বাসন্তী দেবীপূজা স্তুতি বন্দনা

বাসন্তী দেবীপূজা স্তুতি বন্দনা।
– লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বাঙালি হিন্দুসমাজের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের এই শুভক্ষণে আমরা সবাইকে জানাই বাসন্তী শুভেচ্ছা। পুরাণ অনুসারে, দুর্গা যেমন অসুরবিনাশী দেবী, তেমনি তিনি দুর্গতিনাশিনী, যিনি জীবের দুর্গতি নাশ করেন। তিনি এবার এসেছেন নৌকায় করে। দেবী দুর্গা অসুরদের দলপতি মহিষাসুরকে বধ করে দেবকুলকে রক্ষা করেছিলেন। তাঁর এই জয়ের মধ্য দিয়ে অন্যায় ও অশুভর বিরুদ্ধে ন্যায় ও শুভশক্তির জয় হয়েছিল।

পুরাণ অনুসারে, রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত সমাধি বৈশ্য একদিন মেধস মুনির আশ্রমে যান। সেখানে মুনির পরামর্শে তাঁরা দেবী দুর্গার পূজা করেন। দেবীর বরে তাঁদের মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এ পূজা বসন্তকালে হয়েছিল বলে এর নাম ছিল ‘বাসন্তীপূজা’। বাসন্তীপূজা হয় চৈত্রের শুক্লপক্ষে।
আজ দুর্গাপূজার মহাষষ্ঠী। এই দিনে কালীঘরে গিয়ে তো বটেই, অন্য সময়েও প্রায়ই ঠাকুর
শ্রীশ্রীচণ্ডীর একাদশ অধ্যায়ের অংশে মহাঋষিগণ দেবীর স্তব করেছেন। তাঁরা এই শক্তিরূপার মঞ্জুল শোভা (স্বর্গীয় সৌন্দর্য) প্রত্যক্ষ করেছেন।

স্মরণ করেছেন, “সিংহস্থা শশীশেখরা মরকতপ্রেক্ষাঃ চতুর্ভিভুজৈঃ, শঙ্খং চক্র ধনু শরাংশ্চ দধতিনেত্রৈঃ স্থিভিঃশোভিতা, আমুক্তাঙ্গদ হারকঙ্কন রণংকাঞ্চী কন্বংনূপুরা -দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী, ভবতুয়ো রত্নোলস্যত্কুোন্তলা।”

প্রতি পদক্ষেপে মহামায়া দুর্গাকে স্মরণ করেছেন – “ত্বং বৈষ্ণবীশক্তিরণন্তবীর্যা/বিশ্বাস্য বীজং পরমাসি মায়া/সম্মোহিতং দেবি সমস্তশেতত্‍/ত্বং বৈ প্রসন্না ভুবি মুক্তি-সিদ্ধিহেতুঃ।।”

মা সিংহবাহিনী, তোমার শক্তি, তোমার বীর্য অনন্ত অপার। তুমিই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের জগত্পাহলিনি শক্তি। এই ব্রহ্মাণ্ডের তুমি আদির আদি কারণ মহামায়া। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডজগত্কো মোহগ্রস্ত করে রেখেছ; কিন্তু তুমি প্রসন্না হলে শরণাগত মুক্তিসিদ্ধি লাভ করে। এই হল বোধনের আদি মন্ত্র।

‘বোধন’ শব্দের ব্যুত্পনত্তিগত অর্থ হল ‘বোধ’-এর ‘অনট্’ ধাতু – অর্থাত্‍ জাগ্রত করা – অপরা জগতের ‘ধী’শক্তি দিয়ে পরাজাগতিক মহাশক্তিকে বোধিত্বে অর্থাত্‍ জাগ্রত অবস্থায় অধিষ্ঠিত করা, প্রতিষ্ঠিত করা।

সত্য যুগে দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গার বসন্তকালে বোধন করেছিলেন রাজর্ষি সুরথ। তাঁর সঙ্গী ছিলেন সমাধি বৈশ্য। সময়টি ছিল চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষ। একে আমরা বাসন্তীপূজা বলি। দেবীর বোধনের আলোচনা পাওয়া যায় মত্স্য পুরাণ, মার্কেণ্ডয়পুরাণ, শ্রীশ্রীচণ্ডী, দেবীপুরাণ, কালিকাপুরাণ এবং দেবী ভাগবতে।

পরবর্তী যুগে অর্থাত্‍ ত্রেতা যুগে রাবণও চৈত্র মাসে দেবী দুর্গার বোধন এবং আরাধনা করতেন। কিন্তু রামায়ণের কাহিনি অনুসারে লঙ্কা থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য যে রাম-রাবণের অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধ, সেখানে রাবণকে বধ করার জন্য রামচন্দ্রকে দেবীর শরণাপন্ন হতে হয়। দেবাদিদেব মহাদেবকে কঠোর তপস্যায় তুষ্ট করে রাবণ বর লাভ করেছেন। দেবী দুর্গার বিভিন্ন রূপের একনিষ্ঠ সাধক ও পূজারি হলেন রাবণ। যুদ্ধক্ষেত্রে মহাকালী স্বয়ং রাবণকে নিজের কোলে স্থান দেন। এ হেন রাবণকে বধ কী করে হবে

রামকে দেবীর নির্দেশের কথা বললেন ব্রহ্মা ও ইন্দ্র। যদিও সময়টা শরত্কা ল – রামচন্দ্র নিজের হাতে দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরি করে পুজো করলেন, অকালে বা অসময়ে প্রকট হওয়ার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা করলেন।

