সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলি!

সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলি!

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বারের শেষে বাংলাদেশে গেছিলাম। বাবা হঠাত করেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো, তাই ছুটে যাওয়া। একই বছরের নভেম্বারের শুরুতে আমার ভাই বাসা বদল করেছে।
১৯৭০ সালের মে জুনের দিকে ভাড়াটে হয়ে এসেছিলাম যে পাকা বাড়িতে, সেই বাড়িতেই কেটেছে ২০১৭ সালের অক্টোবার পর্যন্ত। একটানা সাতচল্লিশ বছর একই বাড়িতে থাকলে যা হয়, সে বাড়ির প্রতিটি ধূলিকণা আপন হয়ে যায়। ঘরের যে দেয়ালে টাটকা নতুন চূনকামের গন্ধ ছিল, সাতচল্লিশ বছর পর সেই দেয়ালে চূনকামের গন্ধ থাকেনা, চূনকামের কোন ছাপ থাকেনা। সেখানে থাকে ভেজা ভেজা গন্ধ, শ্যাওলা না হোক, নোনা ধরা ছাপ। এসবই খুব আপনার জন, আত্মার অংশ। আমাদের প্রতিটি শ্বাস প্রশ্বাসের উঠানামায় দেয়াল জুড়ে এতসব শিল্প কর্ম সৃষ্টি হয়েছে।

এমন আপন বাড়ি পাল্টে যখন নতুন বাড়িতে উঠা হলো, সাতচল্লিশ বছরের জমা স্মৃতিময় থালা বাসন, ঘটি বাটি বালতি, কাঠের চেয়ার, স্মৃতিময় খাট, লেপ তোষক বালিশ, বইয়ের পাহাড় দোতলা বাড়ির কক্ষ, দেয়াল তাক ছুঁয়ে কিছু বারন্দায় ঠাঁই পেলো। পুরনো দিন, পুরনো কথা, পুরনো জিনিসপত্তর ইতিহাসে স্থান পায়, মানুষ ব্যস্ত হয়ে উঠে বর্তমান নিয়ে।
সাতচল্লিশ বছরের স্মৃতিময় ঘরগুলোকে শূন্য করে নতুন দালানের নতুন ঘর পূর্ণ করার কাজে সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

হাসপাতাল থেকে কিছুটা সুস্থ করে বাবাকে তোলা হলো নতুন ভাড়া বাড়ির বারান্দা লাগোয়া ঘরটিতে। বাবার খুব শখ ছিল দোতলার বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসার। সে দিক বিবেচনা করেই বারান্দা লাগোয়া ঘর বাবার জন্য ঠিক করা হয়েছে। শয্যাশায়ী বাবা বিছানা থেকে উঠে বসতে না পারুক, বারান্দার দিকে দরজা খোলা থাকলে বিছানায় শুয়ে থেকেই খোলা বারান্দার কিছু অংশ দেখতে পাবে।

দিন সাতেকের মধ্যেই ছোট ভাইয়ের বউ ঘরবাড়ি সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে। বাপের বাড়িতে আমার কোন কাজ করতে হয়না। বিয়ের পর থেকেই এই নিয়ম, বিয়ের আগে যে আমাকে মায়ের সাথে সব কাজে সাহায্য করতে হতো, সেই আমাকেই বিয়ের পর বাপের বাড়িতে খাটে বসিয়ে খেতে দেয়া হয়। মা বেঁচে থাকতে মা দিত, মায়ের অবর্তমানে ছোট ভাইয়ের বউ আমায় খাটে বসিয়ে খাওয়ায়।

সেদিনও বাবার খাটেই বসেছিলাম, সংসারের কাজ করতে হতোনা বলে অসুস্থ বাবার পাশে বসে ল্যাপটপে লেখালেখি করতাম। বারান্দার দিকের দরজা খোলা, ভাইয়ের ছোট ছেলেটা খোলা দরজা দিয়ে ঘরে বারান্দায় ছুটোছুটি করছে। আমার নজর ওর দিকেও ছিল কারণ ভাতিজার গ্লাস বাটি কাপ গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়ার অভ্যাস আছে । বারন্দায় তখনও অনেক সরঞ্জাম রয়ে গেছে গামলা আর বালতির ভেতর। নানা সাইজের বাসন, পূজোর থালা, ছোট খাটো খেলনা, কিছু বই, দিদিমার আমলের বড় পাটা পুতা, ঠাকুমার আমলের কাহাইল ছিয়া, এমনি অনেক ঐতিহাসিক জিনিস।

