ছেলেধরা গুজবটি এদেশে নতুন কিছু নয়! অনেক পুরানো গুজব। সেই ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। আমার মতো এ গুজব আরও অনেকেই শুনেছে বলে মনে হয়। তবে ছোটবেলা থেকে এপর্যন্ত স্বচক্ষে কখনো সত্যিকারের ছেলেধরা দেখিনি। কেবল মানুষের মুখে মুখেই শুনে আসছি। সেই ছেলেধরা গুজব আবার নতুন করে এই বঙ্গদেশে শোনা যাচ্ছে। যা গত রমজান মাসের মাঝামাঝি থেকে ছেলেধরা, মাথাকাটার গুজব সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। ধারণা করা যায়, হয়তো ফেসবুকের মাধ্যমে এই গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
বর্তমানে যে কোনো গুজব রটানোর সহজ উপায় হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নামের ফেসবুক। এর কারণ হলো, ধনীর দুলাল থেকে শুরু করে বস্তির ছেলে পর্যন্ত সবাই ফেসবুক ব্যবহার করে থাকে। দেশের যেকোনো জরুরি সংবাদ জানতে কাউকে খবরের কাগজ সংগ্রহ করতে হয় না। ফেসবুকে লগইন করার সাথে সাথেই ফেসবুক নিউজ ফিডে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার খবর চোখের সামনে বিড়বিড় করতে থাকে। এর সাথে ফেসবুক বুন্ধুদের আপলোড করা খবরতো থাকেই। একারণেই গুজব রটনাকারীরা বর্তমান যুগের জনপ্রিয় যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে গুজব রটানোর হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাঁরা গুজব রটনাকারীরা অতি সহজে আজগুবি গাঁজাখুরি মিথ্যে খবর ফেসবুকের টাইমলাইনে পাবলিক করে দেয়। ফেসবুকে পাবলিসিটি হওয়া সেই খবর মুহূর্তেই অন্যসব বন্ধুরা শেয়ার করতে থাকে। এরপর খবরটি গুজবে পরিণত হয়ে ভাইরাল হয়ে যায়। গুজব রটনাকারীরা পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা প্রয়োজন এমন গুজব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করে থাকেন।
ছেলেধরা, গলাকাটা গুজব যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়লো, তখন সরকারের পক্ষ থেকে এ সম্পর্কে জনগণকে নানাভাবে সজাগ করেও দেওয়া হয়েছিলো। যা এখনো দেশের জাতীয় দৈনিক খবরের কাগজে, টেলিভিশনের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই এবিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে। তারপরও আমাদের সুষ্ঠু মন-মানসিকতার অভাবে, সত্যমিথ্যা যাচাই বাছাই না করার কারণে; বিভিন্ন স্থানে কেউ-না-কেউ ছেলেধরা গুজবে পড়ে গণপিটুনির শিকার হচ্ছে। এরমধ্যে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে।
বর্তমানে ছেলেধরা গুজব হলো এক আতঙ্কের নাম। যেই আতঙ্ক এখন বাঙলার প্রতি ঘরে ঘরে। প্রতিটি গ্রামে। প্রতিটি শহরে, হাটবাজারে। বর্তমানে ছেলেধরা গুজব ছড়িয়ে কেউ কেউ প্রতিপক্ষকেও ঘায়েল করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকদিনের মনের জ্বালা মেটাতেও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে অনেকে। প্রতিনিয়ত ঘটছে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মানুষ মারার ঘটনা। যা একরকম হীন মন-মানসিকতার পরিচয় দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এমনিতেই আমরা হুজুগে বাঙালি, গুজবে বিশ্বাসী। শোনা কথায় বেশি দৌড়াই। যেমন: চিলে কান নেওয়ার মতো ঘটনা। অথচ নিজের কানটা আছে কি-না, তা কেউ একটু হাত দিয়ে দেখে না। গুজবে বিশ্বাসীরা চিলকে ফলো করে চিলের সাথেই দৌড়ে মরছে।
গুজব শুধু গুজবই। এর আগেও একবার গুজবের জিকির উঠেছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত এক লোককে চাঁদে দেখা যাচ্ছে। সেই গুজব এমনভাবেই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তা আর লিখে শেষ করা যাবে না। চাঁদে দেখা গুজবের সময় দণ্ডিত লোকটির ভক্তবৃন্দদের মুখে শুধু শোনা যেত, হায় চাঁদ হায় চাঁদ, হায় নেতা, মহান নেতা। গুজবের উদ্দেশ্য ছিল দণ্ডিত ব্যক্তি অনায়াসে জেল থেকে মুক্ত করা। ভক্তরা মনে করেছিল হয়তো গুজবে বিশ্বাস করে সরকার তাঁদের নেতাকে মুক্ত করে দিবে। কিন্তু তা আর হয়নি। অথচ প্রতিদিন সন্ধ্যাকাশে চাঁদ মামার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কতো মানুষের যে ঘাড়ব্যথা হয়েছিল, তা এদেশে সকলেই জানে। সেই চাঁদ মামার গুজবের ইতি টানতে-না-টানতেই ইদানীংকালে শুরু হয়েছে কল্লাকাটা, মাথাকাটা, ছেলে