মনের ভেতর মাটির ঘর

মনের ভেতর মাটির ঘর

অনেক বছর ধরে ইটপাটকেলের শহরে বাস করছি। সুখে থাকি আর দুখেই থাকি, সবসময় প্রিয় মাতৃভূমির জন্মস্থানের কথাই মনে পড়ে। মনে পড়ে গ্রামের বাড়িতে নিজেদের মাটির ঘরটির কথা। আমার বাপদাদার ভিটেমাটি ছিল নোয়াখালী জেলার চৌমুহনী থানাধীন মাহাতাবপুর গ্রামে। এই মাহাতাবপুর গ্রামের ‘মাইটগা দেলানয়ালা’ বাড়িটি ছিল আমাদের। অনেকেই হয়তো জানতে চাইবে যে, ‘মাইটগা দেলানয়ালা’ আবার কী? মাইটগা হলো ‘মাটি’, দেলান হলো ‘দালান’। তাই নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় লোকে বলতো ‘মাইটগা দেলানয়ালা’ বাড়ি।

যেই মাটি দিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে, সেই মাটি চাষাবাদ করা কোনও জমির মাটি ছিল না। ঘর তৈরি করার মাটি ছিল চাটগাঁর (চট্টগ্রাম) পাহাড়ি মাটি। মাটির রং ছিল লাল এবং মাটি ছিল আঠালো। তখনকার সময়ে সিমেন্টের খুবই দাম ছিল বিধায়, আমার দাদু (বাবার বাবা) ইটের গাঁথুনির আদলে মাটির গাঁথুনিতে ঘর তৈরি করেছিল। ঘর তৈরির মাটি আনা হয়েছিল চাটগাঁ (চট্টগ্রাম) থেকে নৌকা যোগে।

মাহাতাবপুর গ্রামে শুধু আমাদের বাড়িতেই ছিল দেলান (দালাল) ঘর। মাহাতাবপুর গ্রামসহ আশেপাশে থাকা দুই-চারটা গ্রামের মধ্যে একমাত্র আমাদের বাড়ির ঘরই ছিল দালান, তাও ছিল আবার মাটির দালান। দালানের ঘর ছিল বলেই, সেসময়ে মাহাতাবপুর গ্রামের আশেপাশের গ্রামের মানুষের কাছে আমাদের বাড়িটি খুবই পরিচিত ছিল।

এই মাইটগা দালানয়ালা’ বাড়িতে আমরা ছিলাম দুই পরিবার। দুই পরিবারের দুটি ঘর ছিল। দুই পরিবার বলতে একটি ছিল আমার জেঠাদের, এরেকটি ছিল আমাদের। জেঠা হলো আমার বাবার খুড়াতো ( চাচাতো) ভাই। তাঁরা ছিলেন দুই ভাই। তাঁরা থাকতেন এক ঘরে দুই পরিবার। আমার বাবার ছিলেন তিন ভাই। আমাদের ছিল একটা মাটির দালান ঘর। সেই ঘরে আমারা ছিলাম দুই পরিবার। আমরা সহ আমার ছোট কাকা। আমার মেঝো কাকা থাকতো চাঁদপুর। পুরো বাড়িতে থাকতাম মোট চার পরিবার।

তখনকার সময়ে আমার বাবার খুড়তো (চাচাত) ভাই দুইজনই চাকরি করতেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পুলিশবাহিনীতে। সরকারি চাকরির সুবাদে জেঠাদের সংসার ছিল স্বচ্ছল ও সুখের। তাঁদের আর্থিক অবস্থাও ছিল আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। আমাদের সংসারটা ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাবার মতো। কারণ, আমার দাদু বেঁচে থাকতেই নিজের চিকিৎসায় সব চাষের জমিজমা বিক্রি করে ফেলেছিল। জটিল রোগের কারণে সুস্থ না হয়ে শেষতক পরলোকগমন করে। দাদুর শেষ সম্বল বলতে থেকে যায় শুধু বাড়ির জায়গাটুকু, আর মাটির দালান ঘরটি। এই মাটির ঘরেই ১৯৬৩ সালে জুন মাসের ৮ তারিখের কোনো এক সুন্দর সময়ে আমার জন্ম।

