পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান দ্বিতীয় খণ্ড- চতুর্থ পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
দ্বিতীয় খণ্ড- চতুর্থ পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

ঝাড়গ্রাম যদি জঙ্গল মহলের রানি হয় তাহলে বেলপাহাড়ি অবশ্যই রাজকন্যে৷ টুসু পূজা ও তাকে ঘিরে উৎসব বেলপাহাড়িতে চলে আসছে অনেক বছর ধরে৷ বেলপাহাড়ি সহ সংলগ্ল কানাইশহর পাহাড়ের কোলের ছোট ছোট গ্রামগুলোতে টুসু পুজোর আগে বসে হাট৷ যেখানে টুসু মূর্তি থেকে নতুন জামা কাপড় এবং নানা রকমের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে হাজির হন পাশাপাশি গ্রামের সাধারণ মানুষ৷ তবে বেলপাহাড়ির টুসু হাট ধারে ও ভারে বেশ বড়৷

আসছে মঙ্গলবার মকর সংক্রান্তি এবং পিঠে পুলির উৎসবে ডুব দেবে জঙ্গলমহল৷ তার আগে সোমবারই টুসু পুজোর শেষ দিন৷ সারাদিন এবং রাত পুজোর পর বিকেল নাগাদ টুসুর বিসর্জন৷ এই সময় বেলপাহাড়ি এবং সংলগ্ন গ্রামগুলিতে গেলে শোনা যাবে টুসুকে ঘিরে লোকগীতি৷ টুসু জঙ্গল মহল ও রাঢ় বাংলার মেয়ে হিসেবে পরিচিত৷ তাই তাঁকে গ্রামের মহিলারা মিলে নদী কিংবা পুকুরে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় গেয়ে ওঠে, ‘‘আমাদের টুসু নাইতে নেমেছে…’’৷
টুসু পুজোর আগের বুধবার বেলপাহাড়িতে বসে টুসু হাট৷ বেলপাহাড়ি থেকে সঁন্দাপাড়া যাওয়ার রাস্তা পাশে ফাঁকা জমিতে এই হাটে টুসু মূর্তি, পুজোর সরঞ্জাম এবং নতুন জামাকাপড়ে পাশাপাশি বিক্রি হয় মাটির নানা রকমের আসবাবপত্র৷ বেলপাহাড়ির আশেপাশের গ্রাম থেকে হাটে আসা অনেক মানুষ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করার পাশাপাশি তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাড়ি ফেরেন৷

বেলপাহাড়ির হাটে এরকমই একজন টুসু মূর্তি বিক্রেতা হলেন চন্দন মাহাতো৷ হাটে ঢুকতেই টুসু মূর্তির পসরা সাজিয়ে বসা চন্দন অপেক্ষা করে চলেছে- কখন বিক্রি শেষ হবে৷ সব মূর্তি বিক্রি হয়ে গেলে দিনের রোজগারের একটা অংশ দিয়ে বাড়িতে থাকা মেয়ে বৌয়ের জন্য হাট থেকেই নতুন জামাকাপড় কিনে বাড়ি ফিরবে সে৷

জঙ্গল মহল এখন অনেকেরই পছন্দদের ‘ট্যুর ডেস্টিনেশন’৷ ভাইফোঁটার পর থেকে অল্প অল্প শীত পড়তে শুরু করলে কলকাতা এবং আশেপাশের জেলা থেকে ভ্রমণ পিপাসুরা পৌঁছে যান ঝাড়গ্রাম, বেলপাহাড়ি, পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার সতেজ বাতাসে শ্বাস নিতে৷ এই জঙ্গল মহলের সঙ্গে নাড়ির যোগ রয়েছে ‘টুসু’র৷ শীতের শেষে টুসু পুজো এবং তাকে কেন্দ্র করে মেলা এটাই বিশেষত্ব মালাবতি, ভান্ডারু, কেশদা, সাহাড়ির মতো বেলপাহাড়ির সংলগ্ন গ্রামগুলিতে৷
টুসুর বাপের বাড়ি আসাকে কেন্দ্র করে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয় পরব৷ আবার কোথাও মকর সংক্রান্তির আগের দিনেই শুধু টুসুর পূজা করা হয়৷ বেলপাহাড়ি এবং সংলগ্ন গ্রামগুলিতে এই একদিনের টুসু পুজোয় প্রচলিত রয়েছে৷ শেষ ধানের ক্ষেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়৷ অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন৷

তারপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মণ্ড, দূর্বা ঘাস, আল চাল, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পাত্রটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গির ওপর রেখে স্থাপন করা হয়৷ পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিতা হন৷ পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর নিকট তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন৷ টুসু গান লোকগীতি হিসেবেও বিশেষ জনপ্রিয় জঙ্গলমহলে৷

আর পাঁচটা পুজোর থেকে কোথায় আলাদা এই পুজো? সাধারণত পুজো হয় দেবতাদের সন্তুষ্ট করে কাঙ্ক্ষিত বর লাভের উদ্দেশ্যে৷ কিন্তু টুসু পুজো সেখান থেকে একেবারেই আলাদা৷ চারমাসের পরিশ্রমের পর চাষিরা ফসল ঘরে তুলতে পেরে আনন্দে মেতে ওঠেন এবং টুসু দেবতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে উৎসবে মাতেন৷ কবে টুসু পূজার প্রচলন হয়েছিল সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি৷ তবে প্রথম দিকে টুসু পুজোতে মূর্তি পুজোর চল ছিল না৷ এখন নতুন ধানের শিষের সঙ্গে মাটির মূর্তিও ব্যবহার হচ্ছে টুসু পুজোতে৷ জঙ্গল মহলের মেয়েরা নিজেরায় টুসু পুজো করে থাকেন৷ সাধারণ লৌকিক আচারেই এই পুজো হয়৷

লিখেছেন: শেখর দুবে

তথ্যসহায়তায়: কলকাতা 24 X 7

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।