চিঠি : মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ২

প্রিয় মেঘ,
এই প্রিয় কথাটা লিখতে গেলেই মনে প্রিয়া নামটা চলে আসে। কে যেন পাহাড়কে ভালোবেসে(!) প্রিয়া ডাকতো। আর পাহাড় হেসে কুটোপাটি যেতো। আচ্ছা মেঘ তোর ওই দুই বন্ধুর গল্পটা মনে আছে? ওই যে রে একটা বনের ভেতর দিয়ে দুই বন্ধু যাচ্ছিলো, আর হঠাৎই একটা ভাল্লুক পথ আটকায়। এক বন্ধু অন্য বন্ধুর চিন্তা না করে তাড়াতাড়ি গাছে উঠে যায়। নিজে বাঁচার জন্য। আর অপর বন্ধুকে রেখে যায় মৃত্যুর মুখে। এরাও বন্ধু ছিলো আর তুইও বন্ধু(!) ছিলিস। কি মিল না? আজ আর বন্ধু শব্দটার আর কোনো ওজন নেই আমার কাছে। এই শব্দে আমি ক্ষতবিক্ষত। ভীষণভাবে রক্তাক্ত। ভীষণভাবে অপমানিত। এই শব্দ আজ আমার কাছে অর্থহীন। আমার কাছে ভীষণ অপমানের আর এক নাম বন্ধু।

আমার ভাঙনের সব কথাই তো তুই জানতিস মেঘ। তবে কি করুণা করেছিলি? না কি ভেবেছিলি একটা ভেঙে যাওয়া পাহাড়কে নিয়ে কিছুদিন খেলা যাক। কি তাই ভেবেছিলি? তোকে তো আমি বন্ধুর জায়গা দিয়েছিলাম মেঘ। আমার প্রেমিকার জায়গাও নয়। বন্ধুর স্থান প্রেমিকার থেকে অনেক ওপরে, অন্তত আমার চোখে। হৃদয়ের সেই আসনে তোকে বসিয়েছিলাম, যেখানে আমি কোনোদিন কাউকে বসাই নি। বন্ধুত্বের থেকে কিছুটা বেশিই ছিলো আমাদের সম্পর্ক। এইভাবে পালিয়ে গেলি? সমস্ত জায়গা থেকে আমাকে মুছে দিয়ে পালিয়ে গেলি? কি ভেবেছিলি সেইসব জায়গায় আমি তোকে খুঁজে বেড়াবো? আমি তোকে ডাকবো ? না রে মেঘ, তুই যতটা নীচে নামতে পেরেছিস, অতটা নীচে আমি নামতে পারবো না। আমার রক্ত, পারিবারিক শিক্ষা অনেক বেশি উন্নত। আমি অন্তত কাপুরুষ নই। আমি তো তোর বাড়িই চিনতাম মেঘ, হাত বাড়ালেই তোর বাড়ি। কিন্তু তোকে ধরার কোনো চেষ্টাই আমি করিনি। যেতে চেয়েছিস চিরতরে চলে যেতে দিয়েছি। হাত গুটিয়ে নিয়েছি। নিজের চোখে নিজে ছোট হয়ে গেছি এই ভেবে, যে জীবনে প্রথমবার আমি বন্ধু নির্বাচন করলাম, তাও এইরকম! যে বন্ধু শব্দের অর্থই বোঝে না!