আমরা ছিলাম দুই ভাই চার বোন। আমি ছিলাম সবার ছোট। সবার ছোট বলেই আমার আদর যত্নের কমতি ছিল না। তারপরও অনেকসময় বড় দিদিদের কাজের ঝামেলায় আমকে বাড়ির উঠোন বারান্দায় পড়ে থাকতে হতো। হয় তো সেসময় আমি তেমন কিছুই বুঝতাম না বা বুঝের হয়েও উঠিনি। তবু নিজের মন থেকে ধারণা আসে যে, উঠোন বারান্দার মাটি শরীরে মেখে আর খেয়েই হাঁটি হাঁটি পা পা করতে শিখেছিলাম। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ৮ বছর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়টা খেয়ে-না-খেয়ে পার করেছিলাম ঠিক, দেশ স্বাধীন হবার পর সেই মাটির ঘরে আর থাকতে পারিনি।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের অন্যান্য জেলাশহরের কথা জানা না থাকলেও আমাদের গ্রামে ডাকাতির মতো ঘটনা ছিল প্রতিনিয়ত। ডাকাতদের টার্গেট ছিল হিন্দুদের বাড়িগুলো। সেসময় আমার বড় তিন বোনের মধ্যে দুই বোনই ছিল বিয়ের উপযুক্ত। ডাকাতদের ছোবল থেকে বোনদের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য আমার মা নিজ ঘরের মাঝখানের মাটি খুরে কবরের মতো করে তৈরি করেছিলো ব্যাংকার। এমনভাবে ব্যাংকার তৈরি করেছিল, সেই ব্যাংকারে আমার বড় দুই বোন আড়াআড়িভাবে শুয়ে থাকতে পারতো। উপরে ফেলে রাখা হতো শোবার বিছানা। আমার মা এই পদ্ধতিটা চালু করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। সেসময় ব্যাংকার তৈরি করেছিল; রান্নাঘরের পেছনে। কারণ, পাকবাহিনী বাড়িতে হামলা করলে আগে বাড়িতে থাকা ছোটবড় ঘরগুলোতেই তল্লাসি করতো আর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতো তাই।

তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের গ্রামে থাকা আরও দশটি বাড়ি বাদে আমাদের বাড়িটি ছিল রাজাকারদের টার্গেট। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিন সন্ধ্যা হতে মধ্যরাত পর্যন্ত ৪-৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আড্ডা ছিল আমাদের বাড়িতেই। এই আড্ডার পেছনে একটা কারণও ছিল। তা হলো, বজরা রেলস্টেশন থেকে আমাদের গ্রামে ঢুকতে হলে আমাদের বাড়ি ঘেঁষেই অন্যসব বাড়িতে যেতে হবে। রাস্তাটি ছিল আমাদের বাড়ির পূর্বদিকে। এই রাস্তাটিই ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেট। তাই আমাদের গ্রামসহ আরও দুই একটা গ্রামের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা গ্রামের নিরাপত্তা রক্ষার্থে আমাদের বাড়িতে ডিউটি বেশি দিয়ে থাকতো। সন্ধ্যা থেকে তাঁদের আড্ডা শুরু হবার পর একেক দিন একেক ঘর থেকে তাঁদের চায়ের সাথে মুড়ি দেওয়া হতো। তাঁরা খেতেন, জেঠা মশাই’র সাথে বিভিন্নরকম আলাপ আলোচনা করতেন, আমাদের সাহসও দিতেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আড্ডার কারণেই মাহাতাবপুর গ্রামের অন্যসব বাড়ির চেয়ে আমাদের বাড়িটি ছিল, ডাকাতদের টার্গেট। সেই টার্গেট স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও অব্যাহত থাকে।

পাক- হানাদারবাহিনী পরাজয় বরণ করে দেশ ত্যাগ করলেও, পাকবাহিনী আর রাজাকারদের থেকেও ভয়ংকর ডাকাতবাহীনী দেখা দেয় আমাদের গ্রামে। দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন পরই শুরু হয় ডাকাতের হিংস্র থাবা। সেই হিংস্র থাবা থেকে আমরা আর রক্ষা পেলাম না। ডাকাতদের অত্যাচারে শেষতক ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে গ্রামের এক মুসলমানের কাছে নামমাত্র মূল্যে বাড়ি বিক্রি করে সপরিবারে নারায়ণগঞ্জ চলে আসি। কিন্তু আজও নিজেদের সেই মাটির ঘরে কথা ভুলতে পারিনি। ভুলতে পারিনি মাহাতাবপুর গ্রামের মাটির কথাও।

তাই মনের তাগিদে ১৯৮৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে একবার নিজের গ্রামে গিয়েছিলাম। গ্রামে গিয়ে আমার এক দুরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম। সেসময় গ্রামের অনেকেই ঘরবাড়ি বিক্রি করে গ্রাম ছেড়ে দিয়েছে। কেউ পাড়ি জমিয়েছে ভারত, কেউ থাকছে দেশের অন্যসব বিভাগীয় শহরে। আমি যেই আত্মীয়ের বাড়ি উঠেছিলাম, তাঁদেরও তখন ভেতরে ভেতরে চলছিল গ্রাম ছাড়ার প্রস্তুতি। এর কারণ শুধু একটাই, তা হলো, ক’দিন পরপর ডাকাতদের তাণ্ডবলীলার ভয়ে।

