মেগাবাইট ভূতের জন্য সংসারে অশান্তি

মেগাবাইট ভূতের জন্য সংসারে অশান্তি

ছোট একটা সংসার। সংসারের কর্তা হলেন রমজান আলি। বিয়ের উপযুক্ত হয়েছে অনেক আগে থেকে। কিন্তু অভাবের কারণে বিয়ে করার সাহস পায় না। কিন্তু ইচ্ছে আছে বিয়ে করার। ইচ্ছাপূরণ হয় না শুধু অর্থ নেই, তাই। রমজান আলি জন্ম থেকেই দুখী। অভাব অনটনের মধ্যেই রমজান আলি ছোট থেকে বড় হয়েছে। মা, বাবা, ভাই, বোন বলতে এখন আর রমজান আলির কেউ নেই। রমজান আলি মা বাবাকে হারিয়েছেন অনেক আগেই। দুই শতাংশ জায়গার উপর ছনের একটা ঘর ছাড়া রমজান আলির আর কিছুই নেই।

পরের বাড়িতে কাজ করে যা পায়, তা দিয়েই রমজান আলির দৈনন্দিন জীবন চলা। একসময় রমজান আলি পাশের গ্রামের ফুলজান বিবি নামের এক গরিবের মেয়ে বিয়ে করবেন বলে ভাবছিল। বিয়েতে রমজান আলির তেমন কোনও দাবিদাওয়া নেই। শুধু নতুন জামাপ্যান্ট বানিয়ে দেওয়া, আর বিয়েতে বরযাত্রী যাওয়া ২০জনকে সমাদর সহ বিয়ের কার্যসম্পাদন শেষ করে দেওয়াই ছিল রমজান আলির দাবি। বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে গেল। দিন তারিখও নির্ধারণ করা হলো।

রমজান আলিকে তাঁর পাড়াপড়শি বুঝাতে লাগলো, “গরিবের মেয়ে সাংসারিক হয়! তোর কপাল ভালো তাই এমন একটা মেয়ে পেলি! গরিবের মেয়েরা স্বামী ভক্ত হয়ে থাকে। আবার অনেক গরিবের মেয়েরা একটু জেদী টাইপের থাকে। কোনও কোনও মেয়ের আবার একটু অহংকার অহংকার ভাবও থাকে। আমাদের ধারনা এই ফুলজান মেয়েটার কোনও অহংকার গরিমা নেই। মাঝেমাঝে দেখি বড় একটা মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে। মানুষের ছবি তুলে, নিজের সেলফি তুলে। এছাড়া এই মেয়েটাকে আর কোনও মেয়ের সাথে আড্ডাও দিতে দেখি না। ফুলজান বিবি খুব ভালো মেয়ে। তোর সাথে মানাবে খুব!” শুনাইলেন, রমজান আলির গ্রামের লোকজন।

সবার কথা শুনে রমজান আলি তো খুশিতে আত্মহারা! যাক! আল্লাহর রহমতে মনে হয় আমার কপাল এবার ফিরলো। রমজান আলি ভাবছে, গরিবের মেয়ে বিয়ে করলে আমার অভাবের সংসারে আর অভাব থাকবে না। কিছু না থাকলেও কাইজা কীর্তন একটু কম হবে। বড় একটা মোবাইল ব্যবহার করে তো ভালো। আমিতো সারাক্ষণ পরের বাড়িতেই কাজে ব্যস্ত থাকি। আমার স্ত্রী নাহয় মোবাইলটা নিয়ে একা একা বাড়িতে বসে বসে টিপাটিপি করুক! তাতে ওর সময়টাও কাটবে, আমার সংসারের দুই মুঠো ডাল ভাতও তৈরি হয়ে যাবে। আর গরিবের মেয়েরা স্বামীর কাছে বেশি কিছু আবদারও করে না। গরিবের মেয়েদের বিলাসিতার দিকে নজরও থাকে কম। স্বামী যা-ই দিবে, তা-ই দিয়ে খুশি থাকবে। এটা ছিল রমজান আলির ধারনা।

