শাহ আলম বাদশা এর সকল পোস্ট

শাহ আলম বাদশা সম্পর্কে

৮০ দশকের কবি, ছড়াকার, গীতিকার বিশেষত; শিশুসাহিত্যিক। ৬টি প্রবন্ধ সংকলন, ৩টি গল্পসংকলন, ৩টি শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ, ২টি ছড়াগ্রন্থ, ৩টি কাব্যগ্রন্থ, ৭টি অডিও-ভিডিও এলবাম প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ ও ভারতের পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। ১৯৭৮ সালে তৎকালীন রেডিও বাংলাদেশ রংপুর কর্তৃক ‘‘উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ ছড়াকার’’ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ১৯৮৬ সালে সিলেট ছড়া পরিষদ কর্তৃক ছড়ায় অবদান রাখার জন্য পুরস্কৃত। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিভিন্ন দৈনিকে সাংবাদিকতাছাড়াও বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা যেমন; লালমনিরহাট থেকে ত্রৈমাসিক চলমান, ত্রৈমাসিক ব্যতিক্রম, ত্রৈমাসিক দারুচিনি, ত্রৈমাসিক কিশোরকন্ঠ, ত্রৈমাসিক প্রজাপতিসহ (অধুনালুপ্ত) বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক এবং লালমনিরহাটের প্রথম প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক জানাজানি’র প্রতিষ্ঠাতা সাহিত্যসম্পাদক ছিলেন। শাহ আলম বাদশা’র প্রকাশিত অডিও-ভিডিও এলবাম এবং গ্রন্থসমূহঃ ১। ভোরের পাখিরা [অডিও-ভিডিও এলবাম-১৯৮৯] ২। শিহরণ ১ ও ২ [অডিও এলবাম-১৯৯৩] ৩। শিহরণ ২ [অডিও এলবাম-১৯৯৩] ৪। প্রত্যয় [অডিও এলবাম-১৯৯৪] ৫। প্যারোডি গান [অডিও এলবাম-১৯৯৫] ৬। তথ্য পেলেন কাশেম চাচা [নাটিকার ডিভিডি-২০০১৪] ৭। তথ্য কমিশনের বিচারিক কার্যক্রম [প্রামাণ্যচিত্রের ডিভিডি-২০১৪] ৮। কিশোকন্ঠ গল্পসমগ্র-১ (গল্পগ্রন্থ)-২০০১] ৯। মা ও শিশু [প্রবন্ধগ্রন্থ (১খণ্ড)-২০০৬] ১০। মা ও শিশু [প্রবন্ধগ্রন্থ (২খণ্ড)-২০০৭] ১১। মা ও শিশু [প্রবন্ধগ্রন্থ (৩খণ্ড)-২০০৮] ১২। মা ও শিশু [প্রবন্ধগ্রন্থ (৪খণ্ড)-২০০৯] ১৩। স্বপ্ন দিয়ে বোনা [গল্পগ্রন্থ-২০১৩] ১৪। মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য গল্প [গল্পগ্রন্থ-২০১৫] ১৫। দুরছাই ধুত্তোরী ছাই [শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ-২০১৫] ১৬। ছড়িয়ে দিলেম ছড়া [ছড়াগ্রন্থ-২০১৬] ১৭। হৃদয়জমিন [কাব্যগ্রন্থ-২০১৬] ১৮। নিপুণ শব্দস্রোত [কাব্যগ্রন্থ-২০১৬] ১৯।লিন্তামণির চিন্তা-[শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ-২০১৬] ২০। ছোট্টমণির প্রশ্ন অনেক [শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ-২০১৭] ২১। ধোঁয়াচ্ছন্ন অন্ধকার-[কাব্যগ্রন্থ-২০১৭] ২২। ছড়াময়-[ছড়াগ্রন্থ-২০১৭] ২৩। লিমেরিক-[লিমেরিকগ্রন্থ-২০১৭] ২৪। কমন-স্যার-[গল্পগ্রন্থ-২০১৭]

শাহ আলম বাদশা

#শামেরিক #সাহেবজাদা

সাহেবজাদা তোলেন চাঁদা ভোলেন দেশের নীতিও
দেশের প্রতি দশের প্রতি আছেও নাকি প্রীতিও!
আমরা যারা চুনোপুঁটি
অভাবে খাই লুটোপুটি
আইনে বাঁধে সাহেবজাদে শোনায় নিয়ম-গীতিও।
ক্ষমতাতে মমতাতে এরাই আবার কৃতীও!!

কবিকবি-ভাব ছন্দের অভাব

ছড়ার ছন্দ বনাম মাত্রাবৃত্ত এবং সেকেলে শব্দ:
আমি বিচ্ছিন্নভাবে ছন্দ ও পদ্যের ভাষা ও শব্দচয়ন নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছি। সবগুলো প্রবন্ধ কেউ পড়ে থাকলে আমাকে ভুলবোঝার বা আমার কথার অপব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই। কিন্তু আমার মতামত বা বক্তব্য বলে অনেকেই এমন কিছুকথা লিখছেন বা বলছেন, যাতে ভুলবোঝাবুঝির অবকাশ আছে। তাই আমার এই আত্মপক্ষসমর্থন।

স্বরবৃত্ত ছন্দ:
আমার শত শত ছড়া, কবিতা ও পদ্য রয়েছে স্বরবৃত্তছন্দে, যার অর্থ হচ্ছে এই যে, এই ছন্দে শুধুই ছড়া নয় পদ্য ও কবিতাও রচনা করা যায়, করতে বাধা নেই। কিন্তু যুগযুগ ধরে এই ছন্দের স্বভাবানুযায়ী ছড়াকার কর্তৃক চটুল ছড়ারচনার সাবলীলতা ও সিদ্ধহস্ততার দরুণই একে প্রাজ্ঞজনরা “ছড়ার ছন্দ” বলেই চিহ্নিত ও অভিহিত করেছেন। ফলে আর কোনো ছন্দেরই এই কৃতিত্ব নেই। তাই একে আমি ‘ছড়ার একমাত্র ছন্দ’ বলায় অনেকেই ভুলবুঝেছেন যে, অন্যছন্দে বুঝি ছড়ারচনা সম্ভব নয় বা নিষিদ্ধ।

আসলে এই ছন্দটি আমাদের এতই মজ্জাগত যে, পদ্যলিখতে গেলেই কেন যেন আপনাআপনিই এটি এসে যায়। উল্লেখ্য, আমার অধিকাংশ ছড়াই স্বরবৃত্তে রচিত। আমার নতুন একটি স্বরবৃত্তের ছড়া দিলাম দেখুন:

খটকা
শাহ আলম বাদশা
[মুক্তক স্বরবৃত্ত]

খটকা ভীষণ খটকা
মনটা বলে দ্বন্দ্বঝেড়ে
ফালতুকথা মন্দছেড়ে
ঘাড় পাজিদের মটকা।
খটকা ভীষণ খটকা!!

