নক্ষত্রের গোধূলি-১২

২৩।
সামনে আর মাত্র দুই দিন বাকী আছে। বিকেলে মামিকে নিয়ে মামা এলেন। মামা মামি দুজনেই বোঝালেন।
-মনে কর ও যাবার পর কোন অসুখে পরলে তখন কি হবে, অন্তত তুমি যদি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পার তাহলে কেমন হবে আর যদি কেও কাউকে দেখতে না পার তাহলে কেমন হবে? মন স্থির কর, ওখানে তোমাকে কাছে পেলে ওর শক্তি সাহস বেড়ে যাবে কয়েক গুন। ওর শরীর চেহারা কেমন হয়েছে দেখছ না? এরকম অবস্থায় তোমাকেই সব চেয়ে বেশি দরকার। তুমিই পার ওকে আগের সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে। কাজেই মন খারাপ না করে কে কি ভাবল তা চিন্তা না করে ওর সাথে যাওয়াই মঙ্গল। লোক লজ্জা নিন্দা যা আসে তা আমি দেখবো। এসব নিয়ে তুমি ভেবো না।

এই মামাই রাশেদ সাহেবের সুখ দুঃখের খবরাখবর রাখেন, বিপদ আপদে সাহায্য সহযোগিতা করেন, পরামর্শ দেন। তার কথা মনি ফেলতে পারলো না। মনে মনে প্রস্তুত হলো, মুখে কিছুটা হলেও শ্রাবণ আকাশের বৃষ্টির পর মেঘের ফাঁকে যেমন একটু খানি রোদের ঝিলিক দেখা যায় তেমনি একটু হাসি ফুটে বের হলো, বিশেষ করে মামার অনুরোধ বেশ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করলো। তবুও পদ্ম পাতার পানি যেমন টলমল করে তার মনের তেমন দোদুল্যমান ভাবটা কিছুটা হলেও রয়ে গেলো।

মামাতো ঠিকই বলেছেন। ওখানে যাবার পর যদি ওর কিছু হয়েই যায় তখন কি উপায় হবে? তার চেয়ে ওর সাথে এক বার যেয়ে আমার যাতায়াতের পথটা খুলে দেয়াই ভাল। রাতের খাবার খেয়ে মেহমানরা সবাই চলে গেলে মনি রাশেদকে নিয়ে ছাদে গিয়ে বসল আলাপ করার জন্য। রাশেদ মনির এই পরিবর্তন দেখে মহা খুশি। মনের আনন্দে মনির হাত ধরে গেয়ে উঠলো-
‘তরে লইয়া যাইমু আমি লন্ডনে, ভিসা করছি টিকেট করছি উইরা যাইমু পেলেনে’।
শুনে মনিরা হেসে উঠলো।
সে হাসিতে যে একটু অবাক মাখানো চমক ছিলো তা এক মাত্র রাশেদ সাহেবই টের পেলেন। আজ কতদিন পর যেন মনির হারিয়ে যাওয়া সেই ছোট বেলার হাসিটা দেখতে পেলেন। দুজন দুজনকে ছুঁয়ে হাস্না হেনার টবের পাশে বেঞ্চে বসে রইলেন। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। উভয়েই উভয়ের উষ্ণ স্পর্শে কত দিন পর যেন সেই ঝর্ণা ধারায় স্নান করছিলেন। সে রাত আর রাত রইলো না হয়ে গেলো মধু যামিনী।
কতক্ষণ এভাবে বসে ছিলো সেদিকে কোন খেয়াল ছিলো না। হঠাৎ করেই একটু একটু বৃষ্টি নামছে দেখে মনি উঠে রাশেদের হাত ধরে নিয়ে নিচে নেমে শুয়ে পড়লো। মধু মাখা এই রাতটা যে কোথা দিয়ে কেটে গেলো দুজনের কেওই টের পায় নি। ভোর হতে পাশের মসজিদ থেকে আজান ভেসে এলো। চলো মনি গোসল করে আসি, ভীষণ ক্ষুধা লেগেছে। চলো। গোসল করে এসে নামাজ পরে মনি চলে গেলো রান্না ঘরে।
নাশতা খাবার পর রাতের এই ক্ষণিকের মধু মাখা বসন্তের আমেজ বেশিক্ষণ রইলো না। পৃথিবীর সব অনর্থের মূল এই অর্থ। অভাবের গ্লানি আর দুশ্চিন্তার ছায়া যার চারিদিকে তার কীইবা করার আছে। মধু বসন্ত সারা জীবনের জন্য আসেনি, এসেছিলো ক্ষণিকের জন্য। চোখের পলকেই যেন আবার কোথায় হারিয়ে গেলো, মিলিয়ে গেলো দূর দূরান্তের স্বপ্নে দেখা গভীর প্রশান্তির অতলে। সেখানে জায়গা করে নিল ঘন কুয়াশা ঢাকা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কি হবে কি হবে না তাই ভেবে রান্না ঘরের জানালা দিয়ে নারকেল গাছের মাথায় যে সিনেমা দেখেছিলো সেই কথা মনে এসে ভিড় করলো আবার।

