সমাজমনস্ক সুকুমার রায় – বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় – ৬

সমাজমনস্ক সুকুমার রায় – বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় ৬

সুকুমারের প্রতিটি লেখাই প্রধানত ছোটদের জন্য। তাদের সমাজমনস্ক করার জন্য বাস্তব অবস্থা বোঝাতে তিনি নিরলস প্রয়াস চালিয়েছেন। তিনি বুঝেছিলেন ছোটদের শুধু বাস্তব অবস্থা বোঝালেই চলবে না, তাদের করে তুলতে হবে প্রকৃত শিক্ষিত। সেদিনের ও আগামী শতকের শিক্ষক হয়ে তিনি – ‘জীবনী’, ‘জীবজন্তু’, ‘বিবিধ’ প্রমুখ প্রবন্ধ গ্রন্থে (এগুলি তাঁর মৃত্যুর পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়) লিখেছেন জীবনের নানান কার্যকর দিকের কথা। এইসব বইয়ে আছে নানা রকমারী জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা। খগেন্দ্র নাথ মিত্র তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন, “অন্ধ সংস্কারে পঙ্গু, নানা বিধিনিষেধে জড়, পরাধীনতার নাগপাশে মৃতপ্রায় ও উদ্যমহীন জাতি কে জাগ্রত করবার প্রচেষ্টা তাঁর রচনার মর্মকথা” (‘শতাব্দীর শিশুসাহিত্য’)।

অসংখ্য ছবি এঁকেছেন তিনি সারাজীবনে। তাঁর সুযোগ্য পুত্র সত্যজিৎ রায় এ সম্পর্কে বলেছেন, “উপেন্দ্র কিশোর বা সুকুমার কেউই আঁকা শেখেন নি। … এক হল তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, আরেক হল অফুরন্ত কল্পনা শক্তি। এই দুইয়ের সমন্বয়ে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু টেকনিককে অতিক্রম করে চোখের সামনে জলজ্যান্ত রূপ ধারণ করে”। আসলে তাঁর ছবি ও রচিত সাহিত্য এ দুটি ছিল পরস্পরের পরিপূরক। সমস্ত ক্ষেত্রেই আমরা তা স্পষ্ট বুঝতে পারি।

মুদ্রণ শিল্পে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার, তাঁর প্রতিভার অন্যদিক। তবে ইচ্ছা থাকা সত্বেও জীবিতাবস্থায় এর পেটেন্ট তিনি নিতে পারেন নি। কবি ও সাহিত্যিকদের সংগঠিত করে প্রথমে ‘ননসেন্স’ ও পরে ‘মানডে ক্লাব’ (তাঁর ভাষায় ‘মনডা সম্মিলনী’) প্রতিষ্ঠা, প্রথমে ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ ও পরে দীর্ঘ আট বছর ধরে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করা, ব্রাহ্ম যুবকদের নিয়ে একটি সমিতি গঠন করে সাপ্তাহিক বক্তৃতা ও আলোচনার মাধ্যমে সমাজের চিন্তাধারা ও কর্মপদ্ধতির মধ্যে নবীনতার রক্ত সঞ্চার করা, প্রভৃতি বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন সুকুমারকে প্রতিভাত করে। এর সব কটি ক্ষেত্রেই তিনি সফল।

সুকুমারের মৃত্যুর (১০ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৩) পরে দীর্ঘ পঁচানব্বই বছর কেটে যাওয়ার পরেও এখনো এমন সাহিত্যিক আসেন নি যার হিউমার সুকুমারকে ছাপিয়ে যায়। ‘আবোল তাবোল’ এর শেষ পংক্তি সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় বলেছেন, “জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপস্থিত হয়ে (ছড়াটি সুকুমারের মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে লেখা) এমন রসিকতা আর কোনো রসস্রষ্টার পক্ষে সম্ভব হয়েছে বলে আমার জানা নেই”।

মর্মান্তিক হলেও এ দৃঢ় সত্যি।

(শেষ)

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

3 thoughts on “সমাজমনস্ক সুকুমার রায় – বহুমুখী প্রতিভার সমন্বয় – ৬

  1. সুকুমারের মৃত্যুর পরে দীর্ঘ পঁচানব্বই বছর কেটে যাওয়ার পরেও এখনো এমন সাহিত্যিক আসেন নি যার হিউমার সুকুমারকে ছাপিয়ে যায়। __ অস্বীকারের সুযোগ নেই।

  2. সমাজমনস্ক সুকুমার রায়

    সম্পর্কে অনেক অজানা জানা হল…

    ধন্যবাদ সুপ্রিয়।

  3. সুকুমার রায় সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম।

    শুভেচ্ছা প্রিয় কবিhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।