২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছর ও মুজিব শতবর্ষ

161077528_

প্রতি বছরই মার্চ মাস আসে, মার্চ মাস গত হয়। কিন্তু আমার মন থেকে সেই ভয়াল মার্চ মাসের স্মৃতি মুছে যায় না। বলছি, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের কথা। যেই মার্চ মাস আমাদের পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতার সূচনালগ্ন। যেই মার্চমাস মুক্তির জন্য মুক্তিযুদ্ধ। যেই মার্চ মাস বাংলার মুক্তিকামী মানুষের মুক্তির সূচনালগ্ন। যেই মার্চমাস আমাদের জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার সূচনালগ্ন। আমি সেই মার্চ মাসের কথাই বলছি।

আমি তখন ৭/৮ বছরের নাবালক শিশু। নাবালক শিশু হলেও আমি তখন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলাম। তখন আমার মোটা-মুটি ভালমন্দ বোঝা এবং স্মৃতিতে ধরে রাখার বয়স হয়েছিল। তাই প্রতিবছর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি গত হয়ে যখনই মার্চ মাসের আগমন ঘটে, তখনই আমার স্মৃতিতে জমা থাকা সেই ভয়াল মার্চ মাসের কথা মনে পড়ে। আমার মনের টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর লাগানো আগুনের লেলিহান শিখার কালো ধোঁয়া, আর সেই সময়ে খেয়ে-না-খেয়ে থাকার কষ্টের স্মৃতিগুলো।

তখন আমার বাবা আর বড়দা চাকরি করতেন নারায়ণগঞ্জে। আমি আর আমার চার বড়দি ও মা-সহ থাকতাম নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতেই। আমাদের বাড়িটা ছিল, নোয়াখালী বেগমগঞ্জ থানাধীন বজরা রেল স্টেশনের পশ্চিমে মাহাতাবপুর গ্রামে। আমাদের বাড়িটা ছিল মোটামুটি একটা বড়বাড়ির মতো। আমার বাপ-কাকারা ছিলো তিন-ভাই, আর বাবার জেঠাতো ভাই ছিলো দুইজন। এক বাড়ি হলেও সংসার ছিলো আলাদা-আলাদা ভাবে যারযার মতো। আমাদের বাড়ির ঘরগুলো ছিলো মাটি দিয়ে তৈরি, সেই মাটি আনা হয়েছিল চাটগাঁও (চট্টগ্রাম) থেকে গহনা নৌকা করে। সেজন্য আমাদের বাড়িটাকে সবাই নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় ‘মাইটগা দেলানওয়ালা বাড়ি’ নামেই চিনতো-জানতো।

আমাদের গ্রামে আমার বয়সী সব ছেলেদের মধ্যে আমি ছিলাম একটু দুষ্টু টাইপের। যেকোনো খেলাধুলায়ও ছিলাম সবার আগে সবার ওপরে। আমার স্মৃতিশক্তিও ছিলো খুবই প্রখর! তাই এখনো স্পষ্ট মনে আছে সেই মার্চ পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ের কথা। মনে পড়ে আমার বয়স যখন ৭/৮ বছর, তখন-ই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ৭-মার্চ ঢাকার রেডক্রস ময়দানে দিয়ে দিলেন স্বাধীনতার ডাক, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে বললেন শত্রুর বিরুদ্ধে। এরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা ২৫ মার্চ কালরাতে শুরু করে দেয় নির্বিচারে গণহত্যা। জ্বালাও পোড়াও আর লুটতরাজের মতো ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড। তখন আমি কেবলমাত্র তৃতীয় শ্রেণি পাস করে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া শুরু করেছিলাম। সেই ভয়াল অগ্নিঝরা মার্চে ১৯৭১ এর কথা এখনো মনে পড়লে শরীর শিউরে ওঠে।

162196494_

সে সময় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ও তাদের দোসররা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ হত্যাযজ্ঞে কতজন বাঙালি নিহত হন, তা নির্ধারণে কোনো সঠিক জরিপ পরিচালিত হয়নি; তবে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এক হিসাব অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ ধরা হয়। বলা হয় পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক এই গণহত্যা ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম। যাই হোক, এবার আমার জানা আর আমার নিজ চোখে দেখা কিছু স্মরণীয় ঘটনায় আসা যাক।

