এদেশ ওদেশ ৯

শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ নবম পর্ব।

গণ হিস্টিরিয়া। ব্যাপারটা যদি সপক্ষে ঘটে, তাহলে যেকোনো দেশের শাসকদের খুবই পছন্দের। কিন্তু বিপরীতে গেলেই তার রূপ মারাত্মক। দেশের বৃহত্তম অংশের মানুষ কোনো কারনে কোনো ইস্যুতে অংশগ্রহণ করলে সেখানে আর যুক্তিতর্ক বা ইস্যুর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। সাধারণত ক্রমক্ষীয়মান জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য বা সাদা কথায় বলা ভালো, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের অপদার্থতা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেবার জন্য শাসকদল এটা করে থাকে।

১৯৬২র চীন যুদ্ধ বা ৬৫র পাকিস্তান যুদ্ধের অহমিকা তখন অস্তমিত। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর অকস্মাৎ মৃত্যুর পরে দিল্লীর ক্ষমতার অলিন্দে ষড়যন্ত্রের কালো ছায়া। একপক্ষ ভাবলো নেহরুর সাদাসিধে সুন্দর মেয়েটাকে নাম কা ওয়াস্তে প্রধানমন্ত্রী করে দেশ শাসন করবে। বাদ সাধল অন্যপক্ষ। তারা সরাসরি ক্ষমতা ভোগের সপক্ষে। ৬৬তে সরাসরি লড়াই হয়ে গেল মোরারজী দেশাই এর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর, প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবীদারত্ব নিয়ে। দেশাইকে হারিয়ে ইন্দিরা হলেন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী।

১৯৬৭র ফেব্রুয়ারীর শেষে সাধারণ নির্বাচনে ২৮৩ আসন জিতে ইন্দিরা যখন সরাসরি ক্ষমতায় এলেন, তখন দেশের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ২.৪ শতাংশ। অথচ উন্নয়ণের দিকে নজর না দিয়ে নিজেরই দলের ক্ষমতালিপ্সুদের সামলাতেই সময় চলে যাচ্ছে।

অন্যদিকে বিশ্বরাজনীতিতে আমেরিকার সমর্থন পেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে পাকিস্তান। তাসখন্দের বিষম চুক্তির ফলে জম্মু কাশ্মীরের বড় অংশ হাতছাড়া। তার ক্ষোভ কাজে লাগাচ্ছে দেশের বিরোধী দলগুলো। আর্থিক উন্নয়ন থেমে থাকার জন্য দেখা দিচ্ছে খাদ্যাভাব। বেকার সমস্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। শিল্পবিপ্লবের প্রতিশ্রুতি আকাশ কুসুম কল্পনা।

মাত্র দুবছরের মধ্যেই ইন্দিরার জনপ্রিয়তা তলানিতে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে একটাই দাওয়াই তখনো জানা, আর সেটা হলো যুদ্ধ। মৌলবাদের বিষ ছড়িয়ে মানুষকে দমিয়ে রাখার কৌশল যদিও ৪৬ এই জানা গেছিল, কিন্তু সঠিক চর্চার অভাবে তার যথাযথ উন্নতি হয়নি, অথচ পাকিস্তান তখন এব্যাপারে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছে।

এই টালমাটাল অবস্থার মধ্যেই মেঘ না চাইতেই জল। ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেললো উদ্বাস্তু সমস্যা।

তারচেয়েও বড় উদ্বেগের কারন ছিলো, ঘরের পাশে পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর এর ঘাঁটি গাড়ার হুমকি। এটা হলে উপমহাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক ভারসাম্য যে নষ্ট হয়ে যাবে তা বুঝতে সময় লাগেনি ঝানু রাজনীতিবিদদের।

ঠিক ওই অবস্থায় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের প্রহসন অন্তে মুজিব গ্রেপ্তার। আর্মি ও হন্তারক দালালদের দাপাদাপি। আর একঝাঁক মুক্তিকামী গ্রেপ্তার এড়িয়ে পালিয়ে এলেন এপারে। গড়লেন স্বাধীন সরকার।

যুদ্ধের ঠিক আগে ইন্দিরা, উদ্বাস্তু সমস্যা এবং উদ্ভুত রাজনৈতিক ও মানবাধিকার হত্যার পরিস্থিতি নিয়ে দরবার করলেন স্বয়ং আমেরিকায় গিয়ে। কিন্তু হোয়াইট হাউসের কাছে তখন সুবর্ণ সুযোগ উপমহাদেশ করায়ত্ত করার। ইন্দিরাকে দেখা করার সময়ই দিলেন না তৎকালীন ইউএস প্রেসিডেন্ট।

অপমানিত, ক্ষুব্ধ ইন্দিরা দেশে ফিরেই যুদ্ধ ঘোষণা করলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।

(চলবে)

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

2 thoughts on “এদেশ ওদেশ ৯

  1. সাধারণত ক্রমক্ষীয়মান জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য বা সাদা কথায় বলা ভালো, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজের অপদার্থতা থেকে নজর ঘুরিয়ে দেবার জন্য শাসকদল কৌশল নিয়ে থাকে। অনেকে বুঝলেও তেমন ভাবে সম্মুখ সারিতে এগিয়ে আসতে পারেন না। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. যতই পড়ছি, ততই কিছু-না-কিছু জানছি। শুভকামনা থাকলো দাদা। 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।