‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াৎ মামুদ… ২য় ভাগ

স্বপ্ন ও সময়: ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াৎ মামুদ… ১ম ভাগ।

ইতিহাস তো আর কিছু নয়, তা স্থান-কাল-পাত্রের সমন্বয়ে গড়ে-ওঠা ঘটনাপ্রপঞ্চ। নাকি, গড়ে তোলা? আমি নিজে ‘গড়ে-ওঠা’ বলবার দলে। ষাটের দশকটাকে ভাবা যাক না। কেমন ছিল সে-সব দিন? এই ঢাকা শহরটা তখন কেমন ছিল? আর শিল্পের চিন্তা মাথায় পুরে যাঁরা ঘুরে বেড়াতেন, প্রবীণ ও নবীন, কারা তাঁরা?

তখনকার ঢাকা শহর মানে এখনকার পুরনো ঢাকার চৌহদ্দি। তারই মধ্যে অভিজাত-অনভিজাত এলাকা, উচ্চবিত্ত আর মধ্যবিত্তের গা ঘেঁষাঘেঁষি ভাব- ভালোবাসা। পঞ্চাশের শেষ আর ষাটের প্রথম দিকে বনেদি পাড়া তো ছিল মাত্র দুটো- গেণ্ডারিয়া আর ওয়ারী। এখনকার গুলিস্তান এলাকার ওদিকটায় আর শহর যায় নি; ফাঁকা জায়গা, মাঠ, বনবাদাড় এইসব। নটরডেম কলেজে ক্লাস করতে সাইকেলে চেপে গেছি ধেনো জমির ওপর তৈরি নতুন সড়ক ধরে। এখন যেখানে ইত্তেফাক অফিস (তখনও কি ওখানেই ছিল? মনে পড়ছে না) তার সামনেটা আর গোপীবাগের তল্লাট সবই তো ফাঁকা ধু-ধু: সামনের দিকটায় ধানক্ষেত-আখক্ষেত কমলাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত, আর ডানদিকে ডাঙ্গা উঁচু জমি ফাঁকা পুকুর দু’ একটা ঘরবাড়ি দু’ একটা ছড়ানো-ছিটানো পার হয়ে গেলে একদম দক্ষিণের শেষপ্রান্তে ‘রোজ গার্ডেন’ প্রাসাদবাড়ি। সত্যি বলতে, রমনা কি পুরনো পল্টন একঘরের মতো বাইরে পড়ে থাকত। অর্থাৎ জীবন জ্যান্ত ছটফট করত, নানান ছন্দে মাতামাতি করতো এদিকটাতেই যা এখন পুরনো ঢাকা। তারও মুখের দুটো পাশ, নাকের দু’দিকে গণ্ডদেশ যেমন। নাকটা হল নবাবপুর রাস্তা চওড়া কপাল হল সদরঘাট-বুড়িগঙ্গা। ঐ মুখাবয়বের সীমা টেনে দিয়েছিল, আমার বিবেচনায়, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকার যোগসূত্রের একটি অংশ- গেন্ডারিয়া থেকে ফুলবাড়িয়া (অর্থাৎ ঢাকা রেলস্টেশন পর্যন্ত বিছানো রেললাইন) গেন্ডারিয়াই তো একটা দিকের শেষ সীমানা ঢাকা শহরের।