সে সময় আমার মা স্বামী সন্তানের চিন্তায় পাগলের মতো হয়ে সকাল-সন্ধ্যা ঘুরে বেড়াতো গ্রামের বড়বাড়িতে রেডিওর খবর শোনার জন্য। তখন আমাদের গ্রামে শুধু বড়বাড়িতেই একটা ওয়ান বেন্ডের রেডিও ছিল, টেলিভিশন তো কি জিনিস তা মানুষ বুঝতোই না। গ্রামের মানুষের মনে তখন শুধু আতঙ্ক আর ভয়! কখন যেন শুরু হয়ে যাবে জ্বালাও পোড়াও। এদিকে পাক-হানাদার বাহিনী সারাদেশ রক্তাক্ত করে ফেলছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে খবরও আসতে শুরু করছিল। আমার মায়ের কান্না আরও ভারী হতে শুরু করলো, স্বামী আর সন্তানের জন্য। সেসময় আমার তিন বোন ছিল বিয়ের উপযুক্ত, তাদের নিয়েও আমার মায়ের চিন্তার কোনও কমতি ছিল না। সারাদিন আমার বোনদের চোখে-চোখে রাখলেও রাতে রাখতো ঘরে কাঁড়ের ওপরে, নাহয় ঘরের বাইরে সুপারি বাগানে মাটির নিচে। পাকিস্তানি মিলিটারি আর দেশীয় রাজাকারদের ভয়ে আমার মা আর আমার তিন বোন মিলে গোপনে সুপারি বাগানের মাঝখানে মাটি খুঁড়ে বাংকারের মতো তৈরি করেছিল। যাতে দেশীয় আল-বদরদের থেকে ইজ্জত বাঁচতে পারে। এমনভাবে বাংকার তৈরি করেছিল যে, আমার তিন বোন দলাদলি করে ওই বাংকারে শুয়ে থাকতে পারতো। বাংকারের উপরে বাঁশের চটি বিছানো থাকতো। চটির উপরে থাকতো মাটি আর ছড়ানো-ছিটানো গাছের লতা-পাতা। যাতে অপরিচিত কেউ দেখেও বুঝতে না পারে যে, এটা বাংকার।

এভাবে চলতে-চলতে কেটে গেল প্রায় দুই মাস, এরপর হঠাৎ একদিন বাবার আগমন। ঠিক সকালবেলা সবার অজান্তে বাবা বাড়িতে এসে হাজির। বাবার ক্লান্ত শরীরে ময়লা জামাকাপড়। বাবাকে দেখে আমার তিন বোন আর আমি খুশিতে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে ঝাপটে ধরলাম। কিন্তু আমার মা’ তেমন খুশি হতে পারেনি, বড় ছেলেকে সাথে না-দেখে। আমার মা’ আমার বাবাকে বলছিল, “আমার নিমাই কোথায়” মায়ের কথা শুনে বাবার কোনো কথা নেই। বোবা যেন হয়ে গেছে। তখন বাড়ির সবাই বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “নিমাই কোথায়?” বাবা শুধু এইটুকুই বললো যে, জানিনা। তবে শুনেছি ও-নাকি শরণার্থী হয়ে ভারত চলে গেছে। বাবার কথা শুনে তখন বাড়ির সবাই আমার মাকে সান্তনা দিচ্ছিল, আর কান্নাকাটি না-করতে। তারপরও আমার মায়ের কান্নাকাটি থামছিল না।

এদিকে বাবা নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছিল একেবারে খালি হাতে। সাথে তেমন কোনও টাকাও আনতে পারেনি। সংসারে পাঁচজন খানেওয়ালা, জামাকাপড় বাদ দিলেও খাওয়ার খরচ কম নয়। তখন আমার বাবার মনের অবস্থা আমি দেখেছি। বাবা পাগলের মতো হয়ে কাজের সন্ধানে গ্রামের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বেড়াতো। কিন্তু তখন আমার বাবাকে কাজ দিবে কে? সবারই একই অবস্থা! সবার মনে তখন শুধুই আতঙ্ক, কখন কি যেন হয়ে যায়! তারপরও অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা সংগ্রহ করে যুদ্ধের পুরোটা সময় বাবা মুড়ির ব্যবসা করে সংসারের চার-পাঁচজনের মুখের আহার জুগিয়েছিল। তারপরও কোনোকোনো দিন তিন বেলার মধ্যে দু’এক বেলা না খেয়েই থাকতে হতো।

আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেতো মার্চের শেষ থেকে পাকবাহিনীর তাণ্ডবলীলা শুরু হওয়ার পর থেকে রাতের-বেলায় আমাদের বাড়ি থেকে দেখা যেতো বজরা বাজারের দোকানগুলিতে লাগানো আগুনের লেলিহান শিখা, আর সাদাকালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এসব দৃশ্য দেখে মনে হতো, হানাদার বাহিনী যেন আমাদের গ্রামের আশেপাশেই অবস্থান করছে। এই যেন কারো-না-কারোর বাড়িতে হানা দিচ্ছে। তবে মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আমাদের গ্রামে পাক-হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি। দেশীয় আল-বদর রাজাকার বাহিনীও তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারেনি। পারেনি মুক্তিযোদ্ধাদের কারণে।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই মাস পরই আমাদের গ্রামে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা গ্রাম ও গ্রামের নিরীহ মানুষদের বাঁচানোর জন্য সর্বক্ষণ টহল দিতে থাকে। গ্রামের সব বাড়ি থেকে আমাদের গাড়িটিই ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের বেশি পছন্দের। কারণ, আমাদের গ্রামে প্রবেশ করতে হলে প্রথমেই আমাদের বাড়ি পাশ দিয়েই প্রবেশ করতে হবে। মানে আমাদের বাড়িটা ছিলো গ্রাম ঢোকার প্রবেশদ্বার। তাই মুক্তিযোদ্ধার সকাল থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত আমাদের বাড়ির উঠানে বসে আমার বড় জেঠার সাথে আলাপ-আলোচনা করতো। চলতো চা-পানের আয়োজন। আমাদের বাড়িতে সে সময়কার মুক্তিযুদ্ধের নিয়ে নিত্যদিনের চা-পানের আয়োজনে আমি সঙ্গী হয়ে। বয়সে ছিলাম খুবই ছোট, তবুও তাদের চারপাশে সর্বক্ষণ ঘুরে বেড়াতাম।

এভাবে চলতে চলতে একসময় পাক-হানাদার বাহিনী ও দেশীয় আল-বদরদের পরাজয়ের ঘণ্টা বেজে ওঠতে শুরু করলো। নভেম্বর গত হয়ে যখন ডিসেম্বরের আগমন ঘটলো, সেসময় পাক-হানাদার বাহিনী ও দেশীয় আল-বদর রাজাকার বাহিনীরা আরও হিংসাত্মক হতে লাগলো। কিন্তু শত প্রাণপণ চেষ্টা করেও পাক-হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর বাহিনীরা কুল-কিনারা পাচ্ছিল না। শেষ অবধি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে পরাজয় বরণ করে ভারতীয় সেনা ও মুক্তিযুদ্ধের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই থেকে গত গেলো ৪৯ বছর! এখন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়া বীর মুক্তিযুদ্ধের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছর ও মুজিব শতবর্ষ।

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

3 thoughts on “২৬ মার্চ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছর ও মুজিব শতবর্ষ

  1. সকল আপদ বিপদ আর দুঃসময়ের মাঝেও "আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়া বীর মুক্তিযুদ্ধের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ৫০ বছর ও মুজিব শতবর্ষ হোক নিরাপদ গৌরবের। শান্তি চাই। দেশের মানুষের প্রতি জাতির পিতার কমিটমেন্ট পূর্ণ হোক। শুভেচ্ছা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. কামনা করি আমাদের এই দেশটা যেন হয় জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা। 

      শুভকামনা থাকলো শ্রদ্ধেয় দাদা। 

      1. শুভ কামনা রইলো আপনার জন্যও কবি। সময় ভালো কাটুক। :)

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।