ছোটগল্পঃ ঈশ্বরচন্দ্র

-তোমার দেয়া শিশিরগুলি আমি জমিয়ে রেখেছি
-কেন? দীপাবলি জানতে চাইলো।
-একটা নদি বানাবো।

পার্কে ঘাসের ডগায় শিশির পেলেই দীপাবলি সেগুলোর ছবি তুলে প্রাঙ্গণের ইনবক্সে পাঠিয়ে দেয়। এই শিশির দিয়ে নদি বানানোর কথাই প্রাঙ্গণ তখন দীপাবলিকে বলছিল। ওরা ইনবক্সে চ্যাট করছে। প্রাঙ্গণের শেষ কথাটার জন্য কোন মন্তব্য না করে দীপাবলি আবার জগিং শুরু করে। তার মাঝারি সাইজের চুল। দৌড়ানোর সময় ঝুঁটিটা যেন খুব আনন্দ নিয়ে নাচে।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে প্রাঙ্গণ আবার লিখে;
-তোমার নদি পছন্দ না?

মেসেজের শব্দ শুনে দীপাবলি ধারে কাছের একটা বসার জায়গার দিকে যায়।
-হ্যাঁ, খুব পছন্দ;
পার্কের ব্যাঞ্চে বসে দীপাবলি জবাব দেয়।

-ওটার নাম হবে মনছুঁই নদ। তোমার নামে দলিল করে দেবো।
-নদ কেন? দীপাবলি জানতে চায়।
-কারণ, কোন শাখা থাকবেনা। যা কিছু আমি তোমাকে দেই তার কোনটারই শাখা হয়না।

প্রাঙ্গণ; পুরো নাম ঈষান চন্দ্র প্রাঙ্গণ। তার জন্য দীপাবলির মন কানায় কানায় প্রেমে পূর্ণ। কিন্তু ট্রাউজার পরে পার্কে জগিং এবং মাঝারি সাইজের একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালানোর সাহস ও স্মার্টনেসের অভাব তার মধ্যে না থাকলেও প্রেমের জন্য আছে। তাই প্রাঙ্গণকে সে একবারও ভালোবাসার কথা বলতে পারেনাই।

সব বিধবারই কী এসব বিষয়ে সাহসের অভাব হয়? দীপাবলি ভাবে; কিন্তু উত্তর খুঁজে পায়না। সে জানে, একজন মানুষ তার জীবনের কোন সময়েই স্বাধীন নয়। বিশেষ বিশেষ অবস্থায় মানুষের স্বাধীনতাহীনতা খুব তীব্র হয়। দীপাবলি এখন সেই বিশেষ অবস্থাটার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে।

গত তিনদিন প্রাঙ্গণ খুব অল্প সময় অনলাইনে এসেছে। ওর জ্বর; ছুটিতে আছে। দীপাবলির হঠাৎ ইচ্ছে হলো, আজ সারাদিন প্রাঙ্গণের সাথে চ্যাট করবে। অফিসকে জানিয়েও দিল, আজ সে যাবেনা। এরপর পার্কের ব্যাঞ্চ থেকে দীপাবলি ওঠে দাঁড়ালো। আজ আর জগিং করবেনা। সে বাড়ির পথে হাঁটছে আর চ্যাট করছে।

-একটু দাঁড়াও। ফান করে প্রাঙ্গণ লিখলো
-কেন? দীপাবলি জানতে চাইলো
-তোমার গায়ে একটা প্রজাপতি বসেছে
-ওটা পাঙ্গু চন্দ! দীপাবলি হাসির ইমো দিয়ে জবাব লিখলো

এরপর কিছুক্ষণ কেউ কোন কথা বললোনা।

দীপাবলির এই বয়সে নিয়মিত জগিং করাকে প্রাঙ্গণ খুব এপ্রিসিয়েট করে। যদিও সে নিজে কোনদিন করেনা।

-কোন কোন পুরুষ চায় তার প্রিয়তমা মোটা সোটা হোক। প্রাঙ্গণ মন্তব্য করলো
-আমি সুস্থ থাকার জন্য এক্সারসাইজ করি। হাওএভার, কেউ কেউ ফ্যাটি লেডি পছন্দ করে বললে। কেন করে?
-ওপার বাংলার একটা ভিডিও দেখেছিলাম। সেখানে এক ফ্যাটি মহিলা বলছে, “আমার বয়ফ্রেন্ড আমার এই অবস্থাকে সমর্থন দিয়ে বলে, কোয়ালিটির চেয়ে কোয়ানটিটি বেশি জরুরি। কোয়ালিটি হলো মায়া”।
-তুমি কেমন লেডি পছন্দ কর?

