ট্যাগ আর্কাইভঃ এখন

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৫ শেষ পর্ব

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪

চতুর্থ পর্বের শেষাংশ:
উজির সাহেব সব সদাই গুলো বাজারে রেখে চলে এসেছে। তাই আর পয়সার কেনা সদাই গুলো আনা হলো না। কী আর করা! যাই দরবারে। হিরা চললো রাজদরবারের দিকে।

প্রহরীর সাথে কথা বলে হিরা যাচ্ছে রাজদরবারে। হিরা’র পিছনে পিছনে গেইটের প্রহরীও গেইট ফেলে রেখে দরবারের দিকে ছুটলো। প্রহরীর উদ্দেশ্য উজির আর ছেলের বাজারের কাহিনী শোনার জন্য। আর উজির সাহেব তো আগেই দরবারে এসে রাজার কাছে হিরা বিষয়ে সব বৃত্তান্ত খুলে বলেছে। উজিরের মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে রাজাও একটু দুশ্চিন্তায় আনমনে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল, আর ভাবছিল।

এমন সময় হিরা রাজদরবারে এসে হাজির। পিছনে পিছনে গেইট প্রহরীও। হিরা’কে দেখেই উজির জোরে চিৎকার করে বলতে লাগলো, ‘এই যে হুজুর বাটপারটা এসেছে। মনে হয় আবার পয়সা তিনেক নেওয়ার জন্যই দরবারে এসেছে। দিবেন না হুজুর, দিবেন না। আর একটি পয়সাও দিবেন না। আপনি পয়সা দিলেন সদাই কেনার জন্য। আপনার দেওয়া সেই পয়সা দিয়ে জিলাপি কিনে খায়। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়। রূপবান গানের ড্যান্স দেখে বকশিস দেয়। কাকে যে সদাই আনতে দিলেন হুজুর, এটা আমার মাথায় কিছুতেই খেলছে না। শেষপর্যন্ত আমাকে থাপ্পড় মারার বিচারটাও করলেন না, হুজুর।’ এই বলেই উজির হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। রাজা উজিরকে শান্তনার সুরে থামতে বললেন।

এরপর রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, এই ছেলে, ‘আমার উজির যা বলেছে, তা কি ঠিক?’ হিরা বললো, ‘হ্যা, রাজা হুজুর। আপনার উজির সাহেব যা বলেছে সবই সত্যি।’ রাজা বললেন, ‘তাহলে আমার পয়সা তুমি খেয়ে ফেলেছ?’ হিরা বললো, ‘হ্যা, হুজুর। আমি পয়সা খেয়ে সদাইও কিনেছি।’ হিরা’র কথা শুনে উজির তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো! উজির ধমক দিয়ে বললো, ‘এই বেটা মিত্থুক! কখন সদাই কিনলি? তুই বেটা এক পয়সার জিলাপি খাইলি। এক পয়সা ফকিরকে দিলি। আর এক পয়সা দিলি কোমড় ঢুলানি ড্যান্স দেইখা। তিন পয়সা তো এখানেই শেষ! আবার সদাই কিনলি কোত্থেকে? এই বেটা, সদাই কই? সদাই বের কর? এখানে বাটপারি করতে আসছ? তেরো সিকে ঢুকাইয়া রাখুম, বুঝলি!’

উজিরের বাড়াবাড়িতে রাজা ধমক দিয়ে উজিরকে থামিয়ে হিরা’কে বললো, ‘এই ছেলে, সদাই যদি কিনেই থাক, তাহলে সদাই কোথায়? সদাই বের করো। নাহয় পয়সা বের করো! যেই তিন পয়সা তোমাকে দিয়েছি, সেই তিন পয়সা দিয়ে এক মুল্লুকের জমি কেনা যায়। তুমি বাবা সদাই দাও, নাহয় পয়সা বের করো।’ রাজার কথায় হিরা কিছুই বলছে না। হিরা চুপ চোরের মতো এক কোণে করে বসে আছে।

উজির হিরা’র দিকে টগবগিয়ে চাচ্ছে আর বলছে, ‘রাজা হুজুর, আপনি ও-কে বন্দি করে কারাগারে ঢুকিয়ে রাখুন। সকালে ওঁর ঠিকানামতো ওঁদের বাড়িত্তে গিয়ে, ওঁর বাবাকেও তিন পয়সা বাটপারির দায়ে বন্দি করে নিয়ে আসবো। তারপর পরের পয়সা দিয়ে জিলাপি খাওয়া বের করবো।’ এবার হিরা বসা থেকে উঠে হাত দুটো জোড় করে বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনি আমাকে সদাই তিনটি কী কী যেন আনতে বলেছিলেন? দয়া করে আবার একটু বলুন, সবাই শুনুক! আমি ঠিক মনে করতে পারছি না।

রাজা বললো, ‘ওহ্! আচ্ছা, মনে হয় তুমি সদাই তিনটির নাম ভুলে গিয়েছ। তাহলে শুনো, আবারও বলছি! এক পয়সার এখন। এক পয়সার তখন। আর এক পয়সার এখনো না তখনো না। এবার শুনলে তো?’ হিরা বললো, ‘তাতো আমি এনেছি হুজুর! সদাই গুলো সব আপনার উজিরের কাছে আছে।’ এই কথা শুনেই উজির বসা থেকে দৌড়ে গিয়ে হিরা’র গলা চেপে ধরে বললো, ‘এই বেটা মিত্থুক! আমার কাছে সদাই দিছস কখন? তুই বেটা আমাকে জিলাপি খাওয়াতে চাইলি, তাওতো আমি খাইনি! এখন বলছিস সদাই আমার কাছে?’ রাজা ধমক দিয়ে উজিরকে থামিয়ে বললো, ‘এই ছেলে, উজির সাহেবের কাছে সদাই গেলো কীভাবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমি যা করেছি, আপনার উজির সাহেবের সামনা-সামনিই করেছি। তাই সদাই তিনটিও উজির সাহেবের সহযোগিতায় করা হয়েছে।’ উজির উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘কই, সদাই কই হে? জিলাপি খাও! ফকিরকে দাও! ড্যান্স দেখো! আবার সদাই কিনছে? বেটা বাটপার।’

রাজা বললো, ‘কখন কীভাবে সদাই কিনলে? আর আমার উজির সাহেবের কাছেই বা কখন দিলে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, উজির সাহেব-সহ যখন আপনার বাড়ির সামনে বউ বাজার গেলাম। বাজারে ঢুকতেই দেখি এক লোক জিলাপি ভেজে রেখেছে। উজির সাহেবকে বললাম, আমি জিলাপি খাব। উজির সাহেব জিলাপি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো, জিলাপি গরম না ঠান্ডা? জিলাপি বিক্রেতা বললো, একেবারে টাটকা গরম জিলাপি। এখন ভেজে রেখেছি, এখন। উজির সাহেব একপোয়া জিলাপি দিতে বললেন, জিলাপি বিক্রেতা একপোয়া জিলাপি মেপে দিলেন। আমি এক পয়সা জিলাপির দাম দিয়ে দিয়ে মনের আনন্দে জিলাপি খেতে শুরু করলাম। এই হলো আপনার তিনটি সদাই’র মধ্যে একটি সদাই, ‘এক পয়সার এখন’। কারণ, জিলাপি বিক্রেতা বলেছিল, এখন ভেজে রেখেছি এখন। তাই আপনার একটি সদাই, এখন।’

হিরা’র কথা শুনে উজির সাহেব এখন ভাবছে! আর মনে মনে বলছে, হায়! হায়! ঠিকই তো! রাজা তো এই এখনের কথাই বলছিল। এটা তো আমিও পারতাম! ছেলেটা তো ঠিকই করেছে।

হিরা’র কথা শুনে রাজা বললো, ‘তা মেনে নিলাম। বাদবাকি সদাই গুলোর হিসাব দাও।’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, জিলাপি খাচ্ছি আর হেঁটে যাচ্ছি বাজারে ভেতরে। আপনাদের এখানকার বাজার খুবই সুন্দর হুজুর। হেঁটে হেঁটে দেখছিলাম। এমন সময় এক ভিক্ষুক আমার কাছে ভিক্ষা চাইলো। যখন ভিক্ষুক ভিক্ষা চাইলো তখন আমি ভিক্ষুককে এক পয়সা ভিক্ষা দিয়ে দিলাম। এই হলো আপনার তিনটি সদাই’র মধ্যে দ্বিতীয় সদাই, এক পয়সার তখন।’

এরপর গেলাম আপনার বউ বাজারের শেষ মাথায়। সেখানে যেতেই কানের সামনে বাজনার আওয়াজ এলো। একটু সামনে গিয়ে দেখি মানুষ গোলাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে নাচগান চলছে। আমি হুজুর নাচগানের পাগল। তাই আর বাইরে থাকতে পারিনি। ঠেলেঠুলে ভেতরে গেলাম। রূপবান গানের সাথে এক হিজরার ড্যান্স দেখে নিজেও কিছুক্ষণ নাচলাম। চমৎকার ড্যান্স হুজুর। আপনার উজির সাহেবও দেখেছে। উনি আমার পিছনেই ছিল। একসময় যখন ড্যান্স শেষ হলো, সবাই সবার সাধ্যমতো এক পয়সা আধা পয়সা করে হিজরাকে বকশিস দিচ্ছিলো। তা দেখে আমিও সাথে থাকা এক পয়সা হিজরাকে বকশিস দিয়ে দেই, হুজুর। আপনার দেওয়া তিন পয়সার মধ্যে এই এক পয়সার হিসাব পাপপুণ্য বা ইহকাল পরকালের কোনও কাজে লাগেনি। তাই এটা জাহান্নামই গেলো হুজুর। এটা হলো আপনার তিন পয়সার তিনটি সদাই’র মধ্যে তৃতীয় সদাই, এখনো না তখনো না। এই বলেই হিরা উজিরকে জিজ্ঞেস করছে, কি উজির সাহেব, আমি কি মিথ্যে কিছু বলেছি?’

উজির বোকার মতো চুপ করে বসে বসে ভাবছে, এই সদাই তো আমি নিজেও করতে পারতাম। কেন যে বোকার মতো অপারগতা স্বীকার করলাম! পারবো না বলে ছেলেটার হাতে ছেড়ে দিলাম! হায়রে কপাল আমার! এখন ছেলেটাই তো রাজ্যের সব নিয়ে নিবে!

