আগেই বলেছি ১৯৭১ এর যুদ্ধে ভারত এবং বর্তমান বাংলাদেশ ইউনাইটেড স্টেটস এর রণতরী সপ্তম নৌবহরের আক্রমণ থেকে বেঁচে গেছিল তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরোধের ফলে। আজ যাঁরা আমেরিকার স্বরূপ না জেনে অথবা জেনেও চোখ বুজে আছেন তাঁদের অনেকের এই ঘটনাটি ভালো না লাগলেও এটাই চরম সত্য। আর এই জন্যই তৃতীয় বিশ্বের কাছে সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ত্রাতা। যাইহোক বহু চেষ্টার ফলস্বরূপ ১৯৯১ সালে ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর এরপর তৃতীয় বিশ্ব চলে গেল সম্পূর্ণ এক মেরু বিশিষ্ট শক্তির কব্জায়।
সোভিয়েতের পতনের পিছনে আমেরিকা ও ইউরোপীয় বড় দেশগুলির দীর্ঘ প্রয়াস সফল হয় সোভিয়েতের নিজের ভুলে। ব্রেজনেভ প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন একটি সিদ্ধান্ত নেন যা পোল্যান্ড চুক্তি নামে খ্যাত। চুক্তিটি হলো কোনো দেশের কমিউনিস্ট পার্টি যদি হুমকির সম্মুখীন হয় তাহলে সেখানে সোভিয়েত হস্তক্ষেপ করবে। এই চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট প্রশাসন যখন পাক – ইয়াংকি যৌথ হুমকির মুখোমুখি হয় তখন ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে প্রবেশ করল সোভিয়েত সেনাবাহিনী। কিন্তু আগেই বলেছি গেরিলা যুদ্ধের জন্য আফগান জনগণ বিগত আটশ বছর ধরে প্রসিদ্ধ। সেখানে যুদ্ধ করে তাদের দমন করতে পৃথিবীর কোনো শক্তি কখনো সক্ষম হয় নি। তার ওপরে সেখানে কমিউনিস্ট সরকার উৎখাত করার জন্য মুজাহিদীন বাহিনী নামে এক বিদ্রোহী বাহিনী তৈরী করে তাদের অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ সহ সবরকম সাহায্য দিতে থাকে ইউনাইটেড স্টেটস এবং তাদের সহযোগী পাকিস্তান। ফল যা হওয়ার তাই হলো। মুজাহিদীনদের আচমকা গেরিলা আক্রমণে ক্রমাগত বিপর্যস্ত হয়ে তৎকালীন সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করলেন আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার করা হবে ১৯৮৯ এর ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং এরপর থেকে কোনো দেশে কোনো বিপদ হলে সোভিয়েত সেনা যাবে না। সিদ্ধান্ত কার্যকর করা মাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হয়ে গেল। ১৯৭৯-১৯৮৯ দীর্ঘ সোভিয়েত বনাম আফগান মুজাহিদীন – আমেরিকা – পাকিস্তান জোটের লড়াইয়ের সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক সোভিয়েত অনুগামী সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে কমিউনিস্ট সরকারগুলির পতন হতে থাকল ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলির চাপে ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। অবশেষে চুয়াত্তর বছর স্থায়ী হওয়ার পরে ভেঙে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
