ট্যাগ আর্কাইভঃ অবহেলিত প্রাণী

অবহেলিত প্রাণী ধলু’র ভালোবাসা

নাম তাঁর ধলু। তবে ধলু জীবের সেরা মানুষ নয়! ধলু একটি অবহেলিত প্রাণী কুকুরের নাম। এই ধলুর সাথে আমার সখ্যতা, ২০১৬ইং সালের মাঝামাঝি থেকে। ধলু তখন খুবই ছোট ছিল। বয়স ছিল আনুষ্ঠানিক দেড়মাস। গায়ের রং ছিল ধবধবে সাদার মাঝে কালো লাল-খয়েরি ছাপ। তাই ওর নাম রেখেছিলাম ধলু। ধলুকে দেখতে হুবহু বিদেশি কুকুরের মতো দেখা যেতো। কিন্তু ধলু কোনও বিদেশি কুকুরের জন্মের ছিল না। ধলুর জন্ম হয়েছিল, এদেশের এক নামীদামী শহরের এক মহল্লার খোলা ডাস্টবিনের পাশে। ধলুর জন্মদাতার পরিচয় ছিল না বলে ধলু বেজন্মা বেওয়ারিশ কুকুর ছানা। যার কারণে ধলুর কোনও মালিকানাও ছিল না। ধলুর মালিকানা নিয়ে কেউ কখনো দাবিও তুলেনি। তাই রাস্তাই ছিল ধলুর একমাত্র ঠিকানা। ধলুর থাকা, খাওয়া, খেলাধুলা চলতো, আমার অফিসের সামনের মহল্লার এক রাস্তার পাশে। অবুঝ ধলুকে নিয়ে ওর মা-ও সেখানেই থাকতো।

সেই রাস্তা দিয়েই আমার প্রতিদিন অফিসে যাওয়া আসা হতো। যা এখনো একই রাস্তা দিয়ে আমি অফিসে যাওয়া আসা করি। একসময় যাওয়া আসার মাঝে সুন্দর ফুটফুটে এতিম ধলুকে দেখে আদর করতাম। দোকান থেকে বিস্কুট কিনে খাওয়াতাম। এভাবে ধলুর প্রতি আমি মায়ায় জড়িয়ে পড়লাম। ধলুও আমাকে ভালোবাসতে লাগলো, আমিও ধলুকে ভালোবেসে ফেললাম। এরপর নিজের বাসায় নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। অথচ রাস্তায় থাকা অবহেলিত প্রাণী ধলুর মতোই আমার অবহেলিত জীবন। বাড়ি নেই। বিত্তশালীদের মতো টাকা নেই। নিজের ঘরদোর নেই। পরের বাড়িতে থাকি ভাড়া। যেই শহরে ধলুর জন্ম, সেই শহরের এক মহল্লার ভাড়াটিয়া আমি। তবুও একদিন ধলুকে কোলে করে নিয়ে গেলাম ভাড়া বাসায়। যেই বাড়িতে আমি ভাড়া থাকি, সেই বাড়িতে।

বাড়ির মালিক সম্মানিত ব্যক্তি আমার খুবই পরিচিত ছিলেন। কোনো এক সময় এই মালিকের টেক্সটাইল মিল ছিল। আমি সেই মিলেরই শ্রমিক ছিলাম। সেই থেকে বাড়ির মালিক আমাকে খুবই ভালো ভালোবাসতো এবং ভালোও জানতো। বাড়ির মালিক ছিলেন মুসলমান। আমি হিন্দু। বাড়ির সব ভাড়াটিয়াও ছিল হিন্দু। বাড়িতে মোট ভাড়াটিয়ার সংখ্যা ছিল, ১৪ টি। এই ১৪ টি ভাড়াটিয়া সবই ছিল হিন্দু ফ্যামিলি। মুখে ছিছিছি, রামরাম বলা যাঁদের অন্যতম বুলি।

আমি যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, সেই বাড়িতে এমন টাইপের কিছু হিন্দু ফ্যামিলি ছিল। তাঁরা নিজ ধর্মের গুণকীর্তনের যা-ই করতো, তারচেয়ে বেশি কুসংস্কারে বিশ্বাসী। তাঁরা কিছুতেই স্রষ্টার সৃষ্টির প্রাণী কুকুর বিড়াল দুই চোখের লীলায় সহ্য করতে পারতো না। আমার অবস্থান আর বাসস্থানও ছিল সেসব মানুষের মাঝেই। তারপরও কুসংস্কারাচ্ছন্ন আচার আচরণ আমাকে গ্রাস করতে পারবে না ভেবে একদিন প্রাণীজগতের অবহেলিত প্রাণী ছোট্ট ধলুকে নিয়ে গেলাম বাসায়।

