মুনিয়া এবং কাহিনি একাত্তর ২

উত্তাল উনসত্তর। বছরের শুরুতে আগড়তলা মামলায় বন্দি নেতা শেখ মুজিবর রহমান এবং সহযোগিদের মুক্তি আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। বাংলার মানুষের স্বাধীনতার রূপরেখা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ ছয়দফা আর ছাত্র সংগ্রাম কমিটির কয়েকটি দাবি যোগ হয়ে এগারো দফা আদায়ের আন্দোলন জোরদার। সেই আন্দোলনে পরবর্তীতে যোগ দিল আরও কিছু সংগঠন। রাস্তায় রাস্তায় মিছিল। এখানে-ওখানে আলোচনা। উদ্দীপ্ত শপথ উচ্চারণ। উত্তপ্ত বক্তৃতা। সরকার সান্ধ্য আইন জারি করল। সড়কে জোরদার টহল। অস্থির বাতাসে কী হয় কী হয় ফিসফাস আলাপ। চব্বিশে জানুয়ারি, শুক্রবার আইয়ুব শাসনের উৎখাত আর নেতাদের মুক্তি দাবিতে মানুষজন সান্ধ্য-আইন উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে পড়ল। শ্লোগানমুখর সময়। শাসকের পেটোয়াবাহিনি বসে রইল না। যতরকম পদ্ধতি সবগুলোর প্রয়োগ শুরু হয়ে গেল। রাইফেল গর্জে উঠল। ক্লাস নাইনের ছাত্র মতিউর গুলিতে আর একজন রুস্তম ছুরিকাঘাতে নিহত হলে সরকারের অবস্থা টালমাটাল। দেন-দরবার আলোচনা ব্যর্থ হলো। অবশেষে পঁচিশে মার্চ, মঙ্গলবার, লৌহমানব প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রেডিও-টেলিভিশনে ভাষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনি প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে রাস্ট্রক্ষমতা ছেড়ে দিলেন। ইয়াহিয়া খান ওইদিন দুপুরে সংবিধান স’গিত রেখে নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা করলেন। রাতে আরেক ভাষণ। বাংলার মানুষ শুনল নির্বাচনের আশ্বাস।
আমরা কাঠের গ্রিনরুম কাম রেস্টহাউসের ঘরে-বারান্দায় গল্প করি। গল্প শুনি। এ হলো নন-ফিকশন গল্প। আলোচনা চলে…গভীর রাত আরও নিবিড় হতে থাকে। পুনর্ভবা নদীর স্রোতের মতো এক সূত্র থেকে অন্য সূত্রে ঢেউ বয়ে যায়। আমার ক্লাসমেট বাচ্চু। সে বোঝে। আমি রাফিদুলের মতো হাঁ হয়ে শুনি। ইয়াহিয়া খান ছাত্রছাত্রিদের আইডেন্টিটি কার্ড সিস্টেম প্রবর্তন করেছেন। অনেক সুবিধে। ট্রেন-বাসের ভাড়া অর্ধেক। সিনেমার টিকিট প্রায় ফ্রি। আমরা কোনোদিন দল বেঁধে ম্যাটিনি শো দেখেছি। দিলীপ সোমের সাত ভাই চম্পা-য় খান আতার ‘হক মওলা’ কারও মুদ্রাদোষ হয়ে গেল। রহিম নেওয়াজের সুয়োরানি দুয়োরানি-র নায়ক-নায়িকা প্রেমের দশকলা শেখায়। কাজী জহিরের ময়না মতি। মানুষ আপনমনে গুনগুন গায় ‘অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেটে যায়’। আমি ভুলে যাই, মানুষ এই তো সেদিন চাঁদ জয় করেছে।