ভেজাল বেচি ভেজাল করি
ভেজাল নিজেও চাই না
ফাঁকিবাজের লিস্টে পড়ি
মাস গেলে নিই মাইনা।
নোংরা-পচার ব্যবসা-গড়ি
নোংরা নিজে খাই না।।

বোমফাটালে কই না কিছু
আবার কারো লই যে পিছু
ফাটায় যদি পটকা।
খটকা ভীষণ খটকা।।

পালের গোদা পাপ করে যেই
তড়িঘড়িই মাফ করে দেই
মফিজ হলে হাড্ডিফুটাই
তেড়েমেরে চামড়া-গুটাই
কেউ বলি ফের
হয়নি তো ঢের
লটকা ওকে লটকা।
খটকা ভীষণ খটকা।।

ঋণ নিয়েছি পেটের দায়ে
শোধতে যদি না-ই পারি
দৌড়ঝাঁপে হয় ফোস্কাপায়ে
নিলাম যে হয় ঘরবাড়ি!

কোটিপতি ঋণখেলাপী
হয় না কেন আদৌ পাপী
আইনমারে কে চটকা?
খটকা ভীষণ খটকা!

পাকবাহিনী জ্বালিয়ে গেছে
ঠেলায় পড়ে পালিয়ে গেছে
চাই আবারো ঝটকা;
দূর করে দেই
চুর করে দেই
ফটকাবাজি ফটকা!
খটকা ভীষণ খটকা!!

স্বরবৃত্তছন্দের বৈশিষ্ট্য:
এই ছন্দের অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য আছে, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য যেমন:
১. দ্রুতলয় বা চটুল তালসৃষ্টিকারী।
২. সাধারণত চারমাত্রার পর্বভিত্তিক।
৩. অতিপর্ববাদে প্রতিপর্বের মাত্রা সমান হয়।
৪. মুক্তস্বর ও বদ্ধস্বর সবই একমাত্রার হয়।

বলাবাহুল্য যে, আমাদের ছন্দের ব্যাকরণে বা সাহিত্যের আইনে এমন কথা বলা নেই যে, কোনো ছন্দের বা স্বরবৃত্তের এই নিয়মভেঙ্গে নতুন নতুনছন্দে ছড়ালেখা যাবে না। কিংবা ছড়ার ছন্দ হিসেবে আর কোনো নতুনছন্দ আবিষ্কৃত হবে না। এমন কাজ দক্ষছড়াকাররা করতেই পারেন, যদি গ্রহণযোগ্য হয়।

মাত্রাবৃত্তছন্দ:
মাত্রাবৃত্তছন্দের চাল হয় সাধারণত ৪, ৫, ৬ ও ৭ মাত্রার পর্বযুক্ত। স্বরবৃত্তের মতন এতে ৪মাত্রার চাল থাকার কারণেই এই ছন্দেও ছড়ালেখা যায় যদিও এই ছন্দ মধ্যলয়ের পদ্য ও কবিতারচনার জন্য সাধারণত উপযুক্ত। বাকি ৫, ৬ ও ৭ মাত্রার চালে কিন্তু ছড়ার চটুল তাল আসা খুব একটা স্বাভাবিক নয় বলে মাত্রাবৃত্ত পদ্য বা কবিতার ধীরলয়সৃষ্টি করতে সক্ষম ও উপযুক্ত।

এবার চারমাত্রাযুক্ত দু’পর্বের মাত্রাবৃত্তছন্দে আমার একটি ছড়া দেখুন:

আলুদম
শাহ আলম বাদশা
[মাত্রাবৃত্ত ৪+৪]

টেরাকের ধাক্কায়
লোকটা তো পাক খায়-
পাক খেয়ে একদম
ঢুকলোরে চাক্কায়!

চাক্কার তলে তার
হাড্ডি তো ছারখার
ঠিক যেন আলুদম
ছিটকালো ফাঁক্কায়।
টেরাকের ধাক্কায়।।

ফাঁকা অই রাস্তায়
হতভাগা লাশটায়
মাছিরাও হরদম
কীযে ঘুরপাক খায়?
রাজধানী ঢাক্কায়।।

মাত্রাবৃত্তের বৈশিষ্ট্য:
মাত্রাবৃত্তের প্রধান বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ,
১. মধ্যলয়ের ছন্দ।
২. ৪, ৫, ৬ ও ৭ মাত্রাভিত্তিক পর্ব হয়।
৩. অতিপর্ববাদে সমসংখ্যক পর্ব থাকে।
৪. ছড়া, পদ্য ও কবিতার জন্য উপযুক্ত।
৫. বদ্ধস্বর ২মাত্রা এবং মুক্তস্বর ১মাত্রাবহনকারী।

স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত দু’সহোদর:
উপর্যুক্ত দু’ছন্দে আমার দুটো ছড়াপড়ার পর নিশ্চয়ই এ ভুলধারণা দূর হবে যে, মাত্রাবৃত্তে ছড়ালেখা যায় না। যদিও মাত্রাবৃত্তের ছন্দ হচ্ছে মধ্যলয়ের বা স্বরবৃত্তের মতন দ্রুততালের চেয়ে ধীরলয়যুক্ত। কিন্তু স্বরবৃত্তের মতো ৪মাত্রা পর্যন্ত সমানপর্বে ছড়ারচনা করলে তাও স্বরবৃত্তের মতো চটুল ছন্দের হতেই পারে। সেজন্য আমরা এই দু’ছন্দকে পরস্পর সহোদর বলতেই পারি। স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তে যেমন ছড়ারচনা করা যায় তেমনই পদ্য বা কবিতাও রচনা করা যায়। ফলে প্রায়শই একটা মজার ব্যাপার ঘটে যে, স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের ছড়ার মধ্যে ফারাক করা কঠিন হয়ে যায়। সূক্ষভাবে মাত্রার হিসেব বের না করলে এদের গুলিয়ে ফেলতে হয়। এবার তবে ৪+৪/৪+৪+৩ চালের মাত্রাবৃত্তের আরেকটা উদাহরণ দেখুন:

