কবিতার নামে পদ্য বা গদ্যলেখা:

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, শব্দে শব্দে বিয়ে দিলেই কবিতা হয় না। একেবারেই খাঁটি ও সত্যকথা। তেমনই ছন্দ ও উপমা নাথাকলেও কবিতা হয় না।

কবিতার ছন্দ:
কবিতাসহ সবধরণের পদ্যেরই প্রাণ হচ্ছে, মনমাতানো ছন্দের দ্যোতনা। ছন্দহীন কবিতা গন্ধহীন ফুলের মতন। সুন্দরশব্দ ও উপমাবিহীন কবিতা প্রাণহীন শুকনো পুষ্পমাল্যবিশেষ। তবে পদ্যের ছন্দের সাথে ছন্দের ব্যাকরণ ব্যতীত বাংলাব্যাকরণের কোনোই সম্পর্ক নেই।

কবিতার উপমা-চিত্রকল্প:
একটা সফলকবিতার মূল-উপাদান হচ্ছে, ছন্দের পাশাপাশি নিখুঁতভাষা ও শব্দালঙ্কার। আর কবিতার কাব্যালঙ্কার হচ্ছে, সুন্দরসুন্দর শব্দযোগে নান্দনিক ও বাস্তব উপমা ও চিত্রকল্প।
সুন্দরসুন্দর পছন্দের ফুল দিয়ে যেমন আমরা মনের মতো মালাগাথি তেমনই উপমিত শব্দ ও চিত্রকল্পের মালা হচ্ছে একটি কবিতা। বৃষ্টির রিমঝিমসুর, নাচের মনকাড়া ছন্দ আর পাখির কলতান যেমন আমাদের মনে ছন্দের বাজনাবাজায়, তেমনই কবিতাও যদি মনে দোলা নাদেয়, তা কবিতাই নয়। জোর করে শব্দের পাশে শব্দবসিয়ে বা শব্দে শব্দে বিয়ে দিলেই তাই কবিতা হয় না। পত্রিকার কলামের মতন বা কবিতার পঙক্তির মতন সাজালেই কবিতা হয় না যেমন একটা অচলঘড়িকে দেয়ালে টাঙ্গালেই তাকে ঘড়ি মনে হলেও ঘড়িবলা যায় না।

কাব্যালঙ্কার:
কবিতার শরীর, ভাষা, শব্দ ইত্যাদি হচ্ছে রান্নার কাঁচা-তরকারীবিশেষ এবং ছন্দ-মাত্রা, পর্ব, তাল, লয় হচ্ছে কবিতা, পদ্য বা ছড়ার মুখরোচক মসলাপাতি। কাঁচা-তরকারীতে এসসব মসলার সুষমমিশ্রণ ঘটলেই একটা কবিতা বা পদ্য হয়ে ওঠে দুর্দান্ত-সাবলীল।

আবার কাঁচাতরকারীরূপী একটা কবিতা হচ্ছে, উলঙ্গ-নবজাতকের মতন। সুন্দর পোশাকপরালেই যেমন শিশুটি আরো সুন্দর হয় তেমনই একটা পরিণত কবিতাকেও উপযুক্ত অলঙ্কার নাপরালে কবিতা যৌবনবতী হয় না। একটা নারীর স্বাভাবিক রূপ-সৌন্দর্য যা-ই থাক, তাকে উপযুক্ত ও সুন্দর পোশাক আর অলঙ্কারে সাজালে যেমন মনকাড়ালাগে, তেমনই কবিতার শরীরে যদি বাস্তবিক উপমা, চিত্রকল্প, উৎপ্রেক্ষার সংমিশ্রণ ঘটে, তবেই তা হয়ে ওঠে সার্থক ও সুন্দর কবিতা।

কবিতায় দুর্বোধ্যতা ও ব্যাখ্যাহীনতা:
কবিতার বাহন হচ্ছে ভাষা। কবিতা এমনিতেই উপমা আর চিত্রকল্পের দোলাচালে কিছুটা দুর্বোধ্য ও ব্যাখ্যাতীত বটে। কিন্তু অপভাষা ও অপবাক্যগঠন যেন তাকে অবোধ্য-ফালতু করে নাতোলে! দেখতে যাই হোক, কবিতাপড়তে যদি গদ্যের মতো মনে হয়, হৃদয়-মন না নাচায়, মনে অবর্ণনীয় ভাল্লাগা নাজাগায়, তবে তা স্রেফ গদ্যই। কবিতাপড়তে গেলে যদি কবি মীর মোশাররফ হোসেনের “বিষাদসিন্ধু”র মতন হৃদয়াবেগ ও ছন্দের ঢেউ মনে নাওঠে তবে তা কবিতাপদবাচ্য নয়।

