নিও না মুছে সিঁথির সিঁদুর

নিও না মুছে সিঁথির সিঁদুর
বিভাগ : ছোট গল্প

কলমে – লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

গাঁয়ের মেয়ে বর্ণালী, একটি ছোট মেয়ে। অতি অল্পবয়সেই তার বিয়ের ব্যবস্থা পাকা হলো। তারপর একদিন শুভদিন দেখে অনুষ্ঠান করেই তার বিয়ে হল। কিন্তু সুখ কপালে সইলো না। বিয়ের পরদিনই ওর স্বামী অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল। পুলিশ ডেড বডি মর্গে পাঠিয়েছে। বর্ণালী কিছুই জানে না। ওকে কেউ বলে নি, ওর কাছে সব কিছু গোপন করা হলো। জানালো না কিছুই।

আজ সকাল থেকেই বর্ণালীর মনটা কু গাইছে। সারা দিনে একটি বারও সে এলো না। বর্ণালী তার মুখটা মনে করতে চেষ্টা করে। বিয়ের রাতে ছাঁদনাতলায় টোপর মাথায়, ধুতি পাঞ্জাবী পরা, আর গায়ে চাদর জড়ানো ওর মনের মানুষটাকে। কিন্তু হায়! সে আজ একটি বারও তার কাছে এলো না। বর্ণালী মনের আয়নায় খুঁজে পেতে চায় তাকে।

বর্ণালী বাপের বাড়ি ছেড়ে এই প্রথম নতুন শ্বশুরবাড়িতে এলো। ওর পোষা টিয়াপাখিটা হয়তো দু’দিন ভাল করে খাবে না। কালো গাইটা হয়তো দু-তিন ভাল করো দুধ দেবে না। রাঙী বাছুরটা হয়তো অভিমানী হয়ে পড়ে থাকবে। আর কেউ তাকে আদর করবে না। হুলো বেড়ালটা হয়তো মাছভাত মুখে দেবে না। টমি কুকুরটা হয়তো মনের দুঃখে কোথাও মুখ গুঁজে শুয়ে পড়ে থাকবে। আর কেউ তাকে ডাকবে না। এই কথা ভাবতে ভাবতে একসময় কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল বর্ণালী জানে না।

সেদিন দুপুরবেলায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্নে দেখল তার মনের আয়নায় মনের মানুষটিকে। ওর হাতে হাত রেখে সে ওকে বলছে- “এইতো আমি এসেছি। এবার ঘুমাও তুমি প্রিয়া।” স্বপ্ন কি কভু সত্যি হয়? বর্ণালী ওঠে পড়ে।
ওর ননদরা ওকে পরিপাটি করে সাজিয়ে দিল।

আর ওদের ফুলশয্যা। বিয়ের সানাই বাজছে। আত্মীয়স্বজনের সবাই এক এক করে খাওয়া দাওয়া সেরে চলে গেল। অবশ্য কেউ কেউ যাবার আগে বর্ণালীর হাতে উপহারের প্যাকেট দিয়ে বললো- “কনগ্র্যাচুলেশন! তোমাদের বিবাহিত জীবন সুখের হোক।” দেওয়া উপহারগুলো পাশের সোফায় এখনও থরে থরে সাজানো রয়েছে। কেউ তা খুলে দেখে নি। হয়তো আর কোন দিনই সেগুলো খুলে দেখা হবে না।

এখন অনেক রাত। বন্ধ হয়ে গেছে বিয়ের সানাই। ঝাড়লণ্ঠণের বাতিগুলো এক এক করে সব নিভে গেল। বর্ণালীর ফুলশয্যার ঘরে আজ সে একা। অথচ আজও সে এলো না।

রাত কেটে ভোর হয়, নতুন সকাল বহন করে আনে এক নিদারুণ দুঃসংবাদ। বন্ধুদের সাথে মার্কেটিং করতে গিয়েওর স্বামী অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। আজ সকালে ঘরে পুলিশ এসে দিয়ে গেল মরা লাশটা। বর্ণালী কিছুই ভাবতে পারে না। ওর মাথাটা ঘুরছে। টপ্ টপ্ করে দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো ওর দু চোখ বেয়ে।