সাগর, তোর প্রেমিক, তোর সর্বস্ব, যাকে তুই ভীষণ ভালোবাসিস। তোর কথা অনুযায়ী, সে আমার আর তোর বন্ধুত্বের কথা জেনে প্রলয় নৃত্য করেছে। জানিস মেঘ, সাগরের জায়গায় যদি আমি হতাম, যদি জানতাম মেঘ আর পাহাড়ের বন্ধুত্বের কথা, আমি কোনোদিন প্রলয় ঝড় বইয়ে দিতাম না। কারণ, আমার বিশ্বাস, আমার ভালোবাসা মেঘের ওপর অনেক বেশি। আমি কথা বলতাম আর মেঘের বন্ধু বলে পাহাড়ের দিকে আমিও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিতাম। সাগর আর মেঘের সম্পর্ক অনেক পুরোনো, আর পাহাড় আর মেঘের সম্পর্ক কিছুদিনের। তাই ভালোবাসার থেকে বিশ্বাস থাকে অনেক বেশি, আর সেই বিশ্বাসের ওপরে আস্থা রেখেই আমি সাগর হলে পাহাড়ের বন্ধু হতাম। কারণ জানতাম মেঘের বন্ধু নির্বাচন ভুল হবে না।

মনে আছে মেঘ, তোর আর সাগরের একসাথে একটা ছবি আমাকে দেখিয়েছিলি। আমি বলেছিলাম, মেঘ তোর সাগর তো ভীষণ সুন্দর! আমি মেয়ে হলে নির্ঘাত তোর সাগরের সাথে প্রেম করতাম। তুই মিথ্যে রেগে বলেছিলি, আমিই প্রেম করতে দিতাম না, সাগর আমার। আমি বলেছিলাম, তোদের ভীষণ মানায়, তোরা মেড ফর ইচ আদার। তুই হেসে বলেছিলি, তোর জীবনে সাগরই সব। ও একটু অসুস্থ হলে তুই পাগলের মতো হয়ে যাস। আমি তো তোর সাগরকেও ভালোবাসতাম মেঘ। তোর দুই শাখা নদীর সঙ্গে। তোকে বলেছিলাম, তোর সাগরের সাথে আমি বন্ধুত্ব করতে চাই মেঘ, সাগর কি আমার বন্ধু হবে? তুই, আমি, সাগর ভীষন ভালো বন্ধু হবো। হলো না মেঘ, আমার কোনো চাওয়া কোনোদিন পূরণ হয় নি।

তোর ওপরে একমাত্র সাগরের অধিকার মেঘ। আমি কোনোদিন তোকে অধিকার করতেই চাই নি। কারণ বন্ধুত্বে অধিকার মানায় না। আমি তো তোর পাশে হাঁটতে চেয়েছিলাম, তোর সাথে কিন্তু কখনো হাঁটতে চাই নি। তোর সাথে তো হাঁটবে সাগর। খুব বেশি কি চাওয়া ছিলো মেঘ? ভালোবাসা অনেক রকমের হয়, বাবা মায়ের প্রতি ভালোবাসা এক রকম, সন্তানের প্রতি ভালোবাসা এক রকম। স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা এক রকম, আবার বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা এক রকম। আমি তো সেই বন্ধুর ভালোবাসাটুকুই চেয়েছিলাম মেঘ। সেটা কি একেবারে অমূলক চাওয়া ছিলো? আমাকে কি সত্যিই ভালোবাসা যায় না মেঘ? আমি কি সত্যিই অপমানের যোগ্য মেঘ? তবে আমার বন্ধুত্ব খাঁটি ছিলো, তোর কাছে গল্প শুনে আমি সাগরকেও ভালোবেসেছিলাম, আর তোর দুই শাখা নদীকেও ভালোবাসি মেঘ।

বড্ডো ছোট করে দিলি তুই আমার চোখে আমাকে। বড্ডো অপমান করলি মেঘ। যদি এক মুহূর্তের জন্য আমাকে ভালোবাসতিস, তাহলে এইভাবে অপমান করতে পারতিস না। তবে তুই যেভাবে সমস্ত রাস্তা মুছে দিয়ে পালিয়ে গেলি, এতে এটাই বোঝা যায়, অন্যান্যদের মতো এটা তোর কাছে শুধুই খেলা ছিলো। কি খেলা মেঘ? কি অদ্ভূত না, তুইও বাকিদের মতোই ছিলি, তোকে তো আমি আলাদা ভেবেছিলাম। জেনেছিলাম তোর বাবার শিক্ষায় তুই বড় হয়েছিস, ওই মানুষটার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আমার। তুই তার শিক্ষার কি প্রতিদান দিলি ? এইভাবে কাপুরুষতা কি তোকে মানায়? আমি তোকে বিশ্বাস করতাম, অনেক বিশ্বাস করতাম। তোর সব কথাই বিশ্বাস করতাম। আমি তো তোর কথা শুনে সাগরকেও অত্যন্ত শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনষ্ক ভেবেছিলাম, সেও যে বন্ধুত্বের মানে বুঝবে না,এটা ভাবিই নি কখনো। কতখানি ভুল ভেবেছিলাম না আমি?