হিরা’র কথা শুনে রাজা এবার মনে মনে ভাবলো, ছেলেটা তো আমার তিন পয়সার তিনটি সদাই ঠিকই কিনে ফেলেছে। এখন যদি আমি বলি সদাই তিনটি ঠিক হয়েছে, তাহলে তো আমার রাজ্যের অর্ধেক ছেলেটার হাতেই চলে যাওয়ার সম্ভাবনা। না, তা হতে দেওয়া যাবে না। এই ভেবেই রাজা বললো, ‘শুনো ছেলে, এই তিনটি সদাই’র মধ্যে শেষ সদাইটি এভাবে হবে না। এটা অন্যভাবে হবে। তিনটি সদাই’র মধ্যে তুমি দু’টি সদাই ঠিকমতো করতে পেরেছ। তৃতীয় সদাইটি ঠিকমতো করা হয়নি।’

রাজার কথা শুনে দরবারে উপস্থিত সবাই চুপ হয়ে হেল। কেউ খুশি হলো। কেউ রাগ হলো কেউ আবার দুঃখও পেলো। উজির এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলো, ছেলেটা তো সদাই তিনটি ঠিকমতোই করেছে। কিন্তু, রাজা এখন অস্বীকার করছে কেন? ছেলেটা যদি কিছু বকশিস পায়, তাহলে তো আমিও সেই বকশিস থেকে কিঞ্চিৎ কিছু পেতাম। তা যে-ভাবেই হোক ছলে-বলে কলেকৌশলে ছেলেটার কাছ থেকে আদায় করতাম। কিন্তু রাজার কথায় মনে হচ্ছে, সব আশাই আমার বিফলে যাচ্ছে। তারপরও দেখা যাক, কী হয়! এই ভেবে উজির কালো মুখ করে হিরা’র দিকে চেয়ে থাকলেন।

হিরা রাজার কথা শুনে বললো, ‘রাজা হুজুর, তা যদি আপনার মনোমত না হয়। তাহলে তো আমার কিছুই করার থাকলো না। দয়া করে আমাকে মাপ করে দিন। যদি তিন পয়সার জন্য আপনার কোনও দাবি থাকে তাও বলুন! আমি আমাদের বাড়িতে গিয়ে আপনার দেওয়া তিন পয়সা জোগাড় করে নিয়ে আসবো। তবে এরজন্য আমাকে অন্তত তিনদিন সময় দিতে হবে হুজুর।’ এই বলেই হিরা রাজদরবার থেকে বের হয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিলো।

রাজাও দরবারে বসে বসে ভাবতে লাগলো, এরকম মিথ্যা কথা বলা আমার ঠিক হয়নি। ছেলেটা তো আমার কথামতো তিনটি সদাই ঠিকই করেছে। কিছু চাওয়া-পাওয়ার জন্য এমন একটা বুদ্ধিমান ছেলেকে হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এই ভেবে মনস্থির করলো হিরা’কে ফিরিয়ে আনতে ডেকে পাঠাবেন, উজিরকে। কিন্তু হিরা ততক্ষণে রাজবাড়ি থেকে অনেকদূর চলে গেছে। রাজা উজিরকে বললেন, ‘উজির সাহেব, আপনি ছেলেটাকে ডেকে আনুন! আমি ছেলেটাকে উপযুক্ত বকশিস দিবো। এমনকি, ছেলেটা যা চাইবে, তা-ই দিবো। ডাকুন ছেলেটাকে! এই বুদ্ধিমান ছেলেটাকে আমি কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাই না। আপনি তাড়াতাড়ি গিয়ে ছেলেটাকে ডেকে আনুন।’ রাজার উপদেশ পেয়ে উজির সাহেব মনের আনন্দে দৌড়াতে শুরু করলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে মনে মনে বুদ্ধি করলেন, ‘যে-করেই হোক, ছেলেটার কাছ থেকে বকশিসের অর্ধেক আমার পেতেই হবে।’

আসলেন গেইটের সামনে। প্রহরী বললো, ‘উজির সাহেব, তাড়াতাড়ি দৌড় দেন! ছেলেটাকে ফিরিয়ে আনুন! ছেলেটা বকশিস পেলে আমিও কিছু বকশিস পেতে পারি। যান যান হুজুর, তাড়াতাড়ি যান।’ গেইট থেকে বের হয়ে উজির দৌড়াচ্ছে। হিরাও হেলেদুলে হেঁটে যাচ্ছে। উজির দৌড়ে গিয়ে হিরা’র সামনে গিয়ে বললো, ‘বাবারে, অনেক কষ্ট করে রাজাকে রাজি করিয়েছি। এখন তুই বাবা যা চাস, তা-ই পাবি! কিন্তু বাবা আগে আমার সাথে তোর একটা শর্ত করতে হবে৷’ হিরা বললো, ‘কী শর্ত করতে হবে উজির সাহেব? তা আমাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন!’ উজির বললো, ‘তুই বাবা যা পাবি, তার অর্ধেক আমাকে দিতে হবে। আমি বাবা রাজাকে তেল মাখতে মাখতে হাত দুটো বিষ করে ফেলেছি। আমি যদি রাজাকে না বলতাম, তাহলে রাজা আর রাজি হতো না, তোর কপালেও আর বকশিস জুটতো না। এখন বল, তুই আমার সাথে শর্ত করতে রাজি কি-না?’

হিরা হাসতে হাসতে বললো, হ্যাঁ উজির সাহেব, আমি রাজি আছি। তো, এভাবে মুখের কথার কোনও গ্যারান্টি নেই। কিছুক্ষণ পর হয়তো বকশিস পেয়ে আমিও অস্বীকার করতে পারি। সেজন্য একটা কাগজে লিখে সই-স্বাক্ষর করে রাখা ভালো।’ উজির মনের আনন্দে রাজি হয়ে গেলেন। হিরা একটা দোকান থেকে এক টুকরো সাদা কাগজ সংগ্রহ করে কাগজে লিখল, “রাজা থেকে আমি যা পাবো, তার অর্ধেক সম্মানিত উজির সাহেব পাওনা।” এরপর লেখার নিচে উজিরের স্বাক্ষর রাখলো।

এদিকে রাজবাড়ির গেইট প্রহরী গেইট খুলে আগে থেকেই তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে, কখন উজির-সহ ছেলেটা আসবে। উজির-সহ হিরা যখন রাজবাড়ির গেইটের সামনে আসলো, গেইট প্রহরী হিরা’কে বললো, ‘বাবারে, তোর জন্য রাজাকে অনেক তেল মালিশ করেছি। এখন তুই যা পাবি আমাকে অর্ধেক দিবি। বকশিস কিন্তু আমার কারণেই পাচ্ছিস।’ হিরা বললো, ‘আমি যা পাবো তা থেকে তো অর্ধেক উজির সাহেবকে দিতে হবে। তাহলে আপনাকে আমি কীভাবে অর্ধেক দিবো?’ প্রহরী বললো, ‘তাহলে উজির সাহেবকে অর্ধেক দিয়ে যা থাকে, তার অর্ধেক আমাকে দিবি।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। তবে এই কাগজে একটা স্বাক্ষর দিতে হবে।’ গেইট প্রহরী মনের আনন্দে সাদা কাগজে স্বাক্ষর দিয়ে গেইট ফেলে তিনজন মিলে চললো রাজদরবারের দিকে।

তিনজন মিলে দরবারে যেতেই দেখা হয় এক মহিলার সাথে। তিনি রাজবাড়ির পরিচ্ছন্নতা কর্মী। সেই মহিলা হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘বাবারে, তোর জন্য রাজাকে অনেক তেল মেখেছি। তারপরও রাজা কি-আর রাজি হয়! অনেকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছি তোকে বকশিস দিতে। এখন বাবা তুই যা পাবি, আমাকে এর অর্ধেক দিবি।’ হিরা হেসে বললো, ‘আমার বকশিসের ভাগিদার আপনার মতো আরও দুইজন আছে। তাহলে আপনাকে দিবো কীভাবে?’ পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলা বললো, ‘তাঁদের দিয়ে থুইয়ে যা থাকে, তার অর্ধেক দিলেই হবে বাবা।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে তা-ই হবে। এখানে একটা স্বাক্ষর দিন!’ পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলা স্বাক্ষর জানতেন না। তাই কলমের কালি মহিলার বৃদ্ধাঙ্গুলিতে লাগিয়ে টিপসই নিয়ে নিলো। এবার চারজন গিয়ে হাজির হলো রাজদরবারে।

রাজদরবারে তখন অনেকেই উপস্থিত ছিল। যত লোকই থাকুক-না-কেন, হিরা’ই এখন দরবারের হিরো। সবার দৃষ্টি হিরা’র দিকে। হিরা’কে রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘এই ছেলে, বাজার থেকে তোমার এনে দেওয়া তিন পয়সার তিনটি সদাই আমি খুশি মনে গ্রহণ করেছি। আমি যা চেয়েছি আর যেভাবে চেয়েছি, তুমি ঠিক সেভাবেই করতে পেরেছ। তাই আমি তোমাকে উপযুক্ত বকশিস দিতে চাই। এখন বলো তুমি কী চাও! তুমি এখন এই মুহূর্তে যা চাইবে তা-ই আমি তোমাকে দিতে রাজি আছি। বলো তুমি কী চাও!’

রাজার এই ঘোষণা শুনে উজির হিরা’র কানে কানে গিয়ে বললো, ‘বাবারে, ‘তুই বাবা রাজার সিংহাসনটা চা! তাহলে আমি রাজ্যের অর্ধেক পেয়ে যাবো। এই রাজার উজিরগিরি আর ভালো লাগে না। তুই বাবা তাড়াতাড়ি সিংহাসনটা চা।’ উজিরের এরকম পরামর্শে হিরা বললো, ‘চাচ্ছি উজির সাহেব, চাচ্ছি! চাইতে আমি আর কম চাচ্ছি না। একটু বেশি করেই চাচ্ছি। যাতে আপনাদের দিয়ে আমারও কিছু থাকে।’ হিরা’র কথা শুনে উজির খুশিতে তাইরে-নাই-রে নাই-রে-না করে নাচতে লাগলো!

হিরা’র চাইতে দেরি দেখে রাজা বললো, ‘কী ব্যাপার! চাও তুমি, কী চাইবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, চাইতে আমার কেমন যেন দ্বিধাবোধ হচ্ছে। আমি যা চাইবো, তা যদি আপনি না দেন, তাই।’ হিরা’র এমন কথায় রাজা খুব রেগে বললো, ‘কি, আমার মুখের কথার কি কোনও দাম নেই? চাও তুমি কী চাইবে!’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনার কাছে ধনসম্পত্তি, রাজ সিংহাসন এসব কিছুই চাই না।’ রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে তুমি কী চাও? যা-কিছুই চাও, তা-ই তোমাকে দেওয়া হবে। বলো কী চাও!’ হিরা বললো, রাজা হুজুর, ‘আমি আপনার দরবারে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি চাই!’

