ডাক্তার সাহেব

ডাঃ সঞ্জুমোহন দেব। উনি হাসলে আমার মনে হতো উনার ঠোঁটের উপরিভাগের গোঁফ গুলাও হাসছে। ডিপ ব্ল্যাক কালারের গোঁফগুলো চিকচিক করে হাসছে। হাসি আর গোঁফের নতুনত্বে উনার চল্লিশোর্ধ্ব বয়সটা কোথায় জানি লুকিয়ে যেতো।
.
উনার ঘনকালো গোঁফের গোপনীয়তা থাকলেও মুখের হাসিতে কোনো গোপনীয়তা ছিলো নাহ। একেবারে’ই সাদামাঠা হাসি। কথাবার্তাও ঠাণ্ডা প্রকৃতির। অন্যসব ডাক্তারদের মতো ততটা উগ্রমেজাজী নাহ। ব্যবহারেও কোনো প্রকার অহমিকা দেখিনি। আমি ইনসোমনিয়ায় ভুগতাম। উনার থেকে চিকিৎসা নেয়ার পর ঠিকঠাক ঘুম হতো। আমার জন্য ভিজিট ফি একেবারেই ফ্রি ছিলো।
.
দুই..
সেদিন উনার চেম্বার থেকে বিদায় নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে আবার দম ফেলি। পেছনে তাকিয়ে দেখি সঞ্জুদা আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। আগুপিছু না ভেবেই হুট করে বলে ফেললাম ‘দাদা আজ যদি ফি দিই আপনি কি রাগ করবেন’?
‘অবশ্যই করবো’ উনি সিরিয়াসলি বললেন।
.
আমি আর হাঁটতে হাঁটতে উনার চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আসার সময় আরেকবার পেছনে তাকালাম। নেক্সট সিরিয়ালের রুগী চেম্বারে ঢুকছে। এবার আর উনাকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু ঐ স্লিপিং পিলটা কাজ দিচ্ছিলো না।
.
আগের চেয়ে ইদানীং আরো বেশী রাত জাগি। রাত কাটে উচাটন করে। ভোররাতের দিকে ঘুমালে সকাল দশটার আগেই ঘুম ছেড়ে যায়। ১২ টা ১ টা পর্যন্ত আধঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় শুয়ে থাকি।
.
তিন..
১৬ অগাস্ট ভোর নয়টার দিকে ঘুম ভেঙ্গে গেলে ঐ দিন ভোর দশটা পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে হাসফাস করেও আধঘুমন্ত অবস্থাটা আমার মধ্যে আসলোনা। জেগে জেগে বিছানায় শুয়ে থাকতেও কেমন অস্বস্তি লাগে। উঠোনে রাখা তেপায়া টুলে বসে চোখ ডলতে ডলতে ভাবছিলাম বিকেলে একবার সঞ্জুদার চেম্বারে যাবো।
.
তখন আব্বার গলার আওয়াজ শোনে ভাবনায় ছেদ পড়লো। ‘আজ দেখছি খুব সকাল সকাল। তা কোথাও বের হবে নাকি’ ?
‘নাহ’ আমি উঠে দাঁড়ালাম।
‘নাস্তা করবে চলো’ আব্বা ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন। ‘ডাক্তার সাহেব ৮টার দিকে পরলোকগমন করেছে।’
.
‘ডাক্তাররাও পরলোকগমন করে ?’ চোখেমুখে পানি দিতে দিতে মাথার ভেতর প্রশ্নটা খেলে গেলো ।
‘ডাক্তার সঞ্জুমোহন’ আব্বা স্থির গলায় বললেন। ‘ওটা তোমার ডাক্তার’
আব্বার সব কথা’ই আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু ঐদিনের কথাটা বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝামাঝি পড়ে গেলে আমি আবারো জিজ্ঞাসু গলায় বলি ‘কে? কি নাম?’
.
চার….