দীপাবলির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে প্রাঙ্গণ প্রসঙ্গ পাল্টালো।

-তাকিয়ে দেখ, তোমার সম্মুখে একদল স্বপ্ন
-আমার সম্মুখে এখন এক বৃদ্ধা। দীপাবলি জবাবে লিখলো
-আমি উনার দুচোখে স্বপ্ন ভরে দিতে চাই
-বৃদ্ধাটা অন্ধ; দীপাবলি জানালো
-ও…
-উনার সাথে একটা পোষা বিড়াল আছে
-নাম দুখি? প্রাঙ্গণ ফান করলো
-তা জানিনা। তবে বিড়ালটাও অন্ধ।

কথাটা বলেই দীপাবলির মন ভার হলো। কেন জানি অন্ধ বৃদ্ধার সাথে তার নিজের একটা মিল খুঁজে পেলো।

দীপাবলি পার্ক থেকে বাসায় ফিরলো। নিতিকা ক্লাসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। একমাত্র মেয়ে নিতিকা; আর কোন সন্তান নাই। মেডিক্যাল কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। মায়ের অস্বাভাবিক পরিবর্তন নিয়ে নিতিকা যে ইদানিং ভাবে সেটা দীপাবলি বুঝতে পারে। প্রাঙ্গণের সাথে বয়সের পার্থক্য, ঘরে সোমত্ত মেয়ে- এসব প্রথম সাক্ষাতের দিনই তীব্রভাবে অনুভব করে প্রাঙ্গণকে অনলাইন চ্যাট করার বিষয়ে তার আপত্তির কথা জানিয়েছিল।

কিন্তু এখন এই পর্যায়ে প্রাঙ্গণকে ছাড়া দীপাবলি তার দুনিয়াটাকে অন্ধকার দেখে। সে লম্বা সময় শাওয়ার নিলো। তারপর বসুন্ধরা মার্কেটে “সাদাকালো” দেশি ব্র্যান্ড থেকে কেনা একটা শাড়ি পরে কপালে বড় একটা লাল টিপ দিলো। সে তার রেশমি চুলগুলি ছেড়ে দিয়েছে। ল্যাপটপ অন করার সাথে সাথে ক্যামেরাও অন হলো। অন্যপাশে প্রাঙ্গণ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে।

-শাড়িটা তোমার গায়ে জোছনা রাত হয়ে ফুটে আছে। আর কপালের টিপ রাতের অবাক সূর্য।
-ইউ অলোয়েজ মেইক মাই ডেইজ।

মন্তব্যটা লিখেই দীপাবলি টের পেলো, আবেগে তার চোখ ভিজে গেছে। যাবেই তো, এমন করে যে কথা বলে যে কোন বয়সের মেয়ে তার মুগ্ধতায় বুদ হয়ে থাকবে। ভার্চুয়াল জগতে রোম্যান্টিক মানুষেরা এভাবেই কথা বলে ঠিক; কিন্তু শুধু অনলাইনে না সামনাসামনিও প্রাঙ্গণ অমন।

দীপাবলি মানে দীপাবলি চ্যাটার্জি; সাড়ে চল্লিশ। স্বামী অমিত চ্যাটার্জি তিন বছর আগে হার্ট এটাকে মারা গেছেন। স্বামীর রেখে যাওয়া ব্যবসা সে দেখে। গত বছর প্রাঙ্গণের সাথে অনলাইনে পরিচয় হয়। কিছুদিন চ্যাট করার পর ওরা একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করে। সেই সাক্ষাতের সময়ও দীপাবলির সাথে সে সাবলীলভাবে স্বপ্নের কথা বলেছে। ইনবক্স চ্যাটিংএ যেমন। প্রাঙ্গণ বছর দুয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে একটা মাঝারি মানের চাকরি করে।

বয়সের তুলনায় দেখতে ছোট প্রাঙ্গণকে প্রথম সাক্ষাতে দেখে দীপাবলি অবাক হয়েছিল, কী করে এতো পার্থক্যের কারো সাথে সে এভাবে কথা বলেছে?

কিন্তু এখন মনে হয়, প্রাঙ্গণ তার বহুজন্মের চাওয়া ছিল এবং অবশেষে এইজন্মে এসে তাকে পেয়েছে। এখন তাকে হারালেই যেন দীপাবলির সর্বনাশ হবে! অনুভবের এমন তীব্রতা দীর্ঘ সময় প্রেমের আকালের কারণেই কী হয়?

দীপাবলি কল্পনা করে, অল্পদিনের মধ্যে নিতিকার বিয়ে হবে। মেয়ে এবং মেয়ের স্বামী মিলে প্রাঙ্গণের সাথে তার বিয়ের আয়োজন করবে এবং বাকী জীবন প্রাঙ্গণ তার জন্য একই রকম থেকে যাবে।

-আমার নিজের একটা নদি আছে কেউ জানেনা। ওতে খুব ভাঙ্গন হয়! দীপাবলি লিখলো।

দীপাবলির অন্তরের কথা আঁচ করতে পেরে প্রাঙ্গণ প্রসঙ্গ পাল্টালো।
-বাসায় ফুলের মালা আছে?
-জগিং করে ফেরার সময় একটা কিনেছি। দীপাবলি জবাব দিল।
-খোঁপায় পরবে?
-হ্যাঁ।

