মহরমের চাঁদ উঠতেই পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে আখড়া। মাঝরাত পর্যন্ত চলবে নকল যুদ্ধের মহড়া। ওদিকে খানকায় চলতে থাকবে হৃদয় নিঙড়ে নেওয়া মর্শিয়া গানের মজলিশ।
আশমানির মামাশ্বশুরেরা, অর্থাৎ কৃষ্ণার শ্বশুরবাড়ির লোকজন পির দীক্ষিত সুন্নি মুসলমান। বাড়ি সংলগ্ন সেই পিরের খানকা, তৎসংলগ্ন মসজিদ- মাদ্রাসা, পির ও পিরাশ্রিতের আলাদা কবরস্থান যাকে বলে মাজার,— স-ব স-ব কিছু পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে গুজিয়ে তুলতে সব শিষ্যরা একত্রিত হয়েছে। এঁরা ক্বাদেরিয়া তরিকায় হুজুর পিরের বায়েতি মুরীদ, অর্থাৎ দীক্ষিত মন্ত্রশিষ্য। মহরমের চাঁদ- ভোর নারী-পুরুষ, ছেলে- বুড়ো, প্রত্যেকেই এক বিশিষ্ট ধর্মীয় বাতাবরনের মধ্যে অতিবাহিত করবেন।
গ্রামের মানুষ যে যেমন পারেন হাত বাড়ান। মূল দায়িত্বটি কিন্তু আশমানীর মামাশ্বশুরদের। এঁরাই হুজুর পিরের মূল খাদিম। মহরম চাঁদ উঠলো, তো কী এক শুদ্ধ আধ্যাত্মিক সত্ত্বা এসে ভর করলো এঁদের ওপোর।
এতকাল ধরে মামিশ্বাশুড়িদের দেখিয়ে দেওয়া মতে, মহরমের চাঁদ ওঠার আগেই, ও বিছানা- বালিশের ওয়াড়,কাপড়- চোপড় মাদুর – পাটি, সব – সব কিছু সাবানকাচা করে নিয়েছে। ধুয়ে-মেজে নিয়েছে হাঁড়ি- কড়া- বঁটি- শিলনোড়া, আটাচালুনি, চাকি, বেলুনি,হাতা- খুন্তি স-ব। বাড়ির আর সবার মতো ও নিজেও মাথায় সাবান দিয়ে পাক- গোসল করে নিল। আগামী পনেরোদিন কেউ আমিষ খাবেনা, নারী-পুরুষ এক বিছানায় শোবে না, গায়ে-মাথায় তেল মাখবেনা, পায়ে চটি পরবেনা। কেউ কারো এঁটো খাবেনা। এমনকি একজনের বিড়ির আগুনে অন্যজন বিড়ি ধরাতেও পারবে না। বাধ্যতামূলকভাবে রোজা রাখবে। খাদ্যে- পানীয়ে- আহারে- আচরণে যতটা সম্ভব কৃচ্ছতা পালন করবে প্রত্যেকে। বাড়ির ছেলে- ছোকরা গুলো চাঁদ উঠতেই বাড়ি ছেড়ে কাসিদ্ হতে আখড়ায় গিয়ে জুটেছে।
এসব দিনগুলোয় আশমানীর অভ্রান্তে মনে পড়ে যায় নিজের ছেলেবেলার কথা। প্রায় একই রকম ধুমধামে ওদের গাঁয়ে গাজন উৎসবে চড়ক পুজো হত চৈত্র সংক্রান্তির দিন। এক সপ্তাহ আগে থেকেই ওর কাকারা – ভাইরা সন্ন্যাস নিয়ে হবিষ্যি করতো। একই রকমভাবে দলবেঁধে শিবমন্দিরে একাহারী হবিষ্যি করতো, তেল- সাবান মাখতো না, বাড়ি ঘরে আসতোনা, দোরে দোরে গান গেয়ে ভিক্ষা মেগে সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যা সেজে সিধে সংগ্রহ করতো। বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে আসে স্পষ্ট স-ব ছবি।….একজন মড়া সেজে শুয়ে পড়তো পথের ওপোর, আর দলবল সুর করে গান ধরতো :
শুন শুন সন্ন্যাসী ভাই শুন বিবরণ,
পথের মাঝে মড়া পড়েছে কিসেরই কারন?
মড়া পড়েছে ভাল হয়েছে সন্ন্যাসীদের ভাল,
বুড়োশিবের দয়াতে মড়া উঠে গেল……
এই সময় মড়াসাজা ছেলেটি উঠে বসতেই সবাই মিলে সমস্বরে ধ্বনি দিয়ে উঠবে,
‘ জয় বাবা মহাদেবের চরণের সেবা লাগি,—– মহাদেব’।
এখনো যেন স্পষ্ট কানে বাজে। কী সুন্দর সুন্দর সব গান!…..
আশমানির তন্ময়তা তছনছ করে দিয়ে ওর মামাতো দ্যাওরের দল আকুল প্রশ্ন রাখে,
….মহরমের চাঁদের আজ তিনদিন হয়ে গেল, তুমি যে এখনো নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছো!
……..কেন রে, কি করতে ভুলে গেলাম বলতো?