ব্রহ্মা স্বয়ং দুর্গার বোধনপূজা করেন। পূজার প্রারম্ভে স্বয়ং প্রজাপতি পদ্মযোনি ব্রহ্মা দেখেছিলেন সাগরের বালুকাবেলার অনতিদূরে গভীর অরণ্যের প্রান্তসীমায় একটি বিল্ববৃক্ষের নীচে একটি আট থেকে দশ বছরের বালিকা আপন মনে খেলছে। ব্রহ্মা ধ্যা্নস্থ হয়ে জানলেন, সেই বালিকাই স্বয়ং গৌরী – কন্যকা। ব্রহ্মা চোখ মেলতেই সেই বালিকা ওই বিল্ববৃক্ষে লীন হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মা স্থির করলেন, দেবী দুর্গার সেই বোধনের পূজার্চনা হবে ওই বিল্ববৃক্ষের নীচে। তাই আজও দেবীর বোধনের পূর্বে বিল্বশাখা বা বিল্ববৃক্ষকে পূজা করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হয় দেবীর মৃন্ময়ী বিগ্রহের মহাঘটে। শুরু হয় ‘বোধন’-এর আরাধনা, বেজে ওঠে শঙ্খ, ঢাক।

তাই বোধন হল মহাপূজায় দেবী মা দুর্গার প্রারম্ভিক আবাহন, যা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে পরম্পরাগত ভাবে প্রবহমান। বসন্তকালের সঙ্গে ত্রেতা যুগে যুক্ত হল শরত্কাাল – অর্থাত্‍ অকালে হল দেবীর বোধন, তাই এ হল অকালবোধন।

উচ্চারণ করি বোধনের মন্ত্র –
রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানু গ্রহায় চ/অকালে ব্রহ্মনা বোধো দেব্যাস্ত্বয়ি কৃতঃ পুরা। অহমপ্যাশ্বিনে ষষঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়ামি বৈ।।

ষষ্ঠী তিথিতে দুর্গার বোধন সপ্তমীতে মূতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা। অষ্টমী ও নবমীতে মহাপূজা ও দশমীতে দেবীর বিসর্জন। এই পূজার বিশেষত্ব হল সন্ধিপূজা অষ্টমী ও নবমী তিথির মিলনক্ষনে সন্ধিপূজা।
বসন্তকালে বাসন্তীপূজা জাতীয় জীবনে সর্বাঙ্গীন। তাই বাংলা কবিতা আসরের সকল কবি ও সহৃদয় পাঠকবৃন্দকে জানাই বাসন্তী মহাষষ্ঠীর শুভকামনা, প্রীতি আর বাসন্তী শুভেচ্ছা। বাংলা কবিতার জয় হোক, কবিগণের জয় হোক।

আসুন আমরা সকলেই জাতিধর্ম নির্বিশেষে শক্তির আরাধনায়
রত হয়ে বসন্তকালের বাসন্তী দেবীর পূজার আনন্দে মেতে উঠি।
সাথে থাকুন। পাশে রাখুন। জয়গুরু! জয়গুরু! জয়গুরু!

বাসন্তী দেবীপূজা
স্তুতি বন্দনা।
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী।

চৈত্র মাস শুক্লপক্ষ পূণ্য শুভক্ষণে,
বাসন্তী দেবীর পূজা বিখ্যাত ভুবনে।
দেবী আরাধনা করে পূজে ভক্তিভরে,
বাসন্তী দেবীর পূজা মহা কলেবরে।

আজি শুক্লা ষষ্ঠী তিথি পূণ্য চৈত্র মাস,
বসন্তে বাসন্তী-পূজা ভুবনে প্রকাশ।
অষ্টমীতে সন্ধিপূজা, কুষ্মাণ্ড প্রদান,
বাসন্তী দেবীর পূজা শাস্ত্রের বিধান।

পত্রপুষ্প ফলমূল, ঘটে আম্রশাখা,
মন্দিরের চতুর্ভিতে আলপনা আঁকা।
মন্দিরেতে পুরোহিত বসিয়া আসনে,
করিছেন চণ্ডীপাঠ ভক্তিযুক্ত মনে।

প্রণমি বাসন্তীদেবী, বসন্তে পূজিতা,
লিখিল লক্ষ্মণ কবি ধর্মীয় কবিতা।

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

6 thoughts on “বাসন্তী দেবীপূজা স্তুতি বন্দনা

  1. প্রণমি বাসন্তীদেবী, বসন্তে পূজিতা, লিখিল লক্ষ্মণ কবি ধর্মীয় কবিতা। অভিনন্দন কবি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  2. হে দেবি! তুমি জয়ন্তী, মঙ্গলা, কালী, ভদ্রকালী, কপালিনী, দুর্গা, শিবা, ক্ষমা, ধাত্রী, স্বাহা এবং স্বধা-রূপিনী, তোমাকে নমস্কার।

     

    লেকককে শুভেচ্ছা সহ ধন্যবাদ ।

  3. বাসন্তী দেবীপূজা স্তুতি বন্দনা শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ কবি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  4. ‘বোধন’ শব্দের ব্যুত্পনত্তিগত অর্থ হল ‘বোধ’-এর ‘অনট্’ ধাতু – অর্থাত্‍ জাগ্রত করা – অপরা জগতের ‘ধী’শক্তি দিয়ে পরাজাগতিক মহাশক্তিকে বোধিত্বে অর্থাত্‍ জাগ্রত অবস্থায় অধিষ্ঠিত করা, প্রতিষ্ঠিত করা।

    লিখায় শিক্ষার উপকরণও রেখেছেন। অভিনন্দন কবি ভাণ্ডারী দা।

  5. পুরাণ অনুসারে, দুর্গা যেমন অসুরবিনাশী দেবী, তেমনি তিনি দুর্গতিনাশিনী, যিনি জীবের দুর্গতি নাশ করেন। তিনি এবার এসেছেন নৌকায় করে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।