ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়! তৃতীয় পর্ব

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
তৃতীয় পর্ব।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন (১৮৫৭-১৯৪৭): একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ভারতবর্ষে ২০০ বছরের ইংরেজ শোষনের ইতিহাসঃ (প্রথম পর্ব) পূর্বে প্রকাশিত।
১০০ বছর ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী কর্তৃক শোষনঃ (দ্বিতীয় পর্ব) পূর্বে প্রকাশিত।
৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষনঃ (তৃতীয় পর্ব) বর্তমানে প্রকাশিত।
পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম (চতুর্থ পর্ব) প্রকাশিত হবে।
স্বাধীন ভারত ও ভারতবাসীর স্বপ্ন (পঞ্চম পর্ব) প্রকাশিত হবে।

৯০ বছরের ব্রিটিশ ভারত ঔপনিবেশিক শোষনঃ (তৃতীয় পর্ব)

এরপর ১৮৫৮ সালে ভারতের শাসনভার ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ রাজশক্তির হাতে স্থানান্তরিত হল। রানি ভিক্টোরিয়া নিজ হাতে ভারতের শাসনভার তুলে নেন। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঃ

প্রায় এই ১৯০ বছর এই ভারত ভুখণ্ডের মানুষরা বিভিন্ন ভাবে প্রতিবাদ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। আর তাই ১৮৫৭ সালে ভারতে প্রথম স্বাধীনতার আন্দোলন হয়। কিন্তু বর্বর ইংরেজদের ভাষায় ওটা ছিল “সিপাহী বিদ্রোহ”।

ইংরেজ সেনাবাহিনীর অন্তর্গত ভারতীয় সিপাহীরা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহে মূল ভূমিকা পালন করে। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করলেও এর মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অর্থাত্‍ ১৯৪৫ সালে ভারতবর্ষ জুড়ে “ইংরেজ ভারত ছাড়” আন্দোলন তীব্রতর হয়। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী সহ সব বড় বড় নেতা তখন সরাসরি ইংরেজদের হটাও আন্দোলনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন

মহাত্মা গান্ধীর দিক থেকে তাঁর “অহিংসা মনোভাব” এর কারণে হয়ত আন্দোলন বেগবান হচ্ছিল না। গান্ধীজীর মতে “যখন আমি হতাশ হই , আমি স্মরণ করি সমগ্র ইতিহাসেই সত্য ও ভালবাসার জয় হয়েছে । দুঃশাসক ও হত্যাকারীদের কখনো অপরাজেয় মনে হলেও শেষ সবসময়ই তাদের পতন ঘটে মনে রাখবেন সর্বদাই।” অপরেকে নেতাজীর বক্তব্য ছিল,”তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”।

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু মহাত্বা গান্ধীর এই অহিংসা মনোভাব পছন্দ করতেন না। উনি চাইতেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এবং সেটা হবে সমর যুদ্ধ। তাই তিনি খুঁজছিলেন ঠিক সেই মুহুর্তে ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন পরাশক্তি আছে। সেই হিসেবে সে খুঁজে পায় জামার্নীকে আর ইংল্যান্ড তো তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনী। আর তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষের অংশগ্রহনটা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ভালো ভাবে নেননি। তিনি হিটলারের কাছে গেলেন। কিন্তু সেই মুহুর্তে হিটলার প্রচন্ড ব্যাস্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। তাই নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু অক্ষশক্তির আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র জাপানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। এসময় জার্মান তাকে একটি সাবমেরিনে করে জাপানে পৌছে দেয়। জাপান নেতাজীর পরিকল্পনা শুনে, এতে মত দেয়। এবং প্রয়োজনীয় অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে।

রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নিয়ে ভারত আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ মূলতঃ ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা গঠিত একটি সশস্ত্র সেনাবাহিনী। ১৯৪২ সালে এই বাহিনী গঠিত হয়। এর বাহিনী ভিতরে ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষ, ইংরেজ নির্যাতিত ভারতীয়, মুটে ও মজুর ছিল। আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জাম, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও অর্থের অভাব থাকলেও নেতাজী সুভাসের অসাধারণ নেতৃত্বের ফলে প্রায় ৬০ হাজার সৈন্যের একটি সুশৃঙ্খল দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। জাপানী সহায়তায় বলীয়ান হয়ে এই বাহিনী ভারতের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ভারতকে আক্রমন করে। [এখানে একটা বির্তক আছে যে কেন সে ভারতীয় হয়ে ভারতকে আক্রমন করলো? আসলে তার আক্রমন ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে]