জানিস মেঘ, অনেক প্রাচুর্যের মধ্যে আমি বড় হয়েছি। টাকা,পয়সা, গাড়ি বাড়ি আমার কাছে অর্থহীন। বিশ্বাস, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এই সবের মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি ছিলো। আর সবথেকে যেটা বেশি ছিলো একে অপরের প্রতি সম্মান। তোর প্রতি সম্মান মিশ্রিত ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু তুই সামান্য সম্মানটুকুও আমাকে দিতে পারলি না? এইভাবে বন্ধু – বন্ধু খেলা কি তোর নেশা ? এইভাবে কতো পাহাড়কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিস ?

যেদিন তুই বললি চলে যেতে চাস, আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি মেঘ। হঠাৎ করেই এতো জোড়ে ধাক্কা দিলি তো তাই সামলে উঠতে পারিনি। চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে গেলো, গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে পড়ে গেলাম। তারপর যখন জ্ঞান এলো জানলাম ডান হাতের কনুই এর হাড় ডিসলোকেটেড। এক্সরে তে হাড়ে একটা ফাটল দেখা দিলো। সারা জীবনের জন্য একটা যন্ত্রণা উপহার দিয়ে গেলি। ওই হাতেই অনেক বছর আগে এক প্রচণ্ড আঘাতে সমস্ত টিসু ছিঁড়ে গিয়েছিল, ছোট ছোট টিউমার হয়ে আছে, আর সেই হাতেই তোর দেওয়া উপহার। রঙ তুলি আর কোনোদিন ধরতে পারবো না, হাত আর সাথ দেবে না। তোকে চিঠি লিখতেও বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে হাতে।

শুধু শুধু বেঁচে আছি আমি মেঘ। একটা জীবন্ত লাশ হয়ে। যে স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়, যার ভেতরে নতুন কোনো ইচ্ছে, অনুভূতির জন্ম হয় না। যার আর কোনো চাওয়া নেই, পাওয়ায় ও আর কিছু নেই। অপমানটুকুও তুই পূরণ করে দিয়ে গেলি। আমি কোনো ভুল করিনি, আমি পালিয়ে বেড়াই নি, মাথা উঁচু করে চলেছি চিরকাল। শিরদাঁড়া ভীষণ সোজা। আপোষ করি না কোনো কিছুর সাথে। কিন্তু তুই তো আমার কোমরটাই ভেঙে দিয়ে গেলি মেঘ। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিই যে হারিয়ে ফেলেছি। আমি জানি মেঘ তোর মনের কোথাও আমি নেই। খেলার সামগ্রী মনে রাখতে নেই।

সাগরের সাথে ভালো থাকিস মেঘ। আর পাহাড় তো চিরকাল নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব, যে বার বার ভেঙে যায়, কতো টুকরো যে হয়েছে পাহাড় আজ নিজেও গুনে উঠতে পারে না। পাহাড় চিরকাল একা থেকেছে, যতদিন বাঁচবে একাই থাকবে। প্রেম তো দূরের কথা, বন্ধু হিসেবেই আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না। পাহাড়ের কান্নায় যদি ভালো থাকতে পারিস তাহলে ভালো থাকিস মেঘ। ভালোবাসা তো নয়ই, আজ আমার ঘৃণাও তোকে দিতে পারলাম না মেঘ। ঘৃণা দিতে গেলেও তোকে প্রাধান্য দিতে হবে, সেটাও আর আমি তোকে দিতে চাই না। একটা কাপুরুষের জীবন নিয়ে বেঁচে থাক তুই।

