প্রিয় মেঘ,
আজকাল রাতে ঘুমোতে পারিনা জানিস। আগে ঘুম না এলে ছাদে চুপচাপ বসে থাকতাম, আজকাল আর রাতে ছাদে যাই না। মনে পড়ে যায় সমস্ত কথা, তোর সাথে রাতের বেলা ছাদে ঘুরতে ঘুরতে কতো কথা বলতাম! আমি গান শোনাতাম, তুই গান শোনাতিস। আমিই বেশি গাইতাম, তুই খুব লাজুক তাই কম গাইতিস। মনে আছে তোর? আমার বাড়ির কাছের যেসব রাস্তায় তুই এসে আমার জন্য অপেক্ষা করতিস, এখন সেইসব রাস্তা দিয়ে আমি যাই না মেঘ। অনেকটা ঘুরে আমি আমার গন্তব্যে যাই। সেইসব রাস্তা এড়িয়ে চলি। জানিস মেঘ আজকাল প্রচণ্ড ডিপ্রেশন আমাকে ঘিরে ধরেছে। আজকাল আমি যখন তখন মেজাজ হারাই। হয়তো চাকরিটাও ছেড়ে দেবো। জানিনা শেষ পর্যন্ত শহরের কোন এসাইলামে আমার ঠাঁই হবে।
তুই আমার সেইরকম বন্ধু (!) ছিলিস, যে কিনা নিজের জীবন বাঁচতে, পরিবার বাঁচাতে অনায়াসে বন্ধুকে গুলি করে তার রাস্তা থেকে সরিয়ে দিতে পারে। আর সেই বন্ধুকে যে কিনা তাকে ভালোবাসে! এই ক্ষেত্রে গুলি তুই করিস নি, তবে খুন করেছিস আমার সব ভালো থাকা গুলোকে, আমার সব আনন্দকে, আমার সব হাসিদের, আমার সব ইচ্ছেদের, আমার মনকে, আমার হৃদয়কে, আমাকে জীবন্ত লাশ করে দিয়ে গেছিস। সেদিন ছুরিটা আমার পিঠে নয়, সামনাসামনি এসে আমার বুকে বিঁধতে পারতিস। তোর সাহস দেখে খুশি হতাম। কিভাবে পারলি মেঘ এতোটা নিষ্ঠুর হতে? তোর মনে হয় নি, যে পাহাড় বহু আগে থেকেই ভেঙে ভেঙে টুকরো হয়ে আছে, আর তাকে নাই বা ভাঙলাম। সত্যি মেঘ তুই হঠাৎই যতগুলো টুকরো করে দিয়ে গেলি, সেইসব টুকরো আবার জুড়ে উঠে দাঁড়াবার আর ক্ষমতা নেই রে।
তোকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, আমি বড্ডো অভিমানী। ভুল বলেছিলাম মেঘ। অভিমান তাকেই মানায় যার মান ভাঙানোর কেউ থাকে। আমি একজন একা পড়ে থাকা পাহাড়। যার আশেপাশে কেউ নেই, হাত বাড়ালেও কোনো বন্ধু নেই তাকে কি অভিমান মানায় বল? আর কার ওপরে অভিমান করবো মেঘ? কেউ কি ছিলো আমার? কখনো ছিলো? একা চলা জীবন আমার, একাই চলেছি। চলতে চলতে মুখ থুবড়ে পড়েছি, আবার উঠে চলা শুরু করেছি। তুই বলেছিলি আমি নিজেকে সামলে নিতে পারবো, আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, তুই এতোটুকুও জানিস নি আমাকে, বুঝিস নি আমাকে। আমি নিজেকে সামলে নিতে পারি না রে, শুধু বাইরের খোলসটা মিথ্যে হাসি দিয়ে মুড়ে রাখি। ভেতরে ভেতরে একজন ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া পাহাড় আমি। যার শুধু কঙ্কালটুকুই আছে।