এক দিকে রইল বুড়িগঙ্গার জলরেখা, আরেক দিকে কলের গাড়ির যাত্রাপথ; এ দুয়ের মধ্যিখানে জায়মান রাজধানী সেই সুদূর পঞ্চাশ-ষাটে তখন প্রাণকল্লোলে কম্পমান। নতুন শিক্ষিত এলিট দানা বাঁধবার রসায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে তখন পড়ে গেছে। পুরনো এমন কিছু ছিল না যা কালাপাহাড়ি বিক্রমে দুদ্দাড় করে ভেঙে ফেলতে হচ্ছে। সবই নতুন। দল মত পথ সবই নতুনদের নিয়ে, নতুনদেরই মধ্যে। এই চালচিত্রে সেই সময়টিকে বুঝে নিতে হবে। আমার কাছে এক মহাদূর্লভ ছবি আছে, ভাগ্যগুণে শিল্পী আমিনুল ইসলামের সংগ্রহ থেকে পেয়েছিলাম। আমি মাঝেসাঝে বের করে দেখি।
সকলের বয়স বিশের একটু এদিক-ওদিক। পঞ্চাশ দশকের মহারথী সকলেই: আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, শিল্পী হামিদুর রহমান (শহীদ মিনারের পরিকল্পক-রূপকার), শিল্পী আমিনুল ইসলাম। সকলেরই বয়স তখন বিশ-বাইশের কোঠায়। এখনকার মুখ ছবির মুখগুলোর ওপরে বসাতে গেলে মেলে না। তাতে কী?

চোখ রাখলেই আমার কৈশোরের ঢাকা পেরিয়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। আমরা এরই ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে ষাটের যুগে পা রেখেছিলাম। এইভাবে মনের মধ্যে তৈরি করে নিতে হবে সময়টাকে নইলে তখনকার আনন্দ উত্তেজনা ভালবাসা রোমাঞ্চ কিছুই বোঝা যাবে না।

ঢাকা তো মফঃস্বল শহর তখনও। যে-কোন ঘটনার ঢেউ আছড়ে পড়ে সকলের গায়, ভালো-মন্দ যাই ঘটুক না। সংখ্যায় সবই অল্প। ব্যবসায়ী, লেখক, সাংবাদিক, ডাক্তার, উকিল-সবই যেন হাতেগোনা। দৈনিক কাগজও ওরকমই সংখ্যায়। সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কোনো সাময়িকী যাই বেরুক না কেন, চারদিক তোলপাড়। গোষ্ঠীই-বা এত কোথায় !! দু’চারটে বেশি হলে, কিন্তু যাই ছিল সংহত ছিল।
পঞ্চাশের দশকে অভিজাত গ্রন্থবিপনী আমার হিসেবে ছিল কুল্যে একটি এবং তাও আবার বইপাড়া বাংলাবাজারে নয়। “ওয়ার্সি বুক সেন্টার” আরমানিটোলায়, মাঠের পাশের এক রাস্তার ওপরে। গ্রন্থপ্রকাশেও তাঁরা হাত দিয়েছিলেন, যদিও বেশি বই তেমন বেরোয়নি।
সাহিত্যের আড্ডা ছিল ‘সওগাত’ পত্রিকার অফিসে, পাটুয়াটুলিতে, জগন্নাথ কলেজের, খিড়কী দুয়োরের প্রায় মুখোমুখি। আর ছিল আড্ডা ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকা অফিসে, সেটারই পরবর্তী সময়ে রূপান্তর ঘটে “বিউটি বোর্ডিং”। প্যারীমোহন দাস রোডে ঢুকেই বাঁ দিকের গলিতে। ও-সব স্থানে যাওয়ার মতো বয়স তখনও আমার হয়নি।

তো, এই আবহাওয়ারই তো সম্প্রসারণ ষাটের দশক অবধি চলে গিয়েছিল। কী নবীন স্নিগ্ধ সুবাসিত রূপসীই-না ছিল আমাদের ঢাকা, আজকের প্রজন্মের কাউকেই তা বিশ্বাস করানো শক্ত হবে। হেঁটে বেড়াতে কী আনন্দ ছিল। বিশেষ করে হেমন্তে। ম্লান অপরাহ্নে বিশ্ববিদ্যালয় (এখন মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগ যে-চত্বরে) থেকে বেরিয়ে নিমতলির পথ ধরে জাদুঘর বা এশিয়াটিক সোসাইটির প্রাচীন ভূতুড়ে দালানের পাশ দিয়ে হাঁটছি, ছাতিমের গন্ধ স্নায়ু রোমকূপে নেশা ধরিয়ে দিচ্ছে। কত অবসর ছিল জীবনে।