সফদার ডাক্তার
মাথাভরা টাক তার
খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে।

চেয়ারেতে রাত দিন
বসে গুনে দুই তিন
পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে।
[হোসনে আরা বেগম]

বিদ্রোহী কবি নজরুলের বিখ্যাত শিশুতোষ ছড়াটাও মাত্রাবৃত্তে ৪+৪/৪+৩ চালে দেখুন আর ভাবুন এরা কতটা সহোদর:

ভোর হলো দোর খোলো
খুকুমণি ওঠো রে
ঐ(ওই) ডাকে জুঁইশাখে
ফুলখুকী ছোট রে।

খুলি হাল তুলি পাল
ঐ(ওই) তরী চললো
এইবার এইবার
খুকু চোখ খুললো।

পদ্যের ভাষা ও শব্দচয়ন:
আদিযুগের কবিসহ মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ ও অত্যাধুনিক যুগের কবিদের পদ্যের উদাহরণ দিয়েও আমি বাংলাভাষা এবং পদ্যে ব্যবহৃত শব্দচয়নের কালাক্রমিক ধারাবাহিকতা তুলেধরেছি। সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, রুচি-সংস্কৃতিসহ আমাদের লেখ্য ও কথ্যভাষার পরিবর্তনের কথাও বলেছি। এই অত্যাধুনিক যুগে যেসব শব্দ আমরা কথ্যভাষায় ব্যবহার করি না যেমন মুই, মোরা, করিনু, হেরিয়া, সহিয়া ইত্যাদি পদ্যে ব্যবহারের যৌক্তিকতাই নেই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ আমাদের অগ্রপথিক কবিদের উদাহরণ টেনে যারা বলেন, তারা এসব শব্দের ব্যবহার করলে আমাদের ব্যবহারে বাধা কোথায়? আমিও পালটা প্রশ্ন করি, তাহলে তো মহাকবি কালীদাস, কীত্তিবাস, আলাওল, শাহ সগীর, আব্দুল হাকিমদের তৎকালীন বাংলাভাষাতেও আমরা কাব্যলিখতেই পারি! বিবর্তিত আধুনিক বাংলাছেড়ে তা করাটা কি স্বাভাবিক নাকি যুক্তিসঙ্গত?

পছন্দের সেরাফুল দিয়ে যেমন আমরা মালাগাঁথি তেমনই বাংলা-অভিধানের লাখলাখ শব্দভাণ্ডার থেকে বেছে নিয়ে আমরা অতিসুন্দর, সহজবোধ্য ও চমৎকার শব্দগুলো দিয়েই শব্দের মালাগাঁথি। সবশব্দ আমরা কাব্যে ব্যবহার করি না। অভিধানের অনেক শব্দই থাকে অপ্রচলিত, দুর্বোধ্য ও সেকেলে। নন্দিত ও ছন্দিত ছন্দশিল্পের সূক্ষ্মছাচে ফেলতে আমরা বহুলপরিচিত আঞ্চলিক শব্দও পদ্যে আনতে পারি, আন্তর্জাতিক শব্দসহ বিদেশাগত পরিচিত শব্দের ব্যবহারেও বাধা নেই। মূলব্যাপার হচ্ছে শব্দচয়নের ক্ষেত্রে আধুনিকমনস্কতা আর রুচিবোধের প্রশ্ন।

একটা গ্রামীণ নারীর সাজগোছ বা শাড়িপরা আর একজন আধুনিক নারীর সাজগোছ বা শাড়িপরার স্টাইলের যে ফারাক, সাহিত্যে আধুনিক ও সেকেলে বাংলাব্যবহারের বিষয়টাও তদ্রূপ। এককালের ধুতি বা লুঙ্গিপরার সংস্কৃতি আর আধুনিক সুট-টাইপরার সংস্কৃতির মাঝে শিল্পমনস্কতার সৌন্দর্যের কথাটা আমাদের ভাবতে হবেই যদি আমরা কালজয়ী সাহিত্যরচনা করতে চাই। আমি বলি না যে, আদিযুগ, মধ্যযুগের সাহিত্যে ব্যবহৃত শব্দমাত্রই বাতিলযোগ্য। বরং তাদের যুগে ব্যবহৃত ও বর্তমান আধুনিক যুগেও প্রচলিত শব্দসমুহ পরিহার করা মানেই বাংলাকে পঙ্গু করা। ভালোবাসা, প্রেম, বাবা, মা ইত্যাদি শব্দ যেমন কখনো সেকেলে হয় না তেমনই বর্তমানে ব্যাপক ও বহুলপ্রচলিত শব্দই আধুনিক শব্দ। আমাদের বর্তমান বাংলাভাষাই আধুনিক ভাষা। দরকার শুধু ভাষার ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ মানসিকতার পরিবর্তন।

জীবনঘুড়ি

[তিনপর্ববিশিষ্ট মাত্রাবৃত্ত]

ঝাঁঝালো সকাল রোদেলা দুপুর মিষ্টিবিকেল
পায়ে পায়ে সেযে হেঁটে যায় নিজে ফুরায় না পথ
সময়ের ঘুড়ি করে ওড়াউড়ি যেন একরেল
কচ্ছপগতি হোক না সে অতি অবিরাম রথ।
পার হয় চর বিশাল সাগর এই তার খেল
আমায় সে দলে ছুটে যায় চলে নেই ফুরসৎ
খেলে আলোছায়া কীযে মহামায়া আর হিম্মত
আমার খোলস করে সে বদল দেখায় তো জেল!