কবি বনাম শিল্পী:
একজন শিল্পী মনের তুলিতে মাধুরী মিশিয়ে এবং কালির আঁচড়ে যেমন অপরূপ বা মনলোভা কিছুসৃষ্টি করে, তখন আমরা শিল্পীর চেয়ে তার শিল্পকে নিয়েই বেশি মাতি। শিল্পী হতে পারে প্রতিবন্ধী বা দেখতে চরম অসুন্দর। কিন্তু এতে ভক্ত-অনুরক্তের কিচ্ছু যায়-আসে না। একটা মাকড়সা, মৌমাছি বা বাবুইপাখির রূপ আমরা খুঁজি না। আমরা মোহিত হই মাকড়সার নিপুণ জালের বুননরূপী কাব্যিক বাসা, মৌমাছির অনিন্দ্য মৌচাক আর বাবুইয়ের চমৎকার ঝুলন্ত বাসা দেখেই। এটাই শিল্পীর সার্থকতা, তার শিল্পের সফলতা।

একজন কবিও নিপুণ একশিল্পী। সে ভাষার তুলিতে আঁকে শব্দের নন্দিত শব্দমালা বা কথাসাহিত্য বা কবিতা। অনেকেই কবিতালেখে। সবার কবিতা সার্থক হয় না, কালজয়ী হয় না। জীবনান্দ দাসের ভাষায় তাই “সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।” আমিও বলি, সবাই কবিতালিখলেও কেউ কেউ শিল্পী আর বাকিরা অকবি বা অশিল্পী।

পদ্য:
ছড়া, কবিতা, গানসহ কাব্যোচিত সবই হচ্ছে পদ্য। পদ্যে দুর্বোধ্যতা যেমন নেই তেমনই উপমা, চিত্রকল্প ইত্যাদির বালাই নেই। পদ্য হচ্ছে সোজাসুজি ছন্দ, মাত্রা, অন্ত্যমিল ইত্যাদি বা ছন্দের ব্যাকরণের কড়াশাসনে গঠিত সাদামাটা
বর্ণনাধর্মী লেখা। এতে ব্যাখ্যার মতন কিছু নেই। ছড়া-কবিতার মতন নাটকীয়তাও নেই। কবি যা লিখে বোঝায় পাঠকও ঠিক তাই বোঝে, অন্যকিছু নয়।

অথচ অধিকাংশ কবি আজ কবিতার নামে পদ্যচালায়। পদ্যকার হয়ে নিজেকে কবিও বলে। তারা পদ্য ও কবিতার সংজ্ঞাজানে না, এটা নিশ্চিত। আবার মজার ব্যাপার হচ্ছে, কবিতাসম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ কিছুবিচারক পদ্যকেই সেরাকবিতার উপাধি দিয়ে হাসির কাণ্ডঘটায়। তাদের চরম বানানভুলের কথা নাইবা বললাম। তাই আমাদের বইপ্রকাশের ধান্ধার চাইতে বইপড়ার ধান্ধাবাজিই বাড়াতে হবে। কবিতাসম্পর্কে জানতে হবে।