রমজান আলি বিয়ে করলো। নতুন বউ ঘরে আনলো। দুইদিন যেতে আর না যেতেই শুরু হয়ে গেলো এক অন্য রকম পরিস্থিতি। এখন রমজান আলির আগের ধারনা হয়ে গেল ভুল! এটা নাই, ওটা চাই! দিবে না কেন? দিতে হবে! পারবে না কেন? পারতে হবে! আমার মোবাইলে মেগাবাইট নাই, মোবাইলে মেগাবাইট ভরে দিতে হবে! এসব নিয়ে প্রতিদিন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাকবিতণ্ডা।

এমন পরিস্থিতিতে দিনদিন রমজান আলির দেমাগ খারাপ হতে শুরু করলো। কাজ করে যা পাই, তাতে চাল ডাল কেনার টাকাই হয় না। তার উপর আবার মেগাবাইট? এই মেগাবাইট দিয়ে কী হয়? মেগাবাইট কী খায়? নাকি মাথায় দেয়? রমজান আলি এখন নানান চিন্তায় জর্জরিত! তবে রমজান আলি লোকমুখে শুনেছে, মেগাবাইট মানে হচ্ছে ইন্টারনেট। যা দিয়ে ফেসবুক নামের একটা বুক চালায়। সেখানে অনেকেই সেলফি ছাড়ে, ছবি ছাড়ে, ভিডিও করেও ছেড়ে দেয়। এসব কিছু ছাড়ার পর কোথায় যে চলে যায়, তা অভাবী রমজান আলির অজানা। আর এখন নিজের বিবাহিত স্ত্রীই চালায় ইন্টারনেট। ছাড়ে সেলফি, ছাড়ে ছবি, ছাড়ে ভিডিও সহ আরও অনেককিছু।

রমজান আলি পরের বাড়িতে কাজ করতে গেলে মহাজনের ঘেনরঘেনর, পেনরপেনর শুনতে হয়। আবার বাড়িতে আসলে স্ত্রীর চাওয়া পাওয়ার দাবি। মেগাবাইট মেগাবাইট বলে স্ত্রীর চিল্লাচিল্লি। রমজান আলি এখন বিয়ে করেও এক বিপদের সম্মুখীন হয়ে গেল।

একদিন সকালবেলা রমজান আলি কাজে যাবার সময় স্ত্রীকে বলল, “কিছু পান্তা পুন্তা থাকলে দাও! আমি খেয়েদেয়ে মহাজনের বাড়িতে যাই!” রমজান আলির স্ত্রী জবাব দিল, “এই গোলাম! তোর কি হুশ নাই? কাউল্কা কি বাড়িত আওনের সুম চাইল আনছস? অহনে যে কচ পান্তাপুন্তা? পান্তা গাবাইয়া আইবো? ভাত দেওনের মুরুদনাই, মেগাবাইট ভইরা দেওনের খবর নাই! তয় আমারে বিয়া কইরা আনছস কে?”

স্ত্রীর এমন কথা শুনে রমজান আলি জিদ্দে নিজের ডানহাত বামহাত পাকাচ্ছে! স্ত্রী তো বকবক করছেই। রমজান আলি জিদ আর থামিয়ে রাখতে পারলো না। স্ত্রীর বকবকের মধ্যে রমজান আলি চুলে ধরেই শুরু করে দিল, দাপ্পুর-ধুপ্পুর!
রমজান আলি বিয়ে করার পর এই প্রথম তাঁর স্ত্রীর উপর হাত ওঠাতে বাধ্য হলো। স্ত্রী ফুলজান বিবি স্বামীর শক্ত হাতে মার খেয়ে বাড়ির উঠানে চিৎপটাং হয়ে পড়ে রইল। রমজান আলি সকালের খাবার না খেয়ে মহাজনের বাড়িতে চলে গেল।