ইতি
একলা পাহাড়।

চিঠি: মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ১
_________
রিয়া চক্রবর্তী।

18 thoughts on “চিঠি : মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ২

  1. এমন লেখাকে শ্রেফ কল্পনা থেকে টেনে আনা সম্ভব নয়। জীবনের গল্প তো বটেই। তবে স্পষ্ট বিষণ্নতা জেগে আছে অনুভূতির প্রতিটি প্রকাশে।

    1. স্বীকার করছি লিখায় বাস্তবতা আছে আবু সাঈদ আহমেদ দা। শুভেচ্ছা। 

  2. সাগরের সাথে ভালো থাকিস মেঘ। আর পাহাড় তো চিরকাল নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব, যে বার বার ভেঙে যায়, কতো টুকরো যে হয়েছে পাহাড় আজ নিজেও গুনে উঠতে পারে না। পাহাড় চিরকাল একা থেকেছে, যতদিন বাঁচবে একাই থাকবে। প্রেম তো দূরের কথা, বন্ধু হিসেবেই আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না। পাহাড়ের কান্নায় যদি ভালো থাকতে পারিস তাহলে ভালো থাকিস মেঘ। ভালোবাসা তো নয়ই, আজ আমার ঘৃণাও তোকে দিতে পারলাম না মেঘ। ঘৃণা দিতে গেলেও তোকে প্রাধান্য দিতে হবে, সেটাও আর আমি তোকে দিতে চাই না। একটা কাপুরুষের জীবন নিয়ে বেঁচে থাক তুই।

    নান্দনিক লিখা রিয়াদি ।

    1. ধন্যবাদ প্রিয় কবি দা। খুশি হলাম পড়েছেন জেনে। 

  3. লিখাটিকে শুধু মাত্র চিঠি বা তিক্ত অথবা হারানোর বেদনা শুধু নয়; একটা গল্প লুকিয়ে আছে। জানিন গল্প হতে পারে আপনার অথবা অন্যের। আপনি কি কারু জীবনের না বলা কথা গুলো বলবার প্রতিনিধিত্ব করছেন কবি রিয়া !! শুভেচ্ছা জানবেন। :)

    1. একটা গল্প লুকিয়ে আছে শুধু নয় বলতে পারেন জেগে আছে সুমন দা। ধন্যবাদ।

  4. 'সাগর আর মেঘের সম্পর্ক অনেক পুরোনো, আর পাহাড় আর মেঘের সম্পর্ক কিছুদিনের। তাই ভালোবাসার থেকে বিশ্বাস থাকে অনেক বেশি, আর সেই বিশ্বাসের ওপরে আস্থা রেখেই আমি সাগর হলে পাহাড়ের বন্ধু হতাম।' দেখা যাক কোথায় গড়ায়।

    1. আরও দুই একটি পর্ব আসতে পারে বন্ধু। অপেক্ষা নিন। শুভেচ্ছা। 

  5. গভীর মনযোগে আপনার চিঠি দুটো পড়েছি আপু।

    1. অনুপ্রাণিত হলাম দিদি ভাই সাজিয়া আফরিন। 

  6. আমি অফলাইনে পড়েছি রিয়া। মনটা সেই থেকে আর্দ্র হয়ে আছে।

    1. আমার সম্মান তুবা দি। পরেরটা পড়বেন যদি লিখতে পারি। 

  7. মেঘের গল্পে চোখের কোণে মেঘ জমলো। ভালো থেকো দিদিভাই । https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif     

  8. হৃদয় স্পর্শ করে গেলো https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif। তবে ইদানীং শরীর মন ভীষণ খারাপ যাচ্ছে আমার https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Confused.gif.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।