১।
বাচ্চু মিয়ার দিন খুব একটা ভাল যায় না। একদিন কাজ করতে পারলে দুই দিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয়। ঝাঁর ফুক, গাছ গাছন্ত দিয়ে অনেক দিন চিকিৎসা করান হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি তাই ও পাড়ার মফিজের পরামর্শে কিছু পয়সা জমিয়ে মানিকগঞ্জে বড় ডাক্তার দেখিয়েছে। সে ই পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলেছে লিভারে সমস্যা দেখা দিয়েছে নিয়মিত ওষুধ খাবেন আর বিশ্রামে থাকবেন। কিন্তু যার দিন আনতে পানতা ফুরায় সে কি করে বিশ্রামে থাকবে আর কি করেই বা নিয়মিত ওষুধ খাবে! হযরত আলির লাকড়ির দোকানে কাঠুরিয়ার কাজ করে কি আর বিশ্রামে থাকা যায়? চার পাঁচজন ছেলে পুলে তার পরে আবার ঘরে অবিবাহিত ছোট এক বোন নিয়ে বড় কষ্টে দিন যায়। ভাগ্য ভাল যে বড় মেয়েটা ঢাকায় ওসমান সাহেবের বাসায় কাজ করে। মাস গেলে কিছু টাকা দিয়ে পাঠিয়ে দেয় নয়তো সে নিজে বাড়ি এলে বাচ্চু মিয়ার হাতেই দিয়ে যায়। ঢাকা আরিচা রোডের তরা ব্রিজ পাড় হয়ে এসে বায়ে হরিরামপুরের রাস্তায় দক্ষিণে একটু ভিতরে নবগ্রাম খালের পাড়েই বাড়ি।
২।
বোনটা দেখতে শুনতে ভাল অন্তত কাঠুরিয়ার বোন বলে মনে হয় না। কি জানি, কোথায় বিয়ে হয় কে জানে! বোনটার যদি একটি বিয়ে দিতে পারে তাহলে অন্তত একজনের বোঝা কমে যায় কিন্তু চাইলেইতো আর বিয়ে দেয়া যায় না। তবে বাচ্চু মিয়ার ভাগ্য ভাল বলতেই হবে। যেদিন মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে আসছিল তখন বাসে গিলন্ডের ঘটক রমিজ মুন্সির সাথে দেখা।
কি খবর বাচ্চু মিয়া কেমন আছ?
ভাল আর কেমনে থাকি? এইতো মানিকগঞ্জ থিকা পরীক্ষা করাইয়া আসলাম, লিভারে গণ্ডগোল দেখা দিছে।
ও, তাইলেতো চিন্তার কথা, দেখ যতটা পার চিকিৎসা কর। আইচ্ছা ভাল কথা, তোমার একটা বইন আছে না?
হ ভাই আছেতো, ওরে নিয়েই যত চিন্তা, কি যে করি!
একটা ভাল পোলার খোজ আছে, দেখবা?
কনে?
এইতো, আমাগো গেরামেই। খুব ভাল পোলা, মা বাপ ভাই বইন কেও নাই ভাল জমিজমা আছে আবার রাস্তার মোড়ে একটা দোকানও আছে।
এই পোলা কি আমার মত গরীব মাইনসের বইন বিয়া করব? আমার কি দেওনের কিছু আছে? বাড়ির ভিটা আর ২/৩ পাকি জমি এ ছাড়া আর কিছুই নাই হে কথা তুমরা সব জান
না না কিচ্ছু লাগব না। হে খালি একটা ভাল মাইয়া চায়। ঘর সংসার সামাল দিতে পারব এই রকম একটা মাইয়া, তুমার বইনতো দেখতে শুনতে ভালই
কি জানি রমিজ ভাই, যদি তার পছন্দ হয় তাইলে তুমি দেহ
কাইল বাড়ি থাকবা?