দীপাবলি ওঠে গেল।
মিনিট দশেক পর ফুলের মালা খোঁপায় পরে সে আবার ল্যাপটপের সামনে বসলো।
-চুল ছুঁয়ে দেই? প্রাঙ্গণ লিখলো
-দাও
-তাতে খোঁপাটা যদি খুলে যায়?
-যাক; না হয় আমি বৃষ্টিতে ভিজে যাবো

“এখন আসি” বলে প্রাঙ্গণ হঠাৎ লগ আউট হল।

ল্যাপটপ ভাজ করে দীপাবলি রান্নাঘরে গেল। তার ইচ্ছা ছিল, আজ লম্বা সময় প্রাঙ্গণের সাথে কথা বলবে। হলোনা। তাই একটু মন ভার হয়েছে। নিতিকার জন্য মুরগী-মসলা করলো। ঘি দিয়ে আলুভর্তা প্রাঙ্গণের খুব পছন্দ। সে আসবেনা; সেই উপায়ও নেই। তবু প্রিয় মানুষটাকে ভেবে দীপাবলি আলু ভর্তা বানালো।

রান্না শেষ করে দীপাবলি আবার ল্যাপটপ অন করলো। প্রাঙ্গণের সবুজ বাতি জ্বলছেনা। জ্বর কমেছে কিনা সেটা জানতে চেয়ে সে একটা মেসেজ দিলো। সাথে সাথে প্রাঙ্গণের রিপ্লাই এলো।

-হ্যাঁ, জ্বর কমেছে।
-দেখা করতে চাই; পারবে? দীপাবলি জানতে চাইলো
-কোথায়?
-আগের সেই রেস্টুরেন্টে
-কখন?
-না থাক; আজ দেখা করবোনা! দীপাবলি মত বদলালো।
কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করে দীপাবলির ভিতর। ইদানিং খুব বেড়েছে।

প্রাঙ্গণ একটা হাসির ইমো দিয়ে বিদায় নিলো।

এর পরের দিন; এর পরের সপ্তাহ; এর পরের মাস।
দীপাবলি ঠিকমত ঘুমাতে পারেনি। তার চেহারায় এর স্পষ্ট একটা ছাপ পড়েছে। প্রাঙ্গণ একটু একটু করে দীপাবলিকে এভয়েড করেছে।

এর পরের কোয়ার্টার।
এভয়েড করতে করতে প্রাঙ্গণ গত এক মাস দীপাবলির সাথে কোন যোগাযোগ করেনি।

নিতিকা এখন তার মায়ের চোখে সারাক্ষণ মেঘ দেখে; জলশূন্য মেঘ। সে মায়ের সব জানে, সব বুঝে এবং খুব করে চায়, তার প্রিয় মা যেন যেকোন শর্তে ভালো থাকে।

নিতিকা ভাবছিল, যদি একবার প্রাঙ্গণ আসতেন— ! ঠিক তখনই ডোরবেলের শব্দ হল। নিতিকা দরজা খুলে দিলো। অন্যপাশে এক যুবক; বয়স তার চেয়ে কিছুটা বেশি লাগে।

“আমি ঈষানচন্দ্র”, যুবকটি নিজের পরিচয় দিলো।

কিন্তু নিতিকা শুনতে পেলো যুবকটা বলছে, “আমি ঈশ্বরচন্দ্র (বিদ্যাসাগর)”!

10 thoughts on “ছোটগল্পঃ ঈশ্বরচন্দ্র

  1. বিস্ময়ের সাথে পড়লাম লেখাটি। ঈশ্বর আপনাকে কম ক্ষমতা দেন নাই মি. মিড ডে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. এমন মন্তব্য পেলে ভীষণ ভালো লাগে। লেখালেখিকে তখন প্রথম বা দ্বিতীয় অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করে।

      অনেক ধন্যবাদ মিঃ মুরুব্বী!

    1. আপনার মন্তব্যে মন ভরে গেলো খালিদ ভাই।

      কৃতজ্ঞতা রইলো !

  2. আপনার হাতের অণুগল্প ই দারুণ আসে। ভীষণ ভাল আসে মিড দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. মন্তব্যে মুগ্ধ হয়েছি দিদি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে !

    1. আপনার কমপ্লিমেন্টে ভীষণ আনন্দিত হয়েছি প্রিয় কবি।

      অনেক ধন্যবাদ আপনাকে !

  3. -তোমার দেয়া শিশিরগুলি আমি জমিয়ে রেখেছি
    -কেন? দীপাবলি জানতে চাইলো।
    -একটা নদি বানাবো।

    * শুরুর মতই পুরো গল্পটাই আমাকে আপনার লেখার অসাধারণত্ব ঘোষণা করেই চলছে…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. আপনার মন্তব্য আমাকে ভীষণ ভাবে আনন্দিত করছে প্রিয় কবি।

      অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।