সমাজমনস্ক সুকুমার রায় – বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় – ৪

সমাজমনস্ক সুকুমার রায় – বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় ৪

“খাঁটি ননসেন্স রাইম”, সুকুমারের কবিতা সম্পর্কে প্রাবন্ধিক চিত্রাঙ্গদা গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য। সত্যিই বাংলা সাহিত্যে খাঁটি ননসেন্সের স্রষ্টা সুকুমার রায়। ১৯২২ সালে মৃত্যুর একবছর আগে তিনি লেখেন কল্পবিজ্ঞানের ধাঁচে “হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি”। কিন্তু এতে উল্লিখিত জীবজন্তুদের কোনো প্রাণীতত্ববিদ সনাক্ত করতে পারবেন না। বাংলা ও ল্যাটিন মিলিয়ে অদ্ভুত সুখকর শিশুপাঠ্য এই কাহিনীর জীবগুলির নাম লেখকের কল্পনাশক্তির ব্যপকতা সম্পর্কে বিস্ময় জাগায়। এখনো বাংলায় তথা ভারতবর্ষে – ‘হ্যাংলাথেরিয়াম’, ‘ল্যাগব্যাগর্নিশ’, ‘বেচারাথেরিয়াম’ বা ‘চিল্লানোসোরস’ এর সমকক্ষ জীব সৃষ্টি হয় নি।

খাঁটি ননসেন্সের আরেকটি উদাহরণ ‘হ য ব র ল’। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবমুখীনতা মিশে একটি চিরায়ত রসের সৃষ্টি হয়েছে এখানে। আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র, নীতি ও বিচারব্যবস্থাকে ততখানি তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ বোধহয় একমাত্র সুকুমারের পক্ষেই করা সম্ভব। লুইস ক্যারলের ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ এর কিছু প্রভাব এতে থাকলেও তা আঙ্গিকগত। কিন্তু বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে তা ষোলো আনাই মৌলিক ও দেশজ। এই অ্যালিসের ছায়ায় আরেক মহারথী অবন ঠাকুর লিখেছিলেন বুড়ো আংলা। কিন্তু সম্পূর্ণ দেশজ উপাদানের সেই চিরন্তনী ভারতীয় সাহিত্যের আরেক মাইলফলক হলেও হযবরল র সঙ্গে তার কোনো তূলনাই হয় না। সমাজ, বাস্তবতা ও শিল্পসুষমা এবং অনাবিল হাস্যরস মিশে সুকুমারের প্রতিটি রচনাই এভাবে বাংলা সাহিত্যকে করে তুলেছে সমৃদ্ধশালী। কবিশেখর কালিদাস রায় বাংলা ১৩৫৯ সনের অগ্রহায়ণ সংখ্যার ‘রংমশাল’ পত্রিকায় লিখেছেন, “সত্যকে ভেতর থেকে টেনে বের করে তার যে রূপ দেখলে হাসি পায়, সেই রূপটা ফুটিয়ে তোলার জন্মগত অধিকার ছিল তাঁর”।

(চলবে)

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

2 thoughts on “সমাজমনস্ক সুকুমার রায় – বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় – ৪

  1. * বরাবরের মত এই পর্বও বেশ তথ্য সমৃদ্ধ…
    দাদা, শুভ কামনা সবসময়।

  2. অসাধারণ ধারাবাহিকতা। অভিনন্দন প্রিয় সৌমিত্র। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।