তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-১
গল্পের প্রথম পর্বের শেষাংশ:
হিরা’র কথা শুনে সিপাহীরা বলছে, ‘কি মুশকিলে না পড়লাম রে ভাই! এই ধর ধর শালাকে। ওকে কোলে করেই নিতে হবে।’ এই বলেই চার পাঁচজন সিপাহী হিরা’কে আবার কাঁধে করে রাজদরবারে নিয়ে যেতে লাগলো।
সিপাহীরা ধরাধরি করে হিরা’কে কাঁধে চড়িয়ে রাজদরবারে নিয়ে গেল। রাজদরবারে নিয়ে হিরা’কে সিপাহীরা তাঁদের কাঁধের পর থেকে নামিলে বললো, ‘হুজুর, এই সেই লোক। যে আমাদের উজিরের গালে থাপ্পড় মেরেছে।’ রাজা সিপাহীদের জিজ্ঞেস বললো, ‘তা কি তোমরা জানো? সত্যি কি এই ছেলেটা আমার উজিরকে থাপ্পড় মেরেছে?’ রাজার কথায় সিপাহীদের মধ্যে একজন বললো, ‘হুজুর, আমরা উজির সাহেবকে থাপ্পড় দিতে দেখিনি ঠিক। কিন্তু এই ছেলেটি নিজেই স্বীকার করেছে।’
রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘কীভাবে সে নিজের ইচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিল যে ও নিজের উজরকে থাপ্পড় মেরেছে? তোমরা কি ছেলেটার গায়ে হাত উঠিয়েছ? ছেলেটাকে মারধর করেছো?’ সিপাহীরা রাজার এমন প্রশ্নে সবাই থমকে গিয়ে কাঁপতে শুরু করে দিল। রাজা আবার ধমক দিয়ে বললো, ‘তোমাদের জিজ্ঞাসা করেছি, ছেলেটা কীভাবে নিজের ইচ্ছায় স্বীকার করেছে, বলো!’
একজন সিপাহী বললো, ‘হুজুর, আপনার আদেশ পেয়ে আমরা যখন আপনার বাড়ির প্রধান গেইটের বাইরে গিয়ে খুঁজাখুঁজি করছিলাম, তখনই আমরা গেইটের সামনে ছেলেটকে দেখতে পাই। তখন গেইটের সামনে এই ছেলেটি ছাড়া অন্যকোনো লোক ছিল না। তাই আমাদের সন্দেহের চোখ যায় ছেলেটার দিকে। আমরা ছেলেটার সামনে গিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, তুমি কাউকে আমাদের উজির সাহেবকে থাপ্পড় দিতে দেখেছ? তখন ছেলেটি নিজেই বলতে লাগলো, “উজির না রাজা তা আমি চিনি না, গেইট থেকে বের হবার সময় থাপ্পড় একটা আমিই মেরেছি।” ছেলেটার মুখে এমন কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম, হুজুর! তারপর আমরা ছেলেটিকে ধরে ফেললাম। ছেলেটিকে ধরার পরও আরেক বিপদে পড়ে গেলাম!’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘ছেলেটিকে ধরার পর তোমরা কেমন বিপদে পড়লে শুনি!’ একজন সিপাহী বললো, ‘হুজুর, ছেলেটা যেসব কথা বলেছে, তা আমরা আপনার কাছে বলতে সাহস পাচ্ছি না।’
সিপাহীদের কথা শুনে রাজা ভাবতে লাগলো! এই ছেলেটা কেমন কথা বলতে পারে? যা সিপাহীরা বলতে সাহস পাচ্ছে না! নিশ্চয় মারাত্মক কোনও কথা বলেছে। যা সিপাহীরা বলছে না! যা-ই বলুক, তা আমার শুনতে হবে। এই ভেবে রাজা সিপাহীদের কাছে জানতে চাইলো, ‘তোমরা নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি জানতে চাই ছেলেটা কি এমন কথাবার্তা বলেছে। যা তোমরা সাহস করে বলতে পারছ না? বলো, শুনি!’ এক সিপাহী বললো, ‘হুজুর, ছেলেটা খুবই সাহসী এবং জেদি। ছেলেটাকে ধরে আমরা যখন বললাম, তোমার এতো বড় সাহস! তুমি আমাদের উজিরকে থাপ্পড় মেরেছ কেন? ছেলেটা তখন বললো, “উজির না হয়ে এখানে যদি তোমাদের রাজাও হতো, তাহলে উজিরে থাপ্পড় রাজার গালেই পড়তো।” আমাদের কথা যদি বিশ্বাস না হয় হুজুর, ছেলেটা আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। দয়া করে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করুন, আমরা কোনও কথা মিথ্যে বলছি কিনা। ছেলেটা হুজুর এ-ও বলেছে, “আগে জানলে তোমাদের উজিরকে আরও কয়েকটা থাপ্পড় মারতাম।”
‘এরপরও আমরা যখন ধরাধরি করে ছেলেটাকে আপনার দরবারের দিকে নিয়ে আসছিলাম, তখন ছেলেটা ছিল আমাদের সকলের কাঁধের উপর, হুজুর। আমাদের কাঁধের উপর বসে ছেলেটা বলতে লাগলো, “একটা থাপ্পড় মেরেছি তারজন্য তোমরা আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছ! আগে জানলে দুইটা থাপ্পড় মারতাম। তাহলে মনে হয় আমাকে পালকিতে চড়িয়ে নিতে।” ছেলেটার এসব কথা শুনে আমরা তখন আমাদের কাঁধের পর থেকে নিচে ফেলে দিলে আরেক বিপদ হয়, হুজুর। বিপদ হলো, ছেলেটা তখন মাটিতে বসে বসে চিল্লাচ্ছিল। কিছুতেই ছেলেটাকে বসা থেকে উঠাতে পারছিলাম না। উপায়ন্তর না দেখে এই হারামজাদা ছেলেটাকে আবার কাঁধে করে আপনার কাছে নিয়ে আসতে হলো, হুজুর। এখন আপনি নিজেই ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করুন! তারপর সুষ্ঠু বিচার করুন!’
