ভালো থাকা না থাকা ১২

মনখারাপ। গভীর বিষাদ জড়িয়ে ধরছে রোজ। বিস্তীর্ণ এক বুজে যাওয়া নদীর চর ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পা ডুবে যাচ্ছে। চেষ্টা করছি পা তুলে আনার। পারছি না। একটা পা তুলতে গেলেই অন্য পা আরোও তলিয়ে যাচ্ছে। বুক পর্যন্ত ডুবে গেছি। বুকের পাঁজর ওঠানামা করছে বিগত শতকের অ্যান্টিক হাপরের মত। হাঁপাচ্ছি আর চোখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করছি এমনকি মাথার পেছনেও। আশ্চর্য! এই দিগবিস্তারী চোরাবালির চরে অনেকেই ডুবছে। কারো রং কালো, কারো সাদা, কেউ হলদেটে। মাথা পর্যন্ত, বুক পর্যন্ত, কোমর পর্যন্ত ডুবে আছে। কারো শুধু চুলটুকু দেখা যাচ্ছে। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু আগাছা। কোনোটা ত্রিশূলের মত, কোনোটা চাপাতির মত, কোনো আগাছার আকার খাঁটি কালাশনিকভ রাইফেলের। বালির চরের রং পাল্টে যাচ্ছে। কোথাও গেরুয়া, কোথাও সবুজ, কোথাও ঘন কালো। আকাশটাও কি কালো হয়ে আসছে!

পুরা সচ জানতে আর জানাতে গিয়ে যে মানুষটাকে গিলে খেয়েছিল বুলেট, তিনি বৃথাই বিশ্বাস করতেন খবরের কাগজ গণতন্ত্রের তৃতীয় স্তম্ভ। তিনি জানতেন না খট্টর খট্টাশ রা ঝাঁ চকচকে বিদেশী জাম্বো লাইফস্টাইলের জন্যে সাপের আর ব্যাঙের গালে একই ঠোঁটে চুমু খায়। তিনি জানতেন না ওই গণতন্ত্রের ধ্বজা উড়ানো গোল বাড়ীর প্রধান মুখ সাটাঙ্গে লুটিয়ে পড়ে অর্থলোলুপ যৌনভাতি চর্চকের লোমযুক্ত পায়ে শুধু দু মুঠো ভোটের জন্যে। তিনি জানতেন না। তাঁরাও জানতেন না, যাঁরা সব্জি মান্ডিতে গেছিলেন, যাঁরা স্কুল অফিস আদালত ফেরতা, যাঁরা হাসপাতাল থেকে ফিরছিলেন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, তাঁরা আর বাড়ী ফিরবেন না কোনোদিন।

নাদির শাহ্ অট্টহাসি হাসছে। তাইমুর লঙ হাসছে ঠা ঠা শব্দে। হুন, শক, ইউরোপের বার্বেরিয়ানরা হাসছে বিকট কাচভাঙা আওয়াজে। দাউদাউ জ্বলছে আগুন। ঈশ্বর শব্দ থেকে অক্ষর গুলো ছিটকে সরে যাচ্ছে। আলাদা হচ্ছে ঈশ্বরের যৌথ পরিবার। আগুন … আগুন … চড়চড় করে ফেটে যাচ্ছে তাজমহল, মোনালিসার ছবি, মাইকেলেঞ্জলোর ফ্রেশকো, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, সহস্র এক আরব্য রজনী। পুড়ে যাচ্ছে ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন, দ্য কিড, দ্য গ্রেট ডিক্টেটর, পথের পাঁচালী। হানাদারদের ঘোড়ার খুরে উড়ছে ধুলো। ভয়ঙ্কর শ্বেত সন্ত্রাসের মেঘ ঢেকে ফেলছে অরণ্য খণ্ড। চোরাবালি গিলে ফেলছে স্বপ্ন।

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

12 thoughts on “ভালো থাকা না থাকা ১২

  1. 'পথের পাঁচালী। হানাদারদের ঘোড়ার খুরে উড়ছে ধুলো। ভয়ঙ্কর শ্বেত সন্ত্রাসের মেঘ ঢেকে ফেলছে অরণ্য খণ্ড। চোরাবালি গিলে ফেলছে স্বপ্ন।' অসাধারণ লিখা সৌমিত্র। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. বিস্তর ভালোবাসা প্রিয়ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif সুস্থ্য হয়ে আমাদের মধ্যে আবার ফিরে এসো। অপেক্ষা করবো। কথা রেখো। 

  2. লেখাটি শুধু আপনার ভালো থাকা না থাকা নয় দাদা, যেন আমাদেরও জীবন পঞ্জিকা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

    1. বাহ্ তাই নাকি !! ভালোবাসা কবি বোন সাজিয়া আফরিন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

  3. অসম্ভব উপমাময় একটি ধারাবাহিকের ১২তম পর্ব পড়লাম। অভিনন্দন কবি সৌমিত্র চক্রবর্তী। 

  4.     

    দারুণ লিখেছেন শ্রদ্ধেয় দাদা। 

    বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।        

    1. বিজয় দিবসের ভালোবাসা শুভেচ্ছা কবি নিতাই দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।