জাপানের সহায়তায় আজাদ হিন্দ ফৌজ অতর্কিত আক্রমনে ভারতে ইংরেজরা কিছুটা হলেও নড়বড়ে হয়ে যায়। এক যুদ্ধের ভিতরে আরেক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারতের আরাকান, ইম্ফল, ময়রাং, বিষেণপুর প্রভৃতি স্থান সুভাষ চন্দ্র দখল করে নেন। এসব দখলকৃত জায়গা পুনরুদ্ধারের জন্য ব্রিটেনের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধবিমান ও কামান নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। ঠিক এই মুহুর্তে নেতাজীর দল একটু পিছপা হয়ে পড়ে। তখন তারা রেঙ্গুনে গিয়ে আবারো পুর্নগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে। কয়েক মাস ব্যাপী এ যুদ্ধে মারা যায় উভয় পক্ষের অনেক সৈন্য। কিন্তু ঠিক এই মূহুর্তে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় পরাজিত হয় অক্ষ বাহিনী। তাই জাপানের আত্মসমাপর্নের ফলে বন্ধ হয়ে যায় আজাদ হিন্দ ফৌজের রসদ সরবরাহ। তারপর থেকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু নিখোঁজ হন। কথিত আছে ১৯৪৫ সালের ১৮ অগস্ট তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। (তবে তাঁর এই দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়ে বির্তক আছে)

ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়!
ঐতিহাসিক যাত্রাপালা।
সংগ্রহ ও সম্পাদনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

প্রথম অঙ্ক-তৃতীয় দৃশ্য

সময় : ১৭৫৬ সাল, ১০ই অক্টোবর। স্থান : ঘসেটি বেগমের বাড়ি।
[শিল্পীবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- ঘসেটি বেগম, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রাইসুল জুহালা, রায়দুর্লভ, প্রহরী, সিরাজ, মোহনলাল, নর্তকী, বাদকগণ।]

(পৌঢ়া বেগম জাঁকজমকপূর্ণ জলসার সাজে সজ্জিতা। আসরে উপস্থিত রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, বাদক এবং নর্তকী। সুসজ্জিত খানসামা তাম্বুল এবং তাম্রকূট পরিবেশন করছে। একজন বিচিত্রবেশী অতিথির সঙ্গে আসরে প্রবেশ করল উমিচাঁদ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক পর্যায়ের নাচ শেষ হলো। সকলের হাততালি।)