হ থাকুম, আর কনে যামু? শরীলডা ভাল না কামে যাইতে পারতেছি না কয় দিন ধইরা
আইচ্ছা তাইলে কাইল আসরের পর আমি পোলারে নিয়া আসুম তুমি থাইকো
৩।
বাচ্চু মিয়ার বোন দেখতে শুনতে বেশ রূপবতী, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ, কোমর পর্যন্ত চুল, পটলের মত চোখ, ধারালো নাক আর কি চাই? তারপরে আবার কাজে কর্মেও তেমনি চোখা। গরীবের ঘর থেকে বের হলে জেল্লা আরও বাড়বে বই কমবে না। রূপ যৌবন ভরা এই মেয়ে দেখে মজে গিয়ে ফজর আলির মনে ধরে গেল আর সাথে সাথে মোল্লা ডেকে বিয়ে পড়িয়ে বৌ বাড়ি নিয়ে এলো। পণ যৌতুকতো দূরের কথা বাচ্চু মিয়ার অবস্থা দেখে চিকিৎসা করাবার জন্য তার হাতে হাজার দুই টাকা দিয়ে এলো।
আম্বিয়া শ্বশুর বাড়ি এসে দেখে তার বাড়িতে দুই একজন কাছের আত্মীয় ছাড়া আর কেও নেই। তারাই বাড়ি ঘর ফসলাদি দেখা শোনা করে, রান্না বান্না করে। বাড়িতে পা দিয়েই আম্বিয়াকে তার স্বামী সব বুঝিয়ে দিল। আম্বিয়াও সব বুঝে শুনে নিল। আত্মীয়রা যারা ছিল তারা একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। এতদিন ইচ্ছে মত চলাফেরা করেছে এখন আর সে উপায় থাকবে না। বাড়ির বৌ এসেছে তাহলে সেই গিন্নী হবে এটাই নিয়ম নিশ্চয়ই সে সব কিছু তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিবে! ফজর আলি এত দিন তার নিজের কেও ছিলনা বলে এদের আশ্রয় দিয়েছিল কিন্তু এখন নিজের বৌ এসেছে কাজেই সংসারের চাবি কাঠি তার কাছেই থাকবে এমন ব্যবস্থাই করে দিল। উঠতি সংসার। কয়েকদিনের মধ্যে আম্বিয়া সব কিছু মোটা মুটি দেখে শুনে বুঝে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। রান্না বান্না এখন সে নিজেই করে। স্বামী কি খায় কি খায়না জেনে নিয়েছে।
সকালে উঠে ফজর আলি ঘুরে জমি জমা দেখে এসে নাশতা খেয়ে দোকানে চলে যায়। দোকানের কর্মচারী কুদ্দুস সকালেই দোকান খুলে। ফজর আলি দুপুরে দোকান থেকে এসে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে দোকানে চলে যায় আবার রাতে বেচাকেনা করে হিসাব নিকাশ সেরে আসে। সকালে বা রাতে পুরনো রাখাল বেলালকে বুঝিয়ে দেয় কোথায় কি করতে হবে।
নানা রকম ফসলাদি কোনটা রোদে শুকিয়ে কোন ঘরে তুলতে হবে কোনটা বাজারে নিতে হবে এগুলিও এক সময় আম্বিয়ার হাতেই চলে আসে। ফসল বিক্রির টাকা পয়সাও আম্বিয়ার হাতেই আসে। এত দিন গরীব ভাইয়ের সংসারে থেকে নিজেকে চেপে রাখতে হয়েছিল। মনের কোন সাধ আহ্লাদ কিছুই করার সুযোগ পায়নি। আজ তার দু হাত ভরা, যা চায় তাই পায় দরকার হলে ফজর আলিকে দিয়ে মানিকগঞ্জ থেকে এনে নেয়। নিজের ইচ্ছে মত সংসার করার সুযোগ পায়নি। ভাইয়ের বৌয়ের অধীনে থাকতে হয়েছে। এখন সে স্বাধীন। আজীবন অভাবের মধ্যে থাকা আম্বিয়া বেগম হঠাৎ করে হাতে হিসেব ছাড়া টাকা পয়সা পেয়ে অনেক বদলে গেছে আগের মত নেই। স্বামীর জোরে আজ তার আঁচলের চাবি দিয়ে তালা দেয়া লোহার আলমারিতে টাকার বান্ডিল রেখে দিয়েছে তার হিসেব নেয়া বা দেয়ার মত কেও নেও, সেই সব, সবই তার। ফজর আলি এদিকে কোন নজর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
৪।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আম্বিয়া বেগম পান বানিয়ে স্বামীর হাতে এনে দেয়। ফজর আলি পান চিবায় আর স্ত্রীর সাথে দিনের ফিরিস্তি নিয়ে আলাপ পরামর্শ করে। পান চিবাতে চিবাতে ফজর আলি বলল
কাইল কিছু টাকা দিও, আমার একটু নবগ্রাম যাওয়া লাগব
টাকা নিয়া নবগ্রামে কি করবা?