শাহ আলম বাদশা সম্পর্কে

৮০ দশকের কবি, ছড়াকার, গীতিকার বিশেষত; শিশুসাহিত্যিক। ৬টি প্রবন্ধ সংকলন, ৩টি গল্পসংকলন, ৩টি শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ, ২টি ছড়াগ্রন্থ, ৩টি কাব্যগ্রন্থ, ৭টি অডিও-ভিডিও এলবাম প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রেডিও বাংলাদেশ রংপুর কর্তৃক ‘‘উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ ছড়াকার’’ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ১৯৮৬ সালে সিলেট ছড়া পরিষদ কর্তৃক ছড়ায় অবদান রাখার জন্য পুরস্কৃত। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিভিন্ন দৈনিকে সাংবাদিকতাছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা যেমন; লালমনিরহাট থেকে ত্রৈমাসিক চলমান, ত্রৈমাসিক ব্যতিক্রম, ত্রৈমাসিক দারুচিনি, ত্রৈমাসিক কিশোরকন্ঠ, ত্রৈমাসিক প্রজাপতিসহ (অধুনালুপ্ত) বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক এবং লালমনিরহাটের প্রথম প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক জানাজানি’র প্রতিষ্ঠাতা সাহিত্যসম্পাদক ছিলেন। শাহ আলম বাদশা’র প্রকাশিত অডিও-ভিডিও এলবাম এবং গ্রন্থসমূহঃ ১। ভোরের পাখিরা [অডিও-ভিডিও এলবাম-১৯৮৯] ২। শিহরণ ১ ও ২ [অডিও এলবাম-১৯৯৩] ৩। শিহরণ ২ [অডিও এলবাম-১৯৯৩] ৪। প্রত্যয় [অডিও এলবাম-১৯৯৪] ৫। প্যারোডি গান [অডিও এলবাম-১৯৯৫] ৬। তথ্য পেলেন কাশেম চাচা [নাটিকার ডিভিডি-২০০১৪] ৭। তথ্য কমিশনের বিচারিক কার্যক্রম [প্রামাণ্যচিত্রের ডিভিডি-২০১৪] ৮। কিশোকন্ঠ গল্পসমগ্র-১ (গল্পগ্রন্থ)-২০০১] ৯। মা ও শিশু [প্রবন্ধগ্রন্থ (১খণ্ড)-২০০৬] ১০। মা ও শিশু [প্রবন্ধগ্রন্থ (২খণ্ড)-২০০৭] ১১। মা ও শিশু [প্রবন্ধগ্রন্থ (৩খণ্ড)-২০০৮] ১২। মা ও শিশু [প্রবন্ধগ্রন্থ (৪খণ্ড)-২০০৯] ১৩। স্বপ্ন দিয়ে বোনা [গল্পগ্রন্থ-২০১৩] ১৪। মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য গল্প [গল্পগ্রন্থ-২০১৫] ১৫। দুরছাই ধুত্তোরী ছাই [শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ-২০১৫] ১৬। ছড়িয়ে দিলেম ছড়া [ছড়াগ্রন্থ-২০১৬] ১৭। হৃদয়জমিন [কাব্যগ্রন্থ-২০১৬] ১৮। নিপুণ শব্দস্রোত [কাব্যগ্রন্থ-২০১৬] ১৯।লিন্তামণির চিন্তা-[শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ-২০১৬] ২০। ছোট্টমণির প্রশ্ন অনেক [শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ-২০১৭] ২১। ধোঁয়াচ্ছন্ন অন্ধকার-[কাব্যগ্রন্থ-২০১৭] ২২। ছড়াময়-[ছড়াগ্রন্থ-২০১৭] ২৩। লিমেরিক-[লিমেরিকগ্রন্থ-২০১৭] ২৪। কমন-স্যার-[গল্পগ্রন্থ-২০১৭]

15 thoughts on “কবিতার নামে পদ্য বা গদ্যলেখা:

  1. অনের সুন্দর জ্ঞানের কথা জানলাম—-
    সালাম নিবেন দাদা ———-

  2. বেশ তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।
    শুভ কামনা সবসময়।

  3. মোদ্দা কথা হচ্ছে লিখককে জানতে হবে তিনি আসলে পাঠককে কি দিতে চাচ্ছেন। এই জানানোটা যত পারা যায় পাঠকবান্ধব হতে হবে। সাহিত্যকে দুর্বোধ্য করা যাবে না।

  4. একটা সফলকবিতার মূল-উপাদান হচ্ছে, ছন্দের পাশাপাশি নিখুঁতভাষা ও শব্দালঙ্কার। আর কবিতার কাব্যালঙ্কার হচ্ছে, সুন্দরসুন্দর শব্দযোগে নান্দনিক ও বাস্তব উপমা ও চিত্রকল্প।- অনেক কিছু জানলাম। কাজে আসবে প্রিয় বাদশাহ ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  5. কবিতা হয়ে ওঠার ব্যপারটাই খুব রহস্যময় । উপমা হলো অলংকার হলো কিন্তু কিছু একটার অভাবে কবিতা হলো না – আবার খুব সহজ কথায় শব্দের দ্যোতনায় ও কবিতা হয়ে ওঠে ।
    চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার দিশা –
    এরকম কবিতার দিশা বের করতে করতে কবিকুল হয়রান –
    পদ্য এবং কবিতার ফারাক বুঝে না আপাময় জনসাধারণ – আমাকেও তাই শুনতে হয় কি লিখো কিছু বুঝি না – আগে রবীন্দ্র নজরুল কত সহজ ভাষায় কবিতা লিখেছেন – তোমাদের লেখা টেখা বাপু কিছু বুঝি না , আছি সত্যিই এক জ্বালায় ।

  6. অনেক অনেক তথ্য সমৃদ্ধ লেখা,পড়লাম। অশেষ
    শুভ কামনা সবসময়।প্রিয় শ্রদ্ধেয় কবি।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।