৩৭।
বাসার সামনে এসে কলিং বেল বাজাতেই যে মহিলা দরজা খুলে দিলেন সে ওদের দেখেই বললো-
-ও! আপনারা এসেছেন, আসুন ভিতরে আসুন।
বলেই মনিরার দিকে তাকিয়ে যেন চমকে গেলো এমন একটা ভাব মনে হলো রাশেদ সাহেবের কাছে। বসার ঘরে নিয়ে বসতে বলেই মনিরার দিকে আবার সেই কেমন একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ।
-আচ্ছা আপনি কি মনিরা আপা?
-হ্যাঁ, আমার নাম মনিরা কিন্তু আপনি আমাকে চিনলেন কি ভাবে?
-চিনবো না কেন, আপনারা যেবার স্কুল থেকে বিদায় নিলেন আমি তখন ভর্তি হলাম। যদি না জানতাম যে ভাই মানিকগঞ্জের তাহলে হয়তো একটু সময় লাগতো। কত দিন, মনে হয় পঁচিশ বৎসর তাই না আপা?
-হ্যাঁ তা হবে কিন্তু আপনার নামটা আমার মনে পরছে না।
-আমাকে আপনি করে বলছেন কেন, আমার নাম রুবি।
-ও হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পরেছে।
-আপনাদের ফেয়ার ওয়েলের দিন আপনি যে গান গাইলেন সেই সুর এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। কত খুঁজেছি সেই গান কোথাও পাইনি।
মনি এবার একটু হেসে বললো-
-পাবে কি করে সে গানের কি রেকর্ড আছে যে তুমি পাবে!
এবার রাশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো-
-কই ভাই আপনি তো আপার কথা কিছু বলেননি!
-কি করে বলি, আমি কি জানি যে ভাবী এখন আপা হয়ে যাবে?
কথার ফাঁকে কখন কায়সার বেয়াই পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেও লক্ষ করেনি। -আলাপের ধরন দেখে মনে হচ্ছে ভাবী এখন তার আপাকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেছেন।
-সে কি ভাই, তাই কি হয়? আসলে আপা স্কুল ছেড়ে যাবার পর আর দেখিনি। শুনেছি কে যেন ছোঁ দিয়ে নিয়ে গেছে। আজ দেখলাম কে নিয়েছে। আজ আপনাকে দেখার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভাবতে পারিনি যে আবার দেখা হবে।
মনিরা বললো -হ্যাঁ মেয়েদের জীবন এমনই।
-আপার ছেলে মেয়ে?
-আমার তিন মেয়ে, বড়টা এমকম ফাইনাল দিবে আর ছোটটা স্কুল ফাইনাল দিবে।
-ওদের কেও আসেনি?
-না রুবি, আসলে আমরা বেড়াতেও আসিনি আর তোমার দুলাভাই এই বুড়ো বয়সে হানিমুন করার জন্যেও আনেনি। আমরা এসেছি একটা প্রয়োজনে।
এ পর্যন্ত বলে মনিরা আসল কথাটা এড়িয়ে থেমে গেলো। রুবির স্বামী বাচ্চাদের আনতে স্কুলে গিয়েছিলো, ওরা এলে রুবি একটু উত্তেজিত হয়েই বললো দেখ কে এসেছে! মনিরা আপা। বলে পরিচয় দিয়ে দিল।
-আপা কি এখনও গান করেন?
-একটু করতে হয়, চোখ দিয়ে রাশেদকে দেখিয়ে বললো ওর এই একটা নেশা তাই এখনও ছাড়তে পারিনি।
-মেয়েরা কেও শিখেছে?
-হ্যাঁ বড়টা ছায়ানট থেকে পাশ করেছে। মেঝ টা শুরু করেছিলো, মাঝে মাঝে দুই একটা ফাংশনে যেত। তার আবার কথা বাবার গান ছাড়া সে গাইবে না। গলাও ছিলো বেশ কিন্তু হঠাৎ করেই গান ছেড়ে দিল। ওর মনে কি এলো কে জানে।
-মানে? দুলাভাই কি লেখেন নাকি?
-না, লিখি তা ঠিক বলা যায় না, তবে সময় কাটাই।
-বাহ! বেশ মজার তো। তা আপনি দুলা ভাইর গান গান না?