রমজান আলি সারাদিন না খেয়ে গাঁদার খাটুনি খেটে ঠিক সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরলো। বাড়ি আসার সময় বাজার থেকে চাল ডাল সহ তেল লবণ সাথে করে নিয়ে আসলো। বাড়িতে এসে দেখে, ঘর অন্ধকার! ঘরে আলো নেই! রমজান আলি ভাবলো, হয়ত বিদ্যুৎ নেই, তাই ঘর অন্ধকার। রমজান আলি এক পা দু পা করতে পরতে ঘরে প্রবেশ করলো। ঘরে ঢোকার সাথে সাথে রমজান আলি ধপাস্ করে মেঝেতে পড়ে গেল! পড়ে যাবার সাথে সাথে চাল, ডাল, তেল, লবণ সবকিছু ছারখার হয়ে গেলো! রমজান আলির অনেক কষ্টের রোজগারের টাকা দিয়ে কেনা বাজার সদাই সব শেষ!

রমজান আলি ধূমপান করতো। তাই রমজান আলির পকেটে সবসময় দিয়াশলাই থাকতো। রমজান আলি দিয়াশলাই জ্বালিয়ে দেখে, স্বাদের স্ত্রী মার খেয়ে মনের দুঃখে সটান হয়ে ঘরের মাঝখানে শুইয়ে আছে। স্ত্রীর শরীরের সাথে ধাক্কা খেয়ে রমজান আলি ধপাস করে মাটিতে পড়েছে। স্ত্রী ঘরের মাঝখানে শুয়ে না থাকলে আর রমজান আলি ধপাস করে পড়তো না, রমজান আলির কষ্টের টাকার কেনা চাল ডালও নষ্ট হতো না।

স্ত্রীকে ঘরের মাঝখানে শোয়া দেখেই রমজান আলি এখন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। স্ত্রীকে চুলে ধরে টেনে ওঠালো। আবার শুরু করে দিল ধাপুস-ধুপুস ইন্টারনেটের কনি। ফুলজান বিবি মাগে বাবাগো বলে চিৎকার শুরু করে দিলো। গ্রামের লোকজন বাড়ি ভরে গেলো। কী হয়েছে আর না হয়েছে, পাড়াপড়শির কাছে রমজান আলি বুঝিয়ে বললো। গ্রামের সবাই স্ত্রীকে বুঝাতে লাগলো। সবার উদ্দেশে স্ত্রী ফুলজান বিবির এক কথা।
কথা হলো, “ও আমারে কিচ্ছু না দেক, আমার আফসোস নাই! না খাইয়া থাকুম কারোর কাছে নালিশ দিতাম না। কিন্তু প্রত্যেকদিন আমার মোবাইলে ২০ টেকার মেগাবাইট ভইরা দেওন লাগবো। আমি না খাইয়া থাকতে পারুম, কিন্তু মোবাইলে মেগাবাইট ছাড়া থাকতে পারুম না।”

গ্রামের সবাই এখন অবাক হয়ে বলতে লাগলো, “সর্বনাশ! খাইছে তো! এই ফুলজানরে তো মেগাবাইট রোগে ধরছে? ও তো অহনে এই মেগাবাইট ছাড়া থাকতে পারবো না? তয়লে এই রমজানের অবস্থা কী অইবো?”
তাড়াতাড়ি করে ফুলজান বিবির বাবাকে খবর দিয়ে রমজানের বাড়িতে আনা হলো। ফুলজান বিবির বাবাকে সবাই জিজ্ঞেস করলো, “মেয়েকে মোবাইল কিনে দিয়েছেন কেন? আপনার মেয়েকে তো এখন মেগাবাইট রোগে ধরেছে! মোবাইল আর মেগাবাইট ছাড়া তো এখন আপনার মেয়ে থাকতে পারে না। আপনার জামাতা তো দিনে আনে দিনে খায়, তা আপনি নিজেও জানেন! তার উপর আবার মেগাবাইটের বাড়তি খরচ কী করে রমজান আলি জোগাবে?”
ফুলজান বিবির বাবা দুহাত জোড় করে বললো, “ভাইসব, মেয়েকে আমার বড় মেয়ের জামাই মোবাইলটা দিয়েছে। এই মেগাবাইট নিয়ে আমার নিজ বাড়িতেও অনেক ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। যা বিয়ের আমি আপনাদের কাছে গোপন করে রেখেছি। আমার মেয়ে ফুলজান বিবি ফেসবুক খায়, ভাত খায় না। ভাত না খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু মোবাইলে মেগাবাইট না থাকলে আর চলতে পারে না। এখন আপনারা যা করার করতে পারেন, আমার কোনও আপত্তি নেই।”