সিপাহীদের সব কথা রাজা সিংহাসনে বসে বসে শুনলেন। শুনলেন দরবারে উপস্থিত নাজির, কোতোয়াল, পেশকার-সহ থাপ্পড় খাওয়া উজিরও। বুড়ো বয়সের উজির তখন গালে ধরে তাঁর আসনে নিরিবিলি চুপচাপ বসে আছে। রাজা সিপাহীদের কথা শুনে ভাবছে। হিরা চার-পাঁচজন সিপাহীদের মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজাকে ভালো করে দেখছে। সিপাহীরা তখন জবানবন্দি দিচ্ছিলো, তখনও রাজা শুধু বারবার হিরা’কে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। আর কি যেন ভাবছিল। এরই মাঝে উজির রাজার সিংহাসনের সামনে গিয়ে গালে থাপ্পড়ের স্থানে লেগে থাকা হিরা’র আঙুলের ছাপ দেখাতে লাগলো।
রাজাকে গালে লাগা থাপ্পড়ের দাগ দেখিয়ে বললো, ‘হুজুর, আমি এতো বছর আপনার দরবারে উজিরের দায়িত্ব নিয়ে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছি। আজ পর্যন্ত এমন থাপ্পড় আর কখনো খাইনি। দেখুন! দেখুন! আমার গালের অবস্থা কী হয়েছে, হুজুর। আপনি মহামান্য রাজা। আমি আপনার গোলাম। আপনার চাকরি করে এই বুড়ো বয়সে এই ছেলের হাতে থাপ্পড় খাওয়া কেমন লাগে, হুজুর? এর চেয়ে আমার মরে যাওয়াও ভালো। আপনি এর বিচার করুন!’ উজিরের কথা শুনে রাজা উজিরকে শান্তনা দিয়ে বললো, ‘উজির সাহেব আপনি শান্ত হোন। আমি এর বিচার অবশ্যই করবো। এর আগে ছেলেটার কাছ থেকে কিছু জেনে নেই, ছেলেটা কেন এবং কী কারণে এমন করেছে। ছেলেটার উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কেন ই বা এখানে এসেছে। আর কে ই বা আপনাকে থাপ্পড় মেরেছে। এসব কিছু আমি ছেলেটার মুখ থেকে শুনতে চাই।
এই বলেই রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার নাম কী?তোমার পিতার নাম কী? তোমার বাড়ি কোন গ্রামে? এখানে কেন এসেছ এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ? বল শুনি!’
