আয় বসন্ত, বোস বসন্ত, থাক বসন্ত আমার ঘরে

আয় বসন্ত, বোস বসন্ত, থাক বসন্ত আমার ঘরে।

যাই যাই করেও বারবার ফিরে তাকিয়ে, নাকের জলে-চোখের জলে পরিপার্শ্ব ভিজিয়ে, ভয়ানক অনিচ্ছায় শীত কিছুতেই যেতেই চাইছিল না। আর বসন্তও তার লাজুক স্বভাবের পেটেন্ট নেওয়া লালিত্য ছেড়ে ঠেলেঠুলে শীতকে তাড়িয়েও ঢুকে তার নির্ধারিত সময়ে মৌরসীপাট্টা গড়ে তুলতে পারছিল না।

তবুও সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী, যেতে হয় সবাইকেই একদিন। ব্রহ্মাণ্ডের এই সারসত্য মেনে নিয়েই টুক করে মিষ্টি রোদটা লাফিয়ে পড়লো ধানমাঠের ভিজে ভিজে আলে, শহরের রোমান্টিক পাইথন রঙা রাজপথের পিঠে। আর অমনি তাকে খপ করে ধরে ওই উঁচু শপিংমলের আয়না জানলা ঠিকরে ছুঁড়ে ফেললো মাথা নিচু করে হেঁটে যাওয়া সারা বছর কুঁকড়ে মুকড়ে থাকা মানুষগুলোর মাঝে।

কাণ্ড দেখে সদ্য ঘুম ভাঙা পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া ফিকফিক করে মুচকি হেসে বাসন্তিক শো এর জন্যে তৈরী হতে শুরু করলো। উছলে লাফিয়ে উঠলো ছোট্ট ফ্ল্যাটবাড়ির ক্ষুদের দল, মাটির বাড়ির ক্ষুদের দল, সামনের সানাই এর প্রতীক্ষায় থাকা লাল-সবুজ জীবন্ত বসন্তের দল। ওদের যে আপাত পরীক্ষা শেষ।

খুব বড়দের ধারেকাছে সেই রোদ্দুর ঘেঁষে না। ওদের যে ইচ্ছে করলেই, দেখা হলেই ভ্যালেন্টাইনস্ ডে। ওদের যে বসন্তের উচ্ছলতার মাঝেও হিসেব নিকেশ শেষ হয়না। তাই বলে কি রোদ্দুরের মনখারাপ হয়না? হয় বৈকি, তারও মনখারাপ হয়। যে ছেলেটা কোনোদিন নিজের খালি গা ঢাকতে পারেনি একটাও নতুন জামায়, যে মেয়েটা শুধুমাত্র একটু বিশ্বাসের ভুলে বিক্ষত শরীর নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে, যে লোকটার দাদন শোধ হয়নি বলে নবান্ন হয়নি কিম্বা অপ্রতিরোধ্য ক্ষয় নিয়েও যাকে রোজকার বোঝা মাথায় তুলে টালমাটাল পায়ে এগিয়ে যেতে হয়, তাদের জন্যে চিকচিক করে করে তারও চোখের কোল।

তখন আকাশে কালো হয়ে আসে মেঘ। রাগে নিস্ পিস্ করতে করতে একসময় হা হা শব্দে হেসে উঠে পাগলের মত মাথা নাড়তে শুরু করে সে। আর ওমনি শুরু হয় কালবৈশাখী।

ব্যাস! শুধু এই না চাওয়া টুকু বাদ দিলেই স্যাঁতস্যাঁতে ছায়া ছায়া অন্ধকার উধাও। ভালোলাগা জড়িয়ে একে একে আসে রঙবাহার হোলি, উত্তেজনার চড়ক, পয়লা বৈশাখ, রবিপ্রণাম। আর ভালোলাগার মানুষ বা মানুষীর আড়চোখের চাউনি যদি মিশে যায় তারমাঝে! তাহলে পৃথিবী শান্ত হয় নিষ্পাপ অনুরাগে।

