নারী এবং বাস্তবতাঃ
নারী ও পুরুষ মানব জাতির দুটি রূপ। সৃষ্টিকর্তা এ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর মানুষ, গাছপালা, পশু পাখি, ধূলিকণা, সাগর নদী, পাহাড় পর্বত সব। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। পৃথিবীর চালিকাশক্তির প্রধান ভূমিকায় রেখেছেন মানুষকে মহিয়ান সৃষ্টিকর্তা। মানুষ পৃথিবীতে এসেছে নর এবং নারী হয়ে। ‘আদম’ এবং ‘ঈভ’ মানবজাতির আদি পিতা ও মাতা। সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবী চলছে নর তথা পুরুষ ও নারীর যৌথ প্রচেষ্টায়। একা নারী কিংবা একা পুরুষ বড় কিছু করতে পারেনি কখনো। আর তাই আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ‘নারী’ কবিতায় বলেছেনঃ
“কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী।”
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
সৃষ্টিকর্তা নারী ও পুরুষকে সমান মর্যাদা সম্পন্ন করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো- সমাজে নারী অনেকক্ষেত্রেই বৈষম্যের নির্মম শিকার। নির্যাতন আর অত্যাচারে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে অনেক নারীর জীবন। এটা হয়ে আসছে অনেক আগে থেকেই। কারণ, সৃষ্টির কাঠামোতে পুরুষ আর নারীকে সমান দক্ষতায় আঁকা হলেও পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেয়া হয়নি। এ সমাজে পুরুষরা স্বঘোষিত মানুষ হয়। কিন্তু নারী যেনো সবসময় মানুষ নয়- তার যেনো রয়েছে অন্য এক অস্তিত্ব। শুধু ভোগ করার সময় তাকে আদর করে মানুষ বলে ডাকা হয়। কিন্তু অধিকারের প্রশ্ন আর মর্যাদার প্রশ্নে পুরুষ নারীকে তার সমকক্ষ হিসেবে স্বীকার করতে দ্বিধা করে। অনেকসময় শারীরিক, মানসিক ও বস্তুগত বৈষম্যের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দেয়াল তুলে তাকে বুঝিয়ে দিতেও কুণ্ঠা করে না যে নারী একটি দ্বিতীয় শ্রেণির ভোগ্যপণ্য বা প্রাণীবাচক অস্তিত্ব। তাই, কিছু ব্যতিক্রম সহজভাবে মেনে নিয়েই বলতে হচ্ছে – নারীর সত্যিকার অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আমাদের আরো অনেকপথ হাঁটতে হবে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসঃ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ
বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ৮ মার্চ পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আন্তর্জাতিক নারী দিবস- আজকের পর্যায়ে আসার পেছনে লম্বা ইতিহাস আছে। প্রথমে ৮ই মার্চ ‘বিশ্ব শ্রমজীবি নারী দিবস’ হিসেবে পালিত হতো। দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক উন্নয়নে নারীর অবদানকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্যই ‘শ্রমজীবি নারী দিবস’ হিসেবে দিনটি পালন করা হতো। জাতীয়ভাবে নারী দিবস প্রথম উদযাপিত হয় ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী, যুক্তরাস্ট্রে। পরের বছর কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ‘নারী দিবস’ উদযাপনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ঐ সম্মেলনে জার্মান সমাজবিদ লুইস জিৎস আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের প্রস্তাব করেন, তাঁকে সমর্থন জানান কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন।
পরের বছর ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, জার্মানী, সুইজারল্যান্ডের এক মিলিয়নের অধিক জনগন প্রথমবারের মত আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের পক্ষে মত দেয়। সেটা ছিলো ১৮ই মার্চ। এই দাবী ধীরে ধীরে নারীর সমান অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রূপ লাভ করে। নারীকে ‘নারী’কে নারী হিসেবে নয়, ‘মানুষ’ হিসেবে সম্মান দেয়ার দাবী ছিলো তাদের। আমেরিকায় ২৮শে ফেব্রুয়ারিতেই ‘নারী দিবস’ জাতীয়ভাবে পালিত হতো। কিন্তু রাশিয়ায় ১৯১৩ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন আয়োজনের উদ্যোক্তারা লক্ষ্য করলেন যে, জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে যে দিনটি ২৮শে ফেব্রুয়ারি হিসেবে চিহ্নিত, তা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে ৮ই মার্চ হিসেবে চিহ্নিত আছে। সেই থেকেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের হিসেব অনুযায়ী ৮ই মার্চ বিশ্ব নারীদিবস পালিত হয়ে আসছে। অনেক পরে, ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে সকল সদস্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, ৮ই মার্চ দিবসটিকে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দানের জন্য। স্ব স্ব দেশের ঐতিহাসিক, জাতীয় ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রথার আলোকে নারীর অধিকার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ দিনটিকে পালনের জন্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস জনপ্রিয়তা লাভ করে আজকের পর্যায়ে আসে।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০১৭ প্রতিপাদ্যঃ
‘‘নারী-পুরুষের সমতায় উন্নয়নের যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা’’
The theme for International Women’s Day 2017 is
“‘Women in the Changing World of Work: Planet 50-50 by 2030’, asking for #BeBoldForChange”.

