অশরীরীঃ না গল্প না প্রবন্ধ (৪র্থ)

অলৌকিক সব কাজ – কারবার! যে বাসায় ভাড়া থাকি সেটা অনেক দিনের পুরনো একটা বাড়ি। তিন রুমের একটা সেমি পাকা ঘর। চাকরীর সুবাদে এই শহরে আসা। এলাকায় একদম নতুন। অফিসের কাছাকাছি হবে ভেবে এই খানে ভাড়া থাকি। আরও একজন আমার পাশের রুমে ভাড়া থাকতেন। আক্কাস আলী সাহেব। তিনি পদবীতে আমার নিচে হলেও সিনিয়র হওয়ায় তাকে আক্কাস সাহেব ডাকতাম। উনি এই মুহুর্তে এখানে নেই। নেই মানে বাসা ছেড়ে চলে গেছেন।

প্রায় প্রতি রাতেই উনি এমন জোরে চিৎকার করে উঠতেন যে, পাশের রুমে আমি ঘুমিয়ে থাকা মানুষটাও চমকে উঠতাম। উনার রুমের দরজায় কষাঘাত করার পর দরজা খুলে দিলে দ্বিতীয়বার চমকে উঠতাম উনাট মুখের অবয়ব দেখে। একদম পাংশুটে মুখ। চোখগুলো যেনো ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইতেছে। ভয়ে অস্থির মুখটা থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। শুধু গরগর আওয়াজ করছেন। আমি জগ থেকে একগ্লাস পানি সামনে তুলে ধরতেই তিনি একরকম ছোঁ মেরে গ্লাসটা না নিয়ে জগটা নিয়েই ঢকঢক করে জগের সবটুকু পানি এক নিঃশ্বাসে পান করে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন।

উনি যা বললেন তা শুনে আমার গায়ের রোমগুলো সব দাঁড়িয়ে গেল। উনার কথার সারমর্ম করলে দাঁড়ায় এমন- এই মধ্যরাতে একটা জলজ্যান্ত চার-পাঁচ বছরের বাচ্চা তার পাশে শুয়ে ঘুমোতে দেখছেন। এর আগেও এমন ঘটনা দু- একবার ঘটেছিল। কিন্তু তিনি সেটা স্বপ্ন মনে করে পাশ কাটিয়ে গেছেন। তিনি বাচ্চাটার শরীরে হাত পর্যন্ত বুলিয়ে দিয়েছেন। আর হাত বুলিয়ে দিতে গিয়েই বিপত্তি বেঁধেছে। এমন ঠান্ডা শরীর যেনো বরফের ভেতর থেকে মাত্র বের হয়ে এসেছে। তখনও তিনি ভয় পাননি। কিন্তু বাচ্চাটি যখন তাঁর ডান হাতের বুড়ো আঙুলে কামড় দেওয়ার পর ধীরে ধীরে পুরো হাতটাই তার মুখের ভেতর ঢুকে ফেল ছিল তখনই তার সম্বিৎ ফিরে আসে আচমকা হেঁচকা টানে হাতটি মুখের ভেতর থেকে বের দেয় চিৎকার এবং সঙ্গে সঙ্গে এক লাফেই দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায়। আর বাচ্চাটি তখন সুড়সুড় করে খাটের নিচে ঢুকে পড়ে।

ভয় কি জিনিস এটা আমার জানা নেই। ভুত-প্রেতে চিরকাল অবিশ্বাসী ছেলেটার বুকটাও একটু ধক্ করে ওঠে। অফিস থেকে দেওয়া তিন ব্যাটারীর টর্চের আলো উপুড় হয়ে খাটের নিচে ফেলি। কিছুই দেখতে পাই না। মুখটা ওপরে তুলতেই আমার চোখ পড়ে আক্কাস সাহেবের মুখে। তখনও তিনি কাঁপছেন।

এই ঘটনার পর আক্কাস সাহেব আর এখানে থাকেন নাই। তিনি চলে গেলেন পরের দিনই। আমাকেও উপদেশ দিলেন বাড়িটা যতো তাড়াতাড়ি পারি ছেড়ে দিতে। কিন্তু দেই – দিচ্ছি করেও আমি আর বাড়িটা ছেড়ে দিতে পারিনি। এর কারণও আছে। প্রথমত বাড়িটা একদম অফিসের কাছেই। দ্বিতীয়ত অল্প টাকায় এমন নিরিবিলি বাড়ি এই এই উপজেলা সদরে আর খুঁজে পাওয়াও যাবে না।

বাড়িওয়ালা এখানে থাকেন না। তিনি থাকেন একটা অজপাড়াগাঁয়ে। তিন-চার মাস পর এসে শুধু ভাড়ার টাকাটা নিয়ে যান। তার কাছে আক্কাস সাহেবের বিষয়টা বলতে গিয়েও বলিনি। বললে যদি ভেবে নেন যে, শহুরে ছেলে এ যুগে এসে এখনও ভুত প্রেতে বিশ্বাস করে।

অফিসের নানা ব্যস্ততায় আক্কাস সাহেবের ঘটনাটা ভুলেই গিয়েছিলাম। টুকটাক মাঝেমধ্যে কান্নার আওয়াজ শুনি। খুব করুণ সুরে কে যেনো প্রায়ই কাঁদে। সময় যতো বাড়তে থাকে কান্নার আওয়াজও তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণ হতে থাকে। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো কোন মেয়ের স্বামী বা বাবা/মা মারা গিয়েছে সেই শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কিন্তু না! ভুল ভাঙতে খুব বেশি দেরি হয়নি আমার।

একদিন রাতে অফিসের কাজ করতে গিয়ে ঘুমোতে ষনেক দেরি হয়ে যায়। অফিসে অডিট আসবে। রাজ্যের কাজ। কাজ শেষ করে মাত্র বিছানায় যাবো আর ঠিক তখনই আবারও সেই কান্নার আওয়াজ। এবার আর দূরে কোথাও নয়। আমারই রুমের বাইরে থেকে। আমি খরগোশের মতো কানদুটো খাঁড়া করে দিই। বুঝতে পারি বাড়ির ডান কোণ ঘেঁষেই যে ছোট্ট একটা পুকুর আছে সেখান থেকেই কান্নার আওয়াজ আসতেছে। আমি ওদিকটার জানালা খুলে ডানে-বামে, উপরে-নিচে দেখার চেষ্টা করি। শুধু কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না।
এবার অফিসের দেয়া তিন ব্যাটারী টর্চলাইটটি হাতে নিয়ে দরজা খুলে বের হই। খুব সন্তর্পণে পুকুরটা দিকে এগিয়ে যেতে থাকি।.

……….……….চলবে..!

1 thought on “অশরীরীঃ না গল্প না প্রবন্ধ (৪র্থ)

  1. আপনার এই জীবনবোধের লিখা আমাকে নিয়মিত মুগ্ধ করেই চলেই। অতুলনীয়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।