হয় না সে বুড়ো আমি হই খুড়ো রঙচটা ঘুড়ি
নড়বড়ে খুঁটি খাই লুটোপুটি যন্ত্রবিকল
পাতার মতন শুকনো জীবন তবু আমি উড়ি
ভুলে যাই কেন পায়ে বাঁধা যেন লাটাই-শিকল?
কেন দাও দোলা কী আপনভোলা পেয়ে সুড়সুড়ি
আমি তো পাগল করি যে আসল জীবন-বিকল!

শব্দনীড়কে আদর্শ সাহিত্যব্লগ করতে আমার কিছু পরামর্শ

আমি একসময় ব্লগে নিয়মিত ছিলাম। কিন্তু চাকরিগত ও বিভিন্ন কারণে ২ বছর যাবত সমস্ত ব্লগ থেকেই নির্বাসিত আছি। মূলত ব্লগগুলো গতানুগতিকতার ধারায় আমি খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। একঘেয়েমীও লাগছিল। তাই ফেসবুকের একটি ব্যতিক্রমী একটি ‘রঙধনু সাহিত্যগ্রুপ’ [www.facebook/groups/littlemagazinechharpotro] খুলে সাহিত্যের নবদিগন্ত চালুর চেষ্টা করে সফল হয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই আমার আজকের কিছু প্রস্তাব যেমন দিলাম তেমনই এখন আবার শব্দনীড়কে দিয়েই ব্লগে আগমন ঘটেছে আমার। আমার গ্রুপে ঢুকে আরো বহু সৃজনশীল ইভেন্ট দেখার অনুরোধ করছি। এই গ্রুপ এখন ফেসবুকের সবচে সক্রিয় ও সেরাগ্রুপে পরিনত হয়েছে, এডমিন ২১জন। জানিনে এই ব্লগে এডমিন/মডারেটর কতজন। তবে ইভেন্টের সংখ্যানুযায়ী মোডারেটর নিযুক্ত করে তাদের আলাদা আলাদা দায়িত্ব দিলেই বেশি উপকার পাওয়া যাবে। দায়িত্বে কেন্দ্রীয়করণের বদলে বিকেন্দ্রীয়করণেই ফায়দা বেশি পাওয়া যায়। অবৈতনিকভাবে অনেক সাহিত্যিকই ে দায়িত্বপালনে এগিয়ে আসবেন চাইলে।

ব্লগসম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে যে, একটা ব্লগ খুলে শুধু পোস্টিং অপশন চালু করলেই তা জনপ্রিয়তা পায় না। এজন্য দরকার গতানুগতিকতা পরিহার করে গঠনমুলক ও সৃজনশীল ধারার। শুধুই পোস্ট করা আর দু’চারজনের মন্তব্য থাকলেই ব্লক চলে না বা জনপ্রিয় হয় না। সবব্লগেই এই গড্ডালিকাপ্রবাহ চলমান, নতুনত্বের ধারধারে না কেউই। এজন্য যেমন ব্লগের সক্রিয় এডমিন-প্যানেল থাকতে হবে তেমনই নতুন নতুন প্রতিযোগিতামুলক বিষয় চালু করে লেখকদের মাতিয়ে রাখতে হবে। আমার বিশ্বাস আমার অভিজ্ঞতার আলোকে দেয়া নিচের পরামর্শসহ নতুন নতুন ইভেন্ট নিয়ে এগিয়ে এলে শব্দনীড় সবার সেরা হবেই।

শব্দনীড়কে আদর্শ সাহিত্যব্লগ করতে হলে আমার কিছু পরামর্শঃ

১। দেশের প্রতিষ্ঠিত লেখকসহ ব্লগের সাহিত্যিকদের লেখার মানানুযায়ী একটি ধারাবাহিক তালিকা তৈরি করে নির্ধারিত প্রশ্নের ভিত্তিতে একেকজনের সাপ্তাহিক সাক্ষাৎকার প্রচার করা হলে সাড়া পড়বে। এই তালিকা নির্ধারিত এডমিন/মডারেটর বাছাই ও আপডেট করবেন।

২। কবিতা, ছড়া, গল্প, রম্য, কল্পকাহিনী, প্রবন্ধভিত্তিক সাপ্তাহিক ও মাসিক সাহিত্যপ্রতিযোগিতা চালু করলে ব্লগের বিস্ময়কর উত্থান ঘটবে। বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা যেতে পারে। বিভাগভিত্তিক নির্দিষ্ট বিচারক-প্যানেল করে ব্লগের সাহিত্যিকদের এসব পরিচালনায় যুক্ত করা যেতে পারে।

৩। নিয়মিত সাপ্তাহিক সেরাদশ বা বিশজন মন্তব্য/সমালোচককে বাছাই করে নোটিশবোর্ডে ঝুলিয়ে দেয়া যায় বা স্টিকিপোস্ট করা যায়। এতে উৎসাহ বাড়বে লেখকদের।

৪। ব্লগের উদ্যোগে নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক সাপ্তাহিক আলোচনানুষ্ঠান পরিচালনা করা যায়। এতে আমন্ত্রিত একজন সাহিত্যিক মডারেটর/পরিচালক থাকতে পারে।

বাংলাবানান ও শব্দগঠন: ভুল শুধু ভুল

সাহিত্যে সাধু-চলিত ও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার:
অধুনালুপ্ত সংস্কৃতভাষার সন্তানই হচ্ছে বাংলাভাষা। সংস্কৃতশব্দকে বাদ দিলে বাংলাভাষা আর থাকে না। সাধারণত ক্রিয়াপদের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাভাষাকে আমরা সাধু ও চলিতরূপেই চিহ্নিত করি।

আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাভাষা মূলত তিনপ্রকার, যথা:
১. সাধুভাষা:
আমি তোমাদের বাংলাশিক্ষাদান করিব। এটি সাধুভাষার একটি উদাহরণ। ‘শিক্ষাদান’ আর ‘করিব’ হচ্ছে সাধুশব্দ। ‘করিব’ ক্রিয়াকে চলিতরূপে ‘করবো’ করা গেলেও শিক্ষাদানকে কি সম্পূর্ণ চলিতকরণ করা সম্ভব? ‘শিক্ষাদান করিব’কে বড়জোড়া ‘শিক্ষা দেবো’ করাই যায়। তাই সাধুশব্দ বলে পরিচিত ‘শিক্ষা’শব্দকে চলিতশব্দে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়। সাধুভাষা হচ্ছে বাংলার মাথা। তাই বাংলাভাষায় সাধুশব্দের সংখ্যাধিক্যই বেশি। সাধুশব্দ ব্যতীত আমরা অস্তিত্বহীন। অথচ অনেকেই পদ্যে সাধুভাষাকে ব্যবহার করতে চায় না। কিন্তু তাকি সম্ভব? সাধুভাষামুক্ত পদ্যরচনা আদৌ সম্ভব নয়। তারা যে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলে, তাই বলবো আজ।

