ডিপ্রেশন ও আত্মহত্যা

ডিপ্রেশন ও আত্মহত্যা

ডিপ্রেশন একটি জনসাধারণের গুরুত্বপূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বা Public mental health problem. এ রোগটি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এতে মনে হয় ভবিষ্যতে এটা epidemic রূপ নিয়ে নিতে পারে। আর তা ভাবা আশ্চর্যের নয়। মৃদু বা মাঝারি মাত্রার চেয়েও লক্ষণীয় ভাবে ডিপ্রেশন গভীর রূপ নিতে পারে এবং এটি মানুষের মানসিক ও শারীরিক উৎকর্ষের মাত্রা ও কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিতে পিছপা হয় না। ডিপ্রেশন এমন এক মেন্টাল ডিসঅর্ডার, যার অশুভ থাবায় মানুষের জীবন হয়ে পড়তে পারে ক্ষতবিক্ষত। পৃথিবীর নিয়ম মাফিক কাজের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কাজ হচ্ছে আত্মহত্যা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য ভয়ংকর মেডিকেল এবং সামাজিক ব্যাধি। কিন্তু কথা হচ্ছে আত্মহত্যা বা ডিপ্রেশন সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়া অতি জরুরি। ডিপ্রেশন হচ্ছে emotional illness যার ফলে ব্যক্তির মন মেজাজের অবনতি ঘটে দারুনভাবে এবং হতাশাগুলো আকর্ষিত করে ইচ্ছাশক্তিকে, জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রকে গ্রাস করে বিষণ্নতা, নিরবঘাতক রুপে জীবনে আনে কষ্ট, হতাশা, একাকিত্ববোধ।

** কোন কারন ছাড়াই এমনিতেই মন খারাপ দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চলতে থাকলে মানুষটির ডিপ্রেশন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। মনে রাখার মত কথা হলো… এক নাগাড়ে ২ সপ্তাহ বা তারও বেশী সময় ধরে অকারনে দুঃখবোধ, ক্রন্দনপ্রেরনা, সর্বশেষে আত্মহত্যার চিন্তা চলতে থাকে তবে ডিপ্রেশন বলে গণ্য করা যায়। ডিপ্রেশনে ভুগলে মানুষের জীবন হয়ে যায় বিষাক্ত। নিজেকে totally valueless ভাবতে শুরু করে। বিভিন্ন ট্রমাগত কারনে নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ডিপ্রেসড হয়ে উঠে জীবন। তখন ডিপ্রেশড অন্তর্ভুক্ত মানুষগুলোর ভিতর কিছু সাধারন বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়।

* কনফিডেন্স ব্যাপারটা একদমই হারাতে বসে, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না এটাই বিয়োজকে কনভার্ট হয়ে ভক্ষম করে ফেলতে পারে।

* মাথায় ঝিমঝিম ধরে, খাবারে, ঘুমে অনীহা আসে, গা – হাত-পা সবসময় ব্যথা অনুভব হয়।

* কোনো কাজে মনোযোগ আসে না। ”ভালো লাগছে না” বাক্যটা অনায়াসেই মুখ থেকে নিঃসরিত হয়ে যায়।

* জীবনের টার্নিং পয়েন্টে পৌঁছাতে না পারা। প্রতিটি মানুষ ছোট থেকেই একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে রাখে এবং সেদিকে খেয়াল রেখেই সামনের দিকে এগোতে থাকে। কিন্তু কথা হচ্ছে, মানুষটা হাত চারাদিকে ছড়িয়েও একটুর জন্য টার্নিং পয়েন্টটা ছুঁতে না পারে…… তখনই ডিপ্রেশন চারিদিকে ঘিরে ধরে।

* পারিবারিক সমস্যা থেকে সৃষ্ট চাপ ডিপ্রেশনের বড় একটা কারন।

* প্রেমে বিচ্ছেদ বা আজীবন বলতে না পারার হা- হুতাশ, প্রতারিত হওয়ার কষ্ট, কিংবা নিজের চোখের সামনে প্রিয় মানুষটাকে পাল্টে যাওয়া, বিবাহ বিচ্ছেদ ইত্যাদি হচ্ছে হতাশাগ্রস্থ মানুষের জন্য বড় একটা পাঠ।

* বাচ্চা জন্মের পর মায়ের ডিপ্রেশন হওয়া খুবই কমন বিষয়। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর যে ডিপ্রেশনটা হয় তা অনেকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এক সপ্তাহের বেশী সময় ধরে চলতে থাকলে এটাকে সিরিয়াস ডিপ্রেশন গণ্য করা যেতে পারে। ২য় শতাংশ মা Low grade past-natal depression এ ভোগেন।

* অ্যানিমিয়া ও হাইপার থাইরেডিজম, এপিলেপসি, হেপাটাইটিস, ব্রেন টিউমার, অ্যাজমা ও ম্যালেরিয়ার ঔষধের দীর্ঘদিনের ব্যবহার মেজাজ খিটমিট করে দিতে পারে, জীবনকে মূল্যহীন করে তুলতে পারে।

* কোন কাছের মানুষের মৃত্যু হলে বা অকস্মাৎ কোন মৃত্যু স্বচোখে দেখলে বিষণ্নতা ছেয়ে ধরতে পারে।

* পড়ালেখা বা অফিসের কাজে অতিরিক্ত পরিমানে চাপ পড়লেও অনেকটা ডিজওর্ডার হয়ে পড়ে।

* হঠাৎ করেই নিজের পজিশন সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে যাওয়া। নিজের ফ্রেণ্ড সার্কেলের কাছে তার কোন মূল্য নেই, ভালবাসা নেই এটা আবিষ্কার করে ফেলা প্রচুর পরিমানে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