ঘসেটি : বসুন, উমিচাঁদজি। সঙ্গের মেহমানটি আমাদের অচেনা বলেই মনে হচ্ছে।
উমিচাঁদ : (যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে) মাফ করবেন বেগম সাহেবা, ইনি একজন জবরদস্ত শিল্পী। আমার সঙ্গে অল্পদিনের পরিচয় কিন্তু তাতেই আমি এঁর কেরামতিতে একেবারে মুগ্ধ। আজকের জলসা সরগরম করে তুলতে পারবেন আশা করে এঁকে আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছি।
রাজবল্লভ : তাহলেও এখানে একজন অপরিচিত মেহমান-
উমিচাঁদ : না, না, সে সব কিছু ভাবতে হবে না। দরিদ্র শিল্পী, পেটের ধান্দায় আসরে জলসায় কেরামতি দেখিয়ে বেড়ান।
জগৎশেঠ : তাহলে আরম্ভ করুন ওস্তদজি। দেখি নাচওয়ালিদের ঘুঙুর এবং ঘাগরা বাদ দিয়ে আপনার কাজের তারিফ করা যায় কিনা।
(ঘসেটি রাজবল্লভের দৃষ্টি বিনিময়। আগন্তুক আসরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল)
রাজবল্লভ : ওস্তাদজির নামটা-
আগন্তক : রাইসুল জুহালা।
(সকলের উচ্চহাসি)
রাজদুলর্ভ : জাহেলদের রইস। এই নামের গৌরবেই আপনি উমিচাঁদজিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন নাকি?
(আবার সকলের হাসি)
উমিচাঁদ : (ইষৎ রুষ্ট) আমি তো বেশক জাহেল। তা না হলে আপনারা সরশুদ্ধ দুধ খেয়েও গোঁফ শুকনো রাখেন, আর আমি দুধের হাড়ির কাছে যেতে না যেতেই হাড়ির কালি মেখে গুলবাঘা বনে যাই।
ঘসেটি : আপনারা বড় বেশি কথা কাটাকাটি করেন। শুরু করুন, ওস্তাদজি।
জুহালা : য্যায়সা হুকুম।আমি নানা রকমের জন্তু জানোয়ারের আদবকায়দা সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল। আপাতত আমি আপনাদের একটা নাচ দেখব। পক্ষীকুলের একটি বিশেষ শ্রেণি, ধার্মিক হিসেবে যার জবরদস্ত নাম, সেই পাখির নৃত্যকলা আপনারা দেখবেন। দেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে এই বিশেষ নৃত্যটি আমি জনপ্রিয় করতে চাই। (তবলচিকে) একটু ঠেকা দিয়ে দিন। (তাল বলে দিল। নৃত্য চলাকালে ঘসেটি এবং রাজবল্লভ নিচুস্বরে পরামর্শ করলেন। পরে উমিচাঁদ এবং রাজবল্লভও কিছু আলোচনা করলেন। নাচ শেষ হলে সকলে হর্ষ প্রকাশ।)
রাজবল্লভ : ওস্তাদজি জবরদস্ত লোক মনে হচ্ছে। ওঁকে আরও কিছু কেরামতি দেখাবার দায়িত্ব দিলে কেমন হয়?
(উমিচাঁদ রাইসুল জুহালাকে একপাশে ডেকে নিয়ে কিছু বলল। তারপর নিজের আসনে ফিরে এল)
উমিচাঁদ : উনি রাজি আছেন। উপযুক্ত পারিশ্রমিক পেলে কলাকৌশল দেখাবার ফাঁকে ফাঁকে দু-চারখানা চিঠিপত্রের আদান-প্রদান করতে ওঁর আপত্তি নেই।
রাজবল্লভ : তাহলে এখন ওঁকে বিদায় দিন। পরে দরকার মতো কাজে লাগানো হবে।
রাইসুল জুহালা : বহোত আচ্ছা, হুজুর।
(সবাইকে সালাম করে কালোয়াতি করতে করতে বেরিয়ে গেল)
ঘসেটি : তাহলে আবার নাচ শুরু হোক?
রাজবল্লভ : আমার মনে হয় নাচওয়ালিদের কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিয়ে কাজের কথা সেরে নেওয়াই ভালো।
ঘসেটি : তাই হোক।
(ইঙ্গিত করতেই দলবলসহ নাচওয়ালিদের প্রস্থান)
রাজদুর্লভ : বেগম সাহেবাই আরম্ভ করুন।
ঘসেটি : আপনারা তো সব জানেন। এখন খোলাখুলিভাবে যার যা বলার আছে বলুন।
জগৎশেঠ : সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে শওকতজঙ্গকে আমরা পরোক্ষ সমর্থন দিয়েই দিয়েছি। কিন্তু শওকতজঙ্গ নবাব হলে আমি কি পাব তা আমাকে পরিষ্কার করে বলুন।
ঘসেটি : শওকতজঙ্গ আপনাদেরই ছেলে। সে নবাবি পেলে প্রকারান্তরে আপনারাই তো দেশের মালিক হয়ে বসবেন।
রাজদুর্লভ : এটা কোনো কথা হলো না। যিনি নবাব হবেন-
জগৎশেঠ : আমার কথা আগে শেষ হোক দুর্লভরাম।
রাজদুর্লভ : বেশ, আপনার কথাই শেষ করুন। কিন্তু মনে রাখবেন কথা শেষ হবার পর আর কোনো কথা উঠবে না।
জগৎশেঠ : সে আবার কী কথা?