সাধুভাষার হাজারো শব্দ যেমন গদ্যে ব্যবহৃত হয় তেমনই পদ্যেও। গদ্য-পদ্যে আবার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও আমরা করি। তবে পদ্যে এখন সাধুশব্দের ক্রিয়ারূপ একেবারেই অচল ও পরিত্যাজ্য। অনেকে অতীতের রবীন্দ্র, নজরুলসহ বিখ্যাত কবিদের কাব্যে সাধু-চলিতের মিশ্রণ বা সাধুশব্দের প্রয়োগ দেখে আধুনিক পদ্যেও অবলীলায় তা ব্যবহার করতে চান। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ বাংলার দিকপাল কবিরা তা না করলেও তারা তা ভ্রূক্ষেপ করেন না। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, কে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন? কিন্তু এই বোকারা ভাষা বা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসসম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। ভাষা ও সাহিত্যও যে, আমাদের জীবনযাত্রার মতো আধুনিকায়নের পরশে নিয়ত পরিবর্তিত হয় এবং তা আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই, তা তারা সবক্ষেত্রে মানলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রেই শুধু বেঁকে বসেন! ভাষা ও পদ্যের ব্যাকরণগত শৃঙ্খল থাকলেও তাদের স্বাভাবিক বিবর্তন আইন করে যেমন ঠেকানো যায় না তেমনই তা না মানলেও আধুনিক হওয়া যায় না। ভাষা প্রবহমান নদীর স্রোতের মতোই নিয়ত পরিবর্তনশীল।

এর মানে এ নয় যে, আধুনিক পদ্যে বা গদ্যে মোরা, মোদের, হেরিনু, পশিল ইত্যাদি অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করা যাবে, যা আমরা ব্যবহারিক জীবনে ব্যবহারই করিনে! আপনি নিরেট সাধুভাষায়, গল্প, প্রবন্ধ, রম্যাদি লিখতেই পারেন, নাটক, গল্প, উপন্যাসের সংলাপছাড়া গানেও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করতেই পারেন, আপত্তি নেই। কিন্তু চলিতভাষার পদ্যে সাধু-চলিতের মিশ্রণ বা সাধুভাষা যেমন করিয়া, গড়িব, খাইয়াজাতীয় শব্দের প্রয়োগ আধুনিক যুগে হাস্যকর। বড়বড় আধুনিক কবিরাও তা করেন না, যুগের প্রয়োজনে। এক্ষেত্রে অতীত কবিদের উদাহরণ টানা বোকামো। নতুবা কালিদাস, বাল্মীকির ভাষায় লেখার যুক্তিও সামনে এসে দাঁড়াবেই!

২. চলিতভাষা:
আমি তোমাকে বাংলাশেখাবো। এই হচ্ছে ওপরের সাধুবাক্যটির একটি চলিতরূপ। তাই বলে সাধুভাষার ক্রিয়াপদ ‘শিক্ষা’ শব্দটা কি চলিতভাষায় বা পদ্যে ব্যবহার আমরা করি না নাকি করা যাবে না? এমন হাজারো সাধুভাষার শব্দ আছে, যার চলিতরূপ নেই। এসব শব্দ সাধু-চলিত উভয়রূপেই চালু আছে, যেমন-গমন, প্রস্থান, আগমন, যাতায়াত, অংশগ্রহণ ইত্যাদি। চলিতভাষার আবিষ্কার হয়েছে সাধুভাষার মতো ওজনদার, গাম্ভীর্যপূর্ণ দীর্ঘ-উচ্চারণকে সংক্ষিপ্ত করতেই, কথ্য ও লেখ্যরূপকে চটুল করতেই। তাই এখন আমরা গদ্য-পদ্য উভয়ক্ষেত্রেই চলিতভাষাকেই অগ্রাধিকার দেই। পদ্যলিখতেও এখন কেউই সাধুভাষার ক্রিয়াপদকে আর ব্যবহার করে না। এমনকি সাধু-চলিতের মিশ্রণকেও গুরুচণ্ডালীরূপেই দেখা হয়। পশ্চাৎপদ মনমানসিকতার লক্ষণ মনে করা হয়।

৩. আঞ্চলিক ভাষা:
বাংলাদেশের প্রায় জেলাতেই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব ভাষায় এমনকিছু ক্রিয়াপদ ও শব্দ আছে যা সাধু-চলিত উভয়ভাষাতেই চলে। এসব বহুলপ্রচলিত আঞ্চলিক শব্দও তাই পদ্যে ব্যবহার করতে বাধা নেই। যেমন, তোমার ‘বেবাক’ কথা শুনলাম, আর ‘তর’ সয় না, তোমার মতো মানুষ আজ’তক’ খুঁজে পেলাম না, রংপুরে ‘মঙ্গা’ দেখা দিয়েছে, ‘জাউ’ খেতে মন্দলাগে না ইত্যাদি। অনেকেই বলেন, পদ্যে আঞ্চলিক ভাষার শব্দ আনা যাবে না। তা কি ঠিক? আমরা চলিতভাাষায় কয়জনেই বা কথাবলি? ৯০ জনই আঞ্চলিকে আক্রান্ত আমরা, যা আমাদের মজ্জাগত। তাই সেই ভাষাই হচ্ছে আমাদের মূলমাতৃভাষা, এরপরই চলিত বা সাধুভাষার স্থান।রম্যজাতীয় পদ্য সাধু-চলিত বা আঞ্চলিক ভাষায় লিখতেই পারি আমরা। অধিকাংশ বাংলাভাষীর কাছে পরিচিত যেকোনো আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার পদ্যে বা গদ্যে করাই যায়। এটাই প্রমাণ করবে ভাষার প্রবহমানতা বা গতিশীলতা।