হিরা’র মুখে এই কথা শুনে রাজা-সহ উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে হিরা’র দিকে তাকিয়ে রইল। উজির কাঁপতে কাঁপতে হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘আরে বাবা, তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে?’ হিরা উজিরের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে আবারও বললো, ‘রাজা হুজুর, ‘আমাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি দেওয়ার ঘোষণা দিন!’

রাজা অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে ভেবে দেখলো, ছেলেটার জুতার বাড়ি চাওয়ার পিছনে কোনও কারণ থাকতে পারে। তাই ছেলেটা জুতার বাড়ি চাচ্ছে। দেখি এর পিছনে কী থাকতে পারে? এই ভেবে রাজা বললো, ‘ঠিক আছে, আমি আজকে এ-ই দরবারে সকলের উপস্থিতিতে ঘোষণা দিচ্ছি, তোমাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়িই দেওয়া হবে।’ রাজা ঘোষণা দেওয়ার পর উজির কাঁপতে কাঁপতে মেঝেতে বসে কপালে থাপ্পড় মারতে লাগলো। গেইট প্রহরী রাজ দরবার থেকে বাইরে যেতে চাইলে, হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, জুতার বাড়ি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনার রাজদরবার থেকে কেউ যেন বের হতে না পারে। দয়া করে আপনি তাড়াতাড়ি ঘোষণা দিন!’

হিরা’র জুতার বাড়ি চাওয়ার বিষয়টি আর রাজার বুঝতে অসুবিধা হলো না। রাজা দরবারের গেইটে থাকা দুইজন সিপাহিকে বললো কেউ যেন দরবার থেকে বেরুতে না পারে। যেই কথা সেই কাজ। দরবারের গেইট মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল। জুতার বাড়ি দেওয়ার জন্য জল্লাদ এসে হাজির হলো। (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি মারার জন্য রাজার পুরানো গোডাউন থেকে রাজার বাপদাদার চোদ্দগুষ্টিদের ব্যবহার করা সব পুরাতন জুতা খুঁজে বের করে দরবারে আনা হলো। জুতার বিশাল স্তুপ দেখে উজির-সহ গেইট প্রহরী আর পরিচ্ছন্নতা কর্মী মহিলার এখন জীবন যায় যায় অবস্থা! এর মধ্যে উজির কয়েকবার অজ্ঞানও হয়ে যাচ্ছিল।

রাজা জল্লাদকে হুকুম দিলো, ‘এই জল্লাদ, ছেলেটাকে (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি মারো।’ রাজার হুকুম পেয়ে জল্লাদ দুইহাতে দুটি জুতা নিয়ে হিরা’র দিকে এগুতেই, হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমার কিছু কথা আছে। রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী কথা?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, এই বকশিস’র মধ্যে কিছু ভাগবাটোয়ারা আছে।’ রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘জুতার বাড়ির মধ্যে কেমন ভাগা-ভাগি থাকতে পারে?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, আমাকে এই বকশিস দেওয়ার জন্য আপনার উজির নাকি আপনাকে তেল মালিশ করে রাজি করিয়েছে? তাই উনি আমার কাছে বকশিস’র অর্ধেক দাবি করেছে। দেখুন, আমার সাথে উজিরের শর্ত করার কাগজ। যেই কাগজে আপনার উজিরের স্বাক্ষর আছে। তাই আমি উনার সেই দাবি পূরণ করতে চাই, রাজা হুজুর। দয়া করে (৫.০০০) পাঁচ হাজার জুতার বাড়ি আপনার সম্মানিত উজিরকে আগে দেওয়া হোক। হিরা’র কথামতো রাজা তা-ই হুকুম দিলেন। জল্লাদ আগেকার দিনের পুরাতন জুতা দিয়ে ঠাস্ ঠাস্ করে শখানেক বাড়ি উজিরের গালে মাথায় বসিয়ে দিলেন। উজিরের এখন জীবন যায় যায় অবস্থা। শেষতক হিরা’র অনুরোধে পাঁচ (৫.০০০) হাজার জুতার বাড়ি থেকে বাকি থাকা সব মাপ করে দিলেন। জল্লাদ বেটা জুতা মারা বন্ধ করলেন।

রাজা আর বাদবাকি (৫.০০০) জুতার বাড়ি ছেলেটাকে মারতে বললে, হিরা তাতেও আপত্তি জানিয়ে বলে, ‘রাজা হুজুর, এই (৫.০০০) পাঁচ হাজারের মধ্যেও ভাগ আছে।’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘ভাগটা কাকে দিতে হবে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, এই ভাগিদার হলো আপনার গেইট প্রহরী।’ রাজা অবাক হয়ে বললো, ‘এই গেইট প্রহরী মানে দারোয়ান। দারোয়ানও তোমার কাছে বকশিসের ভাগ চেয়েছে?’ হিরা বললো, ‘হ্যাঁ রাজা হুজুর! উনিও নাকি আমার বকশিসের জন্য আপনাকে তেল মেখেছে? তাই উনাকেও থেকে যাওয়া বাদবাকি বকশিসের অর্ধেক দিতে হচ্ছে।’ রাজা রেগে-মেগে জল্লাদকে বলললো, ‘ও-কে আড়াই হাজার জুতার বাড়ি খুব জোরে জোরে মারবে। রাজার আদেশ বলে কথা। তাই জল্লাদ গেইট প্রহরীকে ঠাস্ ঠাস্ করে দুইহাতে মারতে শুরু করলো। শখানেক মারার পর গেইট প্রহরীর জীবন যায়। তখন হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, গেইট প্রহরীকে মাপ করে দিন।’ হিরা’র কথামতো রাজা মাপ করে দিয়ে জল্লাদকে বললো, ‘থেকে যাওয়া বাকি আড়াইহাজার জুতার বাড়ি ছেলেটাকে মারো।’

হিরা বললো, রাজা হুজুর, আরও একজন ভাগীদার আছে।’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘সে কে?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আপনার রাজবাড়ির পরিচ্ছন্নতা কর্মী এই মহিলা।’ রাজা একেবারে ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন, ‘এই সুইপার মহিলাও তোমার কাছে ভাগ চেয়েছে? কী আশ্চর্য! আমার দরবারে কি সবাই চোর বাটপার? এতো দিন মনে হয় এঁরা রক্তচোষা হয়ে আমার রক্ত তো চুষে খেয়েছেই, সাথে আমার রাজ্যের সকলের রক্ত চুষে খেয়েছে। কিন্তু আমি তা বুঝতে পারিনি। আজ তোমার কারণে সবাইকে আমার চেনা হয়ে গেল। এই বলেই জল্লাদকে বললো, ‘এই সুইপার মহিলাকে পুরো ১২৫০ টি জুতার বাড়ি মেরে, আরও ৫০টি জোতা বেশি মারবে। একটিও যেন কম না হয়।’ জল্লাদ সাথে সাথে শুরু করে দিল ঠাস্ ঠাস্ ঠাস্ ঠাস্ বাড়ি। সুইপার মহিলা মরে যাবে ভেবে হিরা গিয়ে জল্লাদের হাতে ধরে জুতার বাড়ি থামালেন। জল্লাদ থামলেন।

এবার হিরা রাজাকে বললো, ‘রাজা হুজুর, (১০.০০০) দশ হাজার জুতার বাড়ি থেকে আর যা বাকি আছে সব আমাকে মারতে হুকুম দিন।’ এই বলেই হিরা তাঁর শরীরের জামা খুলে খালি গায়ে দরবারের মাঝখানে দাঁড়ালো। তখন রাজা সিংহাসন থেকে নেমে এসে হিরা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘আজ থেকে তুমিই আমার এই সিংহাসনে বসবে। আমি যে ক’দিন বেঁচে থাকি, তোমার পাশে বসে থাকবো। আজ থেকে তুমিই রাজ্যের রাজা। আমি তোমার প্রজা।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-১

এখানেই সমাপ্তি।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩

তৃতীয় পর্বের শেষাংশ:
উজির আর কোনও কথা বললেন না, মাথা নেড়ে যাবে বলে জানিয়ে দিলেন। হিরা রাজার কাছ থেকে তিন পয়সা নিয়ে পকেটে ভরলো। এরপর উজিরকে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো।

হিরা উজির সাহেবকে সাথে নিয়ে রাজবাড়ীর গেইটের বাইর হলো। তাঁদের সাথে নেওয়া হলো সদাই রাখার জন্য একটা বড়সড় টুকরিও। হিরা উজির সাহেবকে বললো, ‘উজির সাহেব আপনি আমার আগে আগে হাঁটুন, আমি আপনার পিছনে পিছনে হাঁটি। বাজারে টুকরিটাও আমার সাথে থাকুক। আপনি বুড়ো মানুষ। কষ্ট করার দরকার কী! আপনি শুধু আমাকে আপনাদের এখানকার ধারে কাছে একটা বাজারে নিয়ে চলুন!’ হিরা’র কথা শুনে রাজার উজির খুবই খুশি হলেন। আবার বেজারও হলেন। বেজার হয় তখন, যখন থাপ্পড়ের কথা মনে পড়ে তখন। সেই থাপ্পড়ের কথা মনে পড়লেই, উজিরের আর ভালো লাগে না। তবুও রাজার হুকুম বলে কথা। তাই আর রাগ থাকতেও রাগ করতে পারছে না, হিরা’র কথা মতোই চলতে হচ্ছে।

এদিকে রাজদরবারে বসে কোতোয়াল সাহেব রাজাকে বললো, ‘হুজুর, চেনা নেই জানা নেই, অচেনা অজানা একটা ছেলের হাতে তিনটি পয়সা দিয়ে দিলেন! কাজটা কি ঠিক হলো?’ রাজা হেসে বললো, ‘এই ছেলে মাত্র তিন পয়সার পাগল নয় বলে আমার বিশ্বাস। এই কারণেই এমন কঠিন সদাই তিনটি কিনে আনার জন্য বলেছি। আমি জানি এই সদাই তিনটি ছেলেটা কিছুতেই আনতে পারবে না। যদি সদাই তিনটি না আনতে পারে, তাহলে আমার করণীয় কাজ করে ফেলবো। চলে বলে কলে কৌশলে, যেভাবেই হোক, আমি ছেলেটাকে আমার রাজদরবারে গোলামের মতো করে রেখে দিবো।’ কোতোয়াল জানতে চাইলেন, ‘আর যদি ছেলেটা সদাই তিনটি কিনে এনে দিতে পারে, হুজুর?’ রাজা বললেন, ‘আমি জানি ছেলেটা তা পারবে না। আর যদি আনতেই পারে, তাহলেও তা হবে না। আমি যা-ই বলবো, তাইতো হবে।’ এই বলেই রাজা দরবারে থাকা দেয়াল ঘড়ির দিকে রাজা তাকালেন। তখন সময় বিকাল চারটার কাছাকাছি বাজতে লাগলো। রাজা ভাবছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উজির-সহ ছেলেটা বাজার থেকে ফিরে আসছে। রাজা সেই অপেক্ষাতেই বসে থাকলেন।