-হ্যাঁ রে ভাই, ওর জন্যই তো এখনও টিকিয়ে রেখেছি। নইলে সংসারের ঘানিতে কোথায় চলে যেত। ওর কথাই হলো তোমার জন্য আমি গান লিখে দিব আর তুমি তা গেয়ে আমাকে শোনাবে।
রুবির স্বামী হঠাৎ বায়না ধরলো আপা একটা গান শোনান। শুধু বায়না করেই ক্ষান্ত না ভদ্রলোক রীতিমত নাছোড় বান্দা। না আপা গাইতেই হবে, এদেশে এসে এখনও কারো সামনে বসে গান শুনতে পারিনি। মনিরার মন কি আর এখন গানের জন্য তৈরি আছে? মন বিক্ষুব্ধ, অশান্ত, শঙ্কিত। মনিরা অসহায় ভাবে রাশেদ সাহেবের দিকে তাকাল, যেন কোন অসাধ্য সাধন করার জন্য জুলুম করা হচ্ছে। রাশেদ সাহেব বুঝতে পারল। সেই বা কি করে, সেও অসহায় ভাবে মনির দিকে তাকিয়েই রইলো। কাদেরের পিড়া পিরিতে শেষ পর্যন্ত একটু সাজানো হাসি ফুটিয়ে বললো আচ্ছা তাহলে শুনেন। শুরু করলো:
লিখতে বলেছিলে গান
হয়নি লিখা আজো তাই, আকাশ ছেয়ে গেছে মেঘে,
বসন্ত আসেনি, বহেনি বাতাস
ওঠেনি এখনও বসে আছি নিশি জেগে।।
ফিরায়ে দিয়েছিলে তুমি
হয়নি দেখা সেই দিন
সেই থেকে আজো ভরে আছে মোর বীণ
হৃদয়ে আজো তুমি তো আছ জেগে।।
বাতাস ছিলো মৌসুমি
মনে পরে সেই দিন
এসেছিলে তুমি ফাগুন নিয়ে, এসেছিলে সেই দিন
স্বপনে যেন সেই ছোঁয়া আছে লেগে।।
গানের সুর শুনে রুবির ছেলে মেয়েরাও এসে মা বাবার পাশে বসে পড়ল। রাশেদ সাহেব লক্ষ করলেন আজকের এই কণ্ঠ আর মনির আসল কণ্ঠের মধ্যে কত তফাত। থামার পর তিন জোড়া হাতে তালি বেজে উঠলো। বাচ্চারাও কিছু বুঝে কিছু না বুঝে বড়দের সাথে হাত তালি দিতেই থাকল।
কাদের বলেই ফেলল আপা এ গান তো আগে শুনিনি কখনো।
রুবি বললো -আমি যে গানের কথা তোমাকে বলি এটা সেই গান, যে গান আপার কণ্ঠে আমি আজ থেকে পঁচিশ বৎসর আগে শুনেছিলাম, তাই না আপা?
-আপা প্লিজ আর একটা। না ভাই আর পারবো না, সে শক্তি এখন নেই, আর বলবেন না।
-এটা কি দুলাভাইর লেখা?
-হ্যাঁ।
-সত্যিই আপা আপনি অসাধারণ।
-না ভাই এভাবে বলবেন না।
-আপা চলেন রান্না ঘরে যাই। কি খাবেন বলেন, রান্না করি এখানে ইফতার করে খেয়েদেয়ে যাবেন।
-না রুবি কিছু করবে না, ওখানে ভাবী রান্না করছে।
রুবির স্বামী বললো -তাই কি হয় নাকি? কোনদিন আসেন নি, আর এখানে আমরা নিজেদের মানুষ পাই কোথায় বলেন, যে ভাবেই হোক আপনারা এসেছেন না খেয়ে যাবেন তাই কি হয়?
-রোজা না হলে হয়ত কিছু খেয়েই যেতাম।
-না না তা হবে না।
-না ভাই পরে সময় হলে আর একদিন আসবো আজ না, আজ আমাদের গ্লস্টার যেতে হবে।
-গ্লস্টার কেন?
কায়সার বেয়াই বললো, -ওখানে উনার ভাই থাকে।
-তো খেয়ে যান এ দেশে ঘড়ে সব কিছুই রাখতে হয়, সব সময় বাজার করা যায় না। রান্না করুক এক সাথে বসে খাওয়া, এইতো!
-না ভাই আজ কিছুতেই সম্ভব না।
দুপুর একটা নাগাদ ওরা উঠলো। কায়সার বেয়াই সহ কাদের ওদেরকে গাড়িতে করে টিউব স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে আবার আসার অনুরোধ জানিয়ে চলে গেলো। যাবার আগে বেয়াইর সাথে আবার কবে কখন কোথায় দেখা হবে সে ব্যাপারটাও ঠিক করে নিল।
* শুভ কামনা সুপ্রিয়….
মুরুব্বীর জন্য মনটা খারাপ ছিলো। পড়লাম খালিদ ভাই।