আমার ভাতিজাকে দেখলাম একটা গামলা থেকে খুব সুন্দর একটা চকচকে মেটালের গ্লাস টেনে বের করেছে। দেখেই আমি দৌড়ে গেলাম বারান্দায় যাতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে গ্লাস বাইরে ফেলে না দেয়। না, পিচ্চি গ্লাসটা বাইরে ফেলেনি, আবার গামলার মধ্যেই রেখে দিয়েছে।

গ্লাসটা হাতে নিলাম, রুপোর গ্লাস। ছোট বাচ্চাদের জল খাওয়ার গ্লাস। আমাদের বাড়িতে রুপোর গ্লাস এলো কিভাবে! ভাইবৌ বললো, এই গ্লাসটা আমাদের বড় মামী উপহার হিসেবে দিয়েছিল ভাইয়ের ছেলেকে। গ্লাসটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে গামলার মধ্যে রাখতে যেয়ে আরেকটা পুরনো কালচে হয়ে যাওয়া স্টিলের গ্লাসের দিকে নজর গেলো। ওই গ্লাসটার দিকে নজর যেতেই বুকের মধ্যে কারণ ছাড়াই এক মুহূর্তের জন্য বিদ্যুৎ খেলে গেলো। কেন এটা হলো বুঝিনি। গামলা ভর্তি বাসন কোসন, রুপোর গ্লাসটা একটু ভেতরের দিকে ঢুকিয়ে রাখলাম যেন দুষ্টুটা খুঁজে না পায়।

বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে আসার সময় আবার পেছন ফিরে গামলার দিকে তাকালাম। নজর গেলো সেই কালচে স্টিলের গ্লাসটার দিকেই। আবারও বুকের মধ্যে কিছু একটা অনুভূতি। সমুদ্রের গভীর থেকে যেন জেগে উঠছে কিছু একটা অনুভূতি।

গ্লাসটা কি আমার? এই গ্লাসে কি আমার নাম লেখা আছে? সেই গ্লাসটা? এখনও আছে? দেখবো গ্লাসটা বের করে নাম আছে কিনা! যদি না হয়! সত্যিই কি আমার জল খাওয়ার গ্লাস ছিল? দিদিমা এনে দিয়েছিল না? বেনারস থেকে আমার জন্য একটা গ্লাস এনেছিল দিদিমা! হ্যাঁ, মনে পড়ছে, দিদিমা আমার জন্য একটা গ্লাস এনেছিল। দেখতে রুপার মত চকচকে ছিল, খুব ভারী ছিল।
আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম, দিদিমার একমাত্র নাতনী। দিদিমা খুব বেড়াতো, এখানে ওখানে সবখানে। কাছে পিঠের দূরত্বে দিদিমা আমাকে সাথে নিয়ে যেত। দূরে কোথাও গেলে ফিরে আসার সময় আমার জন্য কিছু না কিছু উপহার আনতোই। স্কুলে পড়ার সময় আমার ঘন চুলের বিনুনিতে যত বাহারি ক্লিপ, ফিতা শোভা পেতো, সব দিদিমার দেয়া।

ইন্ডিয়া ছিল দিদিমার অনেক প্রিয়, বছরে একবার দিদিমা ইন্ডিয়া যেতোই যেত। ফিরে এসে ভ্রমণ নিয়ে কত গল্প শোনাতো। দিদিমার মুখে ইন্ডিয়া বেড়ানোর গল্প শুনে শুনেই হয়তো ছোটবেলা থেকে আমারও ইন্ডিয়া নামটা অনেক আপন হয়ে উঠেছিল।

