গোধূলির আনত চিবুক

১.
তোমাকে নিয়ে দীর্ঘ কবিতা লেখার বড় ইচ্ছে আমার,
তীব্র কোন মনের দিকে ধাবমান শব্দগুলোয়
নিজেকে বেঁধে নিয়ে
চৌরাস্তায় থেমে থেকে খুঁজেছি শৈবাল ও ছত্রাকের সদ্ব্যবহার,
বিস্ময় গুনেছি লোকান্তরিত পোড়ামুখের বিতৃষ্ণা শুঁকে।
তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়না আমার,
আমি দূরাগত অস্তিত্বের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুনে রেখেছি আমার অবেলার প্রেম,
তোমাতে এতোটাই মগ্ন থাকি যে আমার শৈশব নিরুদ্দিষ্ট হয়,
কৈশোরের দুর্দান্ত ফুটেওঠা অনুভব অবিন্যস্ত হয়—
যখন এক টুকরো রোদের ডানায় বয়ঃসন্ধি গেঁথে উত্তাল হতাম আমি।
কবিতার মতো করে তখনো সাজিয়েছি তোমায়,
তখনো তোমার পকেটে পুরে রেখেছি আমার বুনো সন্ধ্যাগুলো।
আমার রাত্রির সমস্ত ঘুমে তোমাকে স্বপ্নপোষ্য করে রাখতে গিয়ে
লক্ষবার ভ্রষ্ট হয়েছি মেঘ ও মাঝির শব্দ থেকে,
দুর্বিসহ মনখারাপে তোমার জানালায় অন্ধকার হয়ে থেকেছি কচুরিপানার নিরুত্তাপ অহংকারে।
এগুলো জমা করে বড়জোর সময়ের তালিকা হয়, কবিতা হয়না জানি,
তোমাকে লিখতে হলে ইকারুসের ডানায় চেপে সূর্যের মুখোমুখি হতে হয়,
ঋতুদের ঘরে ঘরে অভ্যর্থনার আকাশ মেলে ধরতে হয়,
এতোটা যোগ্য হয়ে উঠিনি বলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়না আমার।
তিনযুগ ধরে যে মায়া তিলে তিলে সর্ষের ক্ষেতে ঘাম লিখে
ফেনায়িত সমুদ্রের নুনরাশি কিনে এনেছে,
অজস্র সম্ভাবনায় তাকে চোখের দু’পাশে এঁকেছে নিরিবিলি সময়ে
তার কাছে ঋণখেলাপের দায়ে নিলামে উঠেছি আমি,
কারণ কবিতা লেখার সকল আয়োজনে আমি মায়া নয় তোমার ভালবাসা রাখতে চেয়েছি।
বড়বেশি সত্য হয়ে কাছে আসা তুমি অক্ষরের সীমানা ছেড়েছো মধ্যবেলাতেই।