ফুলজান বিবির বাবার কথা শুনে গ্রামের সবাই রমজানের সাথে বুদ্ধি করে সিদ্ধান্ত নিল। সিদ্ধান্ত হলো, সারাদিনে দুইবেলা খাবার হবে। শুধু সকালে আর রাত্রে। দুপুরবেলার খাবারের টাকা মেগাবাইট বাবদ খরচ হবে। রমজানের সংসারে প্রতিদিন চালের দরকার দেড় কেজি। এখন থেকে সারাদিনে সংসারে চাল দেওয়া হবে এক কেজি। বাজার সদাইও থাকবে সীমিত। গ্রামের সবার সিদ্ধান্তের সাথে রমজান আলির স্ত্রীও একমত হয়ে রাজি হয়ে গেলো। গ্রামবাসী সবাই ফুলজান বিবি আর রমজান আলিকে মিলিয়ে দিয়ে যার যার বাড়ি চলে গেলেন। রমজান আলি আর ফুলজান বিবি ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চাল ডাল সহ সবকিছু কুড়িয়ে রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে শুয়ে রইল।

রাত পোহাতেই ফুলজান বিবির গলা পিটানি শুরু হয়ে গেল। রমজান আলিকে উদ্দেশ্য করে বলছে, “কাজে যাবার সময় ফোন ফেক্সের দোকান থেকে যেন ০১৭৭৭ নাম্বারে মেগাবাইট পাঠায়! আইজগা দুইদিন ধইরা আমি ফেসবুক চালাইতে পারতাছি না। ফেসবুকের কতো বন্ধু আমার লাইগা কানতাছে! মনডায় কয় মোবাইলডারে ভাইঙ্গা চুইরা হালাইয়া দেই! মোবাইলে মেগাবাইটই যদি না থায়ে, তয় এই মোবাইল রাইক্ষা কী অইবো?”

ফুলজান বিবির কথা রমজান আলি শুধু কান পেতেই শুনলো, কিন্তু কিছুই বলেনি। বলেনি এই কারণে, আগেরদিন নতুন বউকে দুইদফা খিছানী দেওয়া হয়েছে, তাই। এরপরও যখন রাত ভোর হতে না হতে বকবক শুরু করে দিলো, তাহলে আর কী করা? চোখ বুঝে রমজান আলি না খেয়েই মহাজনের বাড়ি রওনা হলো। পথিমধ্যে ফোন ফেক্সের দোকান থেকে ফুকজান বিবির মোবাইল নাম্বারে ২০ টাকার মেগাবাইট পাঠিয়ে দিল।

সন্ধ্যার সময় রমজান আলি চাল ডাল নিয়ে যথারীতি বাড়ি ফিরলো। সাথে আনা চাল ডাল সহ কিছু কাঁচা তরিতরকারিও ফুলজান বিবির কাছে বুঝিয়ে দিল। পুকুর থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে বললো, “ক্ষুধা লাগছে, ভাত দে!”
ফুলজান বিবি বললো, “লাকড়ি নাই দেইখা ভাত রান্ধি নাই! ভাত খাইতে অইলে একটু সবুর করতে হইবো।”
রমজান আলি ঠিকই বুঝতে পেরেছে আসল ঘটনাটা ঘটনা হলো, মোবাইল। সারা বিকাল বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফেসবুক নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণেই ভাত রান্না করার সময় পায়নি। স্ত্রীর মুখে ভাত রান্ধি নাই কথা শুনে রমজান আলি আর দেরি করলো না। ওমনি ফটাফট ফুলজান বিবির চুলে ধরে শুরু করে দিল, ধাপুস-ধুপুস! স্বামীর হাতে মার খেয়ে ফুলজান বিবি আর দেরি না করে সোজা বাপের বাড়ি চলে গেল। এরপর রমজান আলি নিজেই এক কৌটা চালের ভাত রান্না করে খেয়ে-দেয়ে আরামে শুয়ে রইল।