ভাইজানরে কিছু টাকা দিয়া আসি
ও, আইচ্ছা যাইও, কত টাকা দিবা?
অন্তত হাজার খানিক দিও, না কি কও?
তুমার যা খুশি দিবা, আমি কি কমু?
এভাবে উদার বোন জামাই বাচ্চু মিয়ার দেখা শুনা থেকে শুরু করে তার সংসারের অনেক দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে তবে সে কোনদিন এ কথা বলতে পারবে না যে তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম তাকে এ কাজে অনুরোধ করেছে বা তাগিদ দিয়েছে। যা দেবার ফজর আলি নিজেই দিয়েছে। ইচ্ছা করলে আম্বিয়া বেগম আরও কিছু বেশিই দিতে পারত কিন্তু স্বামী নিজেই যা করছে তাতেই সে সন্তুষ্ট। বাচ্চু মিয়ার অসুখের চিকিৎসা, তার সংসার চলার ব্যবস্থা সবই বোন জামাই চালাচ্ছে। আম্বিয়া বেগম ভীষণ খুশি। মাস বছর যাবার সাথে সাথে সংসারের যাবতীয় কর্তৃত্ব আম্বিয়া বেগমের হাতে চলে এসেছে। ফজর আলির এত দিকে তাকাবার সময় নেই।
বাচ্চু মিয়া আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে আবার ওসমান সাহেবের বাড়ি থেকে মেয়েটাকেও ছাড়িয়ে এনে বিয়ে দিয়েছে। এখন তার ঘরে সচ্ছলতা না এলেও আগের মত অভাব নেই। বড় লোক বোন জামাইর কৃপায় তার দিন ফিরেছে। ছোট দুই ছেলেকে স্কুলে দিয়েছে।
৫।
মানুষ শুধু নিজের স্বার্থই চায়, নিজের সুবিধার জন্য অন্যের অসুবিধার কথা বিচার করতে রাজী নয়। এত দিন অভাবের মধ্যে থেকে বাচ্চু মিয়াও এর বাইরে যেতে পারেনি। বাচ্চু মিয়ার এত কষ্টের দিন কি ভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল আর সে জায়গায় নতুন করে সুখ পাখি এসে কেমন করে ডালে বসল সে হিসাব করার কি দরকার? এগুলি যে কোন যাদু মন্ত্র দিয়ে হয়নি সে কথা বোঝার মত ইচ্ছা বা মনোবৃত্তি বাচ্চু মিয়ার হাতে নেই। বাচ্চু মিয়া পরের ধন পেয়ে ফেলে আসা পিছনের হিসেব মিলিয়ে দেখার ইচ্ছা করে না। হঠাৎ করে জেগে ওঠা সচ্ছলতার স্রোতের বান কোথা থেকে আসল কি ভাবে আসল তার কিছু জানার দরকার নেই। শুধু আরও চাই আরও দাও। এটা নেই ওটা নেই, নেই নেই অনেক কিছুই নেই। নেই কথাটা কখনও শেষ হতে চায় না। এত নেই এত দিন কোথায় ছিল? কে জানে এই কাহিনী? কেও জানে না! শুধু জানে ফজর আলি! ফজর আলি তার সুন্দরী স্ত্রীর মোহে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হলে বাচ্চু মিয়ার দিকে তার খেয়াল রাখতেই হবে।
এত দিনে তার বাড়ি ঘরের চেহারাও কিছু বদলে গেছে। ফজর আলি যখন আম্বিয়া কে বিয়ে করে তখনকার মত গমের ডাটার চালা দেয়া বাঁশের বেড়ার ঘর আর নেই সেখানে এখন টিনের দোচালা ঘর উঠেছে। ফজর আলি যা দরকার মনে করেছে তা দিয়েছে। ভাই এর যখন যা প্রয়োজন হয়েছে আম্বিয়া বেগমও তার হাতে যা ছিল, তা দিতে কৃপণতা করেনি। করবেই বা কার জন্য? তার কি ছেলে মেয়ে কেও আছে?