নারী প্রগতিঃ পরিসংখ্যান যা বলেঃ
সমাজ যখন নারী প্রগতি, নারী আন্দোলন আর নারী নির্যাতন বন্ধের শ্লোগানে তুঙ্গে, তখনও সর্বস্তরের নারীদের নিয়ে বিচার করলে তারা কোন পর্যায়ে অবস্থান করছে- তা চিন্তার বিষয়। “অমুকের ঘর ভেঙ্গে গেছে, অমুক মায়ের মর্যাদা পেতে চায়, কিশোরী ধর্ষিতা, কাজের মেয়ে নির্যাতন ইত্যাদি খবরের হেডলাইন প্রতিদিনের সংবাদপত্রে একজন হৃদয়বান ব্যক্তি দেখতে না চাইলেও নিউজগুলো ঠিক আসে। নারীর অগ্রগতি হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। কিন্তু নির্যাতন কি কমেছে? না। নির্যাতনের টেকনিক পাল্টেছে আর বেড়েছে নির্মমতা ।
মহিলা পরিষদের প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে- গতবছর (২০১৫) জানুয়ারি মাসে দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৮৪ জন নারী। এঁদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হন ৫৫ জন আর গণ- ধর্ষিত হন ৯ জন । ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা ৭ টি। শ্লীলতাহানি হয়েছে চার নারীর।– এ পরিসংখ্যান পত্রিকা প্রকাশিত তথ্য থেকে নিয়েছে মহিলা পরিষদ। প্রকৃত ঘটনা নিশ্চয়ই অনেক বেশি। নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনাই পরিবার পর্যায়েই চাপা পড়ে থাকে।
এছাড়া, দৈনিক সমকাল-এ গত ১ জানুয়ারি ২০১৫ প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, “২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চার হাজার ৬৫৪ নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৩৯টি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯৯ জনকে। মহিলা পরিষদের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি উল্লেখ করে এ খবর দেয়া হয়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন দাবি করেছে গত এক বছরে ১৫৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩১ নারীকে।
মহিলা পরিষদ জানায়, গত বছরে এসিডদগ্ধে মৃত্যু ৪, অপহরণ ১১৮, নারী ও শিশু পাচার ৩০, নারী ও শিশু হত্যা ৮৯৮, যৌতুকের জন্য নির্যাতন ৪৩১, উত্ত্যক্তের শিকার ৪৬৫, বিভিন্ন নির্যাতনে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৩৪১ ও ৯৩ জন বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন রিপোর্টমতে গত বছর হত্যাকাণ্ডের শিকার ৫ হাজার ৬১ জন। এর মধ্যে যৌন নির্যাতনে হত্যা ২৭, যৌতুকের কারণে হত্যা ৩০, এসিড নিক্ষেপে ১, পারিবারিক সহিংসতায় ৬৮৫, রাজনৈতিক হত্যা ১০১ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক হত্যা ৮৬ জন। এ ছাড়া যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার ১৬ ও ৯টি এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে।”
উল্লেখিত দুটি পরিসংখ্যানে সংখ্যাগত কিছু হেরফের আছে – এ কথা ঠিক। কিন্তু শুধু সংখ্যা গণনায় না গিয়ে সাধারণভাবে এটা অস্বীকার করার জো নেই যে, দেশজুড়ে নারীরা নিগৃহীত হচ্ছে অস্বাভাবিকহারে। যে নারীকে জাতীয় কবি ‘বিজয়ী- লক্ষ্মী’ বলে গেছেন, সে নারী আজ যেনো সমাজে আপদ!