২.
তোমাকে নিয়ে দীর্ঘ কবিতা লেখার সাধ আমার বহু জনমের,
হেলাল হাফিজের মতো করে যদি একবার বলতে,
“পরিণত প্রণয়ের উৎসমূল ছোঁব”
হয়তো কবিতার সব তোপধ্বনি গর্ভ ফুঁড়ে বের হতো
জোছনার ভ্রমণসঙ্গী হয়ে খসে পড়া জোনাকির নিঃশ্বাস হতো।
তুমি যতোটা ভালবাসার কথা বলেছো আমায়
তার চেয়ে অধিক গল্প হয়েছে চিলেকোঠা আর ছাদের প্রণয়,
আমি অনিমেষ তাকিয়ে থেকেছি মেঘের সাদা শরীরের দাবি মেনে,
কবিতার বদলে প্রবল গদ্যকথায় তোমাকে তুলে এনেছি।
অবশ্য তুমি এমনই এক হৃদয় খুঁড়া পলিমাটি
যার আকার দিতে খুব বেশি বৃষ্টির ঝুপঝাপ গুনতে হয়না
দু’মুঠো শিশির, দু’টো গাংচিল কিংবা দু’পশলা রূপালী জোছনা হলেই
তোমাকে রাত্রির আকাশ করে রাখা যায় । এমন আয়ুরেখা আঁকা হাতের তালুতে কবিতা নাহোক
খুব মমতায় গোধূলির আনত চিবুক তো হয়!
আমার এতোটা আকাঙ্খা জুড়ে যে চাবিগুচ্ছের ঝনঝন
তার দু’দণ্ড সংলাপে তুমি হয়ে ওঠো সুনিশ্চিত অন্তর।
কবিতার প্রয়োজন কি, আমি ভোরের আলপথ ধরে দোয়েলের শিষ লিখে যাবো
তোমার জামার আস্তিনে খোদাই করবো নীল প্রজাপতির নিরুদ্বিঘ্ন সুখ
বোতামের খাঁজে সেঁটে দেবো বেহালার উষ্ণ নিঃশ্বাস,
কবিতা লিখার অপরিণত হতাশা বিনিদ্র পূর্ণিমায় বিছিয়ে দেবো আমি।
তুমি দেখো তোমায় ঘিরে জেগে উঠবে নতুন চরের চকচকে রোদ,
উঠোনে ও মাচানে লতিয়ে উঠবে গেলো শতকের সুশোভিত পংক্তিরা,
নিরুদ্দিষ্ট হবে দাম্ভিক কবিদের আত্মপ্রতারণা
তোমাকে নিয়ে দীর্ঘ কবিতা নয়, জল ও শিশিরের স্বপ্ন লিখবো আমি
মৃত্যুহীন হবো ঝাঁকে ঝাঁকে প্রেম ললাটে ধারণ করে।
তুমি কবিতা হয়োনা প্রিয় ভালবাসা,
তুমি শুধু আমার নতুন ভোরের প্রথম নিঃশ্বাস হও।

20 thoughts on “গোধূলির আনত চিবুক

  1. তোমাকে নিয়ে দীর্ঘ কবিতা নয়,জল ও শিশিরের স্বপ্ন লিখবো আমি।

     

    পুরো কবিতা পড়তে গিয়ে ছিটকে পড়েছিলাম ।এই লাইনটি আবার আমাকে চোখ বুলাতে সাহায্য করলো । অভিনন্দন কবিকে।

    1. হা হা হা কবিতাটি দীর্ঘ হয়ে গেছে তাইতো ?  শুরুতেই বলেছিলাম কিন্তু । 

       

      পাশে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন সবসময়।         

    1. ধন্যবাদ আপনাকে বোন। শুভেচ্ছা নিরন্তর।     

  2. তোমাকে নিয়ে দীর্ঘ কবিতা নয়, জল ও শিশিরের স্বপ্ন লিখবো আমি
    মৃত্যুহীন হবো ঝাঁকে ঝাঁকে প্রেম ললাটে ধারণ করে।
    তুমি কবিতা হয়োনা প্রিয় ভালবাসা,
    তুমি শুধু আমার নতুন ভোরের প্রথম নিঃশ্বাস হও।

    ভালো লাগা অংশ টুকু রিপিট না করলে কবি'র প্রতি অসম্মান জানানো হয়। অভিনন্দন। :)

    1. দীর্ঘ কবিতায় ভালোলাগা অংশটুকু বের করে আনা কঠিন। আপনি সুন্দর অনুভূতি নিয়ে কবিতার পাশে ছিলেন, এটা আমার জন্য অবশ্যই সুখের। ধন্যবাদ আপনাকে।

  3. সুন্দর হয়েছে কবিতার দুটি খণ্ড। শুভকামনা কবি। 

    1. আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম ভাই।  ধন্যবাদ আপনাকে ।         

  4. কবিতা হয়না জানি, তোমাকে লিখতে হলে ইকারুসের ডানায় চেপে সূর্যের মুখোমুখি হতে হয়,
    ঋতুদের ঘরে ঘরে অভ্যর্থনার আকাশ মেলে ধরতে হয়,
    এতোটা যোগ্য হয়ে উঠিনি বলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়না আমার।