….. সেই ফেস্টুনটা! সেই যে গো, সেই খাজা পিরবাবার মহরম সম্বন্ধে উক্তিটা! এখনো লিখলেনা,—– তারপর শুকুনো,—- তারপরে তো টাঙাতে পাবো।দেরি হয়ে যাচ্ছে না?
——–সেতো কাল মাঝরাত পর্যন্ত লিখে তবে আমি শুতে গেছি। আজ সেহেরিতে তাই দেরি হয়ে গেল।
ওরা একই সঙ্গে খুশি ও চমকিত। আশমানি ঘরের ভেতর থেকে বার করে আনলো চমৎকার- দর্শন ফেস্টুনটা। একটা বড়ো আয়তাকার লাল শালুর ওপর রূপালী রঙ্ দিয়ে তুলিতে লেখা :
“শাহ্ আস্ত্ হোসেন(হোসেনই হচ্ছেন সম্রাট)
বাদশা আস্ত্ হোসেন(হোসেনই হচ্ছেন
বাদশা)
দিঁন্ আস্ত্ হোসেন(হোসেনই হচ্ছেন ধর্ম)
দিঁনপানা আস্ত্ হোসেন ( হোসেনই হচ্ছেন
ধর্মের আশ্রয়)
সর্দাদ্ না দাদ্ দস্ত্দরে দস্ত্এ এজিদ ( মাথা
দিয়েছেন কিন্তু এজিদের হাতে হাত
মেলাননি)
হক্কাকাকে বিনা এ লা- ইলাহা আস্ত্ হোসেন
(আল্লা ভিন্ন অন্য উপাস্য নেই, — এই
কালামের মূল হচ্ছেন হোসেন)
খাজাপির মৈনুদ্দীন চিশ্তি রহমতুল্লাহের মহরম সম্পর্কিত মূল্যায়ম থেকে উদ্ধৃত।।”
…….. কিরে, দেখেনে ভাল করে।কোন ভুল- টুল থাকলে তাড়াতাড়ি বলবি, হাতে যেন সময় থাকে।
……… কি যে বলো! তোমার ভুল ধরবো আমরা!
….. বেশ। তা তোদের প্যান্ডেল কদ্দুর?
—–ফি বারের মতো চন্দননগর থেকে আলোকশিল্পী তো আনিয়েছি,দেখছি…..
বলতে বলতে জোরালো দলবদ্ধ গানের আওয়াজে দৃষ্টি চলে গেল বাইরের দিকে,….
… ওই দ্যাখো। কবে ‘চাহারম’ তার ঠিক নেই, কাসীদের দল বেরিয়ে পড়েছে চাল তুলতে।
…….সর্বত্র তাইতো হয়। চাঁদ উঠলেই তো কাসীদরা মোর্শিয়া গেয়ে চাল তোলে।
….অন্যত্র কাসীদরা চাল তুলে আখড়ায় রেঁধে খায়, কিন্তু আমরা যে ভাবী খানকা থেকেই সবার খাবার ব্যবস্থা করেছি। চাল তোলার কি দরকার ওদের?
….. অমন ছোটখাটো ব্যাপারে নজর দিস না। মোর্শিয়া গাইতে বেরোলেই তো সবাই সিধে দেবে…… কথা বলতে বলতেই একেবারে দুয়োরে চলে এসেছে মোর্শিয়ার দল। দলে চল্লিশ বছর থেকে শুরু করে দশ বছরের বালকও রয়েছে। কী করুন আর্তি নেমে আসছে মোর্শিয়ার কথা ও সুরে :
ভেঙ্গে দে মা হাতের চুড়ি
মাথার সিঁদুর তুলে নে,
এ জীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে–
হাসেম- বানা রণে গেল
আরতো ফিরে এলনা,
এজীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে—-
তুলা রইলো আলতা- সিন্দূর
আর তো পরতে প্যালাম না,
এ জীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে—-
নয়ালাল মোর রণে গেল
আর তো ফিরে এল না,
এ জীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে—–
বাসি বিয়ে না হইতে
ঘুচলো স্বামীর সুখ রে,
এ জীবনে শান্তি নাই মা পুড়া কপালে —–
আশমানি একটা বড় পেতলের থালায় করে চাল- ডাল- আলু ও বেশ কিছু সব্জীর সিধে সাজিয়ে ওদের ঝুলিতে ঢেলে দিলে পর ওরা এই গান শেষ করে অন্য একটা মোর্শিয়া গাইতে গাইতে অন্য দুয়োরে এগিয়ে গেল :
ভাই গো হাসান গো, কে দিল জহর গো,
ভাই গো হাসান গো, হায় – হায়- হায়—-
মেজবিবি জায়েদা দিয়েছে জহর গো
ভাই গো হাসান গো, হায়- হায়-হায়—-
মায়মুনা কুটনি এনেছে জহর গো
ভাই গো হাসান গো, হায়- হায়- হায়—-
গানের ভেতর দিয়ে চুঁইয়ে নামা শোকে থম্ ধরে গেল পুরোটা আবহে।
( ক্রমশ)
কী যে অসাধারণ আপনার লিখন কৌশল !! অবাক হতে হয়। প্রণাম দি ভাই।
ভালবাসা রিয়া
এই খণ্ডটি অন্যান্য গুলোর চেয়ে বেশ সমৃদ্ধ। দারুণ বলা যায়।
ভালবাসা রিয়া
ধন্যবাদ আপনাকে।