পনেরোই আগষ্ট, বাংগালীর জীবনে এক শোকের মাস, এক পরাজয় আর লজ্জার দিন। বাঙ্গালী ভালোবাসার মুল্য দিতে জানে না, বাঙ্গালী বিশ্বাসের কোন দাম দিতে জানে না এই কথা গূলোকে প্রমাণ করে দিয়ে বাঙ্গালীর জীবনে এক মহা সত্য হয়ে ১৫ই আগষ্ট প্রতিবছর আসে। শোকে মুহ্যমান হলেও সেই সাথে এক চরম আত্মগ্লাণি বাংগালীকে কুড়ে কুড়ে খায়। একটি জাতির স্বাধীনতা আর জাতীয় চেতনা প্রতিষ্টায় একজন মানুষের নেতৃত্ব কতো খানী হতে পারে বংগবন্ধু ছিলেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আর একজন মানুষ কতোখানি তার জাতিকে ভালোবাসতে পারেন তারও উজ্জল দৃষ্টান্ত বংগবন্ধু। তার পক্ষেই সম্ভব পাকিস্থানী হানাদারদের রাইফেলের মুখে বলা আমি বাঙ্গালী, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ। একমাত্র তিনিই বলতে পেরেছেন আমি বাংলাকে ভালোবাসি, আমার শক্তি আমার দেশের মানুষের ভালোবাসা। ঠিক একই সাহস আর বিশ্বাস নিয়েই ১৫ই আগষ্ট রাতে খূনীদের সামনে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন “তোরা কি চাস?”
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডকে জায়েজ করতে সেই সময় সাধারন মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছিলো বংগবন্ধু সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা। লুঠপাট, ব্যাংক ডাকাতি, অগ্নিকান্ড আর ঘুম খুনের নানান কিচ্ছা কাহিনী। একদিকে জাসদ আর গোপন বামপন্থী দলসমুহের সশস্ত্র লড়াই, গন শত্রু নিধনের নামে সারা দেশে গলা কাটার মহোৎসব, অন্য দিকে ৭১ সালে পরাজিত শত্রুদের প্রতিশোধের লেলিহান শিখা। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র আত্মসমর্পণ করা হলেও রাজাকারদের অস্ত্র থেকে যায় নিরাপদ ভান্ডারে। রাতারাতি অনেক রাজাকার আত্মরক্ষার্থে যোগ দিতে থাকে জাসদের গনবাহিনী আর গোপন বাম দলগুলোর পতাকা তলে। তাদের ছত্রছায়ায় থেকে তাদের নামে চালাতে থাকে নানা অপকর্ম। অন্যদিকে জাসদ নেতৃবৃন্দ বা গোপন বাম দলগুলোর নেতৃবৃন্দ মনে করতে থাকেন সাধারন মানুষ দল বেধে তাদের দলে যোগ দিয়ে বিপ্লবকে তরান্বিত করছে।
গত ১৩ই আগষ্ট দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত বাংলাদেশে নিযুক্ত বিট্রিশ রাষ্টদুতের এক লিখিত প্রতিবেদন থেকে সেই সময়ের বাংলাদেশের সামগ্রীক চিত্র নিয়ে এক সরকারী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেই সরকারী নথি থেকে জানা যায় সেই সময় অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের সামগ্রীক অবস্থার উন্নতি সাধন হচ্ছিলো। শুধু তাই নয় বাকশাল গঠন এবং সেই বাকশালের সুফল দেশের প্রায় ত্রিশ শতাংশ ভুমিহীনের মধ্যে কিভাবে কাজ করবে এবং পরীক্ষামুলক সমবায় সিস্টেমে বিভিন্ন জায়গায় ভুমিহীন কৃষোক এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের মাঝে কি পরিমান উতসাহ সৃষ্টি হয়েছিলো তার বিবরন পাই। একটা যুদ্ধ বিধস্ত দেশ কিভাবে ঘুরে দাড়াতে পারে তার এক বিশেষ দৃষ্টান্ত বংগবন্ধু বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারতেন এ কথাও বিট্রিশ রাষ্টদুত তার সরকারকে অভিহিত করেছিলেন। বিট্রিশ রাষ্টদুত বলেছেন বংগবন্ধু প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তলা বিহীন ঝুড়ি নয়, একটি খাদ্যে সয়ং সম্পুর্ণ দেশ হবে বাংলাদেশ। ১৯৭৮ সালের মধ্যে দেশ কে খাদ্যে সয়ংসম্পুর্ণ করার পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছিলেন বংগবন্ধু।বিট্রিশ রাষ্টদুত খুব দৃঢ়তার সাথে বাংলাদেশের ঘুরে দাড়াবার কথা বলেছিলেন এবং বিট্রিশ সাহায্য অব্যাহত রাখার সুপারীশ করেছিলেন।