উজির-সহ হিরা যেই বাজারে যাবে, সেই বাজারের নাম রাজবাড়ি বউ বাজার। এই বাজারে গ্রামের বউঝিরা কেনাবেচা বেশি করে থাকে বলে, বাজারটার নাম রাজবাড়ি বউ বাজার। উজির আগে হিরা উজিরের পিছনে পিছনে। বাজারে ঢুকতেই একজন জিলাপি বিক্রেতা জিলাপি ভেজে ডালার উপর সাজিয়ে রেখেছে। হিরা তা দেখে উজিরকে ডাক দিল, ‘উজির সাহেব, উজির সাহেব।’ উজির পিছন ফিরে দেখলো ছেলেটা ডাকছে। উজির হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘কী ব্যাপার! ডাক দিলে কেন?’ হিরা উজিরকে বললো, উজির সাহেব, অনেকদিন ধরে গরম গরম জিলাপি খাই না। আজ হাতের কাছে যখন পেয়েছি পোয়া খানিক জিলাপি দুইজনে মিলেমিশে খেয়ে নিই। কি বলেন উজির সাহেব?’

উজির হিরা’র কথা শুনে মনে মনে বলতে লাগলো, ‘শালার পো, তোমাকে রাজা তিন পয়সা দিয়েছে তিনটি সদাই করার জন্য। সেই পয়সা থেকে তুমি জিলাপি কিনে খেতে চাইছ। আবার আমাকেও খাওয়াতে চাচ্ছো। তাহলে সদাই নিবে কী করে?’ এই বলেই উজির হিরা’কে বললো, ‘না রে বাবা রে, আমার পেট ভালো না। আমি জিলাপি টিলাপি খাবো না। খেতে মন চাইলে তুমিই খাও!’ হিরা বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে উজির সাহেব, আমিই খাবো। তো আপনি দামদর করে কিনে দিন। আপনাদের এখানকার বাজারের ভাবসাব তো আমি বুঝবো না। এঁরা আমার কাছ থেকে দাম বেশি নিবে।’

হিরা’র কথামতো উজির জিলাপি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বেটা জিলাপি কি গরম না ঠান্ডা রে?’ জিলাপি বিক্রেতা বললো, ‘আরে হুজুর, এখন ভাজলাম এখন। একেবারে টাটকা জিলাপি।’ উজির বললো, ‘তাহলে ঠিক আছে। তো কত করে সের বিক্রি করছো হে?’ জিলাপি বিক্রেতা বললো, ‘আজ্ঞে হুজুর, মাত্র চার পয়সা সের।’ উজির সাহেব বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। একপোয়া জিলাপি দাও তাড়াতাড়ি করে।’ জিলাপি বিক্রেতা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে একপোয়া জিলাপি মেপে উজিরের হাতে দিলো। উজির সেই জিলাপি হিরা’র হাতে দিয়ে বললো, ‘দে বাবা এক পয়সা জিলাপির দাম দিয়ে দে।’ হিরা তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে এক পয়সা বের করে জিলাপি বিক্রেতার হাতে দিয়ে সামনে এগুতে থাকলো। হিরা হাঁটছে আর মনের আনন্দে জিলাপি খাচ্ছে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। বাজার দেখছে। দোকানপাট দেখছে। আর জিলাপি খাচ্ছে, হাঁটছে।

এমন সময় এক ভিখারি হিরা’র সামনে এসে হাত পেতে বসলো। হিরা গরিবের সন্তান হলেও মানুষের প্রতি হিরা’র খুব মায়া। মানুষের কষ্ট হিরা সহজে সইতে পারে না। তাই যখন ভিখারি হিরা’র কাছে ভিক্ষা চাইল, তখন হিরা সাথে সাথে ও-ই ভিখারিকে এক পয়সা ভিক্ষা দিয়ে দিলো।

হিরা’র এইরকম দরদী কারবার দেখে, উজির সাহেব মনে মনে বলছে, ‘ছাইরা দে মা কাইন্দা বাঁচি। হায়! হায়! করছে কি! রাজা দিলো সদাই কেনার জন্য। আর ও করছে দান খয়রাত! জিলাপি খায়, ফকিরকে দেয়। বাঃ দারুণ তো! দেখি, আর আছে এক পয়সা। এই এক পয়সা দিয়ে ছেলেটা কী করে, তা দেখেই দিবো এক দৌড়।’

ফকিরকে এক পয়সা দিয়ে হিরা উজিরকে বললো, ‘উজির সাহেব, মানুষের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। তাই ফকিরটা যখন ভিক্ষা চাইলো, তখন এক পয়সা ফকিরটাকে দিয়ে দিলাম। এর জন্য আল্লার দরবারে একটু হলে ছোয়াব জমা রেখে গেলাম। কি বলেন উজির সাহেব?’ উজির বললো, ‘ভালো করেছিস বাবা। একেবারে বুদ্ধিমানের কাজ। তো রাজার সদাই কিনতে হবে না? এভাবে ঘুরলে কি হবে? তাড়াতাড়ি কর বাবা। সন্ধ্যা যে হয়ে গেল। বাড়ি ফিরতে হবে।’

হিরা বললো, ‘উজির সাহেব, রাজা হুজুর যেই সদাই তিনটা কিনতে বলেছে, তাতো আপনাদের এই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তো ঘুরে ঘুরে সদাই খুঁজে বেড়াচ্ছি। দেখি সামনে পাওয়া যায় কি-না?’ এই বলেই হিরা সামনে এগুতে লাগলো। হিরা’র পিছনে উজির বোকার মতো হাঁটছে আর ভাবছে। ‘হায়রে রাজা, কাকে দিলি পয়সা! এই ছেলেটা কি আর রাজবাড়ি ফিরে যাবে? মনে হয় না! রাজার এক গৃহস্থের এক বছরের খাজনা মাইর!’ উজির ভাবলেন।

একটু সামনে যেতেই হিরা দেখলো মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাজনার শব্দে পুরো বাজার মুখরিত হয়ে উঠছে। হিরা ভাবলো হয়তো সাপুড়িয়ারা সাপের খেলা দেখাচ্ছে। এই ভেবে হিরা গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষজন ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকলো। উজির টুকরি হাতে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, ‘কার সাথে যে বাজারে আসলাম রে আল্লাহ! এ দেখি বড় বাটপার। রাজার কাছ থেকে বাটপারি করে তিন পয়সা এনে কি না করতেছে। পরের পয়সা খরচ করতে তো আর গা জ্বলে না। তাই জিলাপি খায়, ফকিরকে দেয়। এখন আবার রূপবান গান দেখার জন্য গোলচক্করে ঢুকছে। দেখি কী করে!’

এই বলেই উজির সাহেবও ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে রূপবান গান গেয়ে এক হিজরা ড্যান্স দিচ্ছে। ড্যান্সের তালে তালে হিরাও নাচতে দিতে শুরু করলো। ড্যান্স শেষ হলে উপস্থিত সবাই এক পয়সা দুই পয়সা করে হিজরাকে বকশিস দিতে লাগলো। হিরাও ড্যান্সার হিজরাকে এক পয়সা বকশিস দিয়ে দিলো। উজির সাহেব তা দেখে বললো, ‘খাইছে রে আমারে।’ খাইছে খাইছে বলতে বলতেই হাতের টুকরি ওখানেই রেখে সোজা এক দৌঁড় রাজবাড়ির দিকে। হিরা এখন উজিরকে খুঁজছে। উজির সাহেব নেই। কোথাও নেই। অথচ টুকরি পড়ে আছে, উজির নেই। হিরা বুঝতে পেরেছে উজির সাহেব ভয় পেয়েছে। তাই আগেভাগে উনি রাজদরবারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। হিরাও বাজার থেকে আস্তে ধীরে হেলেদুলে রাজবাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করলো।

উজির সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে রাজবাড়ির গেইটের সামনে গেলো। গেইটে টোকা দিলো। প্রহরী গেইট খুলে দিলো। উজির সাহেব ভেতরে ঢুকলো। গেইটে থাকা প্রহরী উজির সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব ছেলেটা কোথায়?’ আপনারা গেলেন দুইজন মিলে, অথচ আপনি আসলে একা!’ উজির ধমক দিয়ে বললো, ‘দূর! বাটপার, বাটপার! রাজার মাথা খারাপ হয়েছে রে, রাজার মাথা খারাপ হইছে। কারে দিয়েছে তিন পয়সা রে।’ প্রহরী আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘হুজুর, আসল ঘটনাটা কী?’ উজির বললো, ‘আরে বেটা, রাজার পয়সা দিয়ে জিলাপি খায়। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়। রূপবান গানের ড্যান্স দেখে বকশিস দেয়। এসব কি একটা কাজ? যাচ্ছি রাজার কাছে। ঈশ! আমার থাপ্পড়ের বিচারটা পেলাম না রে!’

এই বলেই উজির রাজদরবারের দিকে রওনা হলো। বাইরে থেকে গেইটে টোকা লাগলো। প্রহরী গেইট খুলেই দেখে হিরা’কে। প্রহরী হা করে হিরা’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ব্যাপার? এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন যে?’ প্রহরী বললো, ‘না, মানে উজির সাহেব বললো তুমি আর আসবে না। তাই অবাক হলাম!’ হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব কোথায়?’ প্রহরী বললো, ‘এইতো এইমাত্র রাজদরবারের দিকে চলে গেলো। তুমি নাকি জিলাপি খাও, ফকিরকে ভিক্ষা দাও, রূপবান গান শুনো?’ হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘এসব আপনার কাছে কে বলেছে?’ প্রহরী বললো, ‘কেন, উজির সাহেবই বলেছে! নাহয় আমি শুনবো কোত্থেকে?’ হিরা বললো, ‘উনি ঠিকই বলেছে।’ প্রহরী বললো, ‘তো রাজা যে তিন পয়সা দিলো সদাই আনতে, সদাই কোথায়?’ হিরা বললো, ‘তিন পয়সা দিয়ে কি আর সদাই আনা যায়? বাজারে জিনিসপত্রের যেই দাম! তবুও কিছু সদাই কিনেছিলাম। উজির সাহেব সব সদাই গুলো বাজারে রেখে চলে এসেছে। তাই আর পয়সার কেনা সদাই গুলো আনা হলো না। কী আর করা! যাই দরবারে।’ হিরা চললো রাজদরবারের দিকে।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৫ শেষ পর্ব

চলবে…

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-২

দ্বিতীয় পর্বের শেষাংশ:
রাজার কথা শুনে বুড়ো উজির সাহেব খুবই খুশি হলেন। রাজদরবারে থাকা সবাই হাততালি দিলেন। হিরা চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলো, সাজা থেকে কীভাবে বাঁচা যায়!