রাজার জিজ্ঞাসা শেষ হবার সাথে সাথে হিরা তাঁর দুহাত জোর করে এক গ্লাস পানি চাইলেন। রাজা দরবারের খেদমতকারীকে হুমম দিলেন ছেলেটাকে এক গ্লাস পানি দিতে। খেদমতকারী হিরাকে পানি দিলেন। হিরা পরম তৃপ্তিতে পানি পান করলেন। এরপর দুহাত জোর করে বলতে শুরু করলেন, ‘রাজা হুজুর, আমি আপনার মুল্লুকের জয়পুর গ্রামে থাকি। আমার বাবার নাম আক্কেল আলি। আমি দেখেছি প্রতিবছর আমার বাবা আপনার দরবারে খাজনা দিতে আসে। একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তুমি কোথায় যাও! বাবা বললেন, “খাজনা দিতে যাচ্ছি রাজদরবারে।” আমি জানতে চেয়েছি কোথায় সেই রাজদরবার, আর কে সে রাজা? উত্তরে বাবা বললেন, “যার মুল্লুকে থাকি সে-ই হলেন রাজা। তাকেই প্রতিবছর নিজেদের জমিজমার খাজনা দিতে হয়। সেই রাজার রাজবাড়ীর রাজদরবার আমাদের গ্রাম থেকে আরও অনেক দূরে। কেন, তুমি কি যাবে?” আমি বাবাকে বললাম, তুমি এখন যাও! আমি একসময় একাই যাবো যাবো, বাবা। তারপর থেকে হুজুর আপনাকে একনজর দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠি। দিনরাত ভাবতে থাকি আপনাকে নিয়ে। কারণ, আপনার মুল্লুকে থাকি। আপনার নুন খাই। আপনাকে একনজর না দেখলে আমার এই জীবনই বিফলে যাবে ভেবে আমি আপনার রাজবাড়ির গেইটে আসি।
‘গেইটে টোকা দেই, সাড়াশব্দ নেই। এভাবে আমি দুইদিন আপনার বাড়ি গেইটে না খেয়ে গেইট খোলাখুলির অপেক্ষায় থাকি। আজকে সকালে প্রতিজ্ঞা করি গেইট থেকে যে-ই বের হবে তাকেই একটা থাপ্পড় মারবো। সকাল ৮টায় যখন গেইটের ভেতর থেকে ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছিল, তখন আমি আমার শক্ত হাতে আরও শক্তি সঞ্চার করে রেডি হয়ে থাকি। তারপর গেইট থেকে একজনকে মাথা বের করতে দেখেই সাথে সাথে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই। এখন জানলাম থাপ্পড় খাওয়া লোকটি আপনার সম্মানিত উজির সাহেব। আপনার কাছে মাপ চেয়ে বলছি, সেসময় উজিরে জায়গায় যদি আপনি হতেন; উজিরের থাপ্পড়টা আপনার গালেই পড়তো, হুজুর! কিন্তু আপনার ভাগ্য খুবই ভালো, আপনি সে-সময় সে-জায়গায় ছিলেন না। মানের মান মহান সৃষ্টিকর্তাই রাখে হুজুর। যাইহোক, এখানে আমার আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো শুধু আপনাকে একনজর দেখা। এছাড়া আর কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আমার ছিল না, হুজুর! এখন আপনার বিচারে আমি যদি দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকি তো, আমাকে আপনি যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন; তা আমি মাথা পেতে নিবো।’
হিরা’র কথা শুনে রাজার খুবই ভালো লাগলো। আবার ভীষণভাবে ভাবতেও লাগলো! ভেবেচিন্তে রাজা হেসে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার মতো এমন দু-চারটে ছেলে আমার মুল্লুকে খুবই কম আছে। তবে তুমি আমার উজিরকে থাপ্পড় মেরে যেই অপরাধ করেছ, তার সাজা তোমাকে বেশি নাহয় একটু হলেও পেতে হবে।’ রাজার কথা শুনে বুড়ো উজির সাহেব খুবই খুশি হলেন। রাজদরবারে থাকা সবাই হাততালি দিলেন। হিরা চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলো, সাজা থেকে কীভাবে বাঁচা যায়!
তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩
চলবে…
আজকের পর্ব শেষ থাপ্পরের কাহিনী বর্ণনায়। হিরা’র জন্য রাজার সাজা জানতে হবে।
হিরা'র সাজা মনে হয় হবে না দাদা। কারণ, হিরা খুবই চালাক ছেলে। শেষতক মনে হয় হিরা'র সাজা মওকুফ করা হবে এবং রাজা নিজেই হিরা'র কাছে ক্ষমা চাইতে পারে। দেখা যাক সামনে কী হয়!
কোন সন্দেহ নাই। মুগ্ধকর গল্প হতে চলেছে।
আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থাকবেন, শ্রদ্ধেয় দাদা।
সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছিলাম। অনেক রাতে পোস্ট দিলেন। পড়লাম দাদা।
যাক! পড়েছেন শুনে খুশি হলাম দিদি। আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থেকে উৎসাহ দিবেন।
মাথায় নিয়ে নিলাম কবি নিতাই বাবু। অপেক্ষা ……………
চেষ্টা করবো তাড়াতাড়ি শেষ করতে দাদা। আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থেকে উৎসাহ দিবেন।
তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন। এখনো না তখনো না। হিরা ভার্সেস রাজা।
রাজার খবর আছে দিদি। হিরা হবে হিরো নাম্বার ওয়ান।
* চমৎকার গল্প পড়লাম….
পড়েছেন শুনে খুবই খুশি হলাম শ্রদ্ধেয় দাদা। আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থাকবেন।
পড়লাম ভাল লাগলো দাদা এখন অপেক্ষার পালা, শুভেচ্ছা
আপনাকেও শুভেচ্ছা। আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থেকে উৎসাহ দিবেন।
দুটো পর্বই পড়লাম। খুবই মজার কাহিনি!
পড়েছেন শুনে খুবই খুশি হলাম শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থাকবেন। শুভকামনা থাকলো।