শব্দ মানেই ফুল, পদ্য মানেই শব্দফুলের মালাঃ
ভাষার শব্দভাণ্ডার যার যত সমৃদ্ধ তিনি ততই সমৃদ্ধলেখা লিখতে সক্ষম বিশেষত পদ্য। কারণ পদ্যে শব্দচয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক শব্দচয়নই পদ্যকে শ্রুতিমধুর ও সাবলীল করতে সক্ষম। শব্দকে আমরা ফুলের সাথেই তুলনা করতে পারি। বিভিন্ন রঙ ও গন্ধের ফুল যেমন আমাদের মনভরিয়ে দেয় তেমনই সেই ফুল চিরস্থায়ী হয় না। আমরা পছন্দের ফুল দিয়ে পছন্দের মালাগাথি। সবফুল যেমন সবার পছন্দ নয়, সবফুল দিয়ে যেমন মালাগাথা যায় না, মালাগাথি না আমরা, তেমনই মালার ফুল একসময় শুকিয়ে যায়। তখন আমরা আবার নতুনফুল খুঁজি এবং নতুন নতুনফুল দিয়ে সুন্দর সুন্দর মালাগাথি।

আমাদের শব্দভাণ্ডার বা অভিধানে তো হাজারো শব্দ থাকে। আমরা কি সবশব্দ জানি বা সবশব্দের ব্যবহার করি পদ্যে নাকি ব্যবহার করা সম্ভব? আমরা ফুলের মালাগাথার মতন পছন্দের শব্দই খুঁজে নিই এবং শব্দের মালাগেথে পদ্যরচনা করি। অভিধানের অনেক শব্দই দুর্বোধ্য, অপ্রচলিত; তাই বলে তারা তো বাতিলশব্দ নয়! তেমনই অতীতের অনেক শব্দ এখন অপ্রচলিত বা পরিত্যাজ্য। এই আমি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত যেসব শব্দ পদ্যে ব্যবহার করেছি, তার অনেকগুলোই এখন পরিবর্তিত রূপেই চালু হয়েছে। যেমন-পাখী, গাড়ী, বাড়ী, শাড়ী, মত, কোন, গরীব, সরকারী ইত্যাদি শব্দ দিয়ে আমার শতশত পদ্য ছাপা হয়েছে, যা এখন অচল। তাই আমাকেও বাংলা একাডেমির এসবের নতুনশব্দরূপকে মেনে নিয়েই নতুন করেই লিখতে হচ্ছে। এটাই ভাষার আধুনিকতা, প্রবহমানতা। এটা মানতেই হবে, যুগের স্রোতে তালমিলিয়ে চলতেই হবে আধু্নিক লেখকদের।তাই শব্দের রূপ যেমন পালটায় তেমনই ভাষায় নতুন নতুনশব্দের উদ্ভব হয়। আঞ্চলিক শব্দ বা বিদেশাগত শব্দ আমাদের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে থাকে। তাই বলে আমি বাংরেজি বা বাংলিশ কিংবা বিকল্পশব্দ থাকতেও কথায় কথায় ইংরেজিশব্দ মিশিয়ে কথাবলার ঘোরবিরোধী।

নৈঃশব্দের অতলান্ত-সুখ

নৈঃশব্দের অতলান্ত-সুখে আমি সাঁতরাতে চাই
সুখ-সাঁতারকাটে যেমন পাখপাখালি-সবুজ
ওরাওতো মানুষের মতো বাঁচে-মরে, খেটে খায়
বড় হয় ক্রমশ বাড়ায় বংশক্রম;
তার কতটুকুই বা দেখে আমাদের চর্মচোখ?
ওদের নিয়ত ভাঙ্গাগড়ার নন্দিত সংগ্রাম
কখনো কি ঘটায় আমাদের সুখের ব্যাঘাত!

অথচ এখানে হার্টবিটবাড়ায় শব্দদূষণ
সকাল-সন্ধ্যা, নিশুতিরাত অহরহ প্রতিদিন–
আমরা সয়ে যাচ্ছি ক্ষয়ে যাচ্ছি হয়ে যাচ্ছি
রোগাটে আর পাণ্ডুর, এই ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর
এক অতিদুর্বল নিন্দিত জীব?

কোথায় পাবো ফুলেল শান্তি, নৈঃশব্দ-সুখ
আমরাও হতে পারি নাকি মাছ-গাছ-পাখি, নদীর মতন।

কবিতার নামে পদ্য বা গদ্যলেখা:

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন, শব্দে শব্দে বিয়ে দিলেই কবিতা হয় না। একেবারেই খাঁটি ও সত্যকথা। তেমনই ছন্দ ও উপমা নাথাকলেও কবিতা হয় না।

কবিতার ছন্দ:
কবিতাসহ সবধরণের পদ্যেরই প্রাণ হচ্ছে, মনমাতানো ছন্দের দ্যোতনা। ছন্দহীন কবিতা গন্ধহীন ফুলের মতন। সুন্দরশব্দ ও উপমাবিহীন কবিতা প্রাণহীন শুকনো পুষ্পমাল্যবিশেষ। তবে পদ্যের ছন্দের সাথে ছন্দের ব্যাকরণ ব্যতীত বাংলাব্যাকরণের কোনোই সম্পর্ক নেই।

কবিতার উপমা-চিত্রকল্প:
একটা সফলকবিতার মূল-উপাদান হচ্ছে, ছন্দের পাশাপাশি নিখুঁতভাষা ও শব্দালঙ্কার। আর কবিতার কাব্যালঙ্কার হচ্ছে, সুন্দরসুন্দর শব্দযোগে নান্দনিক ও বাস্তব উপমা ও চিত্রকল্প।
সুন্দরসুন্দর পছন্দের ফুল দিয়ে যেমন আমরা মনের মতো মালাগাথি তেমনই উপমিত শব্দ ও চিত্রকল্পের মালা হচ্ছে একটি কবিতা। বৃষ্টির রিমঝিমসুর, নাচের মনকাড়া ছন্দ আর পাখির কলতান যেমন আমাদের মনে ছন্দের বাজনাবাজায়, তেমনই কবিতাও যদি মনে দোলা নাদেয়, তা কবিতাই নয়। জোর করে শব্দের পাশে শব্দবসিয়ে বা শব্দে শব্দে বিয়ে দিলেই তাই কবিতা হয় না। পত্রিকার কলামের মতন বা কবিতার পঙক্তির মতন সাজালেই কবিতা হয় না যেমন একটা অচলঘড়িকে দেয়ালে টাঙ্গালেই তাকে ঘড়ি মনে হলেও ঘড়িবলা যায় না।

