শিক্ষক দিবস

আমি মানুষটা ভীষণ প্রাইভেট পার্সন। নিজের ব্যক্তিগত কথা কাছের বন্ধুরা ছাড়া খুব একটা বলি না। কিন্তু আজকে কিছু কথা ভীষণ বলতে ইচ্ছে করছে। আমার বহু ছাত্র ছাত্রী আমার সাথে ফেসবুকে যুক্ত। কিছু কিছু ছাত্র ছাত্রীর বাবা মা ও আছেন আমার সাথে ফেসবুকে। তারা সাইলেন্ট রিডার। কিছুদিন আগের একটা ঘটনা বলি।

আমার এক ছাত্রীর সাথে আমার লাস্ট দেখা ২০০৩ এ। তারপর তার সাথে আমার আর দেখা হয় নি। সে আমার সাথে ফেসবুকে যুক্ত নয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করে গত সপ্তাহে তার মা আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। আমি দেখা মাত্রই নিয়ে নিই। মেসেঞ্জারে আমার নম্বর চাইলেন দিলাম। দীর্ঘ ১৬ বছর পরে কথা হলো। ভালো লাগলো দীর্ঘ ১৬ বছর আগের নিজেকে খুঁজে পেলাম।

রাস্তায় একটি দোকান থেকে কিছু দরকারী কাগজ ফটোকপি করছি, এমন সময়ে এক ভদ্রলোক এসে বললেন -“ম্যাডাম, আপনার ছাত্রী একটি পুত্র সন্তানের মা হয়েছে। আমার বাড়িতে আছে গত ছ মাস। আপনি একদিন আসুন না দেখতে”। তিনি আমার এক ছাত্রীর বাবা। উত্তরে বললাম অবশ্যই যাবো।

একদিন ওষুধের দোকান থেকে কিছু ওষুধ কিনছি, হঠাৎ একটি হাতের স্পর্শ আমার পায়ে। চমকে উঠে সরে গেলাম। ছেলেটি বলে উঠলো, “আমি জানি আপনি কারো প্রণাম নেন না, তাইতো আমি চুপিচুপি প্রণামটা সেরে নিলাম। “চিনতে পারলাম, আমারই এক ছাত্র। আশীর্বাদের হাত তার মাথায় রেখে বললাম ভালো আছিস? কতো বড় হয়ে গেছিস! চাকরি করছিস বুঝি? উত্তরে সে বললো, “হ্যাঁ আন্টি একটা চাকরি পেয়েছি। বাবা মারা গেছেন, আমি আর মা থাকি”। কষ্ট পেলাম ছাত্রটির বাবা, মা দুজনেই অত্যন্ত ভালো মানুষ।

এইরকম অনেক ঘটনা আছে। এইসব ছেলে, মেয়েরা আমাকে খুঁজে বের করে, কারণ আমি নাকি তাদের প্রিয় শিক্ষিকা ছিলাম। কিন্তু আজ আমি যার কথা বলবো, সে আমার এক অত্যন্ত স্নেহের ক্ষুদে ছাত্র। কোলকাতার এক নামি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে সে। ক্লাস ফোরে পড়ে। তার মা যখন আমার সাথে যোগাযোগ করেন তখন সে মাত্র ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে। অন্যান্য সাধারণ বাচ্চার থেকে আলাদা। একটু স্পেশাল বাচ্চা। তাকে যখন আমি প্রথম দেখি সে তখন একেবারে তার বাবার কোল ঘেঁষে বসে আছে। অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের। আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মা যা বলার আমাকে বলছেন। ধীরে ধীরে সে আমার বন্ধু হয়ে ওঠে। বাচ্চাটির বাবা একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ান। মা একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। কিন্তু বাচ্চাটি তার মায়ের কাছে পড়তে চায় না, মাঝেমধ্যে বাবার কাছে অবশ্য পড়ে। আমি যখন পড়াই তার বাবা, মা পাশের ঘর থেকে শোনেন। যেহেতু ওকে পড়াতে হয় স্পেশাল ভাবে। আমিই বলেছি আমার পড়ানো শুনতে এবং ওইভাবে পড়াতে। আমরা শুধু পড়াশোনা করি না, আমরা গান করি, গল্প করি, আমরা মাঝেমধ্যে খেলনা দেখি। মাঝেমধ্যে আবার ওর খাতায় দু লাইনে কবিতাও লিখে দিতে হয়। আমাকে সে মাঝে মাঝে বলে “জানো আন্টি, আমার সৌভাগ্য যে আমি তোমার মতো আন্টি পেয়েছি।” নতজানু হই এইরকম অকৃত্রিম ভালোবাসার কাছে। ছাত্রটি একটি বিখ্যাত পণ্ডিতজির কাছে তবলা শেখে এবং অত্যন্ত ভালো তবলা বাজায়। প্রতিটি তবলার ভিডিও আমাকে ওর বাবা, মায়ের নম্বর থেকে হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠায়। দেরী করে উত্তর দিলে সামান্য অভিমান হয়। ছাত্রটির মা অত্যন্ত ভালো গান করেন ছাত্রটি মায়ের সাথে তবলায় সঙ্গদ দেয়।

এতোকিছু বলার কারণ, আজ শিক্ষক দিবসে আমার সেই অতি প্রিয় ছাত্রটি আমাকে একটি অভিনব উপহার দিয়েছে। যা আমি শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। সে নিজে বাংলায় কবিতা লিখেছে এবং তাতে সুর দিয়েছে। সেই কবিতাটি দিলাম এখানে। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। বাচ্চাটির নাম উহ্য থাক।

14 thoughts on “শিক্ষক দিবস

  1. জীবনের সত্য এক উপলব্ধির কথা পড়লাম। যেমনটা আপনার বর্ণনায় এসেছে পাঠক হিসেবে আমি অন্তত মুগ্ধ হয়েছি। এভাবে মানুষের মনে বসতি থাক আপনার।

    শুভকামনা এবং শুভ সকাল। :)

  2. ধন্যবাদ দিদি  সাথক জীবন আপনার ছাত্রের অঘ পাওয়া দুলভ এ জমানায় । গরবে মন ভরে গেলো গুরু শিষ্যের বন্ধন যুগ যুগ  টদাহরন হয়ে থাক শুভকামনা  সবার জন্য https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

  3. আপনার স্নেহের ছাত্রটি আপনাকে ঠিকই চিনেছে। জহুরি যেমন রত্ন চিনে, ছাত্রটিও শিক্ষক চিনে নিয়েছে, পেয়েছেও। আদরের ছাত্রটির জন্য শুভকামনা সবসময়ই থাকবে। আর মনের কথা শব্দনীড়ে শেয়ার করার জন্য আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।          

    1. আমার এই ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা পড়ার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা দাদা। প্রণাম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  4. এমন কিছু অভিজ্ঞতাই যেন জীবনে বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে লম্বা জাগিয়ে রাখে। :)

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।