আমার মেজো মাসির বিয়ে হয়েছিল পাটনা প্রবাসী পাত্রের সাথে। মাসি আর মেসো থাকতো বেনারস। সেজন্যই দিদিমা বেনারস বেড়াতে যেত। বেনারসে স্টিলের জিনিস নাকি খুবই ভাল মানের, একেবারে রুপোর মত। সেই রুপোর মত স্টিলে তৈরী ছোট একখানা গ্লাস দিদিমা আমার জন্য এনেছিল।

ছোটবেলায় আমাদের ভাইবোনদের নিজস্ব কোন সম্পত্তি ছিলনা। ভাইদের ছিলনা নিজস্ব কোন খেলনা কয়েকটা মার্বেল আর সিগারেটের খালি বাক্স ছাড়া, আমারও কোন সম্পত্তি ছিলনা স্টিলের ছোট গ্লাসটা ছাড়া। একটা ‘চোখ ঘুরানো পুতুল’ অবশ্য ছিল, সেটা মুক্তিযুদ্ধের সময় হারিয়ে গেছিল।

আমাদের ছোটবেলায় শপিং মল, শপিং কমপ্লেক্স বলে কিছু ছিলনা। মা দিদিমারা বছরে একবার বৈশাখি মেলায় যেতো, সেখান থেকে শখের জিনিস কিনতো। পূজোর সময় ছিটকাপড়ের দোকান থেকে জামার কাপড় কিনে আনতো, আর হরলাল সাহার দোকান থেকে শাড়ি কিনতো। এর বেশি বিলাসিতা করার কথা কেউ ভাবতোনা। বাকি বাজার সদাই বাবা কাকা ভাইয়েরা নিত্য বাজার থেকেই করতো।

শপিং কমপ্লেক্স, শপিং মল ছিলনা বলে কি মা দিদিমাদের আলতা স্নো পাউডার চুড়ি কেনা বন্ধ ছিল? মোটেও না, জামদানী শাড়ি, তাঁতের শাড়ির গাটরি কাঁধে শাড়িওয়ালা আসতো বাড়িতে। ‘লেইস ফিতা, চুড়ি শাখা চিরুনি সিন্দুর’ নিয়ে আসতো ফেরিওয়ালা। ‘তামা কাঁসার বাসন’, ‘পিতলের কলসি’ নিবেন, ‘শিল পাটা খোদাইবেন’ বলে হাঁক দিত পাটা খোদানেওয়ালা, ‘ছিট কাপড়ড়ড়ড়’ বলে হাঁক দিত কাপড়ওয়ালা, ‘ডাইলপুরি, গরম গরম ডাইলপুরি’ বলে হাঁক দিত ডালপুরিওয়ালা! শপিং কমপ্লেক্স দিয়ে কাজ কি? ঘরে বসেই যেখানে সব পাওয়া যেতো।

সেরকমই একজন হাঁক দিতো, ‘কাঁসার বাসন, হাঁড়ি ডেকচিতে নাম লেখাইবেন’ বলে। আমার মায়ের ছিল দুইটা শখ। বই কেনার শখ, কাঁসার বাসন কেনার শখ। বাসন শুধু কেনা হতোনা, সেই আমলে মা দিদিমারা কাঁসার বাসনে নিজেদের নাম খোদাই করিয়ে রাখতো। কে জানে, কাঁসার গ্লাস, থালা বাটি ঘটি সবার ঘরের যেহেতু কম বেশি আছে, চিহ্ন দেয়া না থাকলে যদি পাল্টাপাল্টি হয়ে যায়! আমার ভালোটা অন্যবাড়িতে চলে যাবে, অন্যের খারাপটা আমার বাড়িতে আসবে, এটা হলেতো সাড়ে সর্বনাশ।