এদিকে বাচ্চু মিয়ার মাথায় নতুন ফন্দি এসেছে। ইদানীং বোন এবং বোন জামাইকে ভাল করে খাতির আপ্যায়ন করতে শুরু করেছে। শীতের পিঠা, অঘ্রাণ মাসে হাসের মাংস দিয়ে ফজর আলির প্রিয় চাউলের রুটি, আম কাঁঠালের দিনে আম দুধের নিমন্ত্রণ, এমনি যখন যা আসে সম্বন্ধীর বাড়িতে ফজর আলির নেমন্তন্ন লেগেই থাকে। এ ভাবেই কয়েক বছর চলে গেল
ওদিকে দিন চলে যায় কিন্তু আম্বিয়ার গর্ভে কোন সন্তান সম্ভাবনার দেখা নেই। ফজর আলি কি আর কম চিকিৎসা করিয়েছে, নিজের এবং স্ত্রীর। কিন্তু কোন সুফল পায়নি। আশে পাশে নানা জনে নানা আলাপ করলেও বাচ্চু মিয়ার এতে কোন বিকার নেই, তার মনে হয় আম্বিয়ার বাচ্চা না হলেই ভাল!।
৬।
এর মধ্যে একদিন হঠাৎ করেই এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। দুপুরে খেতে আসার পথে দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তা পাড় হবার সময় এক ট্রাকের একটু ধাক্কায় ফজর আলি ছিটকে পড়ে গেল। আঘাত খুব মারাত্মক কিছু নয় মাথায় আঘাত লেগে বেশ ভোগাচ্ছে। এক্সরে, এবং নানা প্যাথলজি টেস্ট করে কোন অস্বাভাবিক কিছু ধরা পড়েনি তবে অবস্থার উন্নতি না দেখে ঢাকায় নিয়ে নিউরোলজিতে টেস্ট করে দেখা গেল স্মৃতি শক্তি কিছুটা ক্ষতি হয়েছে বলে কাওকে চিনতে পারছে না, ডাক্তার বলেছে ঠিক হয়ে যাবে আশা করা যায়। ওদিকে বাচ্চু মিয়া মনে মনে বুদ্ধি করে বোন জামাইকে দেখা শোনা আর সুচিকিৎসার জন্য নিজের বাড়িতে নিয়ে এলো। বাড়িতে থাকলে আম্বিয়া একা চতুর্দিক সামাল দিয়ে স্বামীর সেবা যত্ন করতে পারে না তাই বোন সহ বোন জামাইকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছে। দোকান থেকে কুদ্দুস এক দিন পর পর নবগ্রাম এসে দোকানের বিক্রির টাকা পয়সা দিয়ে যায়। এ টাকা আগে আম্বিয়ার হাতেই দিত এখন বাচ্চু মিয়াই নিয়ে নেয়। বোন জামাইর জন্য অনেক খরচ। কয়েকদিন পরে পরে ঢাকায় নেয়া, ডাক্তার দেখান, নানা রকম পরীক্ষা করা, ভাল পথ্য এগুলি জোগাড় করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। সবসময় কি বোনের কাছে হাত পাতা যায়?