তুই বলেছিলি সাগর ভীষণ অভিমানী, বাড়ির ছোট তো তাই ভীষণ আদরে মানুষ হয়েছে। আমি মনে মনে সেদিন হেসেছিলাম। আমি যেভাবে আদর, যত্নে বড় হয়েছি, খুব কম বাচ্চাই সেইভাবে বড় হয়। একটা নরম ফুলের মতো করে আমি বড় হয়েছি। জানিস মেঘ, ছোটবেলাই ভীষণ ভালো ছিলো রে। এই বড় বেলার জীবন আমি চাইনি মেঘ। জানিস আমি আর বাঁচতে চাই না, বিশ্বাস কর। তুই বলেছিলি, সাগর ভাবে, ‘যেটা আমার, সেটা আমার, সেখানে অন্য কেউ হাত বাড়াবে কেন?’ বন্ধু হতে আর আমার জিনিস, তোমার জিনিস কী? বন্ধু তো আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়! আর তোকে শুধুমাত্র বন্ধু ভেবেছিলাম, অন্যকিছু নয়। তুই অন্য লোকের বাড়ানো হাত ধরিস কেন? কেন বলিস অন্য লোককে ভালোবাসি? সাগরের থেকে পারমিশন নিয়ে নিস ভবিষ্যতে আর কারো হাত ধরার আগে। তবে তোর সাগরকে তুই বলে দিস, মেঘকে পাহাড় কোনোদিন সাগরের থেকে কেড়ে নিতে চায় নি। কোনো দিন না। যেদিন তুই বললি, ‘সাগর পাহাড়ের সাথে ঝগড়া করতে চায়’ – সেদিন অবাক হয়েছিলাম। একজন অচেনা, অজানা মানুষের সাথে সে আলোচনা না করে ঝগড়া করবে! ওর জায়গায় আমি হলে, তিনজনে মিলে আলোচনা করতাম। হয়তো তিনজনেই ভালো বন্ধু হয়ে যেতাম। মনটা উদার করা শিখতে হয় মেঘ।
মেঘ, পাহাড় কি তোর খেলার পুতুল ছিলো? যখন ইচ্ছে খেললি আর ইচ্ছে হলো ছুঁড়ে ফেলে দিলি? মিনিমাম সম্মানটুকুও পাহাড়কে দিলি না? সাগরের কাছে পাহাড়কে এইভাবে ছোট করলি? কেন মেঘ? কোন অপরাধে? তোকে ভালোবাসা কি অপরাধ ছিলো? জানিস, সব ছেড়ে দিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার দায়িত্ব, আমার কর্তব্য আমাকে পেছন থেকে আটকে রাখে। তবে যেদিন আমার দায়িত্ব শেষ হবে, সেদিন হয় আমি নিজেকে শেষ করে দেবো, না হলে দূরে কোথাও চলে যাবো। সব ছেড়ে দিয়ে আমার কষ্টগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যাবো, কারণ আর তো কেউ আমার সাথে থাকতে চায় নি। আমার দুঃখ, আমার কষ্ট এরা ভীষণ আপন। কখনও আমার হাত ছেড়ে দেয় নি। তাই এদের সাথে নিয়ে যাবো। এমন এক জায়গায় যাবো, যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না, কেউ জানবে না। কাউকে বলে যাবো না। হয়তো সেখানে কোনো একটা ছোট্ট ঘরে আমি থাকবো। একা একা, নিজের সাথে থাকবো। আর যখন আমার জীবনের শেষ সময় আসবে, স্থানীয় লোকজনকে বলে যাবো, আমার মৃত্যুর পরে আমার দেহ আগুনে জ্বালিয়েও দিতে পারো, কিংবা মাটির নীচে পুঁতেও দিতে পারো। তবে পুঁতে দিলে সেখানে একটা ছোট্ট চারাগাছ লাগিয়ে দিও। যাতে আমি ফুরিয়ে যেতে যেতেও আমার ভালোবাসা দিয়ে একটা গাছকে সবুজ করে যেতে পারি, অফুরন্ত প্রাণশক্তি তাকে দিয়ে যেতে পারি। কারণ আমি যে শুধু ভালোবাসতেই পারি, মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। তোকেও এমন করেই ভালোবেসেছিলাম।
আর যদি আমার সেই লাওয়ারিশ লাশ আগুনে পুড়িয়ে দেয় তাহলে,
ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম –
এই পঞ্চভূতে মিশে যাক
আমার অভিশপ্ত জীবন।
ইতি
একলা পাহাড়।