হ্যাঁ, কাঁসার বাসনেরও ভাল মন্দ ছিল। ওজন দিয়ে নির্ধারিত হত কাঁসার বাসনের ভাল মন্দ। যে বাসনের ওজন যত বেশি, সেই বাসন তত ভাল। কন্যার বিয়েতে কন্যার বাপ তামা কাঁসা পেতলের বাসন কোসন দান সামগ্রী হিসেবে কন্যার শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতো। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাসন হাতে তুলে তুলে ওজন পরীক্ষা করে সন্তুষ্টি- অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতো। কার বাপে পাতলা ঠনঠনে গ্লাস বাটি দিয়ে ঠকিয়েছে, কোন বাড়ির ছেলের বউ বাপের বাড়ি থেকে ওজনদার তামা কাঁসার তৈজসপত্র নিয়ে এসেছে, এসবই ছিল ঐ আমলের বউ ঝিদের আলাপের বিষয়বস্তু।

আমার দিদিমা আর মায়ের কাঁসা পিতলের ভান্ডার ছিল বিশাল। নানা সাইজের গ্লাস, থালা, বাটি, ঘটি কত কিছু। প্রতিটি জিনিসের মধ্যে দিদিমা আর মা নাম খোদাই করিয়ে রাখতো। একটা মজার বিষয় ছিল, বাসন কোসনগুলো শখ করে কিনতো মা/দিদিমা, বাসনে তাদের নামই লেখানো উচিত ছিল। অথচ দুজনেই বাসনে লেখাতো যার যার স্বামীর নাম। দিদিমার বাসনে লেখা হতো দাদুর নাম ‘ননী গোপাল’, মায়ের বাসনে লেখা হতো আমার বাবার নাম ‘সুনীল’।

তামা কাসার বাসন খোদাইওয়ালা লোকটা যখন আসতো, মা দিদিমার সাথে আমিও বসে থাকতাম। আমার খুব ভাল লাগতো এই কাজ দেখতে। খুব সাধারণ চেহারার একটা লোক কী সুন্দর করে লোহার একটা কাঠিতে পাথর দিয়ে ঠোকা দিয়ে দিয়ে গ্লাসে বাটিতে থালায় ননীগোপাল লিখছে, সুনীল লিখছে। হাতের লেখাও কী সুন্দর। মনে মনে ভাবতাম, আমি খাতার মধ্যে কলম দিয়ে, পেন্সিল দিয়েও এত সুন্দর করে লিখতে পারিনা, আর লোকটা দুই পায়ের পাতার ভাঁজে গ্লাসটাকে চেপে রেখে এক হাতে লোহার শলা( আমরা বলতাম গজাল) বাসনের গায়ে ধরে, অন্য হাতে ধরা পাথর দিয়ে শলার গায়ে ঠুক ঠুক করে ঠোকা দিয়ে কিছুটা ঢেউ খেলানো ডিজাইনে মানুষের নাম লিখে ফেলতো।

প্রশ্নটা আমিই করেছিলাম। “তোমরা সব বাসনেই দাদুর নাম, আর বাবার নাম লেখাও কেন? আমাদের নামওতো লেখাতে পারো। বাবা যেই গ্লাসে জল খায়, সেই গ্লাসে বাবার নাম থাকবে, আমি যেই গ্লাসে জল খাই সেই গ্লাসেও কেন বাবার নাম থাকবে?”
আমার কথা শুনে মা হেসেছিল, বলেছিল, “তোর বাবা হইল বাড়ির কর্তা। সবকিছুতে বাড়ির কর্তার নাম থাকা ভাল”।

মায়ের উত্তর আমার পছন্দ হয়নি, তবে অন্যায্যও মনে হয়নি। সত্যিইতো বাড়ির আসল মানুষতো বাবা। তাই বাবার নামেই সব।

আমি ভাবি আমার মনে, মাও নিশ্চয়ই ভাবতো মায়ের মনে। আমার গ্লাসে কেন বাবার নাম থাকবে, এই প্রশ্নটা হয়তো মা’কে একটু হলেও বিচলিত করেছিল। অন্য একদিন কাঁসার বাসন খোদাইবেন’ ডাক শুনেই মা লোকটাকে ডাকলো। সেদিন অন্য কোন বাসনে নাম লেখায়নি। আমার যে অমূল্য সম্পত্তি বেনারস থেকে আনা ছোট্ট স্টিলের গ্লাস, শুধু সেই গ্লাসটাতে ‘মিঠু’ নাম লেখানোর জন্য মা লোকটাকে ডেকেছিল। কী যে অবাক হয়েছিলাম, কী যে আনন্দিত হয়েছিলাম, গ্লাসের গায়ে ‘মিঠু’ নাম লিখতে দেখে। মনে হয়েছিল, এক লাফে আমি বাবার সমান হয়ে গেছি। আজ থেকে গ্লাসের গায়ে শুধু ‘সুনীল’ না, ‘মিঠু’ নামও থাকবে।