ঐ অবসর ঘিরেই বীজ বোনা চলতো শিল্পভাবনার, চলতো জটলা বন্ধুতে বন্ধুতে, ক্যাপিটাল রেস্টুরেন্টের অনতিপরিসর ছোট্ট ঘরে। টেবিলের ওপরে চা আর মোগলাই পরোটা (ভীষণ বিখ্যাত ছিল, আহা, সেদিন আর আসবে না) সামনে নিয়ে। রেসকোর্সের ময়দানে পা ছড়িয়ে আড্ডা দেয়া গেছে, রমনা কালীবাড়ির শান-বাঁধানো ঘাটে বসেও। সে-সব দিনের মতো বর্ষাও তো আজকাল আর নামে না। বর্ষা যে আর উপভোগ্য নেই তার কারণ কি জনস্রোত, চতুর্দিকে মানুষের ঢল? শীতের হি-হি কাঁপনও তেমন নেই যেন। যে-কোনো মেয়েকেই কী-যে রূপবতী মনে হত, পথেঘাটে মেয়েদের তো আর দেখা মিলতো না তেমন, আমাদের সেকালে মেয়েদের আনাগোনা ছিল মুখ্যত কল্পনায়। সে অন্য গোত্রের আনন্দস্বাদ। তাও বুঝবে না আমার বয়সীদের সন্তানসন্ততি। আমাদের সময়টা ছিল, আজ মনে হয়, সত্যি সত্যিই জীবন-আনন্দের ঘোর লাগা।

আমাদের সকল কর্মোদ্যম, যাবতীয় বাসনা ও স্বপ্ন ঐ আনন্দের অমলতা মেখেই বেরিয়ে আসতো। আমরা তখন যে যা-ই করেছি সবই নিখাদ ভালোবাসা থেকে করেছি। মতের গরমিল থেকে মনের অমিল হতো না।

স্বপ্ন ও সময় : ‘সপ্তক’ ও ‘কালবেলা’ – হায়াত্‍ মামুদ। Munshigonj.com

মুরুব্বী সম্পর্কে

আমি আজাদ কাশ্মীর জামান। আছি মুরুব্বী নামের অন্তরালে। কবিতা পড়ি, কবিতা লিখার চেষ্টা করি। ভেতরে আছে বাউল মন। খুঁজে ফিরি তাকে। জানা হয়নি এখনো। ঘুরতে ঘুরতে আজ পৃথিবীর স্বর্গে। এখানেই পরিচয় হয়েছিলো, কবিতা পাগল এক মানুষের সংগে। নাম জিয়া রায়হান। যার কিছু শব্দকথা, এ্যাতোদিন ভরেছে আমার পাতা। উথাল পাথাল হাওয়া, হৃদয়ে জাগালো দোলা পেলাম কিছু সমমনা মানুষের দ্যাখা। দিনভর আর রাতভর শুধু কবিতায় গেলো বেলা। সব ছেড়েছি- সব পেয়েছি- ভুলতে পারিনি শুধু কবিতার অশ্রুসজল চোখ। ভালো লাগা থেকেই দু’ একটা শব্দ সাজাবার চেষ্টা করি। মাতাল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মাটির কলসে, তবলার ধ্বণী তুলে গাইতে পারি বেসুরো গান- সুর নামের অন্তরালে। ভালোলাগে পোষা কবুতরের পালক ললাটে ছোঁয়াতে। ফুল থেকে রং নিয়ে, খেলি হোলিখেলা, হৃদয়ের উঠোনে। আজ তারি ধমকে এলাম স্বরূপে- স্বকথায় ভরাবো পাতা।   hits counter