রাজবল্লভ : আপনারা তর্কের ভেতর যাচ্ছেন আলোচনা শুরু করার আগেই। খুব সংক্ষেপে কথা শেষ করা দরকার। বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের আলোচনা দীর্ঘ করা বিপজ্জনক।
জগৎশেঠ : কথা ঠিক। কিন্তু নিজের স্বার্থ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে একটা বিপদের ঝুঁকি নিতে যাওয়াটাও তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মাফ করবেন বেগম সাহেবা, আমি খোলাখুলি বলছি। অঙ্গীকার করে লাভ নেই যে, শওকতজঙ্গ নিতান্তই অকর্মণ্য। ভাংয়ের গেলাস এবং নাচওয়ালি ছাড়া আর কিছুই জানে না। কাজেই শওকতজঙ্গ নবাব হবে নামমাত্র। আসল কর্তৃত্ব থাকবে বেগম সাহেবার এবং পরোক্ষে তাঁর নামে দেশ শাসন করবেন রাজবল্লভ।
রায়দুর্লভ : ঠিক এই ধরনের একটা সম্ভাবনার উল্লেখ করার ফলেই হোসেন কুলি খাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে।
জগৎশেঠ : আমি তা বলছিনে। তা ছাড়া এখানে সে কথা অবান্তর। আমি বলতে চাইছি যে, শওকতজঙ্গ নবাবি পেলে বেগম সাহেবা এবং রাজা রাজবল্লভের স্বার্থ যেমন নির্বিঘ্ন হবে আমাদের তেমন আশা নেই। কাজেই আমাদের পক্ষে নগদ কারবারই ভালো।
ঘসেটি : ধনকুবের গজৎশেঠকে নগদ অর্থ দিতে হলে শওকতজঙ্গের যুদ্ধের খচর চলবে কী করে?
জগৎশেঠ : না, না, আমি নগদ টাকা চাইছিনে। যুদ্ধের খরচ বাবদ টাকা আমি দেব, অবশ্য আমার সাধ্য। কিন্তু আসল এবং লাভ মিলিয়ে আমাকে একটা কর্জনামা সই করে দিলেই আমি নিশ্চিত হতে পারি।
রাংদুর্লভ : আমাকেও পদাধিকারের একটা একবারনামা সই করে দিতে হবে। (প্রহরীর প্রবেশ। ঘসেটি বেগমের হাতে পত্র দান)
ঘসেটি : (চিঠি খুলতে খুলতে) সিপাহসালার মিরজাফরের পত্র। (পড়তে পড়তে) তিনি শওকতজঙ্গকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং অবিলম্বে সিরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার পরামর্শ দিয়েছেন।
রাজবল্লভ : বহোত খুব।
উমিচাঁদ : আমার তো কোনো বিষয়ে কোনো দাবিদাওয়া নেই, আমি সকলের খাদেম। খুশি হয়ে যে যা দেয় তাই নিই। কাজেই এতক্ষণ আমি চুপ করেই আছি।
ঘসেটি : আপনারও যদি কিছু বলার থাকে এখুনি বলে ফেলুন।
উমিচাঁদ : নিজের সম্বন্ধে কিছু নয়। তবে সিপাহসালারের প্রস্তুতি আমার পছন্দ হয়েছে তাই বলছি। ইংরেজ আবার সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছে। সিরাজউদ্দৌলার পতনই তাদের কাম্য। শওকতজঙ্গ এখুনি যদি আঘাত হানতে পারেন, তিনি ইংরেজদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পাবেন। ফলে জয় তাঁর অবধারিত।
ঘসেটি : সিরাজের পতন কে না চায়?
উমিচাঁদ : অন্তত আমরা চাই। কারণ সিরাজউদ্দৌলার নবাবিতে নির্বিঘ্ন হতে পারলে আমাদের সকলের স্বার্থই রাহুগ্রস্ত হবে।
ঘসেটি : সিরাজ সম্বন্ধে উমিচাঁদের বড় বেশি আশঙ্কা।
উমিচাঁদ : কিছুমাত্র নয় বেগম সাহেবা। দওলত আমার কাছে ভগবানের দাদামশায়ের চেয়েও বড়। আমি দওলতের পূজারী। তা না হলে সিরাজউদ্দৌলাকে বাতিল করে শওকতজঙ্গকে চাইব কেন? আমি কাজ কতদূর এগিয়ে এসেছি এই দেখুন তার প্রামণ।
(পকেট থেকে চিঠি বার করে ঘসেটি বেগমের হাতে দিল)
ঘসেটি : (চিঠির নিচে স্বাক্ষর দেখে উল্লসিত হয়ে) এ যে ড্রেক সাহেবের চিঠি!
উমিচাঁদ : আমার প্রস্তাব অনুমোদন করে তিনি জবাব দিয়েছেন।
ঘসেটি : (পত্র পড়তে পড়তে) লিখেছেন শওকতজঙ্গ যুদ্ধ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সিরাজের সেনাপতিদের অধীনস্থ ফৌজ যেন রাজধানী আক্রমণ করে। তাহলে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় অভশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে।
রাজবল্লভ : আমাদের বন্ধু সিপাহসালার মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খান ইচ্ছে করলেই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন।
