সঙ্গিনীর নাম নিঃসঙ্গতা

সঙ্গিনীর নাম নিঃসঙ্গতা।

তিন থেকে তিরানব্বই – যে কারোর কাছে অনায়াসে পৌঁছে যেতে পারে উক্ত সঙ্গিনীটি –অবহেলা, মনোযোগহীনতা, বা বিচ্ছিন্নতার রন্ধ্রপথ ধরে। হ্যাঁ, রন্ধ্রপথ পেতেই হবে। লৌহবাসরে কালনাগিনীর ওই একমাত্র প্রবেশপথ। খোলামেলা রোদ হাওয়ার হাট করা দরোজায় নিঃসঙ্গতা নামক সঙ্গিনীটি আদপে পা বাড়ায় না। ওর আগমন ও স্থিতি, নিবাস ও নিকেশি কার্যক্রমের জন্য এক ভয়াবহ অন্ধকার রন্ধ্রপথ জরুরি।

পছন্দের রন্ধ্র ধরে নিজের টার্গেটটি বাছার ক্ষেত্রে সে মোটামুটি থাবা বাড়ায়
ক) বাল্যেঃ
১. উচ্চাকাঙ্খী বাবা- মায়ের একমাত্র সন্তান
২. নিম্নমধ্যবিত্ত আটচালার বিপরীতে ‘পশ’ এলাকায় বাস
৩. যৌথান্নের হাঁড়ি ফুটিফাটা হয়ে গেছে কবেই
৪. রূপকথার বই পড়ার বয়েস এখনো হয়নি, অথবা হলেও বাড়িতে বইপড়া নামক বিলাসিতার রেওয়াজ নেই
৫. পরিবারের মনোনীত জন ছাড়া আর সবার সাথে মেলামেশা ও বন্ধু তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা
৬. তিনকুলে চোদ্দপুরুষে লোলচর্ম বৃদ্ধ – বৃদ্ধা নেই, বা থাকলেও সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ
৭. নির্জীব খেলনা ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রসঙ্গী
৮. অন্যান্য।

সঙ্গিনীটি পদার্পণেই শিকারটিকে বাড়াবাড়ি রকমের আত্মমগ্ন করে তুলবে, অন্যের উপস্থিতি তিক্ত লাগতে থাকবে। যে আদত দূরত্ব ছিলই বাবা -মার সঙ্গে তা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে ভয়াল গহ্বরের চেহারা নেবে, ক্রমশ নিজের সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা বাড়তে বাড়তে মেলাঙ্কলিয়া রূপান্তরিত হবে ডেলিঙ্কোয়েন্সি তে। বিশেষ কিছু বুঝে উঠবার বয়েস আসবার আগেই তকমা পড়ে যাবে গায়ে- ‘প্রবলেম চাইল্ড’। নীট ফল—হয় পরনিগ্রহ, নয় আত্মনিগ্রহের সুনিশ্চিত পরিনমন।

খ) যৌবনেঃ
১. কাছের জনেরা যদি মুখ ফেরায়
২. যদি স্বেচ্ছাদূরত্ব রচনা করেন সাফল্যের হাতছানিতে (অস্বাভাবিক উচ্চাকাঙ্খা)
৩. যদি সাফল্য পেয়ে গেলে গজদন্তমিনারে বসবাস শুরু করে দ্যান
৪. নিজেকে অসাধারণ ভেবে নিয়ে কোনো দল বা সঙ্ঘের ছোঁয়াচ এড়িয়ে চলেন
৫. যদি বই পড়ার পাট না থাকে
৬. যদি নান্দনিক শিল্পকলা বা সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত না থাকেন
৭. প্রাণহীন যন্ত্রই যদি একমাত্র বন্ধু হয়
৮. যদি কোন সদর্থক নেশা না থাকে
৯. অন্যান্য।

প্রথমেই সঙ্গিনীটি ভিকটিমের সর্বায়বে রাশভারি মুখোশ এঁটে দেবে। আশপাশের নিকটজনদের এড়িয়ে শুধু নয়, দাপটে বশীভূত করতে চাইবেন। যতো তীব্র হবে সে প্রচেষ্টা, ততটাই দ্রুত বেগে নিকটজনেরা পাশ কাটিয়ে পালিয়ে বাঁচবে। যে দু- চার আত্মজনের পক্ষে পালিয়ে বাঁচা একান্তই অসম্ভব, অত্যাচারিত হবে তারা মানসে, মননে, এমনকি শারীরিক ভাবে হওয়াও অসম্ভব নয়। ফলতঃ হত্যা – আত্মহত্যা – জীবিতে মৃত্যুর দহন পোড়ন। মেলাঙ্কলিয়া টু এ্যলিয়েনেশন,ভায়া ডেলিঙ্কোয়েন্সী। সঙ্গিনী শুধুই ওই নিঃসঙ্গতা। সঙ্গিনী বললাম, কারণ পুরুষই সচরাচর এর বেশি প্রিয়, খুব সহজে খাপ খুলতে পারে না নারীর কাছে। নারী জন্মগতভাবে, স্বভাবগতভাবে অনেকটাই সাংসারিক ও সামাজিক।