রাত সম্ভবত সাড়ে বারো। রাফিদুল-শহিদ-মনোয়ার প্রথমে লক্ষ্য করে ছায়া। সেই বিরান পাথার, যেখানে শিয়াদের দলবেঁধে আস্তানা ছিল, এখন কেউ নেই, জায়গাটা ভুতুড়ে আবাস, অশরীরী অস্ফুট দীর্ঘশ্বাস বাতাস ভারী করে রাখে সকাল-দুপুর-সন্ধে আর রাত, সেখানে কেউ একজন বা কিছু একটা নড়ে ওঠে। কে সে? কোনো মানুষ অথবা গরু-ছাগল? শহরে এখন কোথাও কোথাও গরু-ছাগল ইতস্তত চরে বেড়ায়। মালিক নেই। কারও কারও ঘরবাড়ি নেই। কারও ঘরবাড়ি আছে মানুষ নেই। চারিদিক শূন্য খাঁ-খাঁ অসি’র সময়ের ক্ষণ-অনুক্ষণ বয়ে যায়। মধ্যরাতের নিশ্চুপ প্রহর। কখনো আচমকা রাইফেল ফায়ার হয়। পাটাশ! কখনো কুকুরের উল্লাসী অথবা অসহায় ক্রন্দন বাতাস থমথমে করে রাখে। আমাদের ঘুম নয়, তন্দ্রাঘোর, সেও বোধকরি ঠিক নয়, চোখদুটো খোলা রেখে রাত পাহারা; তাই সতর্ক ফিসফাসে জেগে উঠি। এ তো জেগে ওঠা নয়, দৃষ্টির সকল কেন্দ্র দূরে একটু দূরে আছড়ে পড়ে। আজ রাত তেমন আবছায়া নয়। আকাশে নক্ষত্রমালা-ছায়াপথ যতটুকু মৃদু আলো ছড়িয়ে রাখে, আমরা দেখি গরু-ছাগল কিংবা রাতে দুড়দাড় দাপটি শূকর নয়; একজন ছায়ামুর্তি। মানুষ। বোধকরি মেয়েমানুষ। রাফিদুল আর শহিদ আস্তে আস্তে নিজেদের আড়াল করে এগিয়ে ধরে ফেলে তাকে। আমরা কাঠঘর বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি একজন মানুষ ঝুপ করে নিচে আছড়ে পড়ল। এরপর শহিদ যখন টর্চের সতর্ক আলো চোখে-মুখে ছড়িয়ে দেয়, আর কেউ না হোক আমি চিনতে পারি। মুনিয়া।
সেন্ট যোসেফস্স্কুলের পশ্চিমে রাস্তা। সেটি পেরিয়ে একসঙ্গে পর পর চারটি দোকান। জান মহম্মদের বেকারি। বেকারির ভাঁজকরা সবুজ রং কাঠদরজা। সেখানের কোনো ফাঁকফোকর গলিয়ে দুপুরের বাতাসে তন্দুরে সেকা বিস্কুট-পাউরুটির সুবাস ছড়িয়ে যায়। দক্ষিণের তিনটি দোকান মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু। প্রথমে মিজানুর বা লুডু মিয়ার মুদি দোকান। সবশেষে মটরসাইকেল আর সিঙ্গার সেলাই মেশিনের ওয়ার্কশপ। মালিকের মুখে সবসময় পান। আশপাশে জরদার মাতাল গন্ধ। আহমদ হাসান মধ্যখানের দোকানে কাজ করেন। আমি তাকে চাচা ডাকি। দোকানের সামনে চার-পাঁচ ফুট প্রশস্ত বারান্দা। এককোনায় একটি বেঞ্চ। বই বাঁধাইয়ের কাজ হয়। তিনি কখনো বারান্দায় বসেন। কতগুলো বই রোদে শুকোয়। সব ধরনের বই অদ্ভুতরকম সেলাই হয়। আমার স্কুল মর্নিং। কোনোদিন স্কুল শেষে বাসায় ফিরে ব্যাগ রেখে সেই বেঞ্চে বসি। পকেটে মাউথঅর্গান। কখনো গানের সুর তোলার হাজার চেষ্টা। ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা, না জানে কিস্পে আয়েগা।’ বাবাকে খুব মানে আহমদ চাচা। তার আইনের বই ফরমাশ মতো বাঁধাই হয়। আমি কাজ দেখি। লম্বা হাতলঅলা খুন্তির মতো হাতিয়ার, নিচে অর্ধবৃত্তাকার ব্লেড, শিলপাথরে ঘষে ঘষে আরও ধারালো হয়, তবেই মোটা মোটা বইয়ের প্রান্তদেশ মসৃণ কেটে ফেলা। মুনিয়া কাপড়ের পোটলায় খাবার নিয়ে আসে। বাবার হাতে দিয়ে সামনের টিউবওয়েল থেকে জগে পানি ভরে। তারপর বেঞ্চের একপ্রান্তে বসে গান শোনার আবদার।
‘ভাইয়া…ভাইয়া ওই গানটা বাজা না?’
‘কোনটা?’
‘ওই যে কুছ লোগ রুঠ কারভি লাগতে হ্যাঁয় কিতনে পেয়ারে। হি হি হি!’
‘দূর আমি পারি না।’
‘ভাইয়া হবে হবে তুম বাজাও না?’