(হঠাৎ বাইরে তুমুল কোলাহল। সকলেই সচকিত। ঘসেটি বেগম কোলাহলের কারণ জানবার জন্যে যেতেই রাজবল্লভ তাঁকে থামিয়ে দিয়ে নাচওয়ালিদের ডেকে পাঠালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তারা সদলবলে কামরায় এল।)
রাজবল্লভ : আরম্ভ কর জলদি। (ঘুঙুরের আওয়াজ উঠবার পর পরই সবেগে কামরায় ঢুকলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। পেছনে মোহনলাল। সবাই তড়িৎ-বেগে দাঁড়ালো। নাচওয়ালিদের নাচ থেমে গেল।)
ঘসেটি : (ভীতিরুদ্ধ কণ্ঠে) নবাব!
সিরাজ : কি ব্যাপার খালাআম্মা, বড়ো ভারী জলসা বসিয়েছেন?
ঘসেটি : (আত্মস্থ হয়ে) এ রকম জলসা এই নতুন নয়।
সিরাজ : তা নয়, তবে বাংলাদেশের সেরা লোকেরাই শুধু শামিল হয়েছেন বলে জলসার রোশনাই আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছে।
ঘসেটি : নবাব কি নাচগানের মজলিস মানা করে দিয়েছেন?
সিরাজ : নাচগানের মহফিলের জন্যে দেউড়িতে কড়া পাহারা বসিয়ে রেখেছেন খালাআম্মা। তারা তো আমার ওপরে গুলিই চালিয়ে দিয়েছিল প্রায়। দেহরক্ষী ফৌজ সঙ্গে না থাকলে এই জলসায় এতক্ষণে মর্সিয়া শুরু করতে হতো। (হঠাৎ কণ্ঠস্বরে অবিচল তীব্রতা ঢেলে)
রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, আপনারা এখন যেতে পারেন। মতিঝিলের জলসা আমি চিরকালের মতো ভেঙে দিলাম। (ঘসেটি বেগমকে) তৈরি হয়ে নিন, খালাআম্মার পক্ষে প্রাসাদের বাইরে থাকা নিরাপদ নয়।
ঘসেটি : (রোষে চিৎকার করে) তুমি আমাকে বন্দি করে নিয়ে যেতে এসেছ? তোমার এতখানি স্পর্ধা?
সিরাজ : এতে ক্রুদ্ধ হবার কি আছে? আম্মা আছেন, আপনিও তাঁর সঙ্গেই প্রাসাদে থাকবেন।
ঘসেটি : মতিঝিল ছেড়ে আমি এক পা নড়ব না। তোমার প্রাসাদে যাব? তোমার প্রাসাদ বাজ পড়ে খান খান হয়ে যাবে। (সহসা কাঁদতে আরম্ভ করলেন)
সিরাজ : (অবিচলিত) তৈরি হয়ে নিন, খালাআম্মা। আপনাকে আমি নিয়ে যাব।
ঘসেটি : (মাতম করতে করতে) রাজা রাজবল্লভ, জগৎশেঠ বিধবার ওপরে এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপনারা কিছুই করতে পারছেন না?
রাজবল্লভ : (একটু ইতস্তত করে) জাঁহাপনা কি সত্যিই-
সিরাজ : (উত্তপ্ত) আপনাদের চলে যেতে বলেছি রাজা রাজবল্লভ। নবাবের হুকুম অমান্য করা রাজদ্রোহিতার শামিল। আশা করি অপ্রিয় ঘটনার ভেতর দিয়ে তা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না।
(রাজবল্লভ প্রভৃতি প্রস্থানোদ্যত) হ্যাঁ, শুনুন রায়দুর্লভ, শওকতজঙ্গকে আমি বিদ্রোহী ঘোষণা করেছি। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে মোহনলালের অধীনে সেনাবাহিনী পাঠাবার ব্যবস্থা করেছি। আপনি তৈরি থাকবেন। প্রয়োজন হলে আপনাকেও মোহনলালের অনুগামী হতে হবে।
রায়দুর্লভ : হুকুম, জাঁহাপনা। (তারা নিষ্ক্রান্ত হলো। ঘসেটি বেগম হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন।)
সিরাজ : মোহনলাল আপনাকে নিয়ে আসবে, খালাআম্মা। আপনার কোনো রকম অমর্যাদা হবে না। (বেরিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়ালেন)
ঘসেটি : তোমার ক্ষমতা ধবংস হবে, সিরাজ। নবাবি? নবাবি করতে হবে না বেশিদিন। কেয়ামত নাজেল হবে। আমি তা দেখব-দেখব।
[দৃশ্যান্তর]

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

5 thoughts on “ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়! তৃতীয় পর্ব

  1. দূর্লভ ইতিহাস এবং নাট্য চিত্রায়ন। অভিনন্দন মি. ভাণ্ডারী। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. ভারতসূর্য ডুবে গেল হায়! :( আরও দুটি পর্ব আছে মনে হচ্ছে। পড়বো আশা করি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  3. তৃতীয় পর্ব প্রথমেই পড়া হলো। বাকি পর্ব গুলোতে যাচ্ছি কবি। :) 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।