনু কিন্তু ওই আইলো না। আমারও মন খারাপ। তখন একা একায় কহিনু কে আর অতখানি রাস্তা আবার তোকে ডাকতে যাইবে আসবি আয় না আসবি না আয়। আমরা পাঁচছয় দিন ফুফুর বাড়িতে থাইকা, ভালোমন্দ খাইনু তার পর বাড়ির দিকের রাস্তা ধরিনু।
(০৯/০৯/২০১৮)
[৩৭৭ সমাপ্ত]
ভ্রমণ বৃত্তান্ত পড়লাম। বেশ বিশদ আকৃতিতে লিখাটি উঠে এসেছে। ধন্যবাদ।
সম্ভব হলে আপনার লিখার পাঠকের মন্তব্যের উত্তর দিলে বেশী ভালো লাগবে।
ধন্য হলাম প্রিয় লেখক! আপনার শুভকামনা করি! সর্বদা….
ভালোই লিখেছেন। পাঠক সম্পর্ক না থাকলে পাঠক হারাবেন ভাই।
আপনাকে ধন্যবাদ প্রিয় লেখক! আপনার শুভকামনা করি সর্বদা!
অনেকটা কথ্য আর সাধু ভাষার মিশ্রণ লক্ষ্য করলাম দাদা। বেশ।
ধন্য হলাম প্রিয় লেখিকা আপনার মন্তব্যে! সর্বদা আপনার শুভকামনা করি আপনার!
কেউ প্রকাশনার নিয়ম কানুন ভালোভাবে বুঝিয়ে দিলে কৃতজ্ঞতা বোধ করবো…
সুস্থ্য আর সুন্দর ব্লগিং এর স্বার্থে শব্দনীড়ের প্রথম পাতায় একজন লেখকের একটি লেখা থাকতে হয়। এটাই শব্দনীড়ের নিয়ম। বিশেষ পরিস্থিতিতে ২৪ ঘন্টায় পোস্ট সংখ্যা কম থাকলে দ্বিতীয় লেখা প্রকাশ করা যেতে পারে।
আপনার অতিরিক্ত লেখা তৈরী হয়ে গেলে খসড়া করে রাখুন দাদা। সহ-ব্লগারের পোস্টে আপনার অভিমত বা মতামত দিতে পারেন।