২৪।
লন্ডন যাবার প্রস্তুতি শেষ। নেহায়েত যা একান্ত দরকার তাই কেনা কাটা করা বা পাসপোর্টে পাউন্ড এন্ডোর্স করা সবই করে ফেলেছে যাবার আগে যাতে কোথাও বের হতে না হয়। আজ মেয়েরা কেও স্কুল কলেজে যায়নি। মেয়েরা সবাই উঠে নাশতা সেরে বাবা মাকে নিয়ে বসল। এ গল্প সে গল্প, আশা আকাঙ্ক্ষা কত কি এলো মেলো কথা হলো। আড্ডা জমে উঠে এতো দিনের গুমোট বাঁধা ভাবটা কেটে গিয়ে যেন বাড়িটা আবার প্রাণ চঞ্চলে ভরে উঠলো। বাড়িটা হাসি খুশিতে ভরে গেলো। মেয়েরা সবাই বায়না ধরল মা আজ খিচুড়ি রান্না কর, বাবা পছন্দ করে সবাই মিলে এক সাথে খাব। বড় মেয়ে বললো না মা তুমি থাক আজ আমি রান্না করি।
দুপুরে ডিম ভাজি দিয়ে খিচুড়ি খেতে বসে মেঝ মেয়ে বললো মাংস হলে ভাল হতো। ছোট মেয়ে বলে উঠলো যা হয়েছে তাই যথেষ্ট হয়েছে। শুনে মেঝ মেয়ে আবার বললো হ্যাঁ তাই, ভাগ্যে থাকলে আবার হবে ইনশাল্লাহ। মেয়েদের এই সব বিচক্ষণতা দেখে রাশেদ সাহেব মনির মুখের দিকে তাকালেন। মেয়ে গুলি হয়েছে একেবারে মায়ের মত। কোন বায়না নেই, কোন চাহিদা নেই, কোন চাওয়া নেই, কোন দাবী নেই। যা পাচ্ছে তাতেই খুশী। না পেলেও কোন আফসোস নেই। খাবার পর মেয়েদের নিয়ে আবার বসলেন। ওরা যাবার পর মেয়েরা কি ভাবে চলবে সে ব্যবস্থা মোটামুটি করে রেখেছিলেন।
বড় মেয়ের হাতে সব বুঝিয়ে দিয়ে বলে দিল এর পরেও যদি কিছু প্রয়োজন হয় তাহলে মামা অর্থাৎ তোমাদের দাদাকে ফোন করে জানাবে। আমি মামাকে বলেছি, উনি দেখবেন। ছোট মেয়ে জানতে চাইল
-আব্বু তোমরা এয়ারপোর্টে যাবে কি ভাবে?
-আমি তো ভেবে রেখেছি আমি আর তোমার মা একটা স্কুটার নিয়ে চলে যাব। তুমি কি কিছু বলতে চাও?
মনিরা বললো, -তা কি করে হয়?
-তাহলে কি করতে চাও?
মনি একটু দ্বিধার সাথে বললো-
-ওদের বাবা মা দুজনেই চলে যাচ্ছে ওরা যদি একটু এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে বিদায় দিয়ে আসতে পারে তাহলে মনে হয় ওদের ভাল লাগবে।
-কিন্তু সে রকম গাড়ি ভাড়া করার মত টাকা কোথায়? আগে বললে হয়ত কিছু খরচ কমিয়ে ব্যবস্থা করতে পারতাম।
-আচ্ছা সে আমি ব্যবস্থা করছি তুমি ভেবো না।
-দেখ যদি পার কর। আমারও তো মনে হয় যাবার আগে সবার মুখে একটু হাসি দেখে যেতে পারলে ভালো লাগতো। দেখ যদি পার কর সবার হাসি মুখ দেখে যাই। আবার কবে ফিরে আসি না আসি তা কি বলা যায়?

