গল্পঃ হায়েনা
************
প্রচন্ড গরমে চুলগুলো উচু করে ঝুঁটি বেঁধে মাথার ঘোমটাটা ফেলে দিয়ে মহুয়া এক মনে ডাটার শাকগুলো বাঁচছে। ডাটা আর আলু দিয়ে তেলাপিয়া মাছ রান্না হবে আজ। আর শাকগুলো হবে ভাজি ।ওপর থেকে বোঝা যায়নি যে ভিতরের শাকগুলো খুব একটা ভালো না। দোকানদারের মিষ্টি কথায় বিশ্বাস করা ঠিক হয়নি তার। মিলির শাক খুব পছন্দ। সে শুধু শাক দিয়ে এক থালা ভাত খেয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আজ শাকের পরিমান নিতান্তই কম। মহুয়া মনে মনে দোকানদারকে একটা গালি দেয়।
মিলি বেচারা না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনে রাতেই একবার রান্না করা হয়। গার্মেন্টসে চাকরি করলে মানুষের জীবন আর জীবন থাকে না। যদিও কষ্ট হয় তবু মহুয়া মিলিকে আগুনের কাছে যেতে দেয় না। তার কি জানি কেন যেন ভয় ভয় করে। একা একা মেয়েটা পুড়ে ধরে মরে না থাকে।
প্রতিদিন মিলি এই সময়টাতে ঘুমিয়ে নেয়। রাত দশটার দিকে এক ডাকেই সে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এটা তার নিত্য দিনের অভ্যাস। ঘুম থেকে উঠে খাওয়া দাওয়া শেষে সে রাত জেগে পড়ে। মহুয়া তার পাশে বসে বসে ঝিমায় আর চোখ মেলে দেখে মাঝে মাঝে, সব ঠিক ঠাক আছে দেখে আবার একটু ঝিমায়। আজ কাজের চাপ একটু বেশি ছিলো, ফিরতি পথে বাজার করে ফিরতে ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গেছিলো। দেরি হলে আজকাল মহুয়ার খুব চিন্তা হয় মেয়ে বড় হয়ে উঠছে। ঘরে একা থাকে। পাশে যে পাঁচ/সাত ঘর লোক থাকে সবাই একই গার্মেন্টসে কাজ করে। বাড়ি থাকে ফাঁকা। দুনিয়ায় খারাপ লোকের অভাব নাই। চিন্তা সেজন্যই। খাওয়ার পর মিলি বই নিয়ে পড়ে আর মহুয়া ঘুমায়। ঘুমায় বলা ভুল।ঝিমুনি বলা চলে একে।
-কত রাত হলো রে মা।
-রাত একটা বাজে, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো মা। আমার দেরি হবে একটু। একটা অঙ্ক কিছুতেই মিলছে না।
-এখন ঘুমা কাল সকালে চেষ্টা করিস।
-ঠিক আছে, মা তুমি এবার কিন্তু আমারে আজিজ স্যারের কাছে প্রাইভেট দিবা। আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি না। না হলে কিন্তু রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে।
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আসলে সে আর পেরে উঠছে না, লেখা পড়ার যা খরচ! এতো টাকা সে কোথায় পাবে? দুবেলা ভাত জোটানোই যেখানে মুশকিল। লেখাপড়াটাকে আজকাল তার কাছে গরীবের ঘোড়া রোগ মনে হয়।
আজ প্রচন্ড গরম পড়েছে। অন্যদিন জানালা দেওয়া থাকে, আজ একটু বাতাসের আশায় জানালা খোলা। আশেপাশের সব ঘরে শুনশান নিরবতা নেমে এসেছে। সবাই এখন গভীর ঘুমে, তাদের ঘরটা অবশ্য বেশ একটু দূরে। তবুও বোঝা যায় কেউ জেগে নেই।
মহুয়া বলল,
-জানালাটা লাগিয়ে দে মা। খোলা রাখিস না।
মিলি জানালার কাছে পৌছতেই একটা মুখ ভেসে ওঠে। এত রাতে জানালায় মুখ! চেনা অচেনা বড় কথা নয়। ভয় লাগারই কথা। মিলি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করে,
-কি চাই। কে আপনি?
-কেমন আছো ? আমি গো আমি, ভয় পাও কেন?
পাশের বাসার মান্নান চাচা!
চাচাকে সে ভালো মতো চেনে আর জানে, মায়ের সাথে ভালো সম্পর্ক, বিপদে আপদে সাহায্য করতে বলার আগেই দৌড়ে আসে। এই লোকটাকে তার মতলববাজ বলে মনে হয় না। তবে এতো রাতে লোকটা এখানে কি চায়? এর আগে তো কোনদিন রাত বিরেতে একে এদিকে আসতে দেখেনি।
মিলির ইচ্ছা না হলেও বলে,
-ভালো আছি চাচা। আপনে ঘুমান নাই?