বাচ্চু মিয়ার সেই কাঠুরিয়ার জীবন আর নেই। বোনের বিয়ের পরে ফজর আলি নিজেই তার দিন ঘুড়িয়ে দিয়েছিল কিন্তু তাতে বাচ্চু মিয়ার মন ভরেনি। ফল খেয়ে কি আর জীবন চলে? আস্ত গাছটা যে তার প্রয়োজন! অনেক দিন থেকেই গাছের দখলের চিন্তায় বিভোর ছিল কিন্তু তেমন সুযোগ আসছিল না। নবগ্রামের খাল পাড়ের বাড়ির বাংলা ঘরের বারান্দায় বসে হুঁকা টানে আর ভাবে কি করে কি করা যায়।
৭।
ফজর আলির অবস্থা উন্নতির দিকে না গিয়ে দিনে দিনে অবনতির দিকেই যাচ্ছে। এতদিন অন্তত কাওকে চিনতে না পরলেও নিজের কাজ নিজে করতে পারত। খাওয়া দাওয়া, সকাল সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরে থেকে বেড়িয়ে ঘুরে ফিরে আসা, ক্ষুধা লাগলে খাবার চাওয়া। কিন্তু ইদানীং তা পারছে না। এক ভাবে বিছানায় পড়ে থাকে। বাচ্চু মিয়া বোনের সাথে এই নিয়েই দিনরাত আলাপ করে কি করা যায়? নানা ভাবে ভেবে দেখে, আবার ঝাঁর ফুক তাবিজ কবজে ফজর আলির গলা ভরে গেছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। যেখান থেকে যেই যে প্রস্তাব নিয়ে আসে তাই করা হচ্ছে কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না।
মানুষের মনের পরিবর্তন হতে খুব বেশি কিছু প্রয়োজন হয় না ঢাক ঢোল পেটাতে হয় না। সামান্য একটু ছুতা ধরে নীরবেই হয়ে যায়। বাচ্চু মিয়া এবং তার বোন আম্বিয়া বেগমেরও তেমন বেশি কিছু প্রয়োজন হয়নি। এ জন্যে ফজর আলির দুর্ঘটনাটাই যথেষ্ট। বাচ্চু মিয়া বুঝিয়েছে। এর এখন বেচে থাকা আর না থাকায় কোন তফাত নেই। কি হবে বেচে থেকে? চেষ্টা চিকিৎসা কি কম হচ্ছে? বোন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এ কথার মানে বোঝার চেষ্টা করে কিন্তু কিছু বুঝে উঠতে পারে না। ভাই ঠিক কি বলতে চাইছে? একদিন শ্রাবণের এক মেঘলা দিনে আম্বিয়া বেগম যে ঘরে থাকে সে ঘরের বারান্দায় বসে ভাই বোনে কথা হচ্ছে।
এর বাইচা থাকার চাইতে না থাকাই ভাল, কি কস
হ ভাই তাইতো দেখতেছি
এক কাম করবি?
কি কাম ভাই?
এমনিও টিনের চালের নিচে বৃষ্টির শব্দে কিছু শোনা যাচ্ছিল না তবুও বাচ্চু মিয়া খুব সাবধানে এদিক ওদিক দেখে বোনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল
আমার মনে হয় এই যন্ত্রণার চাইতে এর মইরা যাওনই ভাল
তাই কইলেই কি আর হয় ভাই? যতদিন আয়ু আছে ততদিন ঠেকাইব কেরা?
শোন, আমি কই কি মানুষটারে এমনে কষ্ট দিয়া কি হইব, ক?
তাইলে কি করুম?
এক কাম করবি?
কি
এহনতো ঘুমাইতেছে, আশেপাশে কেও নাই, বালিশটা নিয়া মুখে চাইপা ধর, দেখবি সব যন্ত্রণা শেষ হইয়া যাইব!
কি কও ভাই, নিজের স্বামীরে এমনে মাইরা ফালামু?
আরে ধুর বোকা, এইডা কি মাইরা ফালান হইল? এইডা তারে যন্ত্রণা থেইকা মুকতির একটা পথ কইরা দেওয়া হইল, বুঝছস? আমি কেমনে কই তর স্বামীরে নিজে মাইরা ফালা!
আম্বিয়া বেগম ভাইয়ের প্রস্তাব শুনে ডুকরে কেঁদে উঠল।
তুমি কি কও ভাই!