নির্ভুল, স্পষ্ট, অসংকোচনীয় ভাবে আব্বা আবারো বললেন ‘ডাক্তার সঞ্জু মোহন’। আয়নার দিকে তাকাতেই সব কিছু ঘোলাটে দেখাচ্ছিল। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে ‘আমি বের হবো’ বলে চলে আসলাম।
.
ডাক্তারেদের থাকতে হয় বিরাট অবদান। তাদের ধর্ম মানে ধনী গরীব সবাইকে সেবাদান। অধিকন্তু ডাক্তার সেবাদানে করে ব্যবধান।
.
সঞ্জুদা নয় নং ইউনিয়নে সরকারী ক্লিনিকের চিকিৎসক ছিলেন। ক্লিনিকের ডিউটি শেষে বিকেলে চেম্বারে বসতেন। প্রাইভেট চিকিৎসা নিলে ফি বাবত বড়জোর পঞ্চাশ টাকা দিলে হতো। অতি অল্পটাকার ডাক্তার তাইনা ? কিন্তু পুরো ইউনিয়নের সাধারণ অসাধারণ মানুষ এক নামে তাকে চিনতো। তার চিকিৎসায় সবাই ফল পেতো।
.
পাঁচ.
সঞ্জুদার বাড়িতে সমুদ্র গভীর মানুষের ভীর। ঘরটা উঁচু ভিটেতে থাকায় বাহিরে থেকে ঘরের বারান্দাটা আগে চোখে পড়ে। একজন ত্রিশ কি পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী মহিলা বেহুঁশ অবস্থায় পড়ে আছে। কয়েকজন মিলে পাষাণের মতো নৈঃশব্দে তার সিঁথির সিধুর মুছে দিচ্ছে। দুই হাতের শাখা খুললো।
.
উঠোনের এককোণে লোকে লোকারণ্য। ডেড বডিটা ঐ কোণটাতে রাখা। সবাই জটলা বেঁধে দেখছিলো। বাড়ির প্রাপ্তবয়স্করা গুনগুন করে কি জানি পড়ছে। এদের চোখে বিলকুল জল নেই। আছে শুধো হাহাকার। এরা ডাক্তার সাহেবের উপর বিরক্ত নাকি অনুরক্ত? দেখে বুঝার উপায় নাই।
.
ছেলেপুলেরাও পাহাড়ের ন্যায় শক্ত হয়ে বসেছে। ওদের চোখের কিনারায় জলপ্রপাত সশব্দে ঝরছে।’এরা পাহাড় হলে দৃশ্যটাকে বলতে হতো ঝর্ণা। মানুষ বলেই দৃশ্যের নাম দেয়া হয়েছে কান্না”।
.
ছয়….
সঞ্জুদার ডেডবডির পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হলো একবার বলি। ‘দাদা কি ঔষধ দিলেন ? কাজ হয়না। ইনসোমনিয়া তো বেড়েছে বললাম না কারণ সঞ্জুদা তখন ঘুমাচ্ছেন। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন উনি ঘুমের মধ্য’ই হাসলেন।
.
আমার মনে হলো উনার ঠোঁটের উপরিভাগে থাকা গোঁফ গুলো হাসছে। ডিপ ব্ল্যাক কালারের গোঁফ চিকচিক করে হাসছে। হাসি আর গোঁফের নতুনত্বে উনার চল্লিশার্ধ্ব বয়সটা কোথায় জানি লুকিয়ে যাচ্ছে।
.
মো: সাব্বির আহমদ।

14 thoughts on “ডাক্তার সাহেব

  1. আপনার আগের লেখাটি অফলাইনে পড়েছি। আমার কাছে আপনার লেখা বাস্তব জীবনের খুব কাছাকাছি মনে হয়। সার্থক হোন আপনি ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

  2. রম্য গাঁথায় আপনার লেখাটি বেশ উপভোগ্য হয়েছে সাব্বির আহমদ দা। 

    আশা করবো নিয়মিত লিখবেন। আমার শুভেচ্ছা জানবেন।

  3.  বেশ ভালো লাগলো বাস্তবতার বিবরণ!

    শুভেচ্ছা জানবেন প্রিয় সাব্বির ভাই https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  4. নস্টালজিক হলেও এমন লিখা মনকে আনমনা করে তোলে। ধন্যবাদ আপনাকে।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।