ধরার মত গুজব। বাঙলায় একটা কথা আছে, ‘যাহা রটে, কিছু-না-কিছু ঘটে’। কিন্তু এ গুজব শুধু রটানোই হচ্ছে। রটনার সাথে ঘটে যাচ্ছে মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ প্রায় শেষপর্যায়ে পৌঁছেছে। এর মধ্যেই দেশের ক্ষতিসাধন করতে ইচ্ছুক কিছু মানুষ গুজব ছড়িয়ে দিয়ছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে মানুষের মাথা প্রয়োজন। এ ধরনের গাঁজাখুরি গুজব ছড়ানো এবং এরপর ছেলেধরা বা কল্লা কাটা বা গলাকাটা সন্দেহে গণপিটুনিতে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটানো হবে, তা কোনোভাবে বাঙলার মানুষ মেনে নিতে পারছে না। যারা এ ধরনের বেআইনি কাজ করছে, প্রশাসনের উচিত দ্রুত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা। পাশাপাশি দেশপ্রিয় মানুষেরও উচিৎ হীন মন-মানসিকতা পরিহার করা। গুজবে কান না দেয়া। আর আইন নিজের হাতে তুলে না নিয়ে, সরাসরি ৯৯৯ নাম্বারে ফোন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করা। প্রয়োজনে নিকটস্থ থানায় খবর দিয়ে ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা।
সমাজ এখন ব্যাপকহারে বিস্তার পেয়েছে। কিছুকাল আগেও ছিলো পরিবারের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা। এখন যেন প্রতিটি মানুষ একটি একটি করে পরিবার। চিন্তা আর বিবেকের ভাবনা গুলোও নিজস্ব। মানুষের মধ্যে চরম হতাশা। কিছু একটা করতে চায় অথচ সে নিজেও জানে না কি করবে।
যখন যা পায় তাই নিয়েই মেতে থাকতে চায়। সেই বাদর খেলায় গোল হয়ে বৃত্ত বানানো অলস সময়ের মতো, রাস্তার খোঁড়াখুঁড়িও চরম আনন্দ নিয়ে দেখার দিন হারিয়েছে।
আমাদের বিবেক থাকতেও আমরা যেন নিজের বিবেকের কাছেই অসহায়। তাই এই অসহায়ত্বের শিকার হচ্ছি শত মানুষের সামনে, লোকালয়ে, রাতে, দিনে, ভরদুপুরে।
গুজবে কান না দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করা উচিৎ। গুজব আর ভৌতিক বিষয়ে কান দেয়ার অভ্যাস কিন্তু বিশ্বজুড়ে। দেখতে হবে গুজব ছড়িয়ে লাভ হচ্ছে কাদের। কোন বিশেষ চক্রের দূরভিসন্ধী এখানে কাজ করছে কিনা সেটাই দেখা দরকার।
প্যানিক তৈরী করে আসল কাহিনী ঘটাতে চলিত সরকার যন্ত্রের কিন্তু জুড়ি মেলা ভার। মনে আছে শাপল চত্বর আর রেশমা উদ্ধারের গল্প। এরই মধ্যে ঘটে গেছে শেয়ার মার্কেটের টাকা লোপাটের ঘটনা।
ঘটছেও এমন! বোঝা বড় দায়। একে অপরকে করছে দোষারোপ। কখনো রাষ্ট্র বিরোধী দলকে, কখনো বা বিরোধীরা রাষ্ট্রকে। সেই সুযোগে কিছু মানুষ নিজেদের কলাকৌশল অবলম্বন করে ফায়দা লুটছে।জাঁতাকলের চিপায় পড়ছে নিরীহ মানুষ।
গুজব পুরো বাংলাদেশকে যেন টলমল করে তুলেছে। এটা ক্ষতিকর। থামাতে হবে।
বর্তমানে ছেলেধরা গুজবের সাথে যোগ হতে চলছে বিদ্যুৎ গুজব। এদেশে গুজবের শেষ নেই দাদা। এমন অবস্থায় পুরোহিতের মুখের বানী শুনলেও গুজব মনে হচ্ছে।
গুজব রটনাকারীরা অতি সহজে আজগুবি মিথ্যে খবর ফেসবুকের টাইমলাইনে পাবলিক করে দেয়। ইনবক্স করে। যাচাই করার ধৈর্য্য মানুষের মধ্যে নাই আজকাল।
আমাদের ভাঙলি জাতির ধৈর্য নেই বলেই মনে হয়। কাউকে যদি বলি, 'দাদা একটু ধৈর্য ধরুন।' লোকটি প্রশ্ন করে, 'ধৈর্য কাকে বলে?' তাহলে কি এখনে আর কোনও কথা চলে?
গুজব নয় সুযোগ। কেউ তো লাভবান হচ্ছে। মানুষকে বিভ্রান্ত করে উদ্দেশ্য হাসিল।
হ্যাঁ দাদা, তা-ই তো হচ্ছে। কেউ কেউ প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এই গুজবকে প্রতিশোধ নেওয়ার হতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করছে।
মানুষ কবে বুঝবে এসব?
বাঙালি বোঝে সবকিছু হারিয়ে। যেমন এখন বুঝতে শুরু করেছে রেনু হয়ার মূল হোতা হৃদয় নামের এক জালিয়াত।
দুঃখজনক অধ্যায়। মানুষ তখন সচেতন হয় যখন অনেক কিছুই ধ্বংস হয়।
তা-ই হচ্ছে শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি। এই গুজবে কয়েকটা জীবনই ধ্বংস হয়ে গেল। আর সরকারে সুনাম তো হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ।
গুজবে সরকারের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্পৃহতা আর অসহায় ভূমিকা লজ্জাস্কর ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথা বলছেন? ওরা তো টাকা খেকো। আর সরকার তো থাকে ভোটের দিকে তাকিয়ে। মরছি শুধু আমারা নিরীহ মানুষ।