আরে শোন আমি তর ভালর জন্যেই কইতেছি। তুই সব কিছুর মালিক, যত চিকিৎসা করবি তত খরচ হইবো। তুই খালি বালিশটা চাইপা ধরবি আর কিছু করা লাগব না।
নিথর আম্বিয়া বেগম অসহায়ের মত ভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল
বাচ্চু মিয়া ছাতা মাথায় তার নিজের ঘরে গিয়ে টিনের একটা বাক্স খুলে একটা সাদা স্ট্যাম্প নিয়ে এসে
নে উঠ, বলে বোনের হাত ধরে টেনে উঠিয়ে নিয়ে ঘরের ভিতরে ফজর আলির কাছে গেল। ফজর আলি গভীর ঘুমে অচেতন। বাচ্চু মিয়া একটা কলমের কালি ফজর আলির বাম হাতের আঙ্গুলে মাখিয়ে কাগজের এক পাশে চেপে একটা ছাপ নিয়ে নিল। নে এবার এই বালিশটা চাইপা ধর। সব তর নামে কইরা দিমু আর কোন চিন্তা নাই কিন্তু আম্বিয়া বেগমের হাত চলছিল না। ভাইয়ের এই প্রলোভন আম্বিয়াকে সায় দিতে পারছিল না। বাচ্চু মিয়া নিজেই বোনের বালিশটা নিয়ে ফজর আলির নাকে মুখে চেপে ধরল। অনেক দিনের অসুস্থ নির্জীব দুর্বল ফজর আলি কিছুক্ষণ ছট ফট করে নিস্তেজ হয়ে এক সময় থেমে গেল।
৮।
সময়ের প্রলেপ দিয়ে একদিন সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে আসল, আম্বিয়া বেগমের কান্নাকাটি থেমে গেল। মনের কোণে জমা মেঘগুলা আস্তে আস্তে দূর আকাশের অন্য প্রান্তে উড়ে গেছে। আস্তে আস্তে আকাশটা নীল হয়ে আসছে। একটু একটু করে সংসারের কাজ কর্ম রাখাল চাকরের দেখা শোনা করতে পারছে। দুই ভাই বোনে মিলে শোকের যে আস্তরণ তৈরি করেছিল তা মুছে ফেলেছে। বাচ্চু মিয়া তাইজুদ্দিন মুহুরির সাথে দেয়া নেয়ার বিনিময়ে ঘিওর সাব রেজিস্ট্রি অফিস থেকে বোনের পরিবর্তে সব কিছু নিজের নামে করে নিয়েছে।
বাচ্চু মিয়া নবগ্রামের খাল পাড়ের ছোট্ট বাড়ি ছেড়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে এখন বোনের বাড়িতে উঠে এসেছে। বোনের বাড়ি এখন তার নিজের বাড়ি। তার অবস্থা এখন রমরমা। এই জমি জমা যা আছে সবই তার। হ্যাঁ, যে বোনের বিনিময়ে এত কিছু তাকে কি আর ফেলে দেয়া যায়? এতটা নির্মম হতে পারে না। মা মরা বোনটাকে যে ছোট বেলা থেকেই কোলে করে বড় করেছে, তাকে আগলে রাখতেই হবে। ছেলে মেয়েরা স্কুল ছাড়িয়ে কলেজে যায়। এমন সুযোগ হাতে পাওয়া কঠিন ব্যাপার হলেও সে এই বোনের জন্যেই তা পেয়েছে। কাজেই বোনকে কোন অবস্থায়ই অনাদর হতে দিবে না। শলা পরামর্শ যা করার দুই ভাই বোনে মিলেই করে। বোনের যখন যা প্রয়োজন তা আগে থেকেই হাতের কাছে এনে দেয়। বোনের কোন দুঃখ সে রাখবে না। বোনের কোন অযত্ন হতে দিবে না।
৯।
এমনি করেই অনেক দিন চলে গেল। বাচ্চু মিয়ার বয়স হয়েছে শরীরটাও আর আগের মত নেই, ভাটার টানে পড়ে গেছে। ছেলে মেয়েরাও বড় হয়েছে বিয়ে শাদী করে তারা এখন ঘর সংসার করছে। ফুফুর প্রতি বাবার আদিখ্যেতা তাদের কোন দিন ভাল না লাগলেও বাবার সামনে কিছু বলার উপায় নেই। অনেকদিন ভুগে বাচ্চু মিয়া একদিন এই সব সম্পত্তির মায়া কাটিয়ে সব কিছু ফেলে রেখে চলে গেল। যাবার আগে ছেলেদের ডেকে বলেছিল তোরা ফুফুর অযত্ন করবি না। ছেলেরা বাবার যাত্রা পথে কিছু বলেনি কিন্তু তারা জানত বাবার মৃত্যুর পর কি করতে হবে।