আমি যখন গিয়েছিলাম, তখন মাহাতাবপুর গ্রামে হিন্দু বাড়ি ছিল মাত্র চারটি। যেখানে আগে বাড়ি ছিল ২০-২২টি। এই চারটি বাড়ি বিক্রি হয়ে গেলেই পুরো গ্রামে আর কোনও হিন্দু বাড়ির নামগন্ধ থাকবে না। শুধু হিন্দুরা হয়ত থাকবে পুরানোদের মনের স্মৃতিতে।

যাইহোক, আমি পরিচিত একজনকে সাথে নিয়ে নিজেদের বাড়িতে ঘুরতে গেলাম। উদ্দেশ্য নিজেদের মাটির ঘরটি দেখার জন্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমি যাবার আরও অনেক আগেই আমাদের বাড়িতে থাকা মাটির ঘর দুটি মাটির সাথে বিলীন করে দেওয়া হয়েছিল। যেখানে ঘর ছিল, সেখানে সবজি ক্ষেত। পুরো বাড়িতে একটা টিনের চৌচালা ঘর মাত্র। সেই ঘরে থাকছে যিনি বাড়ি ক্রয় করেছিলেন, তাঁর এক নিকটাত্মীয়।

তাঁদের কাছে ভেজা চোখে আমি আমার নিজের পরিচয় দিলাম। আমাকে বসতে দিলেন। আমাদের রোপণ করা নারিকেল গাছ থেকে ডাব পেড়ে আমাকে আপ্যায়ন করলেন। আমাদের অবস্থাও জানলেন। দু’এক দিন থাকতেও বললেন। কিন্তু আমি আর থাকলাম না। মাটির ঘরের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে মাটি তুলে নিজের কপালে আর গায়ে মাথায় মেখে, চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমাদের বাড়ি থেকে চলে এলাম আত্মীয়ের বাড়ি। একরাত থেকে পরদিন আবার নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হলাম। এরপর আজ অবধি নিজের বাপদাদার ভিটেমাটিতে যাওয়া হয়নি। আর কোনদিন যাওয়া হবে কি-না তা জানি না। কিন্তু হৃদয়ে সেই মাটির ঘরটি আজও মনের টেলিভিশনের পর্দায় ছবি হয়ে রয়ে আছে।

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

12 thoughts on “মনের ভেতর মাটির ঘর

  1. কতকিছুই না জীবন থেকে হারিয়ে যায়। আহা জীবন !!! :(

    1. হ্যাঁ শ্রদ্ধেয় দিদি। একজীবনে কতকিছুই-না ঘটে যায়! আমার জীবনেও অনেককিছুই ঘটেছে দিদি। 

  2. 'মাটির ঘরের নির্দিষ্ট জায়গা থেকে মাটি তুলে নিজের কপালে আর গায়ে মাথায় মেখে, চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমাদের বাড়ি থেকে চলে এলাম।'

    কী পরিমান দুঃখ আর কষ্ট বোধ জীবনের সকল অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিতে পারে পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা না করলে ব্যথাটুকু অনুভব হবে না।  :(

    1. তবে হ্যাঁ, আর একবার নিজের বাপদাদার ভিটেমাটিতে যাবার আশা আছে শ্রদ্ধেয় দাদা। যদি আয়ুতে বের পাই-তো যাবো একসময়। 

  3. একটি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো বুক থেকে। :(

    1. যখন বাড়ির কথা মনে পড়ে, তখন খুবই কষ্ট হয় শ্রদ্ধেয় দাদা।

  4. আগ্রাসী সমাজ ব্যবস্থার উপর লাথি রাখতে ইচ্ছে করে। 

    1. আবার একসময় নোয়াখালী নিজের বাপদাদার ভিটেমাটিতে যাবার ইচ্ছে আছে দাদা। সাথে মোবাইল ফোন তো নিবোই! ছবি তুলবো, ভিডিও করবো। সেই ভিডিও ইউটিউবে আপলোড করে রেখে দিবো, চিরদিনের জন্য। 

  5. মনের ভেতর মাটির ঘর। যেখানে কেবলই নিঃস্ব নিঃসঙ্গতা। ভাল থাকুন দাদা। 

    1. আপনিও ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় দিদি। 

  6. নিজের সব পর হয়ে গেলে এই দুঃখ রাখার জায়গা পৃথিবীতে কম আছে। 

    1. খুবই কষ্ট হয় শ্রদ্ধেয় দাদা। আবার যাবো একসময়। ঘরের জায়গায় একটু গড়াগড়ি করে বাড়ির ধুলাবালি গায়ে মাখবো। এটা আমার মনে আশা দাদা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।