সকালবেলা রমজান আলি ঘুম থেকে ওঠে যথাসময়ে নিজের কাজে চলে গেল। সারাদিন কাজ করে বাড়ি ফিরে দেখে ফুলজান বিবি বাড়ি নেই। রমজান আলি বুঝতে পেরেছে, ফুলজান বিবি রাগ করেছে। তাই আমার বাড়ি আর সে আসবে না। হয়ত ফুলজান বিবি বাপের বাড়িতে থাকবে। “আসলে আসুক আর না আসলে না আসুক! এই জ্বালা আর সহ্য হয় না, আমিও নিজে থেকে তাকে আনতে যাবো না।” সিদ্ধান্ত নিলেন রমজান আলি।

এদিকে ফুলজান বিবি বড়ি গিয়ে তাঁর দাদীর কাছে বললো, “দাদী আমি আর রমজাইন্নার বাড়িত যামু না। ভাত দিতে পারে না, কাপড় দিতে পারে না, মোবাইলে মেগাবাইট ভরে দিতে পারে না, খালিখালি মারে। ওর বাড়িত ক্যান যামু?”
দাদী ফুলজান বিবির সব কথা শুনলেন। তারপর দাদী ফুলজানকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোকে ক্যাম্নে ধইরা মারে?”
ফুলজান বিবি বললো, “চুলে ধইরা ঘাড় নুইয়াইয়া পিডের মধ্যে খালি কনি মারে গো দাদী! গোলামে মানুষ না গো দাদী, মানুষ না! আস্ত জানোয়ার! কার কাছে যে আব্বায় আমারে বিয়া দিছে গো দাদি। আমি ওর ভাত খামু না।”

দাদী ফুলজানের কান্না দেখে বললো, “হুন নাতিন! ওর ভাত খাইবি, আবার সব কড়ে গণ্ডায় আদায়ও করবি। আমারতন সেরকম বুদ্ধি আছে! তয় তুই আমার বুদ্ধিমত কাজ করতে পারবি কিনা? যদি পারছ, তয় রমজাইন্নায় তোরে মা ডাইক্কা ভাত খাওয়াইবো। বুঝলি?”
দাদীর কথা শুনে ফুলজান বিবি খুশিতে আত্মহারা! দাদীকে বললো, “আমি দাদী তোমার বুদ্ধিমত কাজ করতে পারুম, তুমি আমারে বুদ্ধি দাও। রমজাইন্নার নাকে রশি হান্ধাইয়া ঘুরামু দাদী।”
দাদী বললো, “হুন, রমজাইন্নায় যহনে তোর চুলে ধইরা তোর ঘাড় নুয়াইয়া তোর পিডে কনি দেওয়নের আগেই, তুই রমজাইন্নার লুঙ্গির নিচের অণ্ডকোষে ধইরা হালাইবি। ধইরা জোরে টিবি লাগাইয়া দিবি। যেই পযন্ত রমজাইন্নায় তরে মা না ডাকবো, ততক্ষণ পযন্ত তুই অণ্ডকোষের চিবি ছাড়বি না। আবার বেশি জোরে চিবি দিছ না, তয়ইলে মইরা যাইবো গা। পরে আবার মামলা খাবি!”

