গাই-বাছুর

মায়ের ডাক শুনেই রনি তিড়িং বিড়িং করে তিন লাফ দিয়ে ছুটে আসে। মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। আদর খায়।

রনির প্রতিদিন বিকেলটা খুব ভাল কাটে। পাড়ার খেলার মাঠে ছুটোছুটি করে। ইচ্ছেমত খেলেধুলে বেড়ায়। যখন ইচ্ছে করে মায়ের কাছে ছুটে আসতে পারে।

ওরা গেরস্থবাড়ির গাই-বাছুর। গিন্নিমা আদর করে বাছুরটিকে রনি বলে ডাকেন। ভালবেসে গলায় ঘুঙুর পরিয়ে দিয়েছেন তার।

কত্তাবাবা রোজ বিকেলে এই মাঠে রনির মাকে বেঁধে রেখে যান। বাছুরটি মানে রনিও মায়ের সাথে মাঠে আসে। স্বাধীনভাবে ঘোরে। গলায় তখন তার কোনো দড়ির বাঁধন থাকেনা।

রনির হঠাৎ খিদে পেয়ে যায়। মায়ের পেটের নিচে মুখ চালিয়ে সজোরে গুতো মারে পালানে। বাট ধরে আর আনন্দে লেজ নাড়তে থাকে। মা তার সন্তানের সারা শরীর চেটেচেটে আদরে সোহাগে ভরে দেয়।

-মা, এভাবে যদি সারাক্ষণ তোমাকে পেতাম-
-তাহলে?
– তাহলে আমার আর কোনো কষ্ট থাকতো না। কিন্তু মা বাড়ি গেলেই তো কত্তাবাবা তোমাকে আর আমাকে আলাদা করে দেবে। সারারাত তোমাকে ছেড়ে একাএকা থাকতে আমার খুব কষ্ট হয়।
-আমারও কি ভাল লাগে তোকে ছেড়ে থাকতে?
-ওরা খুব খারাপ। আমার খাবার ওরা জোর করে কেড়ে নিয়ে যায়।
মা নিরুত্তর থাকে।
একটু পরে রনি বলে- আমার খুব খিদে পায়। সারারাত একটুও দুধ খেতে পাইনে তো। পেট একেবারে পিঠের সাথে লেগে যায়। তারপর সকালে যখন আমাকে ছেড়ে দেয় তখন একদৌড়ে চলে আসি তোমার কাছে। বাটে মুখ দিই। তুমি দুধের ধারা যেই দিতে শুরু কর, অমনি ওরা আমাকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায়। আর সবটুকু দুধ নিয়ে যায়। তখন যে আমার কি কষ্ট হয়। খুব রাগ হয় ওদের উপর।
– কি করবে বাছা। ওরা আমাদের যত্ন করে। ভাল ভাল খাবার খেতে দেয়। বিনিময়ে ওই দুধটাই তো ওরা চায়।
– আমার জন্য একটুও দুধ রাখে না বাটে। ওরা ভারি লোভি। স্বার্থপর আর নিষ্ঠুর।
– দুঃখ কোরো না, একটু বড় হলেই তুমি খড় বিচুলি ঘাস খেতে শিখবে। তখন আর খিদের কষ্ট পেতে হবে না।

রনি আর কোনো কথা বলে না। বুঝতে পারে এমন জীবনটাকে মেনে নিয়েই চলতে হবে। মনমরা হয়ে মায়ের পাশে চুপচাপ শুয়ে থাকে।

বেলা পড়ে আসে। কত্তাবাবা এসে ওদের বাড়ি নিয়ে যায়। গোয়ালে মাকে বেঁধে রাখে। তারপর রনির দিকে হাত বাড়ায় । আদর করে। রনির অসহ্য লাগে এই ভালবাসা। দুঃখ ক্ষোভে তার ছোট্ট বুকটা যেন দুমড়ে মুষড়ে যেতে থাকে। ও জানে প্রতিদিনের মত ভালবাসার ছল করে গলায় পরিয়ে দেবে একগাছা লোভের দড়ি। তারপর টেনে হেঁচড়ে আলাদা করে দেবে মায়ের কাছ থেকে।

আজও তার ব্যতিক্রম হল না গলায় দড়ি দিয়ে অন্যঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রনিকে।
মা একবার হাম্বা করে ডাক দেয়।

নিরুপায় রনি ছলছল চোখে মায়ের দিকে তাকায়।

শংকর দেবনাথ সম্পর্কে

শংকর দেবনাথ জন্মঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭৪ প্রকাশিত গ্রন্থ - কবিতার বইঃ ১) আত্মহনন অথবা মৈথুন ২) শিয়রে নীলাভ জ্বর ৩) পরকীয়া ঘুম ছড়ার বইঃ ১) দুধমাখা ভাত ২) টক ঝাল তেতো কড়া ৩) ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ৪) লাগ ভেল্কি লাগ ৫) রসে কষে ভরা প্রবাদের ছড়া গল্পগ্রন্থঃ ১) দুই শালিকের গল্প ২) গাছের জন্মদিন পিডিএফ ছড়ার বই: ১. ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ২. সুজন পাখির কূজন ৩. অথৈ প্রাণের ধারা ৪. ছন্দ মাতে বন্দনাতে ৫. কিম্ভুতকিমাকার ৬. অপ্রচলিত ছড়া ৭. আমার সুকুমার ৮. প্রাণের ঠাকুর ৯. গাছপাগলের পদ্য ১০. ছড়ায় পড়া ১১. শব্দ নিয়ে মজা ১২. ভূত আছে ভূত নেই ১৩) ঠাকুরদাদার বউ ১৪) তাই রে না না ১৫) খুশি মনে পুষি ছড়া ১৬) স্বরবর্ণের ঘর সম্পাদিত পত্রিকাঃ ছোটদের ভোরের পাখি ভেল্কি ছড়াপত্র ঠোঁটকাটা মাসিক ছড়াপত্রিকা পুরষ্কার ও সম্মাননাঃ ১। নিখিলবঙ্গ শিশুসাহিত্য সংসদ প্রদত্ত " কবি কৃত্তিবাস সম্মাননা" -২০১৮ ২। দীনবন্ধু রাখালদাস বিভূতি বিনয় একাডেমি প্রদত্ত " কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার সাহিত্য সম্মান -২০১৯

8 thoughts on “গাই-বাছুর

  1. মায়া ভরা অণুগল্প। ভীষণ ভাবে হৃদয় নাড়া দিয়ে যায়। শুভ সকাল মি. শংকর দেবনাথ। ধন্যবাদ আপনাকে।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।