মিথ … দ্বিতীয় খণ্ড শেষ

২.
একটা ভালো উদাহরন হলো ট্রয় নগরী, যাকে ঘিরে ঘরে উঠেছে হোমারের ইলিয়াড। অনেক অনেক বছর ধরে এই শহরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়, বলা হয় এটা শুধুই কল্পনা, শুধুই মিথ। ১৮৬৮ সালে আসলেই এই শহর খুঁজে পাওয়া যায়। এঁকে তখন স্থান দেওয়া হয় ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু এর পরেও ইলিয়াডকে ধরা হয় ফিকশন হিসেবে, ফ্যান্টাসি হিসেবে, মিথ হিসেবে।

আমরা এটাই জানলাম, যে অনেক পুরনো বলেই মিথ, মিথ্যে নয়। প্রমাণের অভাব থাকলেই মিথ, মিথ্যে নয়। মিথের মাঝে লুকিয়ে থাকা অনেক গল্পই আসলে সত্যি হতে পারে। এটা অবশ্য খুবই সম্ভব যে মিথ বলে প্রচলিত অনেক লোককথা আসলে মানুষের তৈরি কল্পনা। অপার বিস্ময়ের এই সৃজনশীল কল্পনা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ডিভাইন কমেডি, ইলিয়াড, ওডিসি, রামায়ণ, মহাভারত, ইত্যাদি। এ এক অসাধারণ মিথের সমাবেশ।

কিন্তু বাস্তবে চিন্তা, দর্শন, বিজ্ঞান তৈরী হয় স্থান, কাল তথা তার সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, আবহাওয়া ও সভ্যতার ভিত্তিতে। স্থান, কাল পাত্র ভেদে চিন্তার ধরনও আলাদা আলাদা হয়। এগুলো অর্জন করতে হয় জীবন থেকে, সমাজ থেকে, পারিপার্শ্বিকতা থেকে। পারিপার্শ্বিকতা মানুষকে শেখায়। প্রকৃতির সাথে তার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রকৃতির অপার দান থেকে কিছু পাওয়ার জন্য যাযাবর জীবনের বিলুপ্তি ঘটিয়ে যখন কৃষি সভ্যতার পত্তন হয় তখন থেকেই শুরু হয় অবসর আর সৃষ্টির প্রতি অপার কল্পনা ও বিস্ময়। জীবন ও সময়ের প্রয়োজনে এই মিথ মানুষকে জানিয়েছে, অতীত ইতিহাস, মানুষকে আরও ভাবতে শিখিয়েছে। আর বাস্তবের মুখোমুখি হতে হতে মানুষ বিজ্ঞানকে ভাবতে শিখেছে। তখন বিজ্ঞান ও ধর্মদর্শনকে এরিষ্টটলের সামগ্রিক চিন্তার মোড়কে ভাবা হত। ধীরে ধীরে চিন্তার বিকাশ ঘটেছে, বিকাশ ঘটেছে জীবনদর্শন ও বিজ্ঞানের। এরিষ্টটলকে বলা হয় Father of science, ইবনে সীনাকে বলা হয় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক, কবি হয়েও ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন প্রতিথযশা বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন বলেন, Science is lame without religion and religion is blind without science.

মহাকবি হোমারের সময় থেকেই গ্রীসের মিথলজিই সবচেয়ে বিশদ, ব্যাপক এবং জনপ্রিয়। তারও কিছু পরে মিথ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু গ্রীসে মিথের শক্তি ও প্রভাব দুর্বল হয়ে আসে যুক্তিনির্ভর দার্শনিক আলোচনার অগ্রগতির সাথে প্যাগান ধর্মের ক্ষয় শুরু হওয়ায়। যুগে যুগে মিথের প্রতি মানুষের আগ্রহ ও বিশ্বাসের অন্যতম কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক নানা ঘটনাবলী সম্পর্কে জানার অসীম আগ্রহ। ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলো সম্পর্কে ভাবতে গিয়ে জ্ঞাতে -অজ্ঞাতে মানুষ তৈরি করেছে একের পর এক মিথ। যার কোনটা একেবারেই কাল্পনিক আবার কোনটাতে আছে বাস্তব কাহিনীর সংমিশ্রণ।

‘মিথের মৃত্যু হয়েছে’ একথা খ্রিস্ট ধর্মশাস্ত্র বিশারদ বুল্টম্যান এবং কবি ফিলিপ লার্কিন বললেও মিথের বিনাশ নেই। আসলে তার ক্ষয়ও নেই। কেননা মিথ মাঝে মাঝেই রূপান্তরের মাধ্যমে নতুনভাবে আবির্ভূত হয় যেমন হয়েছে উত্তরাধুনিক শিল্প চিন্তায়। যুক্তি এবং কল্পনা যে মাপকাঠিতেই মিথকে বিচার করা হোক না কেন এর উপস্থিতি এবং বাস্তব প্রভাব অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। মানুষের সৃজনশীলতা এবং চিন্তাশীলতার নিদর্শন হচ্ছে মিথ। এর শিল্প মূল্য অনেক। মিথের ভবিষ্যৎ পরিণতি কি তা সময়ের বিচার। কিন্তু ধাপে ধাপে সভ্যতার যে বিকাশ এবং উৎকর্ষ ও ঐতিহ্যের স্বরূপ চিনতে পারি। এগিয়ে যেতে পারি শিল্পের নান্দনিক উৎকর্ষে। সংস্কৃতিকে দিত পারি নতুন মাত্রা।

সমাপ্ত।

9 thoughts on “মিথ … দ্বিতীয় খণ্ড শেষ

  1. চরণে চরণে দারুণ সব কথা; ভীষণ তথ্যসমৃদ্ধ! মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। অসাধারণ উপস্থাপনা; মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়না।

    "এরিষ্টটলকে বলা হয় Father of science, ইবনে সীনাকে বলা হয় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক, কবি হয়েও ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন প্রতিথযশা বিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন বলেন, Science is lame without religion and religion is blind without science".

     

     

  2. ব্যপক তথ্য সম্ভার।

    সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি।

  3. * সুপ্রিয় কবি দি, অনেক ভালো লাগা একটা পোস্ট। শুভ কামনা নিরন্তর… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

  4. ‘মিথের মৃত্যু হয়েছে’ একথা খ্রিস্ট ধর্মশাস্ত্র বিশারদ বুল্টম্যান এবং কবি ফিলিপ লার্কিন বললেও মিথের বিনাশ নেই।  সত্যিই যেন তাই। একদম। 

    ভালো লাগল দিদিভাই 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।