এত দিন আম্বিয়া বেগম ভেবেছে যে ভাই তাকে আগলে রেখেছে সে ভাই চলে গেলে ভাইয়ের ছেলেরা তার দেখা শুনা করবে সে তাদেরকে জমি জমা যা আছে ভাগাভাগি করে দিয়ে যাবে। এক দিন আম্বিয়া বেগম ভাইয়ের বড় ছেলে হারুনকে ডেকে এগুলির একটা বন্দোবস্ত করার কথা আলাপ করল। সব শুনে ছেলে বাবার রেখে যাওয়া টিনের বাক্স খুলে দলিল পত্র বের করে দেখল সবই তার বাবার, ফুফুর কিছু নেই। আম্বিয়া বেগম অবাক হয়ে দূরের আকাশের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইল। তার কিছু বলার নেই। ছেলে বলল
ফুফু, যা হইছে অনেক হইছে তোমার জইন্যে আমরা গ্রামে মুখ দেখাইতে পারি না। সবাই কয় তোর ফুফু গলা টিপা তগো ফুফারে মাইরা ফালাইয়া তর বাপেরে সব সম্পত্তি দিছে। তাই তুমারে আর আমরা আমাগো সাথে রাখা পারতেছি না আবার তাই বইলা এক্কেবারে ফালাইয়াও দিবার পারুম না। তুমারে ওই উত্তরে বাঁশ ছোপের যে ভিটাডা আছে ওই জাগায় একটা ছাপরা উঠাইয়া দিমু ওই হানে থাকবা। তুমি এই বাড়ি ছাইড়া আমাগো একটু নিরিবিলি থাকবার দেও।
দেখতে দেখতে দূরের আকাশের কাল মেঘগুলা অনেক নিচে নেমে এসে আম্বিয়া বেগমকে ছেয়ে ফেলল। আম্বিয়া বেগম কাল মেঘের নিচে ঢাকা পড়ে গেল, সেখান থেকে তার আর বেরিয়ে আসার কোন উপায় নেই সামনে শুধু ধু ধু মরীচিকা।
আবার দেখা হবে যেদিন মরীচিকার আধার মুছে গিয়ে পূর্ণিমার চাঁদ হাসতে থাকবে।
আগে পড়তে হবে পরে মন্তব্য।
বি.দ্র.- এটি কোন মন্তব্য নয়। এটি না পড়ে মন্তব্য দেয়ার একটি প্রচেষ্টা মাত্র।
বুঝছি পড়তে সময় লাগবতো তাই! ঠিক আছে, সময় কইরা নিয়েন।
সম্পূর্ণ গল্পটি একটানে পড়লাম। বেশ ভাল লেগেছে।
ঘটনা বেশ দ্রুত বেগে এগিয়ে গেছে।
বেশ ভাল লেগেছে।
ধন্যবাদ ফকির ভাই।

লাইন ধরে ধরে পড়ছি আর মাউস স্ক্রল করে করে নিচে নামছি।
গল্পে এমনই বুঁদ হয়ে পড়েছিলাম যে, বাইরে শব্দনীড় এর প্রথম পাতায়, আমার নিজেরও একটি অণুলিখন পোস্ট প্রকাশিত হয়ে পড়ে আছে, এমনকি জিরো মন্তব্য নিয়ে চোখের জলও ফেলছে … সেই হতাশা মন থেকে, নেই তো হয়েইছে এমনকি এই গল্পটির লাইন চোখ ফসকালে পুনরায় সেই লাইনে ফিরে গিয়ে পুনরায় শুরু করেছি … ভুলেই যাচ্ছিলাম পৃথিবীর কোথাও কেউ আছে কিনা !! আমার ভাগ্য ভালো আজ আমার পাশে কেউ নেই। একা। একা থাকলে বোধকরি কনসেন্ট্রেশন অতি বাড়ানো যায়।
সার্থক একটি গল্প পড়লাম। বাস্তবতা এর চেয়ে কম নয়। ধন্যবাদ বন্ধু।
বুদ হয়ে পড়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। এই গল্পটা সুনামগঞ্জে যখন ছিলাম তখন একজনের কাছে তার পাশের বাড়ির এক পরিবারের গল্প শুনেছিলাম তার সাথে কিছু জল্পনা কল্পনা মিশিয়ে তুলে ধরেছি। এতে স্থান, কাল, পাত্র সবই কাল্পনিক।
খুব সুন্দর।
ধন্যবাদ জিল্লুর রহমান ভাই। আপনার মত গুনী লেখকের আমার ব্লগে মন্তব্য করা ভাগ্যের ব্যাপার। আবার ধন্যবাদ!