মহুয়া এতক্ষণ ঘুম ঘোরেই ছিলো। সে হঠাৎ অন্য মানুষের গলার আওয়াজে সতর্ক হয়ে গলা চড়ায়,
-এই কে ?এতো রাতে কে কথা বলে?
-আমি মান্নান !
-এতো রাইতে কি? বাড়িত যান, মাইনসে দেখলে খারাপ কইবো।
-কেউ দেখবো না। সব ঘুমে। মহুয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মেয়ের মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। কি একটা ভাবে। কঠিন সিদ্ধান্ত নেবার সময় চলে এসেছে মনে হয়। কিছু একটা করতে হবে না হলে এই হায়েনার হাত থেকে সে মিলিকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবে না।
মানুষের জীবনে অনেক অজানা দিক থাকে যা সযতনে লুকানো। কোন কোন ঘটনা লুকিয়ে রাখতে হয় সামাজিক মর্যাদা হারাবার ভয়ে। আবার কখনো অনেকটা বাধ্য হয়ে। মহুয়ার জীবনে এরকম লুকানো গল্প আছে। সেই প্রবঞ্চনার গল্প কেউ জানে না। সে অতি গোপনে সেই গল্প লুকিয়ে এসেছে সযতনে। এছাড়া তার কি বা করার ছিলো।
তখন মিলি পাঁচ বছর বয়স। সদ্য বিধবা হয়েছে সে। আত্নীয় বলতে এই পোড়া শহরে কেউ নেই। গার্মেন্টসের চাকরিটা আগেই ছিলো বলে মিলির বাপটা মারা যাওয়ার পরে সে এই শহরে টিকে গিয়েছিলো। আর যাওয়ার জায়গাও তো ছিলো না তার। সব জায়গায় যেমন শিকারী পশু থাকে মহুয়ার আশেপাশে তেমন একটা পশু ঘুরে বেড়াতে লাগলো সবার অলক্ষে। সন্তপর্ণে।
একে তো বিধবা একা এক নারী। কৌশলে ফাঁদ পাতে আপাত দৃষ্টিতে নম্র ভদ্র হায়েনারূপী মান্নান। সবাই তাকে অল্পবয়সী সাধাসিধা যুবক হিসাবে খুব ভালো জানে। বাইরে সাধাসিধা হলে কি হবে ভিতরে ভিতরে কামার্ত এক ভয়ঙ্কর পুরুষ সে। খালি চোখে এই এলাকার সবাই তাকে নম্র ভদ্র জানলেও মহুয়া জানে কতটা নরপিশাচ এই মান্নান।
বস্তির বারোয়ারি সাধারণ খোলামেলা গোসলখানার সুযোগ নিয়ে মহুয়ার গোসল দৃশ্য মান্নান মোবাইলে ভিডিও করে অতি গোপনে। তারপর সুকৌশলে সে মহুয়াকে কবজা করে খুব সহজে। অসহায় হরিণীর মতো বাধ্য হয় মহুয়া মান্নানের পাতা ফাঁদে পা দিতে। প্রত্যেক সপ্তাহান্তে সে ধর্ষণের শিকার হয় মান্নানের দ্বারা। অনেকবার ঘর পাল্টাতে চাইলেও মান্নানের নীরব হুমকির কাছে সে আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।
মহুয়ার মন আজ রাতে অন্য আশঙ্কায় উদ্ধিগ্ন হয়ে ওঠে। এক ঝলক দেখে সে বুঝতে পারে মান্নানের চোখ মুখ আজ অন্য কথা বলছে। তার চাওয়াগুলো বদলে গেছে ইদানিং। এর আগে সে ইশারায় দাবিও জানিয়ে এসেছে। তার সাথে যা হয়েছে মহুয়া চায় না মিলির সাথে তা হোক। সে মিলিকে জীবন দিয়ে হলেও আগলে রাখবে।
মান্নান আবদারের সুরে বলে,
-দরজা খুলবা না ভাবী।
-রাত হইছে আপনে বাড়িত যান।
-বাড়ি তো যামু তয় তোমার লগে একটু কথা আছিল। প্রাইভেট কথা। জরুরী।
-এতো রাইতে কোন কথা নাই।
-আহ ভাবী তুমি বড় বেশি অবুঝ হইয়া উঠতাছো।
-আপনে বাড়ি যান।
-যদি না যাই। মান্নান ঘাড় বাঁকায়।
মহুয়া বুঝতে পারে আজ একটা ফায়সালা করতেই হবে। একে এতোদিন প্রশ্রয় দেওয়াটাই হয়েছে চরম ভুল। আগেই একটা হেস্তনেস্ত করা উচিত ছিলো। কথা বাড়ালে লোকজন জেগে যাবে। একে আজ একটা শিক্ষা দিতেই হবে।
মহুয়া দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।
মান্নান আহ্লাদী করলো।
-ঘরে ডাকবা না।
-না।
-কেন?