দাদীর বুদ্ধি ফুলজান বিবি সঠিকভাবে মাথায় ডুকাইয়া পরদিন সাতসকালে রমজানের বাড়ি চলে আসে। রমজান আলি তখন ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে কাজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় ফুলজান বিবিকে দেখে রমজান আলি মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। রমজান আলি মনে মনে বলতে লাগলো, “হালার বউ, কই যাইবা তুমি? যাওনের রাস্তা নাই! আমার কাছে আইতেই অইবো।”
এই বলে রমজান আলি ফুলজান বিবিকে কিছু না বলেই ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। ফুলজান বিবিও মনে মনে খুশি! মনে মনে বলতে লাগলো, “হালার রমজাইন্না, এইবার দেখুম তর কনির বাহাদুরি! এমন টিবি দিমু, মা ডাহাইয়া ছাড়ুম!” এইদিন ফুলজান বিবি ঘরে চাল ডাল থাকা সত্ত্বেও রান্না-বান্না না করে ঘরে শুইয়ে আছে। কাজ সেরে রমজান আলি বাড়ি ফিরে দেখে ভাতের ডেক খালি! ঘরে খাবার নেই! ফুলজান বিবি বিছানার উপর সটান হয়ে শুয়ে আছে।

ফুলজান বিবিকে বিছানায় শোয়া দেখে রমজান আলি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো! ওমনি ফুলজান বিবির চুলে ধরে শোয়া থেকে টেনে উঠালো। এরপর শুরু করে দিল, ধাপুস-ধুপুস ইন্টারনেট কনি! ফুলজান বিবি একসময় সুযোগ বুঝে রমজান আলির অণ্ডকোষে ধরে ফেলে। অণ্ডকোষে ধরে টিবি দেওয়া শুরু করলো।

এমতাবস্থায় রমজান আলির জান যায় যায় অবস্থা হয়ে গেছে। “মা গো, বাবা গো, ছাইড়া দে, আমারে ছাইড়া দে গো ফুলজান, ছাইড়া দে বলতে শুরু করলো।”
ফুলজান বিবি আরও জোরে টিবি দিতে লাগলো। ফুলজান বিবির টিবি খেয়ে রমজান আলি বলছে, “ভাই তর সব কথা আমি শুনুম, তুই আমারে ছাইড়া দে!”
ফুলজান বিবি এখন বলতে লাগলো, “শুন রমজাইন্না! আমি তরে ছাড়ুম! তয় আমার সব কথা তর শুনতে অইবো! যদি আমার কথা মানছ, তয় তর অণ্ডকোষের টিবি ছাড়ুম!”

অসহায় রমজান নিরুপায় হয়ে স্ত্রী ফুলজান বিবিকে বলছে, “কী কবি ক, আমি তর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করুম!” ফুলজান বিবি বললো, “প্রতিদিন তো চাল ডাল ঠিকমত আনবি’ই, হেই লগে আমার মোবাইলে মেগাবাইট ভইরা দিবি। যদি হ কছ, তয় ছাড়ুম! নয়ইলে এক্কেবারে টিবি দিয়া মাইরা হালামু।”
বেচারা রমজান আলি জীবন বাঁচানোর তাগিদে স্ত্রীর কথা মেনে নিল। এরপর ফুলজান বিবি রমজান আলির অণ্ডকোষ থেকে হাতে দেওয়া টিবি ছাড়লো।
রমজান আলি স্ত্রী থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কতক্ষণ মাটিতে বসে মনের দুঃখে কাঁদল। এরপর বাড়ির বাইরে চলে গেলো। সারাদিন বাইরে বাইরে থেকে আরেকজন থেকে কিছু টাকা হাওলাৎ করে ফুলজান বিবির মেবাইলে মেগাবাইট ভরে ভয়েভয়ে বাড়ি ফিরলো। এখন বেচারা রমজান আলি ফুলজান বিবির উপর রাগ হলেই, মার দেওয়ার আগেই ফুলজান বিবি দৌড়ে এসে রমজান আলির অণ্ডকোষের দিকে হাত বাড়ায়। রমজান আলি তখন টিবি খাওয়ার ভয়ে আর কিছুই বলে না।