রাশেদ সাহেব কোন বাঁধা দিলেন না। মনিরা তার হাতের শেষ সম্বল ভেঙ্গে সেঝ দেবরকে দিয়ে এয়ারপোর্টে যাবার জন্য একটা মাইক্রো ভাড়া করার ব্যাবস্থা করল। যাবার সন্ধ্যায় সব কিছু রেডি। গাড়ি এসে অপেক্ষা করছে। মনির মা, বড় বোন, ছোট বোন এসেছে। তারাও এয়ারপোর্টে যাবে। রাশেদ সাহেবের সেঝ ভাই ছোট ভাই আর মেয়েরা সবাই যাবে। মালামাল গাড়িতে তোলা হয়েছে। বাড়ি থেকে বের হবার আগে বাবাকে সালাম করে বিদায় নিতে এলেন।
-আব্বা এর আগেও আমি অনেক বার এরকম যাত্রা করেছি কিন্তু সে সব যাত্রা আর আজকের এই যাত্রার মধ্যে অনেক পার্থক্য। জানি না এটাই আমার শেষ যাত্রা কিনা। ভুল ভ্রান্তি অনেক করেছি, অনেক বেয়াদবিও হয়ে গেছে মাফ করার যোগ্য মনে হলে মাফ করে দিবেন। আমি তো বাড়ি ছাড়া, দেশ ছাড়া হলাম আমার মেয়েরা রইলো।
মনে মনে ভাবলেন বাবা আপনাকে আবার দেখতে পাব কিনা জানি না। এই বলেই ভেজা চোখে বেড় হয়ে গাড়িতে উঠলেন। এয়ারপোর্টে পৌঁছে সবার কাছ থেকে একে একে বিদায় নিলেন। শাশুড়ি, বড় আপা, ছোট শ্যালিকা। শ্যালিকার গাল টেনে একটু রসিকতা করলেন, ছোট ভাই, সেঝ ভাই, সবার শেষে মেয়েদের কাছে। মনি মেয়েদের বোঝাচ্ছে কাঁদে না মা আমি তো কয়েক দিন পরেই আসছি। মেয়েদের একে একে সবাইকে বুকে নিয়ে মন শক্ত করার কথা বলে মনিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন।
এয়ারলাইন্সের চেক ইন কাউন্টারে এসেই কায়সার বেয়াইর সাথে দেখা।
-আরে বেয়াই আপনি এখানে?
-লন্ডন যাচ্ছি। আপনারা?
-আমরাও তো ওখানেই যাচ্ছি।
-যাক ভালোই হলো
[চলবে]

8 thoughts on “নক্ষত্রের গোধূলি-১২

  1. পড়ে নিলাম আজকের অংশটুকু প্রিয় বন্ধু মোঃ খালিদ উমর। শুভ সন্ধ্যা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif.gif

  2. নিজের পোস্ট ছাড়া আপনাকে তো অন্যের পোস্টে মন্তব্য দিতে দেখি না ভাই। :(

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।