-মাইয়ার সামনে আমি….
-আমিতো আজ তোর লগে বইতে আহি নাই। মান্নান দাঁতে দাঁত চাপে।
মহুয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এই শয়তানের লোভ ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
-অন্য দিন হইবো। আজ মিলির শরীর খারাপ।
-আমি কিছু করমুনা, একটু দেখইখ্যা তারপর যামুগা। এই আবদারটুকু রাখবা না।
মিলিরে রাজি করানো লাগবো, চিল্লা চিল্লি হইলে আপনের বদনাম হইবো।
-আমি জানি। আমি সব বুঝি। তুমি কি মনে কর আমি তোমাগো কথা একটুও ভাবি না? তুমি রাজি কিনা কও?
মহুয়া কি যেন ভাবে তারপর মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলে,
-আপনে খাড়ান আমি মিলিরে রাজি করাইয়া আহি।
মান্নান খুশিতে আকাশের তারা গুনতে থাকে। যাক এতোদিনের প্রচেষ্টা সফল তাহলে।
মহুয়ার মাথায় দ্রুত চিন্তারা ঘুরপাক খায়। সে চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এছাড়া যে আর কোন উপায় নাই। তার জান থাকতে সে মিলিকে এই নরপশুর হাতে কিছুতেই তুলে দেবে না। প্রথমে মিলিকে সে রান্না ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বলে। মিলি প্রশ্ন করলে সে ইশারা করে। চুপ থাকতে বলে। মিলির ভয় করলেও সে চুপচাপ মায়ের কথা মেনে নেয়। কি করে যেন সে মোটামুটি একটা ধারনা পেয়ে গেছে। কি হতে চলেছে।
এরপর মহুয়া ভেতর ঘর থেকে ধারালো বঠি সযতনে লুকিয়ে এনে মান্নানকে আহ্বান করে ঘরে আসার জন্য। মান্নান ঘরের চৌকাঠ পেরুতেই অসুরিক শক্তি দিয়ে মান্নানের মাথা বরাবর ধারালো বঠি চালিয়ে দেয়ার আগ মুহুর্তে মিলি এসে তার মায়ের পা চেপে ধরে।
মহুয়া প্রচন্ড অবাক হয়ে বলে,
-সরে যা মা, এই পাপীর বিচার না করলে আমার পাপ হবে।
-মা তুমি উনারে ছাইড়া দাও।
-না, মহুয়ার স্বরে যেন আগুন ঝরে।
-মা আমি উনারে ভালোবাসি। তুমি উনারে কিছু কইয়ো না। তুমি ছাইড়া দাও। যা কওনের তুমি আমারে কও।
ধূর্ত মান্নান সুযোগ বুঝে তার হাত থেকে বঠিটা কেড়ে নেয়।
হঠাৎ দমকা হাওয়ায় মহুয়ার পৃথিবী উল্টা পাল্টা হয়ে যায়। দুলে ওঠে তার চারপাশ। এ কি করে সম্ভব? এটা কি করে সম্ভব?
মহুয়া খুব ঠান্ডা গলায় বলে,
-মা’রে পাপের প্রায়শ্চিত্ত আরো আগে করলে আমার এমন দিন দেখতে হইতো না। অন্যায়ের প্রশ্রয় দেওয়া মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় ভুল। আমি আগে জানলে এই ভুল কোনদিনই করতাম না।
মিলি তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকে। আশেপাশের ঝুপড়ির লোকেরা জেগে উঠেছে। কেউ কেউ এদিকে এগিয়ে আসছে। পরম নিশ্চিন্তে মান্নান বিড়ি ধরালো। সে জানে মিলি আজ তার পক্ষে আছে। তার কোন ভয় নেই। মা মেয়ে দুজনেই আজ তার হাতের মুঠোয়।
মিলি একটানা কেঁদে চলেছে,
-মা তুমি আমারে মাফ কইরা দাও। মা তুমি আমারে মাফ কইরা দাও।
মহুয়ার কাছে আজ এই পৃথিবীটাকে অর্থহীন মনে হয়। লোকজনের ভীড় বাড়তে থাকে। মহুয়া অথর্বের মত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
শুভ্রোজ্জল শ্বেত নির্মল ও স্বচ্ছ কলমের ছোঁয়া
'- মা তুমি আমারে মাফ কইরা দাও।
মহুয়ার কাছে আজ এই পৃথিবীটাকে অর্থহীন মনে হয়। লোকজনের ভীড় বাড়তে থাকে। মহুয়া অথর্বের মত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।"
___ কী একটি অসহনীয় সময় !! শুরুটি ড্রামাটিক মনে হলেও শেষে ছিলো চমক।
ভালগেছে কিন্তু গল্পের নাম হায়না বাদে অন্যকিছু দিতে পারতে কবি দা
মন্তব্য করবার মতো কোন ভাষা নাই আমার…….