এদেশ ওদেশ ১

(শুরু করছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। বুঝতেই পারছেন লেখাটি সামান্য বড়, তাই কয়েক পর্বে এখানে দেব।)

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এই চব্বিশ বছর পাকিস্তান শাসনে ছিল বিভক্ত বাংলার টুকরো। পূর্ব ও পশ্চিম নামকরণেই ছিল বিচ্ছিন্নতার আভাস। আসলে পাকিস্তানের শাসকেরা কখনোই পূর্বপ্রান্তের এই ভূমিকে তাদের উপনিবেশের বেশী কিছুই ভাবতে পারত না। আর এর কারনও ছিল বহুমুখী। ভাষাগত, খাদ্যাভ্যাসগত, সংস্কৃতিগত পার্থক্য কোনোদিনই দুই প্রান্তকে কাছে তো আনেইনি, উল্টে শাসকের অহমিকায় দূরে ঠেলে দিয়েছিল।

আপাদমস্তক গরীব এই অঞ্চল থেকেই চব্বিশ বছর পাকিস্তান লুঠ করে তাদের রাজধানীতে নিয়ে যেত শষ্যসম্পদ থেকে জাত বিপুল পরিমাণে কর। অথচ উন্নয়ণের জন্য ফেরত আসত না কিছুই।

সাম্রাজ্যবাদী শাসকের শাসনযন্ত্রের নিয়মে পূর্ব পাকিস্তানে তখন বাসা বেঁধেছিল মূল পাকিস্তান ভূখণ্ডের কিছু লোক আর সাতচল্লিশে দেশভাগের সময়ে ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশের কিছু মানুষ। কিন্তু পূর্বপ্রান্ততে বাসা বাঁধলেও, তারা উর্দু, আরবী বা ফার্সি না জানা বা বলা বাঙালিদের মানুষ বলে মনেই করত না। তারা ছিল মূল শাসকদের এজেন্ট। এরাই পরবর্তীতে রাজাকার, আলবদর এর মত কুখ্যাত হত্যাকারী সংগঠনগুলির স্রষ্টা।
মৌলানা ভাসানী, শেখ মুজিবরের নেতৃত্বেই যে প্রথম ওপারের বাঙালি মাথা তুলেছিল তা নয়। তাদের শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ছিল ভাষা আন্দোলন। এরপরও ছোটখাটো কিছু আন্দোলন দানা বাঁধলেও বিস্ফোরণ ঘটলো ১৯৭০ এ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রায় কে গায়ের জোরে পাকিস্তানি শাসকেরা রদ করতে চাওয়ায়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কিম্বা তার আগের ইতিহাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্য এই প্রতিবেদন নয়। ইতিহাস সবার জানা, বহু চর্চিত। আমরা শুধু প্রেক্ষাপট বুঝতে বেশ কিছুটা পেছনে একটু অনুসন্ধানে যাই।

উনবিংশ শতকে অনেকগুলি ঘটনা ইংরেজ শাসকদের চিন্তিত করেছিল। একের পর এক বিদ্রোহ আর তার ফলস্বরূপ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে রাজশক্তির ভারত অধিগ্রহণ। এই বিক্ষোভের মাত্রা কমানোর উদ্দেশ্যেই ১৮৮৫ তে অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম কে দিয়ে তৈরী করা হল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামে ধামাধরা সংগঠনের। সশস্ত্র বিপ্লবের প্রশমনের উদ্দেশ্যে এই সংগঠন কাজ করবে নরম পন্থায় তা ধরেই নেওয়া হয়েছিল। আর কার্যত হয়েছিল তাই।

বলতে কি এই কংগ্রেস কোনোদিনই সংগঠিত দল ছিলনা, আদতে এ এক মঞ্চ। আর শাসকের কাছে অগ্রাধিকার পাওয়ায় বেশ কিছুটা ক্ষমতা সম্পন্ন। তাই এর মারফত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার জন্য শীর্ষ স্তরের নেতৃত্বে ছিল তীব্র প্রতিযোগিতা ও হরেক বৈধ বা অবৈধ কৌশল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই বোঝা গেছিল ইংরেজ আর তাদের এই ব্যায়বহুল উপনিবেশ ধরে রাখবে না। তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে কার হাতে? স্বাভাবিকভাবেই প্রিয়পাত্র কংগ্রেস ই দৌড়ে এগিয়ে।

(চলবে)

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

2 thoughts on “এদেশ ওদেশ ১

  1. আপাদমস্তক গরীব এই অঞ্চল থেকেই চব্বিশ বছর পাকিস্তান লুঠ করে তাদের রাজধানীতে নিয়ে যেত শষ্যসম্পদ থেকে জাত বিপুল পরিমাণে কর। অথচ উন্নয়ণের জন্য ফেরত আসত না কিছুই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. সেসময় পাকিস্তান বাংলার (বাংলাদেশ)'র মানুষের সবকিছুই স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু মহান স্রষ্টার কৃপায় তা তারা পারেনি। তাই মহান স্রষ্টার হাতিয়ার হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান'কে বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন। তাই আজ আমরা পাকিস্তানমুক্ত!

     

    শুভকামনা থাকলো দাদা। 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।