নির্জন শ্মশানঘাট। স্বামীর চিতা জ্বলছে। বিধবার বেশে আজ দারুণ লাগছে বর্ণালীকে। পরনে সেদিনের সেই নীল বেনারসী শাড়ি আর আজ নেই। গলার সীতাহার, কানের দুল, হাতের কঙ্কনবালা আর কয়েকগাছা সোনার চুড়ি,
এক এক করে সব খুলে নিয়ে শ্বাশুড়িমার হাতে দিয়ে অস্ফুট এক বোবা কান্নায় বর্ণালী ভেঙে পড়ল। ওর দু’চোখে শ্রাবণের অশ্রুধারা।

শ্বাশুড়ি মা তার চোখের জল মুছিয়ে ওকে স্বান্তনা দেয়। “দুঃখ কোর না বৌমা। আমার এক ছেলে চলে গেলেও আর এক ছেলে আছে। তার সাথে আবার নতুন করে তোমার বিয়ে দেবো। ” বর্ণালী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে “ মেয়েদের যে দুবার বিয়ে হয় না মা। ” এই তো জীবন। জীবনে অজানা কত ঘটনাই চোরা বালি হয়ে যায়।

বর্ণালীর জীবনে বিগত এই দু তিন দিনে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। গায়ে হলুদ, বিয়ে বাড়ির হৈ চৈ, টোপর মাথায় বরানুগমন, বর এসেছে, বর এসেছে, শংখধ্বনি, উলুধ্বনি, পুরোহিতের মন্ত্রপাঠ। সবকিছুই মনে আছে বর্ণালীর।

বিয়ে হল, কিন্তু বাজলো না সানাই, বাসর হল, কিন্তু হল না ফুলশয্যা। বর্ণালীর জীবন অভিশপ্ত।

অনুপম কিন্তু মায়ের কথায় অমত করে নি। অনুপম বলে “ কেন হয় না বৌদি ? এই বিধবার বেশে তোমায় মানায় না। তোমার সিঁথিতে আবার আমি সিঁদুর পরিয়ে দেবো।”

অবশেষ তাই হলো। মন্দিরে গিয়ে মালাবদল করে ওদের দুজনের বিয়ে হল। এর নাম জীবন। জীবনের এক নতুন অধ্যায়। এর নাম বিবাহ বন্ধন। ভালবাসার এক অটুট বন্ধন । দুটো হাত এক সুতোয় বাঁধা হয়ে গেল। বর্ণালীর চোখে অনুপম স্বপ্ন। অনুপমের চোখে বর্ণালী স্বপ্ন।

শাঁখ বাজিয়ে, উলুধ্বনি দিয়ে, মঙ্গলঘট আর পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে, ওদের করুণাময়ী মা বরণ করে নিল নব বরবধুকে। বর্ণালী মাকে প্রণাম করে। বর্ণালীর মাথায় হাত রেখে মা বলে-“আশীর্বাদ করি বৌমা তোমার হাতের শাঁখা আর
সিঁথির সিঁদুর চির অক্ষয় হোক।”

প্রতিসন্ধ্যায় আজও বর্ণালী তুলসীতলায় ধূপ আর প্রদীপ জ্বেলে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে। “ওগো ঠাকুর, প্রাণের দেবতা! তোমার কাছে চেয়েছি অনেক। দাও নি কিছুই। শুধু একটি প্রার্থনা করছি তোমায়। হে জগদীশ্বর! আমার বিবর্ণ সিঁথির সিঁদুর তুমি কোনদিন মুছে নিও না।”

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

2 thoughts on “নিও না মুছে সিঁথির সিঁদুর

  1. অণুগল্পটি পড়লাম কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী। বেশ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।