আত্মহত্যার সর্বপ্রকার চেষ্টা চালাতে থাকে।

কখনো পড়েছিলাম আফ্রিকাতে নাকি একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে আত্মহত্যা করার সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায় সিংহের লেজে দড়ি বেধেঁ, দড়িটা নিজের কোমরে বেধেঁ দড়িতে টান দেওয়া। বন্ধুদের সাথে মজা করে বলতাম কেউ আত্মহত্যা করলে এভাবে যেন করে। যাই হোক শুরুতেই আপনাদের সাথে মজা করলাম। সেই বয়সে আত্মহত্যা বিষয় তেমন কোন ধারনা ছিল না তাই বন্ধুদের আত্মহত্যা করার নানা উপায় বলে দিতাম। সাধারণত আমি ও আমার বন্ধুরা কেউই শান্ত স্বভাবের ছিলাম না।

সবাই বলে জীবনের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান কিন্তু আমার মনে হয় প্রতিটি জীবের প্রধান চাহিদা পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা সম্মানের সাথে। তাই প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার যুদ্ধে নিয়োজিত সবাই। আর এই বেঁচে থাকার সংগ্রাম থেকে সরে আসা কেউ কেউ আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা আমাদের কাম্য নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সড়ক দূর্ঘটনার পর আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুহার সবচাইতে বেশি।

সামাজিক দ্বন্দ্ব, মানসিক অশান্তি ,হতাশা, বিষণ্নতা ও ব্যক্তিত্ব গোলোযোগ আত্মহত্যার প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বহুগুণে। বিষণ্নতা বা Depression ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ পীড়াদায়ক অবস্থা বা Mental health Disorder এটি মস্তিষ্কে মধ্যে রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা তৈরী করে যার ফলে হতাশা, ক্লান্তি অথবা জীবনের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হয়। তীব্র বিষণ্নতা ইন্দ্রিয়কে একটি বিষয় কেন্দ্রিক করে তোলে। যার ফলে ব্যাক্তি জীবনের স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলে এবং একজন মানুষ আশাহীন হয়ে পড়ে।

Attention taking Disorder যাদের মধ্য রয়েছে তারা শুধু মাত্র, অন্যর মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য আত্মহত্যার প্রচেষ্টা নিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে। সংস্কৃতির প্রভাবও আমাদের পরিবেশকে আত্মহত্যা প্রবণ করে তুলছে খানিকটা। মানুষ যখন কোন নাটক বা সিনেমা দেখে তখন সে অভিনেতা বা অভিনেত্রীর সাথে নিজেকে Identification করে ফেলে, তাই কোন অভিনেত্রী আত্মহত্যার প্রচেষ্টার পর জীবিত হতে দেখলে, অনেক মানসিক ক্রুটি সম্পন্ন ব্যাক্তি আত্মহত্যা করতে পারে। সেজন্য আমি কাউকে টিভি দেখতে নিষেধ করছি না, আমাদের দেশীয় চ্যানেল গুলোর কাছে অনুরোধ অনুষ্ঠান গুলো যেন বিনোদন নির্ভর হয় এবং ভাল কোন Message সবার কাছে পৌঁছায়। কোন গণমাধ্যম যখন একটা বিষয় প্রচার করে, সে বিষয়টি অনেকের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাই এমন কিছু প্রচার করা উচিত নয় যার মাধ্যমে আমাদের সমাজের ক্ষতি সাধন হতে পারে।

ছেলে মেয়েদের মোবাইল ফোনে দূর আলাপনের ফলে একে অপরের মধ্যে মানসিক নির্ভরশীলতা বেড়ে যাচ্ছে, হঠাৎ এতে ব্যাঘাত ঘটলে তীব্র মানসিক পীড়নের সৃষ্টি হতে পারে, যাদের পীড়ন সহনশীলতা কম। অনেক মেয়েই নিজেকে ছেলেদের চেয়ে অনেকটা দুর্বল ভাবে। এছাড়াও মেয়েদের আবেগ অনেক বেশি। তারা তাদের মানসিক সমস্যাগুলো নিজেদের মধ্যে চেপে রাখে অর্থাৎ বাইরে প্রকাশ করতে চায় না। ফলে মানসিক চাপ যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় তখন তারা সেটা সহ্য করতে পারে না। এর ফলে তাদের প্রতিরক্ষা কৌশল ভেঙ্গে পড়ে এবং সমাধান হিসেবে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

যারা জীবনটাকে খেলা মনে করছেন, কল্পনাবিলাসী হয়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে তাদের বলছি আপনি হয়ত জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু জীবনটা কি শুধু আপনার? একটি বার আলাদা করে ভাবুন, আপনার Root টা কোথায়? আমি বলবো পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই কোন না কোন দায়িত্ব নিয়ে এসেছে তাই নিজের দায়িত্বটা বুঝে নেওয়া সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ।

ডিপ্রেশন রোগীদের যে যুক্তিই দেখানো হোক বা নীতিজ্ঞান শোনানো হোক না কেন.. রোগীর কোনোই কাজে আসে না। যদিও কথাটা অধিকাংশই ঠিক তবুও কিছুটা হলেও কাজে লাগানোর স্বার্থে সমাধান করার ক্ষুদ্র প্রয়াস।

4 thoughts on “ডিপ্রেশন ও আত্মহত্যা

  1. পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই কোন না কোন দায়িত্ব নিয়ে এসেছে তাই নিজের দায়িত্বটা বুঝে নেওয়া সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ। ___ এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা।
    চাই সচেতনতা।

  2. ডিপ্রেশান এর বাংলাটা খুবই রোমান্টিক “বিষন্নতা”। আমার কাছে তাই মনে হয় ।

    1. রোম্যান্টিক হওয়া ভালো … বিষন্ন না হলেই হল .. ধন্যবাদ

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।