কী সাজা হতে পারে এমন চিন্তা নিয়ে হিরা বসে বসে ভাবছে! দরবারে উপস্থিত সবাই তাকিয়ে আছে রাজার দিকে, কখন সাজার ঘোষণা দিবে। এমন সময় হিরা বসা থেকে উঠে হাত জোর করে রাজাকে বললো, ‘হুজুর, আপনার দরবারে আমি ছোট্ট একটা প্রশ্ন রাখতে চাই, যদি দয়া করে আপনি অনুমতি দেন।’ হিরা’র কথা শুনে রাজা বললেন, ‘কী এমন প্রশ্ন করবে? করো শুনি!’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, আমার প্রশ্ন হলো আপনার রাজদরবার-সহ রাজ্য পরিচালনার জন্য যেসব আইনকানুনগুলো বলবত আছে, এসব আইনকানুন বা নিয়মকানুনগুলো কে তৈরি করেছিল? এগুলো কি আপনি নিজেই তৈরি করেছিলেন? নাকি আপনার রাজদরবারে থাকা অন্য কেউ তৈরি করেছিল?’ হিরা’র করা প্রশ্নে রাজা থমকে গেল! আবার ভাবতেও লাগলো! রাজা মনে মনে বললো, ‘সাংঘাতিক তো!’

রাজা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আমি শুধু হুকুমের মালিক, হুকুম দিয়ে থাকি। রাজ্য পরিচালনার জন্য যেসব আইনকানুন আছে সেসব আইনকানুন প্রণয়ন করেছিল আমার উজির, নাজির, কোতোয়াল-সহ রাজ্যে থাকা বড়বড় পণ্ডিতগণ। আমি শুধু অনুমোদন দিয়েছি। তো হঠাৎ তোমার এমন প্রশ্ন কেন?’ হিরা বললো, ‘রাজা হুজুর, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনার রাজ্যে যেসব নিয়মকানুন চালু আছে, সেসব নিয়মকানুনগুলোর মধ্যে আপনার রাজবাড়ীর গেইট খোলার নিয়মটা মানুষ ভোগান্তির নিয়ম। তা কি আপনি কখনো ভেবে দেখেছেন?’ রাজা বললো, ‘কেমন ভোগান্তি?’ হিরা বললো, ‘আপনি আমার রাজা। আমি আপনার মুল্লুকের একজন। প্রতিবছর আপনাকে আমি খাজনা দিয়ে আসছি। না দিলে আপনি আমার বাড়িতে সৈন্যসামন্ত পাঠিয়ে দেন খাজনা আদায়ের জন্য। অথচ আমার কোনও সমস্যায় আমি আপনার সাথে দেখা করতে হলে আপনার রাজবাড়ির গেইটে খেয়ে-না-খেয়ে দুইতিন দিন বসে থাকতে হয়। জনসাধারণের জন্য এরকম ভোগান্তি নিয়ম হবে কেন? আমারা কি মানুষ না? আমরা কি বন্য জানোয়ার? আপনার কাছে গরিব মানুষের কোন মূল্যায়ন নেই? দয়া করে প্রশ্নের উত্তর দিন, রাজা হুজুর!’

হিরা’র কথা শুনে উজিরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। নাজির-সহ কোতোয়াল সাহেবের অবস্থাও খারাপ। আর রাজা তো একেবারে চুপ হয়ে বসে রইলেন রাজ সিংহাসনে। রাজাকে চুপ দেখে হিরা আবার বলতে শুরু করলো, ‘রাজা হুজুর, আপনি আমাদের মুল্লুকের রাজা। সমস্ত প্রজাদের অভিভাবকও। প্রজাদের কোনও আপদ-বিপদে আপনার কাছে আসবে। আপনাকে তাঁদের সমস্যা জানাবে। তখন যদি আপনার বাড়ির এই বিশাল গেইটখানা বন্ধ থাকে, আর যদি দুইতিন দিন অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে কেমন হয়? প্রজারা কার কাছে গিয়ে তাঁদের সমস্যা জানাবে? আর আপনার বাড়ির গেইট দুইদিন পরপর খোলা হয় কেন? জনসাধারণের জন্য প্রতিদিন আপনার বাড়ির গেইট খোলা থাকলে আপনার সমস্যাটা কী?

‘আজ যদি আপনার এই মানুষ ভোগান্তি নিয়ম বহাল না থাকতো, তাহলে আজ আর এই ঘটনার সূত্রপাত হতো না। আমাকেও আপনার বাড়ির গেইটে দুইদিন বসে থাকতে হতো না। আপনার উজির সাহেবও আমার থাপ্পড়ের কবলে পড়তো না। তাই আজকের এই ঘটনার জন্য তাঁরাই দায়ী, যাঁরা এই নিয়মটা করেছে। আমি সরাসরি তাঁদেরকেই দায়ী করছি, হুজুর। যদি আপনি করে থাকেন, তাহলে আপনিই দায়ী থাকছেন। এখানে আমার কোন দোষ নেই বলেই আমি মনে করি। এরপরও যদি আমাকে সাজা ভোগ করতে হয়, তাহলে আমি মনে করবো বিনা দোষে আমাকে নির্যাতন করা হচ্ছে। তাই দয়া করে এই বিষয়টি আপনাকে একটু ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করছি, হুজুর।’

হিরা’র কথা শুনে দরবারে উপস্থিত সবাই হাততালি দিতে শুরু করে দিল। উজির সাহেব চুপচাপ এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলো। রাজা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে সবাইকে শান্তভাবে বসতে বললো। সবাই চুপ করে বসে রইলেন। রাজা হিরা’কে কাছে ডাকলেন। হিরা রাজার সিংহাসনের সামনে গেলে, রাজা হিরা’র মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ‘তুমি ঠিকই বলেছো। আজ তুমি আমার ঘুম ভেঙে দিয়েছ। আজকের এই ঘটনার জন্য আমিই দায়ী থাকলাম। যদিও আমি এই নিয়মগুলো করিনি, তবুও। কারণ, আমি কেন রাজ্যের রাজা হয়ে এসব নিয়মকানুনগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখলাম না। আর কেন-ই-বা উজির নাজির কোতোয়াল-এর উপর বিশ্বাস করে রাজদরবারে বসে থাকলাম। দোষ তো আমারই!

‘আমি ঘোষণা দিচ্ছি, আজ থেকে আমার বাড়ির গেইট কোনও দিন রাত বারোটার আগ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে না। দেশের মানুষের জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা থাকবে। আসলে এসব তো আমি কখনো খেয়াল করিনি। আমি যখন বাড়ির বাইরে কোথাও যাই, তখন গেইট খুলে। বাড়ি আসলে গেইট বন্ধ হয়। আমি থাকি অন্দরমহলের ভেতরে। অন্দরমহল থেকে বাড়ির প্রধান গেইট অনেক দূরে থাকার কারণে এসব আর আমার চোখে পড়ে না। এসব ব্যাপারে তুমি ছাড়া আর কেউ আজ পর্যন্ত আমার কাছে নালিশও দেয়নি। তাই আজকের এই ঘটনার জন্য প্রথমত আমি আমার উজিরকেই আমি সরাসরি দায়ী করছি। সেই সাথে আজকের এই ঘটনার জন্য তোমাকে নির্দোষ ঘোষণা করছি। আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি যা করেছ জেদের মাথাই করেছ। তুমি নির্দোষ।’

রাজার ঘোষণা শুনে উজির মনে করছে আজ বুঝি আমার চাকরি শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু না, তা আর হিরা হতে দেয়নি। হিরা এর আগেই উজিরের সামনে গিয়ে হাতে ধরে বললো, ‘উজির সাহেব, আপনি আমার পিতৃতুল্য। আমি আপনার সাথে সত্যি খারাপ ব্যবহার করেছি। আপনি আমাকে আপনার ছেলে মনে করে ক্ষমা করে দিন।’

হিরা’র এমন ব্যবহারে রাজা খুবই খুশিও হলেন, অবাকও হলেন। ভাবলেন, ছেলেটার তো উপস্থিত বুদ্ধি আছে। সাজা মওকুফের কথা শুনেও নিজের ভুল স্বীকার করে উজিরের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। চমৎকার বুদ্ধি। এই ছেলেটাকে আমার রাজদরবারে সবসময়ের জন্য দরকার। এই ভেবে রাজা হাসতে হাসতে উজিরকে বললো, ‘উজির সাহেব, আর কী করা! ছেলেটা নিজের ভুল যখন নিজেই স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে, আপনি নিজের ছেলে মনে করে ছেলেটাকে ক্ষমা করে দিন।’ উজির রাজার কথা আর অমান্য না করে হিরা’কে ক্ষমা করে দিয়ে হিরা’র সাথে বুকে বুক মিলিয়ে নিলেন। তারপর হিরা রাজা-সহ রাজদরবারে উপস্থিত থাকা সকলকে সালাম জানিয়ে বাড়ি ফিরতে চাইলেন। কিন্তু রাজা তখন হিরা’কে যেতে দিলেন না। রাজা হিরা’কে বললেন, ‘আমাকে তোমার একটা কাজ করে দিতে হবে। হিরা জানতে চাইলেন, ‘কাজটা কী হুজুর?’