সমস্যা দেখা দিলো, গ্লাসটা এমনিতে যতখানি মূল্যবান সম্পদ ছিল আমার কাছে, ‘মিঠু নাম খোদাই করার পর হয়ে গেলো অমূল্য সম্পদ। সেই গ্লাস আমি মায়ের আলমারীতে যত্ন করে রেখে দিয়ে ‘সুনীল’ লেখা কাঁসার গ্লাসেই জল খেতাম। এত যত্নে রেখেছিলাম যে বড় হতে হতে নিজস্ব সম্পত্তির তালিকা যখন বড় হতে লাগলো, ‘মিঠু’ নামাঙ্কিত গ্লাসটার অস্তিত্বের কথা ভুলে গেলাম।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পর গামলার ভেতর শৈশবকে উঁকি দিতে দেখলাম। একবার ভাবি গ্লাসটা টেনে বের করে দেখি, এটা সেই ‘মিঠু’ নামাঙ্কিত গ্লাসটা কিনা। আবার ভাবি, এটাতো সম্ভব নয়। মায়ের যে কাঁসা পিতলের বাসন কোসনের সাম্রাজ্য ছিল, বাবা নিজে হাতে সেই সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছে। বাবা ছিল খুব গোছানো স্বভাবের, মা ছিল উলটো। মা খালি স্মৃতির ভাণ্ডার তৈরী করতো কিন্তু গুছিয়ে রাখতোনা। দুই রুমের ভাড়া বাড়িতে মানুষের সঙ্কুলান হয়না যেখানে, সেখানে বইয়ের পাহাড়, কাঁসার বাসনের সাম্রাজ্য গড়ে তোলা বোকামি নয়! বাবা সের দরে কাঁসার বাসনগুলো বেচে দিয়েছিল। তাতে ঘর কিছু ফাঁকা হয়েছিল, সাথে ফাঁকা হয়ে গেছিল মায়ের বুকের গভীরে কিছু অংশ।

গ্লাসটা বের করেই ফেললাম। কালচে হয়ে গেছে, কিন্তু বেশ ওজনদার। কালচে ছোপের ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে ঢেউ খেলানো দাগে লেখা নাম ‘মিঠু’। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি হাতে গ্লাসটা নিয়ে, বুকের ভেতর শোঁ শোঁ আওয়াজ হচ্ছে। এটা কি হাউ মাউ করে কান্নার প্রস্তুতি, নাকি একরাশ আনন্দ উচ্ছ্বাস বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি! মা নেই, দিদিমা নেই, কাঁসা পেতলের বাসনের সাম্রাজ্য নেই, কোথাও কিছু নেই, সব নেইয়ের ভাঁজে কেমন করে ‘মিঠু’র গ্লাসটা রয়ে গেলো! গ্লাসটা কি তবে মা তামা কাঁসার সাম্রাজ্যে রাখেনি? কাঁসার বাসনগুলোতো বাবা সব সের দরে বিক্রি করে দিয়েছিল।

ভাইবৌকে ডাকলাম, “অনীতা, এই গ্লাসটা কোথায় ছিল?”
ভাইবৌ জানালো, এই গ্লাসটা মা শোকেসে সিরামিকের বাসন কোসনের সাথে রেখে দিয়েছিল।

