শিরার ভেতরের মানুষটা

শিরার ভেতরের মানুষটা

ছিলেন স্কটিশের ছাত্র। পরে সর্বভারতীয় সার্ভে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিলেন। সারাটা জীবন একের পর এক বেশ উঁচু পদে চাকরী করেছেন, অথচ সেই সংসার অচেতন মানুষটাকে কোনোদিন অহংকারের জালে আটকাতে দেখিনি।

শহুরে মানুষ হয়েও আপাদমস্তক নিখাদ গ্রাম্য মানুষটা সহজেই নিজের পদের বহু নীচের মজুরদের সঙ্গেও মিশে যেতেন। কোনো নাক উঁচু আত্মীয় কোনো কারনে বিদ্রুপ করলে চুপ করে সরে আসতেন সেখান থেকে। অথচ সেই আত্মীয়রাই বহুভাবে আবারও সাহায্য চাইতে আসতেন, আর পেতেনও দরাজ হাতেই।

মনে পড়ে, মা তখন হাসপাতালে মৃত্যু শয্যায়। সেই সময়ে এক পরম আত্মীয় বিন্দুমাত্র পাশে দাঁড়াতে অস্বীকার করেছিলেন। মা কে যখন হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিল আর কিছু করা যাবে না বলে, তখন দাদার বাড়ীতে মা কে রাখা হলো। সেই সময়ে সেই আত্মীয়ই নিজের ছেলের পড়া সংক্রান্ত ভর্তির ব্যাপারে এসে বাবাকে ধরলেন। মা কে দাদার বাড়ীতে এখন তখন অবস্থায় রেখে বাবা প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরে ছুটলেন সেই আত্মীয়র ছেলের ভর্তির ব্যাপারে। ফিরে এলেন দুদিন পরে, তখন মা আর নেই।

একা থাকলেই নিজের মনে আঁকিবুকি কেটে বিভিন্ন নক্সা তৈরী করতেন বা একমনে ডুবতেন প্রিয় অঙ্ক করায়। অবসাদ বলে ছিলনা কিছু। আশি ছুঁইছুঁই হয়েও সাইকেল চালাতেন অকারণেই। আমার ঠাকুমা অন্নপূর্ণা দেবীর মতই অসাধারণ রূপকথার গল্প বলতেন। ছোট্ট কে গল্প শোনাতে বসে নিজের ডাকনামে ছড়া তৈরী করে বলতেন :
“সিংহের মামা আমি ভোম্বলদাস,
বাঘ মেরেছি গোটা পঞ্চাশ।”

আজকের পণ্য সর্বস্ব পৃথিবীতে অচল সেই শিরার ভেতরের মানুষটা ছিলেন আমার আলাভোলা #বাবা।

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

10 thoughts on “শিরার ভেতরের মানুষটা

  1. আজকের পণ্য সর্বস্ব পৃথিবীতে অচল সেই শিরার ভেতরের মানুষটা ছিলেন আমার আলাভোলা #বাবা। ___ তোমার বাবাই এর প্রতি সহস্র সম্মান প্রিয় কবি সৌমিত্র চক্রবর্তী।

  2. আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন আমার প্রিয়জন

  3. শুভেচ্ছা রাখি কবি সৌমিত্র চক্রবর্তী। 

    1. ধন্যবাদ কবি বোন শাকিলা তুবা। 

  4. শব্দগুলোর অনুভব গ্রহণ করলাম সৌমিত্র দা।

  5. মনে পড়ে, মা তখন হাসপাতালে মৃত্যু শয্যায়।
    ফিরে এলেন দু'দিন পরে, তখন আর মা বেঁচে নেই।

    সবার জীবনে বাস্তব কিছু ঘটনা থাকে। লেখাটা পড়ে মনে হয়েছে, এ আপনারই বাস্তব জীবনের সত্য গল্প।

    আপনার বাবা এবং মা, উনাদের প্রতি অজস্র সম্মান প্রিয় কবি দাদা সৌমিত্র চক্রবর্তী।শুভ কামনা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    1. আপনার কথায় স্মৃতিকাতর হলাম বোন হাসনাহেনা রানু।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।