রাজা বললো, ‘কাজটা তেমন কিছুই না। তবে আবার ফেলনাও না। কাজটা হলো বাজার থেকে তিন পয়সা দিয়ে তিনটি সদাই আমাকে কিনে এনে দিতে হবে।’ হিরা জানতে চাইল সদাই তিনটি কী কী?’ রাজা বললো, ‘সদাই তিনটি হলো, “এক পয়সার এখন, এক পয়সার তখন, এক পয়সার এখনো না তখনো না।” আমি জানি তুমি এই তিনটি সদাই কিনে আনতে পারবে।’ হিরা তখন অভিনয় করে দাঁড়ানো থেকে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়লো। রাজা বললো, ‘কী ব্যাপার? তুমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লে কেন?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, যে তিনটি সদাই’র নাম আপনি বলেছেন, এই সদাই তিনটি বাজারে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। এই সদাই তিনটি যেমন মূল্যবান, তেমন আবার খুবই ভারী।’

রাজা বললো, ‘তা যা-ই থাক, আর যেভাবেই হোক সদাই তিনটি আমার দরকার! যদি এই তিনটি সদাই আমাকে কিনে এনে দিতে পার, তাহলে তোমাকে আমি উপযুক্ত বকশিস দিবো।’ হিরা প্রশ্ন করলো, ‘কী বকশিস দিবেন, হুজুর?’ রাজা বললেন, ‘যদি চাও, আমার রাজ্যের অর্ধেক তোমার নামে লিখে দিবো। এ-তে-ও যদি না হয়, তাহলে তুমি যা চাও, তা-ই আমি দিতে রাজি আছি। এসবকিছুর বিনিময়েও আমার আকাঙ্ক্ষা এই তিনটি সদাই চাই চাই। তা কি তুমি পারবে?’ রাজার কথা শেষে হিরা বললো, ‘হুজুর পৃথিবীতে মানুষের অসাধ্য কাজ বলতে কিছুই যদি না থাকে, তাহলে আমি এই সামান্য কাজটুকু করতে পারবো না কেন? আমিও পারবো, হুজুর। তবে এখানে আমার কিছু কথা আছে। কথা হলো, প্রতিদিন আপনার সাংসারিক বাজার-সদাই কে করে? যিনি করে, তাকেই আগে এই সদাই তিনটি কিনে আনার জন্য বলুন। যদি সে না পারে তাহলে আমি কিনে এনে দিবো, কথা দিচ্ছি!’

হিরা’র কথা শুনে রাজা ভেবে দেখলেন, এ-তো ভালো কথা! আমার বাজার সদাই তো আমার উজির সাহেবই করে। তাকেই আগে জিজ্ঞেস করা দরকার। এই ভেবে রাজা উজিরকে জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব, আপনি কি তিন পয়সা দিয়ে বাজার থেকে হোক আর যেখান থেকেই হোক, এই তিনটি সদাই আমাকে কিনে এনে দিতে পারবেন?’ উজির সাহেব বললেন, ‘রাজা হুজুর, এই তিনটি সদাই’র নাম আমার বাপদাদার চোদ্দগুষ্টিও কোনদিন শুনেনি। আমিও শুনিনি হুজুর। মাফ করবেন হুজুর, আমি এটা পারবো না।’ রাজা তখন হিরা’কে বললেন, ‘আমার উজির তা পারবে না। এই কাজ তোমাকেই করতে হবে।’ হিরা বললো, ‘ঠিক আছে হুজুর, আমিই বাজার থেকে তিন পয়সা দিয়ে আপনাকে তিনটি সদাই কিনে এনে দিবো।’ হিরা’র কথা শুনে রাজা খুবই খুশি হলেন। হিরা’কে রাজ অতিথির মতো সমাদর করে খাওয়ালেন। হিরা তো এমনিতেই দুইদিনের না খাওয়া। তাই হিরা পেট ভরে খেলো।

তারপর রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘সদাই তিনটি আনতে হলে তোমার কী কী দরকার?’ হিরা বললো, ‘হুজুর, আপনার নিত্যদিনের বাজার করা লোকটিকে আমার সাথে দিবেন। আমি সদাই কিনবো লোকটি দেখবে, আর শিখবে।’ রাজা ভেবে দেখল এ-তো চমৎকার বুদ্ধি? লোকটারও তো শেখার দরকার আছে! রাজা বললেন, ‘তা-ই হবে। আমার উজির সাহেব তোমার সাথে যাবে।’ এই বলেই রাজা উজিরকে বললেন, ‘উজির সাহেব, আপনি ছেলেটার সাথে বাজারে যাবেন। ছেলেটা কীভাবে কী করে, তা দেখবেন, শিখবেন।’ নিরুপায় উজিরের এখন মরি মরি অবস্থা! না পারে রাজি হতে, না পারে হিরা’র সাথে যেতে। উপায়ন্তর না দেখে উজির বললো, ‘হুজুর, ছেলেটার হাতে থাপ্পড়ও খেলাম, এখন আবার ছেলেটার চাকরগিরিও করতে হবে?’ রাজা উজিরকে দিলেন এক ধমক! ধমক দিয়ে বললেন, ‘থাপ্পড় তো আপনাদের ভুলের কারণেই খেলেন, উজির সাহেব। এখন আমি যা বলছি, তা-ই আপনাকে করতে হবে।’ উজির আর কোনও কথা বললেন না, মাথা নেড়ে যাবে বলে জানিয়ে দিলেন। হিরা রাজার কাছ থেকে তিন পয়সা নিয়ে পকেটে ভরলো। এরপর উজিরকে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৪

চলবে…

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-২

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-১

গল্পের প্রথম পর্বের শেষাংশ:
হিরা’র কথা শুনে সিপাহীরা বলছে, ‘কি মুশকিলে না পড়লাম রে ভাই! এই ধর ধর শালাকে। ওকে কোলে করেই নিতে হবে।’ এই বলেই চার পাঁচজন সিপাহী হিরা’কে আবার কাঁধে করে রাজদরবারে নিয়ে যেতে লাগলো।

সিপাহীরা ধরাধরি করে হিরা’কে কাঁধে চড়িয়ে রাজদরবারে নিয়ে গেল। রাজদরবারে নিয়ে হিরা’কে সিপাহীরা তাঁদের কাঁধের পর থেকে নামিলে বললো, ‘হুজুর, এই সেই লোক। যে আমাদের উজিরের গালে থাপ্পড় মেরেছে।’ রাজা সিপাহীদের জিজ্ঞেস বললো, ‘তা কি তোমরা জানো? সত্যি কি এই ছেলেটা আমার উজিরকে থাপ্পড় মেরেছে?’ রাজার কথায় সিপাহীদের মধ্যে একজন বললো, ‘হুজুর, আমরা উজির সাহেবকে থাপ্পড় দিতে দেখিনি ঠিক। কিন্তু এই ছেলেটি নিজেই স্বীকার করেছে।’
রাজা জিজ্ঞেস করলো, ‘কীভাবে সে নিজের ইচ্ছায় স্বীকারোক্তি দিল যে ও নিজের উজরকে থাপ্পড় মেরেছে? তোমরা কি ছেলেটার গায়ে হাত উঠিয়েছ? ছেলেটাকে মারধর করেছো?’ সিপাহীরা রাজার এমন প্রশ্নে সবাই থমকে গিয়ে কাঁপতে শুরু করে দিল। রাজা আবার ধমক দিয়ে বললো, ‘তোমাদের জিজ্ঞাসা করেছি, ছেলেটা কীভাবে নিজের ইচ্ছায় স্বীকার করেছে, বলো!’

একজন সিপাহী বললো, ‘হুজুর, আপনার আদেশ পেয়ে আমরা যখন আপনার বাড়ির প্রধান গেইটের বাইরে গিয়ে খুঁজাখুঁজি করছিলাম, তখনই আমরা গেইটের সামনে ছেলেটকে দেখতে পাই। তখন গেইটের সামনে এই ছেলেটি ছাড়া অন্যকোনো লোক ছিল না। তাই আমাদের সন্দেহের চোখ যায় ছেলেটার দিকে। আমরা ছেলেটার সামনে গিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি, তুমি কাউকে আমাদের উজির সাহেবকে থাপ্পড় দিতে দেখেছ? তখন ছেলেটি নিজেই বলতে লাগলো, “উজির না রাজা তা আমি চিনি না, গেইট থেকে বের হবার সময় থাপ্পড় একটা আমিই মেরেছি।” ছেলেটার মুখে এমন কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম, হুজুর! তারপর আমরা ছেলেটিকে ধরে ফেললাম। ছেলেটিকে ধরার পরও আরেক বিপদে পড়ে গেলাম!’ রাজা জানতে চাইলেন, ‘ছেলেটিকে ধরার পর তোমরা কেমন বিপদে পড়লে শুনি!’ একজন সিপাহী বললো, ‘হুজুর, ছেলেটা যেসব কথা বলেছে, তা আমরা আপনার কাছে বলতে সাহস পাচ্ছি না।’

সিপাহীদের কথা শুনে রাজা ভাবতে লাগলো! এই ছেলেটা কেমন কথা বলতে পারে? যা সিপাহীরা বলতে সাহস পাচ্ছে না! নিশ্চয় মারাত্মক কোনও কথা বলেছে। যা সিপাহীরা বলছে না! যা-ই বলুক, তা আমার শুনতে হবে। এই ভেবে রাজা সিপাহীদের কাছে জানতে চাইলো, ‘তোমরা নির্ভয়ে বলতে পারো। আমি জানতে চাই ছেলেটা কি এমন কথাবার্তা বলেছে। যা তোমরা সাহস করে বলতে পারছ না? বলো, শুনি!’ এক সিপাহী বললো, ‘হুজুর, ছেলেটা খুবই সাহসী এবং জেদি। ছেলেটাকে ধরে আমরা যখন বললাম, তোমার এতো বড় সাহস! তুমি আমাদের উজিরকে থাপ্পড় মেরেছ কেন? ছেলেটা তখন বললো, “উজির না হয়ে এখানে যদি তোমাদের রাজাও হতো, তাহলে উজিরে থাপ্পড় রাজার গালেই পড়তো।” আমাদের কথা যদি বিশ্বাস না হয় হুজুর, ছেলেটা আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। দয়া করে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করুন, আমরা কোনও কথা মিথ্যে বলছি কিনা। ছেলেটা হুজুর এ-ও বলেছে, “আগে জানলে তোমাদের উজিরকে আরও কয়েকটা থাপ্পড় মারতাম।”

‘এরপরও আমরা যখন ধরাধরি করে ছেলেটাকে আপনার দরবারের দিকে নিয়ে আসছিলাম, তখন ছেলেটা ছিল আমাদের সকলের কাঁধের উপর, হুজুর। আমাদের কাঁধের উপর বসে ছেলেটা বলতে লাগলো, “একটা থাপ্পড় মেরেছি তারজন্য তোমরা আমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছ! আগে জানলে দুইটা থাপ্পড় মারতাম। তাহলে মনে হয় আমাকে পালকিতে চড়িয়ে নিতে।” ছেলেটার এসব কথা শুনে আমরা তখন আমাদের কাঁধের পর থেকে নিচে ফেলে দিলে আরেক বিপদ হয়, হুজুর। বিপদ হলো, ছেলেটা তখন মাটিতে বসে বসে চিল্লাচ্ছিল। কিছুতেই ছেলেটাকে বসা থেকে উঠাতে পারছিলাম না। উপায়ন্তর না দেখে এই হারামজাদা ছেলেটাকে আবার কাঁধে করে আপনার কাছে নিয়ে আসতে হলো, হুজুর। এখন আপনি নিজেই ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করুন! তারপর সুষ্ঠু বিচার করুন!’