একদিন রমজান আলি বেচারা কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। এমনি এক পরিচিত মুরুব্বির সাথে দেখা। মুরুব্বি রমজান আলির কান্না দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কী হইছে রে রমজাইন্না? ক দেহি হুনি!”
রমজান আলি মুরুব্বির কাছে স্ত্রী ফুলজান বিবির সব গুণগান গেয়ে শুনাইলেন। মুরুব্বি মন দিয়ে শুনলেন। এরপর মুরুব্বি রমজান আলিকে বললো, “রমজাইন্না তুই বহুত বিপদের মাধ্যেই আছত রে! অহনে তোরে আমার বুদ্ধি মতন কাম করন লাগবো। তুই যদি আমার বুদ্ধি কামে লাগাইতে পারছ, তয় তুই তর বউয়ের মাইরের তন রেহাই পাইবি। না অইলে একবারে জানে মইরা যাইবি গা।আমার বুদ্ধি কামে লাগাইতে পারবিনি ক? যদি পারছ, তয় সুন্দর একটা বুদ্ধি দিয়া দেই। আমার বুদ্ধিমত বাড়িত যাইয়া ইচ্ছা মতন তর বউয়েরে পিডাগা। তর বউ তরে কিছুই করতে পারত না।”
রমজান আলি মুরুব্বি কথা শুনে বললো, “দেন চাচা দেন, আমারে বাঁচনের বুদ্ধি দেন।”

মুরুব্বি রমজান আলিকে বললো, “হুন রমজাইন্না! বাড়িত যাইয়া তর অণ্ডকোষের মাপ মতন একটা নাইকলের (নারিকেল) আইছা লইবি। আইছাডারে ভালা কইরা চাইছা দুই সাইডে দুইডা কইরা ছেদা করবি। হেই ছেদার মাইধ্যে চিকণ রশি দিয়া তর অণ্ডকোষের মাইধ্যে আটকাইয়া কোমড়ে বাইন্দা রাখবি। তয়ইলে তর বউয়ে আর তর নিচের অণ্ডকোষে ধরতে পারত না, টিবিও দিতে পারত না। তুই ইচ্ছা মতন মনের স্বাদ মিডাইয়া কইন্নাইতে পারবি। হালার বউ, যাইবি কই?”
রমজান আলি মুরুব্বি বুদ্ধিমত বাড়িতে গিয়ে তাঁর অণ্ডকোষের মাপে একটা নারিকেলের আইছা খুঁজে বের করলো। তারপর ভালো করে আইছাটা পরিষ্কার করে দুই সাইটে দুটি করে ছিদ্র করে তার ভেতর চিকণ রশি ভরে অণ্ডকোষের সাথে খাপ লাগিয়ে নিজের কোমড়ে বেঁধে নিলো। এবার আসলো ফুলজান বিবির সামনে।

ফুলজান বিবি রমজান আলিকে দেখে বলছে, “ওই গোলাম! তরে না কইছি, আগে আমার মোবাইলে মেগাবাইট দিতে? দেছ নাই কে? তর কি মনে নাই, কাইলকার কথা? আইজগা তরে মাইরাই হালামু!” এই বলেই ফুলজান বিবি খুব রেগে রমজান আলির সামনে এসে রমজান আলিকে ধরে ফেললো। রমজান আলি হাবার মতন দাঁড়িয়ে থাকলো। রমজান আলি তো জানেই যে, আজকে ফুলজান বিবি আমার কিছুই করতে পারবে না। আমার নিচের অণ্ডকোষে ধরতেও পারবে না, টিবিও দিতে পারবে না।

ফুলজান বিবি যতবার রমজান আলির অণ্ডকোষে ধরতে চাইছে, ততবারই ফুলজান বিবি ব্যর্থ হচ্ছে। ফুলজান বিবি বলছে, “ব্যাপারটা কী রে? এমন তো কাইলকা আছিল না? আইজগা দেখতাছি লোহার মতন লাগতাছে?” রমজান আলি এবার ধরছে ফুলজান বিবির চুলে মধ্যে। মারছে ইচ্ছামত ইন্টারনেটের কনি! জোরে জোরে শুরু করে দিলো ধাপুস-ধুপুস মেগাবাইটের ভূত তাড়ানো ইন্টারনেট কনি।
“হালার ফুলজান! নুন আনতে আমার পান্তা ফুরায়, তারপর আবার তোর মেগাবাইটের খোরাক?”

