ভুলে থাকা মন … ২২ (চিঠি)

প্রিয়মন,
মেঘ নদীতে হাওয়ায় পানসি বেয়ে অবশেষে আমার কাছে এলো তোর চিঠি। চিঠি খুলতেই একরাশ রজনীগন্ধার সুবাস ছুঁয়ে গেলো আমায়। খুঁজে পেলাম তোকে। ঝলমলিয়ে উঠলাম আমি।

জানিস, কাল রাতে বৃষ্টি এসেছিল, ঝড়কে সাথে নিয়ে। তুই তো জানিস এই রাতের বৃষ্টি আমার কত্তো প্রিয়। যখন ঝড় হচ্ছিলো, দৌড়ে গেলাম ছাঁদে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম। প্রশান্ত মহাসাগরের কোন এক অজানা দ্বীপের গন্ধ এসে লাগলো আমার নাকে। সেই দ্বীপকে বুকের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে নীচে নেমে এলাম। আর বৃষ্টি, ঝড়কে নিয়ে আমার শহর ঘুরে ঘুরে আমায় খুঁজে ফেরে… আমার ঘরের জানলাটা খোলা ছিল। তাই ওরা আসার সাথে সাথেও পর্দায় বাঁধা পিতলের ছোট্ট ঘুঙুরগুলোয় সুর তুলল “টুংটাং”।

আর জানিস, পড়ার টেবিলে যত্নমাখা বইগুলোকে পরম আদরে ছুঁয়ে দিলো বৃষ্টি, আর ঝড় রাখলো তার অগোছালো ছাপ। আয়নায় ছুঁয়ে দেখলো আমার প্রতিচ্ছবি …তারপর এঘর থেকে ওঘর গেল ..ওঘর থেকে সেঘর …থমকে দাঁড়াল বারান্দায়… সেই যেখানে আমি দাঁড়িয়ে থাকি রোজ, তোর কথা ভাবি। আর রেলিংয়ে হাত রেখে তোর প্রিয় গানগুলো গুনগুনিয়ে উঠি; জানিস, ঠিক সেখানে, একেবারে সেখানেই বৃষ্টি হাত রেখে গুনগুনিয়ে নিলো বুঝি। ভীষণ হিংসে হচ্ছিল তখন আমার। তোর আর আমার গন্ধমাখা বারান্দা থেকে গন্ধ নিল মেখে…তারপর ভেসে গেল হাওয়ায়… আর ঠিক তখনই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো আয়নায় আমার প্রতিচ্ছবি… বৃষ্টি এল ঝমঝমিয়ে।

প্রতিদিনের চোখের জলে অনেকটা ধুয়ে গেছে মন। জানি তুই ভুলে গেছিস। জানি এখন আমি তোর কাছে গুরুত্বহীন। তাইতো ভীষণ অচেনা জানা আমি আজ তোর কাছে। আর আমি তোকে সেই কিছুদিন আগের মতোই ভেবে নিয়ে আবদার করে বসি। জানিস কখনো কারো কাছে আবদার করিনি। তোর কাছেই করতাম। আর কোন আবদার করবো না কথা দিয়েছি তোকে। আসলে আমি ভীষণ বোকা তাই বারবার বোকার মতো ফিরে পেতে চাই পুরনো তোকে। আর তুই বারবার শব্দের তীর এক্কেবারে আমার বুকে বিঁধে দিস। কালও দিয়েছিস। রক্তাক্ত হয়েছি কাল ভীষণ। চোখে নেমেছে লবন জলের স্রোত। হয়তো ভুলে গেছিস তুই, বলেছিলাম তোকে যে আমি হারাবার ভয় পাই। বলেছিলাম তোকে জানিস আমার যা ভাগ্য, এত সুখ আমার সইলে হয়। এখন বুঝলি তো, যে আমার ভাগ্যে সুখ নেই।

জানি অনেক লেখার মতন এ লেখাও পাবে না তোর ছোঁয়া। তবু আজ মন বড় টলটলে দীঘি। তোর নতুন খেলার সাথীর সাথেই খেলায় মাতিস রোজ। আমি এখন পুরোনো,অচল। এখন এই সব দিনে একা। তুই আর আসিস না ছাদের সে কার্ণীশ বেয়ে, যেখানে কল্পনায় তোকে পেতাম। মেঘেরা তবু রোজ একবার করে এ শহরের শার্সীর আর্শীতে আর্জি জানিয়ে যায় আমাকে ভেজাতে চেয়ে। ভিজে যায় মন-চোখ।