চিঠি: মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ১
চিঠি: মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ২
_________
রিয়া চক্রবর্তী।
মেঘের চিঠির প্রতিটি শব্দ অন্তর স্পর্শ করে। মেঘপ্রিয় বালিকা তুমি মেঘেই করো বিচরণ, তোমার কাব্যকথায় পাঠকের মনে জাগুক অনুরণন।
অনুপ্রাণিত হলাম কবি দিদি ভাই।
আমি ফুরিয়ে যেতে যেতেও আমার ভালোবাসা দিয়ে একটা গাছকে সবুজ করে যেতে পারি, অফুরন্ত প্রাণশক্তি তাকে দিয়ে যেতে পারি। কারণ আমি যে শুধু ভালোবাসতেই পারি, মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। তোকেও এমন করেই ভালোবেসেছিলাম।
চিঠিকে আমি সহসাই সহজ কোন লিখার কাতারে ফেলতে নারাজ। গল্প কবিতায় মানুষ সহজেই আলতা রঙ মিশিয়ে দিতে পারেন। চিঠির রঙ সেটা নিজের সাথে প্রতারণা।
সর্বৈব সত্য মন্তব্য। শুভেচ্ছা বন্ধু।
হৃদয় নিঙরানো চিঠি। তৃতীয় পর্বেও আপনি সার্থক কবি রিয়া চক্রবর্তী।
ধন্যবাদ কবি সুমন আহমেদ।
অফলাইনে আপনার এই চিঠিটি পড়ে কেবল শুভেচ্ছা জানানোর জন্য এলাম। ভালো থাকুন।
অশেষ ধন্যবাদ প্রিয় দিদি ভাই।
লেখাটি পড়ে আমি কেবলই মুগ্ধতা গ্রহণ করতে পারি। বাড়তি বলা অসুন্দর হবে।
শুভেচ্ছা আবু সাঈদ আহমেদ দা।
নিজের কাছে প্রশ্ন করেছি আমি কি এমন চিঠি লিখতে পারবো? উত্তর : পারবো না।
মন্তব্যে ঋণী হলাম প্রিয় কবি দি।
৯০ দশকের ঘ্রান আছে চিঠিতে।
হয়তো চিঠিতে মেঘের উত্তর হবে হেলাল হাফিজের কবিতার মতো-
ইছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সম্রজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে
শুধু তুমি অন্য ঘরে।
ব্রিলিয়ান্ট মন্তব্য পবিত্র হোসাইন দা। কৃতজ্ঞতা।
মেঘের নামে এতো অভিযোগ মেনে নিবো না। চিরকুটের প্রতিটি বাক্য ছিলো অনূভুতির আকুতি। এমন কিছু কথা চিরকুটে চলে এসেছে যা হৃদয়ের গহীন থেকে প্রকাশ পেয়েছে।
আপনাকে ধন্যবাদ শব্দ শিল্পী শাহাদাত হোসাইন দা।
অনবদ্য! শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
ধন্যবাদ প্রিয় কবি অর্ক দা।
চমৎকার লিখেছেন
ধন্যবাদ কবি দা।
অসাধারণ রিয়া দেবী
। আপনার লেখা পড়লে সেই আবেগে আমার লেখা চলে আসে। মনে আছে আশাকরি। 

আশার ভাষা। লিখে ফেলুন দাদা।
তোকে একদিন কথায় কথায় বলেছিলাম, আমি বড্ডো অভিমানী। ভুল বলেছিলাম মেঘ। অভিমান তাকেই মানায় যার মান ভাঙানোর কেউ থাকে।
সত্যি অভিমান তাকেই মানায়। লেখাটা পড়ে এক মায়ায় ডুবে গিয়েছিলাম। শুভেচ্ছা রইলো প্রিয় রিয়া দি।
শুভেচ্ছা প্রিয় কবি দা।
মেঘের চিঠি আমাকে ছুঁয়ে গেলো
অনেক ভালোলাগা
ভালো থেকো
শুভকামনা
শুভ কামনা জীবন বাবু।
কষ্ট ,বেদনা ছেড়ে যায় না আর যেই ছেড়ে যাক । এতো আবেগ মথিত চিঠি হৃদয় ছুঁয়ে গেলো ।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানালাম কবি।