©soumitrachakraborty

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

18 thoughts on “আয় বসন্ত, বোস বসন্ত, থাক বসন্ত আমার ঘরে

  1. ভালোলাগার মানুষ বা মানুষীর আড়চোখের চাউনি যদি মিশে যায় তারমাঝে! তাহলে পৃথিবী শান্ত হয় নিষ্পাপ অনুরাগে। আয় বসন্ত, বোস বসন্ত, থাক বসন্ত আমার ঘরে। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif

  2. গদ্যের এমন শব্দ খেলা অসাধারণ লাগে কবি সৌমিত্র চক্রবর্তী।  

  3. সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী, যেতে হয় সবাইকেই একদিন। ভালো থাকুন কবি সৌমিত্র চক্রবর্তী। 

  4. ঋতুর সাথে মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের একটা তুলনা তো আমরা করেই থাকি। বসন্ত বলি আর মানুষের জীবনে যৌবন বলি সবি কেবলই অনুভব। আশি বছরেও কেউ ভর-যুবক থাকতে পারে যদি সে অনুভবে সেটা জাগাতে পারে। কারণ এই আশি বড়জোর একটা সংখ্যা; অন্তর্গত অনুভবই সব। গাছে শিমুল নাই ফুটুক- প্রিয়তমার খোঁপায় লাল বুনোফুল গুঁজে দিয়েই কিন্তু আশি বছরের সেই যুবক বারো মাস বসন্ত অনুভব করতে পারে!

    পারেনা?

    1. আপনার মন্তব্যে বুক ভরে যায় প্রিয় ডেজারট ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  5. শব্দের খেলা উপভোগ করেছি কবি দা। 

    শুভেচ্ছা রইল। 

    1. ধন্যবাদ আনু আনোয়ার ভাই। ভালোবাসা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  6. আয় বসন্ত, বোস বসন্ত, থাক বসন্ত আমার ঘরে…..

    ঋতুচক্রের এই যে চিরান্তন পরিবর্তন।এক ঋতু আসছে আর এক ঋতু যাচ্ছে আমরা চাইলেও কোন ঋতুকে আটকে রাখতে পারব না।এটাই স্বাভাবিক। খুব সুন্দর লিখেছেন কবি দাদা। শুভেচ্ছা…https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    1. ধন্যবাদ কবি বোন হাসনাহেনা রানু। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  7.  যে ছেলেটা কোনোদিন নিজের খালি গা ঢাকতে পারেনি একটাও নতুন জামায়, যে মেয়েটা শুধুমাত্র একটু বিশ্বাসের ভুলে বিক্ষত শরীর নিয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে, যে লোকটার দাদন শোধ হয়নি বলে নবান্ন হয়নি কিম্বা অপ্রতিরোধ্য ক্ষয় নিয়েও যাকে রোজকার বোঝা মাথায় তুলে টালমাটাল পায়ে এগিয়ে যেতে হয়, তাদের জন্যে চিকচিক করে করে তারও চোখের কোল।

    এ এক চিরন্তন বাস্তব মনে হয়,, ,   ।অনেক ভালো একটি লেখা,,,! শুভেচ্ছা জানবেন শ্রদ্ধেয় কবি   

    1. ব্যাখ্যাময় মন্তব্যে খুশি হলাম কবি পথিক সুজন ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  8. এই নশ্বর ভবসংসারে যাকিছু আছে সবই অনিশ্চিত। কেবল জীবের মৃত্যুই নিশ্চিত । আপনার কেখায় তা-ই নিশ্চিত করেছে বলে মনে হয়।

    ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় কবি সৌমিত্র দাদা।

    1. এই নশ্বর ভবসংসারে যাকিছু আছে সবই অনিশ্চিত। ঠিক তাই দাদা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।