সিপাহীদের সব কথা রাজা সিংহাসনে বসে বসে শুনলেন। শুনলেন দরবারে উপস্থিত নাজির, কোতোয়াল, পেশকার-সহ থাপ্পড় খাওয়া উজিরও। বুড়ো বয়সের উজির তখন গালে ধরে তাঁর আসনে নিরিবিলি চুপচাপ বসে আছে। রাজা সিপাহীদের কথা শুনে ভাবছে। হিরা চার-পাঁচজন সিপাহীদের মাঝখানে বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাজাকে ভালো করে দেখছে। সিপাহীরা তখন জবানবন্দি দিচ্ছিলো, তখনও রাজা শুধু বারবার হিরা’কে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। আর কি যেন ভাবছিল। এরই মাঝে উজির রাজার সিংহাসনের সামনে গিয়ে গালে থাপ্পড়ের স্থানে লেগে থাকা হিরা’র আঙুলের ছাপ দেখাতে লাগলো।

রাজাকে গালে লাগা থাপ্পড়ের দাগ দেখিয়ে বললো, ‘হুজুর, আমি এতো বছর আপনার দরবারে উজিরের দায়িত্ব নিয়ে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছি। আজ পর্যন্ত এমন থাপ্পড় আর কখনো খাইনি। দেখুন! দেখুন! আমার গালের অবস্থা কী হয়েছে, হুজুর। আপনি মহামান্য রাজা। আমি আপনার গোলাম। আপনার চাকরি করে এই বুড়ো বয়সে এই ছেলের হাতে থাপ্পড় খাওয়া কেমন লাগে, হুজুর? এর চেয়ে আমার মরে যাওয়াও ভালো। আপনি এর বিচার করুন!’ উজিরের কথা শুনে রাজা উজিরকে শান্তনা দিয়ে বললো, ‘উজির সাহেব আপনি শান্ত হোন। আমি এর বিচার অবশ্যই করবো। এর আগে ছেলেটার কাছ থেকে কিছু জেনে নেই, ছেলেটা কেন এবং কী কারণে এমন করেছে। ছেলেটার উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কেন ই বা এখানে এসেছে। আর কে ই বা আপনাকে থাপ্পড় মেরেছে। এসব কিছু আমি ছেলেটার মুখ থেকে শুনতে চাই।

এই বলেই রাজা হিরা’কে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার নাম কী?তোমার পিতার নাম কী? তোমার বাড়ি কোন গ্রামে? এখানে কেন এসেছ এবং কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছ? বল শুনি!’

রাজার জিজ্ঞাসা শেষ হবার সাথে সাথে হিরা তাঁর দুহাত জোর করে এক গ্লাস পানি চাইলেন। রাজা দরবারের খেদমতকারীকে হুমম দিলেন ছেলেটাকে এক গ্লাস পানি দিতে। খেদমতকারী হিরাকে পানি দিলেন। হিরা পরম তৃপ্তিতে পানি পান করলেন। এরপর দুহাত জোর করে বলতে শুরু করলেন, ‘রাজা হুজুর, আমি আপনার মুল্লুকের জয়পুর গ্রামে থাকি। আমার বাবার নাম আক্কেল আলি। আমি দেখেছি প্রতিবছর আমার বাবা আপনার দরবারে খাজনা দিতে আসে। একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা তুমি কোথায় যাও! বাবা বললেন, “খাজনা দিতে যাচ্ছি রাজদরবারে।” আমি জানতে চেয়েছি কোথায় সেই রাজদরবার, আর কে সে রাজা? উত্তরে বাবা বললেন, “যার মুল্লুকে থাকি সে-ই হলেন রাজা। তাকেই প্রতিবছর নিজেদের জমিজমার খাজনা দিতে হয়। সেই রাজার রাজবাড়ীর রাজদরবার আমাদের গ্রাম থেকে আরও অনেক দূরে। কেন, তুমি কি যাবে?” আমি বাবাকে বললাম, তুমি এখন যাও! আমি একসময় একাই যাবো যাবো, বাবা। তারপর থেকে হুজুর আপনাকে একনজর দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠি। দিনরাত ভাবতে থাকি আপনাকে নিয়ে। কারণ, আপনার মুল্লুকে থাকি। আপনার নুন খাই। আপনাকে একনজর না দেখলে আমার এই জীবনই বিফলে যাবে ভেবে আমি আপনার রাজবাড়ির গেইটে আসি।

‘গেইটে টোকা দেই, সাড়াশব্দ নেই। এভাবে আমি দুইদিন আপনার বাড়ি গেইটে না খেয়ে গেইট খোলাখুলির অপেক্ষায় থাকি। আজকে সকালে প্রতিজ্ঞা করি গেইট থেকে যে-ই বের হবে তাকেই একটা থাপ্পড় মারবো। সকাল ৮টায় যখন গেইটের ভেতর থেকে ঠকঠক আওয়াজ হচ্ছিল, তখন আমি আমার শক্ত হাতে আরও শক্তি সঞ্চার করে রেডি হয়ে থাকি। তারপর গেইট থেকে একজনকে মাথা বের করতে দেখেই সাথে সাথে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেই। এখন জানলাম থাপ্পড় খাওয়া লোকটি আপনার সম্মানিত উজির সাহেব। আপনার কাছে মাপ চেয়ে বলছি, সেসময় উজিরে জায়গায় যদি আপনি হতেন; উজিরের থাপ্পড়টা আপনার গালেই পড়তো, হুজুর! কিন্তু আপনার ভাগ্য খুবই ভালো, আপনি সে-সময় সে-জায়গায় ছিলেন না। মানের মান মহান সৃষ্টিকর্তাই রাখে হুজুর। যাইহোক, এখানে আমার আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো শুধু আপনাকে একনজর দেখা। এছাড়া আর কোনও অসৎ উদ্দেশ্য আমার ছিল না, হুজুর! এখন আপনার বিচারে আমি যদি দোষী সাব্যস্ত হয়ে থাকি তো, আমাকে আপনি যেকোনো শাস্তি দিতে পারেন; তা আমি মাথা পেতে নিবো।’

হিরা’র কথা শুনে রাজার খুবই ভালো লাগলো। আবার ভীষণভাবে ভাবতেও লাগলো! ভেবেচিন্তে রাজা হেসে বললেন, ‘নিশ্চয়ই তুমি খুব বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার মতো এমন দু-চারটে ছেলে আমার মুল্লুকে খুবই কম আছে। তবে তুমি আমার উজিরকে থাপ্পড় মেরে যেই অপরাধ করেছ, তার সাজা তোমাকে বেশি নাহয় একটু হলেও পেতে হবে।’ রাজার কথা শুনে বুড়ো উজির সাহেব খুবই খুশি হলেন। রাজদরবারে থাকা সবাই হাততালি দিলেন। হিরা চুপ করে বসে বসে ভাবতে লাগলো, সাজা থেকে কীভাবে বাঁচা যায়!

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩

চলবে…

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-১

এক রাজার দেশে এক দরিদ্র কৃষক ছিল। জমিজমা যা-ই ছিল আর না-ই ছিল, কৃষকের এক টুকরো সোনা ছিল। সোনার টুকরো বলতে কৃষকের একটিমাত্র ছেলে। কৃষক যুবক কালে বিয়েসাদী করার পর এই সোনার টুকরো পেতে অন্তত ১২টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অবশেষে ১৩ বছরের মাথায় মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ লীলায় কৃষকের ঘরে ফলল সোনা। সেই সোনার টুকরোর নাম সোনা না রেখে, নাম রেখেছে হিরা। হিরাকে দেখতেও হিরার টুকরোর মতোই দেখা যায়। কৃষকের আদরের ধন হিরা পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছেও ছিল আদরের। সবার কোলেকাঁখে আদরে আহ্লাদে হাঁটি হাঁটি পা পা করে একসময় হিরা বড় হয়ে উঠলো। স্কুলেও শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাছে হিরা হিরার মতোই ছিল। এভাবে একসময় মেট্রিক পাস করে ফেললো। কলেজে ভর্তি হলো। হিরা খেলাধুলা যা-ই করতে, লেখা-পড়ার দিক দিয়ে ছিল খুবই মনোযোগী। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর রাতদুপুর পর্যন্ত হিরা বসা থাকে পড়ার টেবিলে।

একদিন সকালবেলা হিরা’র বাবা তাঁদের জমিজমা’র খাজনা দিতে যাচ্ছিল রাজার দরবারে। বাবার পরনে পরিষ্কার জামা-কাপড় দেখে হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবা তুমি কোথায় যাচ্ছ?’ ছেলে হিরার কথার জবাবে হিরা’র বাবা বলল, যাচ্ছি তো রাজদরবারে। আর এই যাওয়া তো আজকে নতুন নয় রে বাপ! প্রতিবছরই তো খাজনা দিতে যেতে হয়। কেন, তুই কি জানিস না?’ হিরা বাবার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘মনে হয় দেখেছি অনেকবার। তবে নিজের পড়াশোনার ধান্ধায় তেমন একটা খেয়াল করিনি। তো বাবা, যেই রাজাকে তুমি খাজনা দাও। সেই রাজা’র রাজবাড়ীটা কোথায়?’ হিরা’র বাবা বলল, ‘সে-তো অনেক দূর বাবা! কেন, তুই কি রাজবাড়ী যাবি নাকি?’ ছেলে হিরা বলল, ‘যার মুলুকে থাকি, তাকে দেখাও একটা ভাগ্যের ব্যাপার-স্যাপার! তাই এখন দেখার খুবই ইচ্ছে জাগছে বাবা। না দেখলেও তো হচ্ছে না। একদিন আমি নিজেই তোমাদের রাজার দরবারে গিয়ে দেখা করে আসবো বাবা। তুমি এখন যাও।’ ছেলের কথা শুনে কৃষক হাসতে হাসতে রাজ-দরবারের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন।