    অনন্য সাধারণ প্রিয় কবি দিদি ভাই। মুগ্ধতা—- :)

    1. চমৎকার অভিব্যক্তিতে অনুপ্রাণিত হলাম ভাই। ভালো থেকো সবসময় ।     

  5. পারলাম না ধীরেসুস্থে/ হড়বড় করে পড়ে ফেললাম কবিতাটি বোন রুকশানা হক। শুভেচ্ছা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    1. হড়বড় করে পড়াতে ধন্য হলাম দাদা। উৎসাহিত করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে ।     

  6. দু'মুঠো শিশির  ,দু'টো গাংচিল কিম্বা দু'পশলা রূপালী জোছনা হলেই 

    তোমাকে রাত্রির আকাশ করে রাখা যায়। চমৎকার উপস্থাপন কবি আপু।ভাললাগা  রেখে গেলাম।শুভ কামনা।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. আমি ধন্য হলাম আপু ❤।শুভকামনা নিরন্তর।   

  7. লেখার শুরুতে দীর্ঘ কবিতা লিখতে নাপারার দুঃখবোধ থাকলেও ভিতর খুঁড়ে কাব্যালংকারে ভরা সুদীর্ঘ সব কবিতা পেলাম। “সব” বললাম কারণ, “তোমাকে লিখতে হলে ইকারুসের ডানায় চেপে সূর্যের মুখোমুখি হতে হয়”—এটা পড়েই আমি অসাধারণ একটা কবিতার স্বাদ পেলাম।

    “দু'মুঠো শিশির, দু'টি গাংচিল কিংবা দু'পশলা রূপালী জোছনা হলেই
    তোমাকে রাত্রির আকাশ করে রাখা যায়“—এখানেও!

    যখন এক টুকরো রোদের ডানায় বয়ঃসন্ধি গেঁথে উত্তাল হতাম আমি।
    কবিতার মতো করে তখনো সাজিয়েছি তোমায়,
    তখনো তোমার পকেটে পুরে রেখেছি আমার বুনো সন্ধ্যাগুলো।“ –এটাও এবং এইভাবে বহুগুলি ।
    যেন অনেক কবিতার একটা মেলা ঘুরে গেলাম দুই খন্ডের এই কবিতাটা পড়ে।

     “জোছনার ভ্রমণসঙ্গী হয়ে খসে পড়া জোনাকির নিঃশ্বাস”—– ভাব এবং শব্দের কী অসাধারণ এই মেলা!

    1. সাধারণত দীর্ঘ কবিতার পাঠক কম থাকেন । তবুও ধৈর্য ধরে কবিতাটি পড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কবিতাটি নিছক ভালবাসার কবিতা। এ ধাঁচের কবিতায় আমি খুব একটা সুবিধা করতে পারি না। ইচ্ছে তো করেই কাব্যজগতের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াই, কিছু যুক্তিহীন কবিতা লিখি। অথচ ভালবাসার কবিতায় যে যুক্তি অনুর্বর তা এটি লিখতে গিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। 

       

      সুন্দর অনুভূতি  নিয়ে পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ।                

  8. সহসা এতো বড় এবং বেশি শব্দের কবিতা পড়া হয়নি দিদি। আপনার লেখা কবিতাটি পুরো পড়েছি । যদিও একটু সময় লেগেছে, তার চেয়ে বেশি ভালো লেগেছে । সত্যি অসাধারণ লিখেছেন দিদি।

    শুভেচ্ছা জানবেন ।

    1. বড় কবিতা লেখার ঝক্কি যতটা  বেশি ,তার পাঠকের  মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষমতা ততটাই কম। ধৈর্য ধরে কবিতাটি পড়ার  জন্য কৃতজ্ঞতা দাদা। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম ।  ভালো থাকুন ।              

    1. অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। ভালো থাকুন সবসময় ।       

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।