কাব্যালঙ্কার:
কবিতার শরীর, ভাষা, শব্দ ইত্যাদি হচ্ছে রান্নার কাঁচা-তরকারীবিশেষ এবং ছন্দ-মাত্রা, পর্ব, তাল, লয় হচ্ছে কবিতা, পদ্য বা ছড়ার মুখরোচক মসলাপাতি। কাঁচা-তরকারীতে এসসব মসলার সুষমমিশ্রণ ঘটলেই একটা কবিতা বা পদ্য হয়ে ওঠে দুর্দান্ত-সাবলীল।

আবার কাঁচাতরকারীরূপী একটা কবিতা হচ্ছে, উলঙ্গ-নবজাতকের মতন। সুন্দর পোশাকপরালেই যেমন শিশুটি আরো সুন্দর হয় তেমনই একটা পরিণত কবিতাকেও উপযুক্ত অলঙ্কার নাপরালে কবিতা যৌবনবতী হয় না। একটা নারীর স্বাভাবিক রূপ-সৌন্দর্য যা-ই থাক, তাকে উপযুক্ত ও সুন্দর পোশাক আর অলঙ্কারে সাজালে যেমন মনকাড়ালাগে, তেমনই কবিতার শরীরে যদি বাস্তবিক উপমা, চিত্রকল্প, উৎপ্রেক্ষার সংমিশ্রণ ঘটে, তবেই তা হয়ে ওঠে সার্থক ও সুন্দর কবিতা।

কবিতায় দুর্বোধ্যতা ও ব্যাখ্যাহীনতা:
কবিতার বাহন হচ্ছে ভাষা। কবিতা এমনিতেই উপমা আর চিত্রকল্পের দোলাচালে কিছুটা দুর্বোধ্য ও ব্যাখ্যাতীত বটে। কিন্তু অপভাষা ও অপবাক্যগঠন যেন তাকে অবোধ্য-ফালতু করে নাতোলে! দেখতে যাই হোক, কবিতাপড়তে যদি গদ্যের মতো মনে হয়, হৃদয়-মন না নাচায়, মনে অবর্ণনীয় ভাল্লাগা নাজাগায়, তবে তা স্রেফ গদ্যই। কবিতাপড়তে গেলে যদি কবি মীর মোশাররফ হোসেনের “বিষাদসিন্ধু”র মতন হৃদয়াবেগ ও ছন্দের ঢেউ মনে নাওঠে তবে তা কবিতাপদবাচ্য নয়।

কবি বনাম শিল্পী:
একজন শিল্পী মনের তুলিতে মাধুরী মিশিয়ে এবং কালির আঁচড়ে যেমন অপরূপ বা মনলোভা কিছুসৃষ্টি করে, তখন আমরা শিল্পীর চেয়ে তার শিল্পকে নিয়েই বেশি মাতি। শিল্পী হতে পারে প্রতিবন্ধী বা দেখতে চরম অসুন্দর। কিন্তু এতে ভক্ত-অনুরক্তের কিচ্ছু যায়-আসে না। একটা মাকড়সা, মৌমাছি বা বাবুইপাখির রূপ আমরা খুঁজি না। আমরা মোহিত হই মাকড়সার নিপুণ জালের বুননরূপী কাব্যিক বাসা, মৌমাছির অনিন্দ্য মৌচাক আর বাবুইয়ের চমৎকার ঝুলন্ত বাসা দেখেই। এটাই শিল্পীর সার্থকতা, তার শিল্পের সফলতা।

একজন কবিও নিপুণ একশিল্পী। সে ভাষার তুলিতে আঁকে শব্দের নন্দিত শব্দমালা বা কথাসাহিত্য বা কবিতা। অনেকেই কবিতালেখে। সবার কবিতা সার্থক হয় না, কালজয়ী হয় না। জীবনান্দ দাসের ভাষায় তাই “সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।” আমিও বলি, সবাই কবিতালিখলেও কেউ কেউ শিল্পী আর বাকিরা অকবি বা অশিল্পী।

পদ্য:
ছড়া, কবিতা, গানসহ কাব্যোচিত সবই হচ্ছে পদ্য। পদ্যে দুর্বোধ্যতা যেমন নেই তেমনই উপমা, চিত্রকল্প ইত্যাদির বালাই নেই। পদ্য হচ্ছে সোজাসুজি ছন্দ, মাত্রা, অন্ত্যমিল ইত্যাদি বা ছন্দের ব্যাকরণের কড়াশাসনে গঠিত সাদামাটা
বর্ণনাধর্মী লেখা। এতে ব্যাখ্যার মতন কিছু নেই। ছড়া-কবিতার মতন নাটকীয়তাও নেই। কবি যা লিখে বোঝায় পাঠকও ঠিক তাই বোঝে, অন্যকিছু নয়।

অথচ অধিকাংশ কবি আজ কবিতার নামে পদ্যচালায়। পদ্যকার হয়ে নিজেকে কবিও বলে। তারা পদ্য ও কবিতার সংজ্ঞাজানে না, এটা নিশ্চিত। আবার মজার ব্যাপার হচ্ছে, কবিতাসম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ কিছুবিচারক পদ্যকেই সেরাকবিতার উপাধি দিয়ে হাসির কাণ্ডঘটায়। তাদের চরম বানানভুলের কথা নাইবা বললাম। তাই আমাদের বইপ্রকাশের ধান্ধার চাইতে বইপড়ার ধান্ধাবাজিই বাড়াতে হবে। কবিতাসম্পর্কে জানতে হবে।

৬ পঙক্তির “শামেরিক”

ছড়ার একমাত্র ছন্দ স্বরবৃত্তচালের নতুন এক পদ্যরীতি হচ্ছে ‘শামেরিক।’ এর চরিত্রগত কাঠামো হবে স্রেফ ছড়ারই আদলে।