আমার খুব অস্থির লাগছিল। গ্লাসটা হাতে ধরে বসে আছি। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, বাসন খোদাইওয়ালাকে ডেকে মা এই গ্লাসটায় আমার নাম লেখাচ্ছে। কারণ আমিই বলেছিলাম, সব বাসনে কেন বাবার নাম লেখা হবে? না, বাবার সাথে আমার আড়াআড়ি ছিলনা, আসলে ঐটুকু বয়সে আমার আলাদা অস্তিত্ব সম্পর্কে যে বোধ তৈরী হয়েছিল, সেই দাবীতেই বলেছিলাম, যার যার বাসনে তার তার নাম লেখা হোক।
মা দিদিমা ঠাকুমাদের সকলেই ছিল সরলা নারীর দল, কখনোও নিজেদের আলাদা অস্তিত্বকে আবিষ্কার করার চেষ্টাই করেনি। কী লাভ হলো, বাবা কি বুঝেছিল প্রতিটি বাসনে বাবার নাম থাকার গুরুত্ব! ঘর ফাঁকা করার জন্য নিজের নামাঙ্কিত ভালোবাসায় কেনা জিনিসগুলো দের দরে বিক্রি করে দিলো তো!

গ্লাসটা একটু ঘষলে মাজলে হয়তো চকচকে হতো। আমি গ্লাসটা মাজলাম না। গ্লাসটা মাজা ঘষা করলেই গ্লাসের গায়ে লেগে থাকা দিদিমার স্পর্শ, মায়ের স্পর্শটুকু ধুয়ে যাবে। গ্লাসটা আমার ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে নিলাম।

প্লেন যখন আকাশে মাঝে মাঝে হাত দিয়ে ব্যাগে থাকা গ্লাসটাকে অনুভব করলাম। দিদিমা গিয়েছিল বেনারস মেজো মাসির কাছে, সেখান থেকে আমার জন্য ছোট্ট একটা গ্লাস এনেছে, মা সেই গ্লাসে আমার নাম লিখিয়ে দিয়েছে, বাবা ঘরের সব তামা কাসা বিক্রি করে দিয়েছিল, মা এই গ্লাসটা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। এত বছর পর আমার জিনিস আমার হাতে ফিরে এসেছে। আজ দিদিমা নেই, মেজো মাসি নেই, আমার মা নেই, রয়ে গেছে তাদের তিনজনের হাত ঘুরে আসা ‘মিঠু’ নামাঙ্কিত আমার গ্লাসটি।

বুকের ভেতর কেমন যেন ‘নেই নেই’ অনুভূতি হচ্ছিল! এতটা পথ এসে আজ মনে হচ্ছে, ” সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা, কৃষ্ণকলির দিনগুলি যদি থাকতো”!

8 thoughts on “সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলি!

  1. এমন একটি লিখা বা স্মৃতিকথন নিশ্চয়ই আপনার প্রিয় হবে এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তারপরও বলে রাখি আমরা যারা পাঠক রয়েছি আমাদের কাছেও ভালো লেগেছে বন্ধু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. * অপূর্ব স্মৃতিকথন… https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    শুভরাত্রি।

  3. সেই শান্ত ছায়ায় ঘেরা কৃষ্ণকলির দিনগুলি! পড়ে ভীষণ নস্টালজিক হলাম দিদি ভাই। কেমন করে যে দিন চলে যায়, বড় হয়ে যাই, জননী হয়ে যাই !! সঙসার হয়ে যায়। অনটন দায়িত্ব আর জীবিকা সব কি এক সাথে চলে ? চলে না। স্মৃতিদের ছাঁইচাপা দিয়ে রাখি। :( ভাল থাকুন।

  4. অপুর্ব! নামকরণ স্বার্থক হয়েছে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    একটা বিষয়ে জানতে আগ্রহবোধ হচ্ছে,  আপনার সেই ছোট্ট বেলার ছবিটা কি তখনকার তোলা? এটা পেলেন কি করে?

  5. গ্লাসটা বের করেই ফেললাম। কালচে হয়ে গেছে, কিন্তু বেশ ওজনদার। কালচে ছোপের ফাঁক গলে দেখা যাচ্ছে ঢেউ খেলানো দাগে লেখা নাম মিঠু

    শৈশবের অম্লান স্মৃতিসুধায় হারিয়ে গেলাম।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।