এক রাতে হিরা পড়ার টেবিলে বসে বসে ভাবছে! ভাবনা হলো ঐযে, খাজনা নেওয়া রাজা আর রাজদরবার এসব নিয়ে। সারারাত ভেবে রাত শেষে ভোরবেলা হিরা রাজাকে দেখার জন্য বাড়ি থেকে বের হলো। কোথায় রাজা আর কোথায় রাজার মুলুক, তা হিরা’র ছিল অজানা। মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করতে করতে একসময় হিরা রাজবাড়ীর সামনে পৌঁছে গেল। রাজবাড়ীর প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে গেইটে টোকা দিল। কোনও সাড়াশব্দ নেই। আবার টোকা দিল। তাও কোনও সাড়াশব্দ পেল না। সাড়াশব্দ না পেয়ে হিরা’র মনটা খারাপ হয়ে গেল। রাজ গেইটের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। এভাবে দুপুর শেষে বিকাল হয়ে গেল। আর কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা হয়ে যাবে। সন্ধ্যা হয়ে গেলে হিরা আর আজ বিড়িতে ফিরতে পারবে না ভেবে আবার নিজের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো। সারাদিন রাজবাড়ির সামনে থেকে সন্ধ্যার পর বাড়ি আসলো। রাত শেষে আবার ভোর হতে-না-হতে রাজার বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলো। আগের দিনের মতো রাজ গেইটে টোকার পর টোকা দিয়েও যখন সাড়াশব্দ পাচ্ছিল না, তখন হিরা প্রতিজ্ঞা করল রাজাকে না দেখা পর্যন্ত আর বাড়ি ফিরে যাবে না। এতে গেইট আরও পাঁচদিন না খুললেও না। আর যে – সময় ই গেইট খুলুক, গেইটের ভেতর থেকে আগে যে-ই বের হবে, তাকেই এক থাপ্পড় মারা হবে। এতে করে জীবন যাক আর থাক, একটা হবেই। যেই ওয়াদা, সেই কাজ! হিরা রাজ গেইটের সামনে ভিখারির মতো বসে রইল।

এভাবে দুইদিন রাজবাড়ির গেইটের সামনেই পার হয়ে গেল। কিন্তু রাজার বাড়ির গেইট আরও খুলছে না। আর খুলবেই বা কেন! রাজবাড়ির গেইট খোলার একটা নিয়ম বাঁধা আছে। নিয়ম হলো, গেইট খুলবে দুই-তিন দিন পরপর। রাজার বাড়ির গেইট যে তিনদিন পরপর খোলে, তা আর হিরা’র জানা ছিল না। প্রতি শুক্রবার, সোমবার, বৃহস্পতিবার। আবার রবিবার, বুধবার ও শনিবার। এভাবে হিসাব করে তিনদিন পরপর গেইট খোলা হয়। হিরা এই নিয়মটা জানলেন রাজবাড়ীর পাশে থাকা এক লোক থেকে। তা কখন কোন টাইমে খোলা হয় তাও হিরে জেনে নিলেন। কেন এই নিয়ম, তাও জানলেন। নিয়মটা হলে রাজবাড়ীর বাজার এবং রাজ্যের কারোর কোনও নালিশ সালিশ করার জন্য এই নিয়মটা নির্ধারণ করা। সময় সকাল ৮টায় বাজার। ১০ থেকে দুপুর পর্যন্ত সালিশ নালিশ, দেন-দরবার। এরপর আবার দুইদিন গেইট বন্ধ। তা থাকুক বন্ধ! একসময় গেইট তো খুলবেই। এই ভেবে হিরা চুপচাপ রাজ গেইটের সামনেই বসে আছে। গেইটেই সামনেই হিরা’র দিন যাচ্ছে, রাত পোহাচ্ছে। নাছোড় বান্দা হিরা তাঁর ক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে, বসেই আছে খেয়ে না খেয়ে।

আবারও রাত পোহালো, সকাল হলো। হিরা চেয়ে আছে গেইটের দিকে! কখন গেইট খুলবে, সেই আশায়। সকাল ৮টার সময় রাজার উজির সাহেব সাথে করে এক চাকর বেটা সাথে নিয়ে বাজারে যাওয়ার উদ্দেশে গেইটের সামনে আসলো। প্রহরী গেইট খুলছে এমন শব্দ হিরা’র কানে এলো। হিরা তাঁর ডানহাত বাড়িয়ে রেডি হয়ে আছে। গেইটের ভেতর থেকে যার মাথাই আগে বের হবে তাকেই বসিয়ে দিবে এক থাপ্পড়! এই নিয়ত করে হিরা রেডি! এমন সময় গেইটের পকেট গেইট দিয়ে উজির বের হবার জন্য মাথা বাড়িয়ে দিতেই, ঠাস্ করে এক থাপ্পড় মেরে দিলো উজিরের গালে। উজির তো গালে ধরে মা-গো, বাবা-গো বলে ডাক চিৎকার শুরু করে দিল। উজিরের সাথে আসা চাকর দিলো এক দৌড়! গেইটের প্রহরী দৌড় দিলো রাজদরবারে দিকে। প্রহরী রাজদরবারে গিয়েই কাঁপতে কাঁপতে ধপাস্ করে পড়ে গেল। রাজা তাঁর সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালো। কী হয়েছে, কী হয়েছে শোরগোল পড়ে গেলো! প্রহরীকে দরবারে থাকা সবাই টানাটানি করে ওঠালেন।

তারপর রাজা ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বেটা রামছাগল, কী হয়েছে বল!’ প্রহরী তখন কাঁপতে কাঁপতে বললো, ‘হু-হু-হুজুর, উজির সাব শেষ!’ প্রহরীর কথা শুনে রাজার চোখ উঠলো কপালে। রাজা তাঁর দুই চোখ বড় বড় করে বললো, এই বেটা ছাগল, ভালো করে বল কী হয়েছে?’ প্রহরী বললো, উজির সাহেব গেইট থেকে বাইর হবার সময় কে যেন ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় মেরে দিল। সাথে সাথে উজির সাহেব মাটিতে পড়ে গেল। এতক্ষণে মনে হয় উজির সাহেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে, ‘হু-হু-হুজুর। প্রহরী এসব বলতে বলতে উজির সাহেব গালে ধরে গেইটের চাকরের কাঁধে হাত রেখে রাজদরবারে হাজির হলো। রাজা উজিরের এই অবস্থা দেখে বলল, ‘এই কে আছিস! জলদি যাও! গেইটের সামনে যাকেই পাও ধরে নিয়ে আস! কার এতবড় সাহস! আমার উজিরকে থাপ্পড় মারে? ওকে আমার একটু দেখার ইচ্ছে হচ্ছে। যাও তাড়াতাড়ি!’

রাজার হুকুম বলে কথা। হুকুম দিতে দেরি, যেতে আর দেরি নেই। চার পাঁচজন সিপাহী ঢাল-তলোয়ার নিয়ে দৌড় দিলো গেইটের দিকে। গেইট তখনো খোলা। সিপাহীরা দেখল গেইটের বাইরে একটা ছেলে এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই ছেলে, আমাদের উজিরকে থাপ্পড় মারলো কে রে?’ হিরা হেসে বললো, উজির না বাদশা তাতো আমি চিনি না। তবে পাঁচ মিনিট আগে একজন লোক গেইট থেকে বের হবার সাথে সাথে আমিই থাপ্পড় মেরেছি।’ হিরা’র কথা শুনে সব সিপাহীরা ঘাবড়ে গেল। সিপাহীরা বলছে, ওরে বাপরে! বলে কী! উজিরকে থাপ্পড় মারার পরও এতো সাহসিকতা?’ ওমনি রাজার সিপাহীরা হিরাকে খপ্ ধরে ফেললো।

হিরা বললো, ‘আমার কি অপরাধ? আমাকে তোমরা এভাবে ধরলে কেন? ছাড়ো, হাত ছাড়ো বলছি! তোমাদের উজিরকে থাপ্পড় মেরেছি বলে আমাকে এভাবে ধরলে? আরে ভাইসব, তোমাদের রাজার তো কপাল ভালো। এখানে উজির না হয়ে রাজা হলেও থাপ্পড়টা রাজার গালেই পড়তো। ছাড় আমাকে। আমি নিজেই রাজার কাছে যাবো।’ হিরা’র কথা শুনে এক সিপাহী বললো, না, তোকে ছাড়া যাবে না। এটা রাজার হুকুম! চল আমাদের সাথে। হিরা বললো, ‘না আমি এভাবে যাবো না।’ আরেক সিপাহী বললো, ‘বেটা তুমি এভাবে যাবে না তো কীভাবে যাবে? প্রয়োজনে তোমাকে কাঁধে করে নিয়ে যাবো।’ এই বলেই চার পাঁচজন সিপাহী হিরার হাত পায়ে ধরে শূন্য করে নিয়ে চললো রাজদরবারের দিকে।

তখন হিরা সিপাহীদের কাঁধে দুই হাত রেখে হাসতে হাসতে বললো, ‘কি যে ভুল করেছি আমি! আগে জানলে তোমাদের উজিরকে আরও কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতাম। মাত্র একটা থাপ্পড় মেরেছি। সেজন্য আমাকে তোমরা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছ! যদি আরও দুইটা থাপ্পড় মারতাম, তাহলে তো তোমরা আমাকে পালকিতে করে নিয়ে যেতে।’ এই কথা বলার সাথে সাথে সিপাহীরা হিরাকে শূন্যের উপর থেকে ধপাস্ করে নিচে ফেলে দিয়ে বলে, ‘বেটার সাহস কত বড়? দুইটা থাপ্পড় মারলে নাকি আমারা পালকি করে নিতাম! চল বেটা, হেঁটে চল!’ হিরা তখন মাটিতে বসে বসে মা-গো, বাবা-গে বলে চিল্লাচ্ছে, আর বলছে, ‘ভাই তোমরা তো আমাকে উপর থেকে ফেলে আমার কোমরটা ভেঙে দিলে। এখন আর আমার হাঁটার শক্তি নাই। আমি এখানেই বসলাম, তোমরা তোমাদের রাজাকে এখানে আসতে বলো!’ হিরার কথা শুনে সিপাহীরা বলছে, ‘কি মুশকিলে না পড়লাম রে ভাই! এই ধর ধর শালাকে। ওকে কোলে করেই নিতে হবে।’ এই বলেই চার পাঁচজন সিপাহী হিরা’কে আবার কাঁধে করে রাজদরবারে নিয়ে যেতে লাগলো।

তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-২

চলবে…