শামেরিক মূলত ব্যঙ্গাত্মক, রসাত্মক, ঘৃণাত্মক, প্রতিবাদী ও অর্থবোধক ছড়া যা কক+খখ+কক চালের। এর ১ম দু’পঙক্তি ও শেষ দু’পঙক্তির মাত্রাসংখ্যা হয় মোট ১৪ বা ১৫টি করে।

কক চালের এই ৪পঙক্তিতে চারমাত্রার তিনটি করে পর্ব এবং ২ বা ৩মাত্রার ১টি করে অতিপর্ব থাকে। আর খখ চালের ৩য় ও ৪র্থ পঙক্তিতে চারমাত্রার দুইটি করে পর্ব থাকে যাদের মোট মাত্রাসংখ্যা হয় ৮টি করে।

১ম, ২য়, ৫ম ও ৬ষ্ঠ পঙক্তির অন্ত্যমিল থাকে হুবহু একই ও নিখুঁত। আবার তুলনামূলকভাবে ও অপেক্ষাকৃত ছোট ৩য় ও ৪র্থ পঙক্তির অন্ত্যমিলও হয় আরো ভিন্ন ও নিখুঁত।

আবার খখ চালের ৩য় ও ৪র্থ পঙক্তির অন্ত্যমিল মুক্তস্বর বা বদ্ধস্বরে হলেও কক চালের অন্ত্যমিল হবে সবসময়ই মুক্তস্বরে।

আয়ারল্যান্ডের লিমেরিকো শহরের নামের সাথে মিল রেখে লিমেরিক এর নামকরণ করা হয়। কিন্তু লিমেরিকের সাথে সঙ্গতি রেখে এটির নামকরণ “শামেরিক” করা হলেও লিমেরিক থেকে এটি অনেকটাই ভিন্ন। কারণ লিমেরিকে অন্ত্যমিল, স্বর, মাত্রা, পর্ব, অতিপর্ব ইত্যাদি কাঠামোগত সুনির্দিষ্ট হিসেবের বালাই যেমন নেই তেমনই তাতে ব্যাঙ্গাত্মক চরিত্র থাকলেও প্রতিবাদী ও ঘৃণাত্মক চরিত্র থাকে না মোটেই। এর নামটি অবশ্য আমারই দেয়া।

ছড়াকাররা ভাল্লাগলে আপনারাও শামেরিক লেখা শুরু করে দিতে পারেন ।

এবার দেখুন আমার ২টি শামেরিক:

১. #নেতা
শাহ আলম বাদশা

কেমন নেতা, বিপদ এলে কর্মীরা যায় পালিয়ে
আবার আসে তোমায় যখন দুশমনে যায় জ্বালিয়ে
হাত-উঁচিয়ে ঢোলটা বাজায়
জাতে ওঠার খোলটা বাজায়
তোমায় কেমন যায় ভুলিয়ে শ্লোগান ও তালিয়ে!
দুধের মাছি, এদের আগে নাও ওরে নাও ঝালিয়ে।।

২. #চিল ও কান
শাহ আলম বাদশা

লোকটা এসে খবর দিলো কান নিয়েছে চিলে
তাই না শুনে আমারতো ভাই চমকে ওঠে পিলে।
কানহারালে শুনবো কীসে
পাই না ভেবে হারাই দিশে
চিলটা কোথায়? চলেই গেছে অইদূরে চাটখিলে।
কানহারিয়ে কাঁদতে থাকি চোটটা যে পাই দিলে!!

সিঁড়ি

ফ্লাগহাঁকিয়ে যাও তাকিয়ে
আমরা কেমন বলদ রে
ভোট দেয়াটাই গলদ রে!
ভোটটা নিয়ে রোডটা দিয়ে
যাও দেখিয়ে দাপটটা
পাবে কি আর সাপোর্টটা?

রোড কি আবার তোমার বাবার
দাও করে দাও বন্ধ রে
এইটা কেমন ছন্দ রে!
তোমার যাওয়া আমার পাওয়া
এমন নাজেহাল যে
খুব পোড়াকপাল যে।

মন্ত্রী তুমি যন্ত্রী তুমি
কী দারুণ সেবক রে
বকধার্মিক হে বক রে।
তুমিই দামি আর যে আমি
হাদারাম ভোটার তো
‘সিঁড়ি’ উচ্চে ওঠার তো?

আমার কবিতারা

নীলাকাশে যখন হেসে হেসে ছন্দতুলে নেচে যায়
নানারঙের শাড়িপরা উর্বশী পেজাপেজা মেঘ;
তখন আমার কবিতারা বারবার উঁকিঝুঁকি দেয়
উড়ে যেতে চায় ঐ সুন্দরী-নর্তকীমেঘের ভেলায়
মনটাও মোচড় দিয়ে ওঠে কী প্রচণ্ড প্রসব-ব্যথায়।

পাখপাখালি জারিগেয়ে সারিসারি উড়ে যায়
ধীরে ধীরে মিলিয়ে তারা দূরনীলিমায় বহুদূরে যায়
সাথে সাথে সুরমিলিয়ে আমার পাগল-কবিতারাও
ছুটে যেতে চায়, ছন্দসুরে আহা কীযে নাচে গায়।

সবুজগাছেরা ব্যস্ত-বাতাসের গায়ে দিয়ে হেলান
ছড়ায় ঘুমজাগ্রত নারীর মতো এলায়িত চুল
আমার কবিতারাও তখন পরে নেয় নাচের নুপুর
ময়ূরীনৃত্যে উহু কী দুন্দুভি নাচই না নেচে যায়!

তুলে নানাসুর গাভিনমেঘের দুধেল ওলানবেয়ে
রিমঝিম-বিষ্টিরা যখন টিনের চালে গাছের পাতায়
নেচে চলে তালে তালে জলতরঙ্গে ঝুমুরঝুমুর—
আমার কবিতারাও নেচে হয় মদমত্ত-মাতাল।

আমি তাদের শেকলবদ্ধ রাখতে পারিনে আর
হঠাৎ তারাও গাছগাছালি পাখপাখালি হয়ে যায়;
তুলে ঝিরঝির টাপুরটুপুর টুপটাপ একটানা তান
ওদের সাথেই মিশে হয়ে যায় কীযে একাকার।