ফুলজান বিবি আজকে আর রমজান আলির অণ্ডকোষে ধরতে পারেনি। নারিকেলের আইছা লাগানোর কারণে। তারপর রমজান আলির হাতে পায়ে ধরতে লাগলো। আর বলতে লাগলো, “ভাই আমারে আর মারিছ না, আমি আর মোবাইলের লাইগা মেগাবাইট চামু না! আমারে তুই মাপ কইরা দে!”
তারপর ফুলজান বিবির আকুতি মিনতিতে রমজান আলির মায়া লেগে যায়। রমজান আলি ফুলজান বিবিকে ওয়াদা করাইয়া ছেড়ে দেয়। এরপর থেকে আর কোনদিন ফুলজান বিবি মেগাবাইটের জন্য রমজান আলির কাছে আবদার করেনি। আর রমজান আলির সংসারে কোনদিন ঝগড়াঝাঁটিও হয়নি। শুরু হলো মেগাবাইট বিহীন রমজান মিয়া আর ফুলজান বিবির নতুন করে পথচলা। জয় হোক মানবতার!

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

6 thoughts on “মেগাবাইট ভূতের জন্য সংসারে অশান্তি

  1. .. অতঃপর শুরু হলো মেগাবাইট বিহীন রমজান মিয়া আর ফুলজান বিবির নতুন পথচলা।

    লিখাটি আমি মনযোগ দিয়ে পড়েছি। আমার কাছে তো ঝগড়াঝাঁটি বেশ ভালোই লেগেছে। রম্য লিখাতেও আপনি যথেষ্ঠ সাবলীল। অভিনন্দন মি. নিতাই বাবু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Razz.gif.gif

    1. দেশের আনাচে-কানাচে এমন কিছু ঘটনা ঘটে থাকে শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। তাই লেখায় একটু রস লাগিয়ে শেয়ার করলাম। আপনিপুরোপুরি পড়েছেন শুনে খুশি হলাম। 

  2. জানিনা কেমন মানসিকতায় লিখেছেন তবে লিখাটি পড়ে পাঠক হিসেবে যথেষ্ঠ মজা পেয়েছি। সাংসারিক খুঁটিনাটি আর মেগাবাইটের অভাব লিখাটির মূল উপজীব্য বিষয় হলেও উপস্থাপন অসাধারণ হয়েছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Claps.gif.gif

    1. কিছুদিন আগে এমন এক ঘটনা দেখেই আমার এই লেখা শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি। বর্তমানে দেশের প্রায় মানুষেই মেগাবাইট রোগে আক্রান্ত । আমি নিজেও একজন রুগী। 

  3. মুরুব্বি রমজান আলিকে বললো, “রমজাইন্না তুই বহুত বিপদের মাধ্যেই আছত রে! অহনে তোরে আমার বুদ্ধি মতন কাম করন লাগবো। তুই যদি আমার বুদ্ধি কামে লাগাইতে পারছ, তয় তুই তর বউয়ের মাইরের তন রেহাই পাইবি। না অইলে একবারে জানে মইরা যাইবি গা। আমার বুদ্ধি কামে লাগাইতে পারবিনি ক? যদি পারছ, তয় সুন্দর একটা বুদ্ধি দিয়া দেই। আমার বুদ্ধিমত বাড়িত যাইয়া ইচ্ছা মতন তর বউয়েরে পিডাগা। তর বউ তরে কিছুই করতে পারত না।”

    হাহাহা নিতাই বাবু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Laugh at.gif.gifঅনেকদিন পর আজকে হাসলাম। রমজান devil

    1. শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র দাদা, ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা থেকেই এই লেখা। সময়সময় 

      আমার উপর আশ্রয় করা মেগাবাইট ভূত তাড়ানোর জন্য নিজের স্ত্রীও সাধুসন্ন্যাসীদের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু আমাকে ধরেছে মেগাবাইট ভুতের বড় ওস্তাদে। তাই আমার উপর থেকে আর মেগাবাইট ভূত তাড়াতে পারছে না। আমি বর্তমানে একজন মেগাবাইট রুগী দাদা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।