নারী বা পুরুষঃ মানদণ্ড হোক পারস্পারিক সম্মান ও বোধে উজ্জীবিতঃ
কেনো ঘটে এসব? নারীর উপর কেনো চলে এতো অত্যাচার? সমাজের কি কিছুই করার নেই? বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে কি দায় সাড়া যায়? কিংবা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে কতোটা অর্জন হচ্ছে তা ভাবতে হবে
পুরুষের প্রতিপক্ষ হয়ে নয়; মানুষ হিসেবে নারীর আছে পূর্ণ অধিকার সবকিছুতে। নারী ও পুরুষ তাই পরস্পরের সহযোগী হয়ে নিজেদের উন্নয়নের মধ্য দিয়ে মানবতার উন্নয়নেও বৃহৎ পরিসরে ভূমিকা রাখতে পারে।
নারীর প্রতি মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। নারীর প্রতি বিকৃত মানসিকতাকে নৈতিক অবক্ষয়ই বলা যায়। আর এমন নৈতিক অবক্ষয়ের পরিণতি হবে খুব নেতিবাচক। মানবতার উন্নয়ন রবে সুদূর পরাহত।
তাই চাই এ মানসিকতার পরিবর্তন। আর তা লোক দেখানো কিছু আনুষ্ঠানিকতা দিয়ে সম্ভব নয় মোটেও। শুধু আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, র্যা লি আর বক্তৃতা করে খুব যে ফল আসবে তা নয়। সমাজকে, দেশকে যারা কিছু দিতে চান, এ কাজে এগিয়ে আসতে পারেন তাঁরা।
যাদের মধ্যে ইতোমধ্যে বিদ্বেষের বীজটি ঢুকে গেছে, তাদেরকে সুস্থ চিন্তায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। সফল না হলে আইনের হাতে দিতে হবে ছেড়ে। তবে সে আইনকে হতে হবে সত্যিকার অর্থে আইন।
আমাদের ভাবতে হবে আগত দিনের কথা। আমাদের নতুন প্রজন্ম, যারা আমাদের সমাজের ভবিষ্যৎ কর্ণধার, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে তাদের মানসিকতা মানবিক করে গড়ে তোলার সার্বিক প্রয়াস নিতে হবে। তারা যেনো পুরুষ হয়ে নারীকে মানুষ ভাবতে শেখে এবং নারী হয়ে পুরুষকে নিছক প্রতিপক্ষ বা শত্রু না ভাবে। সমচিন্তা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে।
বলিষ্ঠভাবে বলতে হবে- নারীরা এ সমাজের আপদ নয়, যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের পাত্র নয়; নারী হলো পুরুষের বন্ধু, ‘বিজয়ী লক্ষ্মী’। তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। পৃথিবী আমাদের। নারী ও পুরুষের মানবিক বোধকে মূল্য দিয়ে একে সুন্দর করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
–
একবিংশ শতাব্দীতে সমঅধিকারের স্লোগান নয়; বাস্তবতা চাই।
নারী ও পুরুষের মানবিক বোধকে মূল্য দিয়ে একে সুন্দর করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
অশেষ ধন্যবাদ প্রিয় মুরুব্বী।
“কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী।”
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
*
ধন্যবাদ
ধন্যবাদ
বলিষ্ঠভাবে বলতে হবে- নারীরা এ সমাজের আপদ নয়, যথেচ্ছভাবে ব্যবহারের পাত্র নয়; নারী হলো পুরুষের বন্ধু, ‘বিজয়ী লক্ষ্মী’। তাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। পৃথিবী আমাদের। নারী ও পুরুষের মানবিক বোধকে মূল্য দিয়ে একে সুন্দর করার দায়িত্ব আমাদের সবার।
হৃদ্য ধন্যবাদ
“বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
স্যালুট
ধন্যবাদ
নারী পুরুষ নয় সবার পরিচয় হোক মানুষ। ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান লেখার জন্য।
হৃদ্য ধন্যবাদ আপনাকে
বিশেষ দিনে নয় নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই প্রতি দিন …… চিরদিন! বিশ্ব নারী দিবস সফল হোক
সমঅধিকারের স্লোগান নয়; বাস্তবতা চাই।


আমি গর্বিত এই জন্য যে, আমি তিন কন্যার পিতা! এতেই আমার সুখ এতেই আমার শান্তি!
সুন্দর বলেছেন। দুজন প্রেমময়ী কন্যার বাবা হিসেবে আমি বুঝি আপনার অনুভব।
আন্তরিক ধন্যবাদ
ভীষণ ভালো লাগলো লেখাটা ….
অনেক ধন্যবাদ ফেসবুকের প্রিয়বন্ধু।
শুভেচ্ছা নিন।