তাইতো কাল গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টিরা এসেছিলো নিয়ে যেতে, বাধা পেয়ে চোখে জলের সাথে সুর তুলেছে। তোর কাছে এতটুকু আকাশ চাইতে গিয়ে অপমানিত হয়ে গুটিয়ে গিয়েছি নিজের কোলের ভিতরে। রাতের পর রাত নিজের কোলে কোল পেতে নিজেকে ঘুম পাড়াই আমি। আস্তে আস্তে বড় হয় দীর্ঘশ্বাস। তোর এখন, তোর প্রিয়ার সাথে নীল রঙা রাতভোর। আর আমি শিশির ভেজা কুয়াশার গন্ধের মতন একটু একটু করে মুছে যাই তোর মন থেকে।মুছে দিচ্ছিস তুই একটু একটু করে। কেউ বোঝেনা জানিস। কেউ না। তুইও না। না, তুইও আমাকে বুঝিস নি।বুঝতে চাস নি। হেঁয়ালির মতো উচ্ছিষ্ট হয়ে যাই আমি। উপাচারে যেমন অসম্মানিত ঈশ্বর, অবহেলায় তেমনি আমার বিসর্জন।

আজ আর আমি কোথাও নেই। আমি নেই জানিস তুই? মরে গেছি আমার আমি। এখানে, ওখানে, সেখানে, কোনখানেই আমি নেই। কোত্থাও নেই …

ভালো থাকিস রে মন। আকাশের তারাদের মতো ঝলমলিয়ে, খুব ভোরের রোদের মতোই সতেজ থাকিস। জানবি তুই ভালো থাকা মানেই আমার ভালো থাকা।

… ইতি,
আমার হারানো মন…
______________

25 thoughts on “ভুলে থাকা মন … ২২ (চিঠি)

  1. এই বয়সেও এমন চিঠি পড়লে যারপরনাই উদ্বেলিত হই আমি। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_cry.gif
    সেই বয়সটা থাকলে দোয়াত কালিতে হয়তো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরেও যেতো।
    আর এখন পেটে অথবা মগজে বিস্ফোরক বিস্ফোরিত হলেও বোধকরি আর হবে না।

    1. চিঠি লেখার বয়স হয়না …লিখে গেলুন একখান চিঠি বন্ধু

  2. চিঠির ভাঁজে বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
    এত দারুন করে কিভাবে যে লিখেন! ঈর্ষা হয় খুব।
    ভাল থাকবেন।

  3. পড়লে শুধু পড়তেই মন চায়, পড়তেই মন চায়। পড়তে পড়তে একসময় মন ছুঁয়ে গেল দিদি। সত্যি দারুণ লিখেছেন দিদি। আপনার মতো এমন করে লেখা তো অসম্ভব!       

  4. মেঘ নদীতে হাওয়ায় পানসি বেয়ে অবশেষে আমার কাছে এলো তোর চিঠি। চিঠির অপরূপ সৌন্দর্য্য মুগ্ধ হবার মতো কবি রিয়া চক্রবর্তী। হতাশা দুঃখ বেদনা আনন্দ কী নেই এতে!! সব আছে। 

  5. জানি ফিরবি না, তবু মন তোর ফেরার অপেক্ষায়। মন ভারী করে দিলেন কবি রিয়া দি।

    1. জানি ফিরবি না, তবু মন তোর ফেরার অপেক্ষায়। ভাল থাকুন দিদি ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  6. তোর এখন, তোর প্রিয়ার সাথে নীল রঙা রাতভোর। আর আমি শিশির ভেজা কুয়াশার গন্ধের মতন একটু একটু করে মুছে যাই তোর মন থেকে।মুছে দিচ্ছিস তুই একটু একটু করে। কেউ বোঝেনা জানিস। কেউ না। তুইও না।

     

    * প্রিয় কবি দি, আপনার প্রকাশ ক্ষমতা দেথে মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে!!!

    ভালো থাকুন নিরন্তর…. https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  7. মনকে লিখা চিঠি পড়লাম দিদি ভালো লাগলো  মন ই সব মন ই হাসায় কাদায় বাচায় আবার নিজেকে মারার জন্য মনই  দায়ী, শুভকামনা সব সময় https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. নিজেকে মারার জন্য মনই দায়ী। ভাল বলেছেন দিদি ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  8. শব্দের ভাঁজে ভাঁজে চমৎকার চিঠির কথাগুলি মনকে নাড়া দিয়ে গেলো। শুভকামনা দিদিভাই 

  9. ভালো থাকিস রে মন। আকাশের তারাদের মতো ঝলমলিয়ে, খুব ভোরের রোদের মতোই সতেজ থাকিস। জানবি তুই ভালো থাকা মানেই আমার ভালো থাকা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।