এযাবৎ সংখ্যাগরিষ্টে সামান্যে ব্যাপৃতা, কাজেই উচ্চাকাঙ্খা, অসামান্য প্রত্যাশা এবং তার প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিতে নিঃসঙ্গতা গ্রাস করতে পারে না তাকে চট করে। বেঁচে থাক আমাদের কাপড় কাচা ডিটারজেন্ট এবং বাসন মাজার ‘নিম্বুক্ষার কেক’, এর পিছু পিছু বউ- ঝিয়ের সঙ্গে মুখ চালাচালি, তেলের শিশি ভাঙ্গার কারনে শিশুর ওপোর তোড়- তড়পানি, হলুদ জব্দ করা কিল্ গত মৌতাতে রূপান্তরিত হয়ে আবহমান কালের এই গৃহস্থালি প্রক্রিয়া অমৃতের উৎস হয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে উচ্চাশা বিহীন, তুঙ্গ – লক্ষ্য বিবর্জিত কোটি কোটি মা- ঠাকুমা, মাসি-পিসিদের। অবশ্যই পাশাপাশি যুৎসই সঙ্গত দিয়ে গেছে ছেঁড়া – ফাটা- কাপড়ে গড়া নক্সিকাঁথার শিল্পকলা, রামায়ণ – মহাভারত – কোরান- পুরাণের নিয়মিত পঠন ও শ্রবণ, ছেলে ভোলানো ঘুমপাড়ানি ছড়া, আচার- আমসত্ত্ব, খই-মুড়কি, পিঠে – পায়েস, মোয়া- নাড়ুর সৃজনী শিল্প,সর্বোপরি নিজের চারপাশের প্রতিটি জনের সুখ -সুবিধে,আনন্দ – আহ্লাদের ব্যবস্থা করার ব্যস্ততায় নিজের সুখ কী জিনিস সেটাই বুঝতে না পারা এই নমস্য সাধারণীদের সঙ্গ নিঃসঙ্গতার এক্কেবারে না পসন্দ্।

গ) তার বাছা শিকার বার্ধক্যেঃ
১. অবসরপ্রাপ্ত পুরুষ — হঠাৎ করে যার দিন তিন চব্বিশ বাহাত্তর ঘন্টার হয়ে গেছে
২. স্ত্রী বিয়োগ অথবা চিরতরে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় প্রতিদিনের অভ্যস্ত জীবনযাপনে হঠাৎ করে অনেকটা ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়ে যাওয়া
৩. শরীর মনের অশক্তি এতোকালের লালন করে আসা আসক্তির নাগাল না পাওয়া
৪. স্বাবলম্বী সন্তানের সংসার ছোট করে দেওয়া
৫. চাইলেও শিল্পচর্চা বা সমাজসেবামূলক কাজে শরীরের সহযোগিতা না পাওয়া
৬. অন্যান্য।

এই পর্বে হত্যা নেই, শুধুই আত্মহনন। এইসব কিছু একযোগে বা এককে, চতুষ্পার্শ্বে বিচ্ছিন্নতার ঘেরাটোপ রচে, যুগের এ্যাতো এ্যাতো বিলাস বৈভব, চুড়ো করা দেখানে সফলতার উচ্ছ্বাস, উঁচু উঁচু হাইটেকের যত্রতত্র বিজয় নির্ঘোষ, —- বুড়োঠোঁট অসহায়ে বিড়বিড় করে, …. নিঃসঙ্গতা নাম্নী সঙ্গিনীর হাত চেপে ধরে… ‘দেয়ারস্ এবসোলিউটলি নো হাইটেক টু ওভারকাম দিস ডিসট্যান্স’।

মোহময়ী শক্তিময়ী সঙ্গিনীর বগলদবা হয়ে কেউ নিরালম্বে ঝুলে পড়েন সিলিং থেকে, কেউ তার ঠান্ডা কোলে জান্ জুড়ান বিষ পেয়ালা মুখে তুলে, কেউবা আবার খ্যাতির দ্যুতি পিঠ- আড়াল করে স- ব ছেড়েছুড়ে এই অহংকারী সঙ্গিনীকে নিয়ে জলকেলিতে মগ্ন হ’ন গঙ্গার গহীনেঃ

সবাই চলে গেছে —
শুধু একটি মাধবী তুমি
এখনো তো তবু জেগে আছো—
কে- ন, কতো আর জেগে জেগে
দেখে যাবে আমার
চোখের জলের একাকার……

________________
( ‘এবং প্রবন্ধ’ বই থেকে)

5 thoughts on “সঙ্গিনীর নাম নিঃসঙ্গতা

  1. সবাই চলে গেছে –
    শুধু একটি মাধবী তুমি
    এখনো তো তবু জেগে আছো-
    কে- ন, কতো আর জেগে জেগে
    দেখে যাবে আমার
    চোখের জলের একাকারhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. সঙ্গিনীর আগমন ও স্থিতি, নিবাস ও নিকেশি কার্যক্রমের জন্য এক ভয়াবহ অন্ধকার রন্ধ্রপথ জরুরি। মনে হয়।

  3. বিশ্লেষণ আর উপাত্তের বিচার তুলে এনেছেন। অনেক শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।