বংগবন্ধুর দোষ ছিলো দুটো, এক তিনি বাংলাদেশ কে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীন করেছিলান দ্বিতীয়টা হলো তিনি শুধু সংবিধানে সমাজতন্ত্র কথাই সংযোজন করেন নাই, তিনি তা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তার এই দুই পদক্ষেপ মার্কিন সামাজ্যবাদ, পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দালালদের ভালো লাগে নি। ভালো লাগেনি সেই সময়ের চীনা পন্থী বাম রাজনীতিক দের। ভালো লাগে নি আওয়ামী লীগের ভিতর ঘাপ্টি মেরে বসে থাকা মুজিব সরকারের পাকিস্তানী কনফেডারেশনের স্বপ্ন দেখা কিছু বেঈমানের। তাই তারা তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে উঠে পড়ে লাগে। এই ষড়যন্ত্রে যোগ দেয় পাকিস্থান থেকে ফেরত আসা কিছু সামরিক বেসামরিক আমলা। পাকিস্তানের মাতিতে মুক্তিযুদ্ধ কালীন সমইয়ে আরামে থেকে যুদ্ধার পর দেশে এসে পদোন্নতি আর সুযোগ সুবিধা আদায়ে হয়ে উঠেন তৎপর। তাদের অসন্তুষ্টিকে উপরের চক্র কাজে লাগায় খুব সফলভাবে।
বংগবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশ কে পিছনে নেওয়ার যে কাজ সেই কাজ খুব দক্ষতার সাথে শুরু করেন জেনারেল জিয়া। তার সুবিধা ছিলো তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার এবং যেড ফোর্সের অধিনায়ক। এই তিন পরিচয় কে উর্দ্ধে তুলে ধরে তিনি পিছনে থেকে কল কাঠি নাড়তে থাকেন। এবং সুযোগ পেয়েই প্রাণ রক্ষাকারী বন্ধুকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। পরবর্তী ইতিহাসো সবাই জানেন। বাংলাদেশ একে একে তার সমাজতান্ত্রিক ভিত্তি, গনতান্ত্রিক ভিত্তি, আর ধর্মনিরেপেক্ষতার ভিত্তি থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। সংবিধানে বিসমিল্লাহ আর পরবর্তীতে রাষ্ট ধর্ম বিল পাশ হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্থানী পরাজিতদের আশা ষোলকলা পুর্ণ হতে থাকে। একে একে রাষ্ট ক্ষমতার অংশীদার হয়ে এদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা জাতিয় পতাকা উড়িয়ে মুলত আমাদের স্বাধীনতাকেই ব্যঙ্গ করতে থাকে।বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ এবং অকার্যকর রাষ্টে পরিনত করার অংশ হিসেবে জংগীবাদ এবং জংগি গোষ্টীগুলো কে রাষ্টীয় পৃষ্টোপোষকতা দেওয়া শুরু হয়। জাতীর জনকের কন্যা শেখ হাসিনা কে হত্যার উদ্দেশ্যে চলতে থাকে প্রাণনাশী আক্রমন। ২১ আগষ্টের গ্রেনেড হামলা সেই প্রাণনাশী চক্রান্তের অন্যতম। হত্যা করা হতে থেকে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা, ধর্মীয় নেতাদের।
বংগবন্ধু কে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে থাকে জগাখিচুড়ী মার্কা এক রাজনৈতিক দল যাদের জন্ম হয় সামরিক ছাউনীতে, যাদের পিছনে শক্তি যোগায় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি, আর ক্ষয়ে যাওয়া বাম ভুল রাজনীতি।
বাংলার ইতিহাস থেকে শেখ মুজিব কে মুছে দেওয়ার যে হাস্যকর প্রয়াস নিয়েছিলো সেই পদক্ষেপে আজ নিজেরাই ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। জীবিত জাতির পিতা আজ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে তারুন্য আর বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে। আজ যে যবক মাঠে নামে তার ন্যায্য দাবী আদায়ে তার বুকেও থাকে শেখ মুজিবের প্রতিচ্ছবি। প্রতিবাদী যুবক সাহসের সাথে উচ্চারন করে আমার বুকে গুলি করো না, আমার বুকে আছে শেখ মুজিব। গুলি যদি করতেই হয় আমার মাথায় করো।
শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি বাংলাদেশী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে।
জাতির এই শোক হোক শক্তি।
জাতির পিতা আজ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছে তারুন্য আর বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে।
* বিনম্র শ্রদ্ধা জাতির পিতার প্রতি…