আমি পকেট থেকে মাউথঅর্গান বের করি। অনেকদিন ধরে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে কেনা। চায়নার তৈরী চৌষষ্টি ঘরের সুর মায়াজাল ভিক্টরি। মুনিয়াকে পরিস্তানের পরি মনে হয়। সোনালি-কালো ঝাঁকড়া চুলের ছায়ায় অসম্ভব উজ্জ্বল ফরসা মুখছবি। গোলাপি রং লিপিস্টিক চিকন ঠোঁটে কিংবা আলতা আবীর। নীল চোখের দিকে তাকাতে তাকাতে কেমন শিহরন লাগে। আমার সুর তোলা হয় না। ‘হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা, না জানে কিস্পে আয়েগা।’ হয় না। মাউথঅর্গান শুধু পোঁ-পোঁ করে। আহমদ চাচা অজু করে এসেছেন। কোরআন শরীফ সেলাই করতে হবে। আমি লক্ষ্য রাখি। কেমন করে জুস সেলাই হয়। মুনিয়া আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারি। তার সারা মুখে অদ্ভুত আলো। আহমদ চাচা হাসতে হাসতে বলেন, –
‘কি রে বেটা পেঁ-পোঁ বাঁশি বাজাচ্ছিস? মেট্রিক ইমতেহান সামনে। প্রিপারেশন কেমুন? উকিলের ছেলে ব্যারিস্টারি পড়তে হবে। বাপ্কা নাম রওশন করনে হোগা।’
‘স্কুল তো ছুটি চাচা। আব্বা বইয়ের খোঁজ নিতে বলেছে।’
‘উকিল সাব কো বলবে কাল এতোয়ার কা দিন হ্যায়, ইখানে যেনো আসেন।’
‘আচ্ছা।’
মুনিয়া বাসনপত্র গুছিয়ে ব্যস্ত হয়। ফিরে যেতে হবে। গণেশতলা মসজিদের গলি হয়ে অনেক পেছনে ভাড়া বাড়ি। আমি সেখানে কয়েকবার গিয়েছি। মুনিয়া মাসুমার ক্লাসমেট। একই স্কুলে পড়ে। সই পাতিয়েছে। ওদের দু-জনের বন্ধুত্বে দুই পরিবারে মেলবন্ধন। মুনিয়ার বড়ভাই সুইহারিতে মটর গ্যারেজে কাজ করে। একদিন তার সঙ্গে দেখা হয়। সেদিনও মাসুমার আবদারে যাওয়া। আমার হাতে ক্যামেরা। বাচ্চুর কাছে থেকে ধার নিয়েছি, কিন্তু মনের আড়ালে লুকোচুরি ভাব অন্যরকম, যেন জিনিসটা আমার। সকালে নতুন ফিলম লোড করা হয়েছে। মাসুমা বান্ধবীর সঙ্গে ছবি তুলবে। আমি দক্ষ ক্যামেরাম্যান। তখন আখলাকের সঙ্গে দেখা। গোলাপি উজ্জ্বল ফরসা, নাকের নিচে লালচে-কালো গোঁফ, সাদা পাজামার সঙ্গে ঘি-রং ঝুল পাঞ্জাবি, সেখান থেকে অচেনা কোনো আতরের সুবাস ভেসে বেড়ায়। সাইকেল নিয়ে বেরোবে। আঙিনা থেকে চেঁচিয়ে বলে, –
‘আম্মি ম্যায় যা রাহা হু, লওটনে সে দের হোগা। আস্সালামু আলায়কুম।’
‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম। আল্লা হাফিজ বেটা।’
‘আল্লা হাফিজ।’
তারপর আমাদের দেখে একগাল মৃদু হেসে বলে উঠে, –
‘মুনিয়া দেখ্দেখ্কে এসেছে। মাসুমার বড়াভাই ভি আয়া।…আউর ছোটেভাই হামার একটা ফটো তুলবে না? হা হা হা!’
‘হা হা জরুর ভাইজান।’
‘না রে ইয়ার্কি করছি। বহুত কাম আছে। আভি যেতে হবে। অন্যদিন বাতচিত করব কেমুন। আল্লা হাফিজ।’
(চলমান)
আগের পর্ব পড়ুন মুনিয়া এবং কাহিনি একাত্তর

মাহবুব আলী সম্পর্কে

মাহবুব আলী দিনাজপুর, বাংলাদেশ। প্রভাষক। প্রকাশিত বই: ১. অস্তিত্বের পলায়ন (গল্প) ১৯৯২ ২. ছোটগল্পের নির্মাণশৈলী (সাহিত্য ও সাংবাদিকতা) ২০১৮ ৩. অস্তিত্বের পলায়ন (গল্প) (রিভাইজড ভার্সন) ২০১৮ ৪. ভয় (গল্প) ২০১৮ ৫. পিঙ্গল বিকেলের আয়নায় (গল্প) ২০১৮ ৬. অযোগ্যতার সংজ্ঞা (গল্প) ২০১৮ ৭. রাত পাহারা চোখ (গল্প) ২০১৮ ৮. গোপনীয়তার অলিগলি (বড়গল্প) ২০১৮

2 thoughts on “মুনিয়া এবং কাহিনি একাত্তর ২

  1. চমৎকার লাগলো আরও একটি পর্ব। কত দিকেই না নজর রেখেছেন কাহিনী বিন্যাসে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।