এই ঘটনাক্রমের মধ্যেই পৃথিবীর মধ্য স্থানে ঘটে গেছে আরেকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যা ইরান – ইরাক যুদ্ধ নামে খ্যাত। ইরান-ইরাক যুদ্ধের সূচনা হয় ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ১৯৮৮ সালের আগস্টে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এর অবসান ঘটে। ইরানের কাছে এ যুদ্ধ অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ (জঙ্গ এ তাহমিলি) এবং পবিত্র প্রতিরোধ (দেফা এ মাক্বাদ্দাস) হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এ যুদ্ধকে ব্যাটল অব ক্বাদেসিয়া নামে অভিহিত করেন। আদতে ইরান মধ্য এশিয়ার এমন এক বৃহৎ পেট্রোলিয়াম সম্পদের ভাণ্ডার যা দখল করা ন্যাটো ভুক্ত দেশগুলির বহুদিনের স্বপ্ন। সেখানে তাদের মদতে শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে তখত দখল করেন রুহুল্লাহ খোমেইনী। অথচ ক্ষমতা হস্তান্তরের কিছুদিন পরেই ইরানের তৈলকূপগুলি থেকে পশ্চিমী দেশগুলির অবাধ তৈল নিষ্কাশন বন্ধ করে দেয়। তার প্রতিবেশী দেশ ইরাকে তখন মার্কিন মদতে আরেক পুতুল সাদ্দাম হোসেনের সরকার। ধর্মীয় মত অনুযায়ী এই দুই দেশ ইসলামের শিয়া ও সুন্নি দুই আলাদা পথে বিভক্ত। ধর্মীয় মত, সীমানা, পেট্রোলিয়াম নিষ্কাশন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তাদের আগেও মতবিরোধ ছিল আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইরাককে দিয়ে আক্রমণ করানো হলো ইরানকে।
সীমান্ত বিরোধ এবং ইরাকের অভ্যন্তরে শিয়া জঙ্গীদের ইরানি মদত দেয়ার অভিযোগে ১৯৮০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ইরাকি বাহিনী পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অবৈধভাবে ইরানি ভূ-খন্ড আক্রমণ এবং সেখানে অণুপ্রবেশ চালায়। সদ্য ঘটে যাওয়া ইরানি ইসলামি বিপ্লবের পরবর্তী অবস্থাকে ব্যবহার করে ইরাক যুদ্ধে দ্রুত অগ্রগতি অর্জনের চেষ্টা চালায়। কিন্তু কার্যত সে চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৮২ সালের জুনের মধ্যে ইরান তার হারানো সমস্ত ভূ-খন্ড পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এর পরের ৬ বছর ইরানি বাহিনী যুদ্ধে অগ্রসর ভূমিকায় ছিল। জাতিসংঘের বারবার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ১৯৮৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়। ২০০৩ সালে দু’দেশের মধ্যে সর্বশেষ যুদ্ধবন্দীর বিনিময় ঘটে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কৌশলের সাথে এ যুদ্ধের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পরিখা, কাঁটাতার, মানব স্রোত, বেয়নেট চার্জ এ যুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। ইরাকি বাহিনী ইরানি সৈন্য, বেসামরিক নাগরিক এবং ইরাকি কুর্দিদের উপর রাসায়নিক গ্যাস এবং মাস্টার্ড গ্যাস প্রয়োগ করে। ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধ পশ্চিমী শক্তিদের স্বার্থে লাগানো হল অথচ মারা গেল ইরান ও ইরাকের অসংখ্য নিরীহ মানুষ। পশ্চিমী বৃহৎ পুঁজিবাজার দ্বারা মধ্য এশিয়ার তেল সম্পদ লুটের জন্য দুই দেশের আভ্যন্তরীণ বিবাদ পরিণত হয়ে গেল মারণ যুদ্ধে।
(চলবে)
যুদ্ধ শিরোনামের এই ধারাবাহিক প্রচুর কষ্টসাধ্য এক একটি এপিসোড সেটা কিন্তু ইতিহাসের তথ্য উপাত্তের মিশেলে স্পষ্টতঃ বুঝে নেয়া যায়। শ্রমসাধ্য এমন একটি ধারাবাহিক চালিয়ে যাওয়াও যথেষ্ঠ কঠিন।
মন্তব্য বা শব্দ উচ্চারণকারী পাঠকের সংখ্যা কম হলেও অনুসন্ধিৎসু পাঠক নিশ্চয়ই খুঁজে নেবেন তাদের প্রয়োজনীয় অংশ বিশেষ। বিশেষ ধন্যবাদ প্রিয় সৌমিত্র চক্রবর্তী।