ধলুকে দেখে প্রথমেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো নিজের সহধর্মিণী। সেও ধর্মের নামে কুসংস্কারাছন্ন হয়ে নিত্যদিন জপের মালা জপে। এরপর জ্বলতে শুরু করলো বাড়ি অন্যান্য ভাড়াটিয়ারা। ছিছিছি, রামরাম, দুরদুর, যা যা, সরসর! এসব পেঁনপেঁনানি সহ্য করেও চলছিল আমার ধলুর প্রতি সেবাযত্ন। নিজের সন্তানের মতো করে শ্যাম্পু দিয়ে ধলুকে স্নান করাতাম। খাওয়াতাম। আদর করতাম। এরপর গলায় বেল্ট পড়ালাম। বেল্টের সাথে লোহার চেইন লাগালাম। ধলুও আমাকে আস্তে আস্তে ভালো করে চিনতে শুরু করলো। একসময় পুরোপুরি চিনেও ফেললো। এখন আর আমাকে না দেখলে ধলুর ভালো লাগতো না। আমাকে না দেখলেই ধলু কেঁউকেঁউ শুরু করে দিত। আমার গলার আওয়াজ পেলেই ধলুর শান্ত হয়ে যেতো।

আমি যতক্ষণ বাসায় থাকতাম, ততক্ষণ রাখতাম বাসার সামনে। বাসার সামনে কুকুর থাকলে নাকি কিছু ধার্মিক হিন্দুদের জাত যায়! তাই কুকুর দেখলে তাঁদের ছিছিছি, আর রামরাম বলা শুরু হয়ে যেতো। এসব দেখে আর শুনে আমি বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার সময় ধলুকে বেধে রাখতাম বাড়ির নির্জন আউট সাইডের একটা কলা বাগানে। ধলুর সামনে থেকে আমি চলে আসার পরপরই ধলু শুরু করে দিতো কান্নাকাটি, হাউমাউ কেঁউকেঁউ। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে ধলুর সামনে যেতেই, ধলু শান্ত! হাউমাউ নেই! কেঁউকেঁউ নেই! চিল্লাচিল্লি নেই! বাধ খুলে নিয়ে আসতাম বাসার সামনে। রান্না করা মাছ দিয়ে ভাত মেখে দিতাম, ধলু লেজ নেড়ে মনের অানন্দে খেত। আবার নিয়ে বেধে রাখতাম কলা বাগানে। এভাবে মাত্র ৭ দিন ধলুকে ভাড়াটিয়া বাসায় কোনরকমভাবে রাখলাম।

এরপর ধলুকে আর রাখতে পারলাম না, ছিছিছি রামরাম আর সহ্য হলো না। যেখানে জীবের সেরা মানুষের আচার ব্যবহার থাকার কথা উৎকৃষ্ট বন্ধুসুলভ! সেখানে কিছু মানুষের নিকৃষ্ট আচরণের কাছে আমি হেরে গেলাম। শেষমেশ বাধ্য হলাম ধলুকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার সিদ্ধান্ত বাড়ির মালিক জানতে পেরে তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, ‘ধলুর জন্য আমি এই বাড়িতেই একটা সুন্দর ব্যবস্থা করে দেই, তুমি ধলুকে এখানে রেখে দাও!’ সম্মানিত বাড়ির মালিকের কথায় আমি রাজি না হয়ে বললাম, ‘না স্যার, আমি ও-কে যেখান থেকে এনেছি, ঠিক সেখানে নিয়েই ছেড়ে দিবো। এই বাড়িতে ধলুকে রেখে বাড়তি কোনও ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’ সম্মানিত বাড়ির মালিক আর কোনও কথা বলেনি, আমি আমার সিদ্ধান্তেই অটল থাকলাম।

যেদিন ধলুকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাবো, সেদিন সকালবেলা ধলুকে কয়েকটা টোস বিস্কুট সামনের দিয়ে বললাম, ‘খা ধলু, খা। এই বাড়িতে এটাই তোর শেষ খাওয়া। তোকে এখনই তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাবো। আজ থেকে তুই মুক্ত। তোর গলায় আর শিকল বাধা থাকবে না। তোকে দেখে কেউ ছিছিছি রামরামও বলবে না। তোর কারণে কারোর উপাসনাও নষ্ট হবে না। আজ থেকে তুই তোর মায়ের সাথেই থাকবি। স্বাধীনভাবে ঘুরবি। ইচ্ছেমতো খেলবি। মনের আনন্দে দৌড়াবি।’

এসব আমি যখন বলছিলাম, ছোট্ট ধলু তখন আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল! আমার বলা কথাগুলো শুনছিল। কিন্তু একটা বিস্কিটের বেশি আর সেদিন ধলু খেলো না। ধলুকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশায় চড়ে রওনা হলাম অফিসের দিকে। পথিমধ্যেই ধলুর মা কয়েকদিন যাবত ছোট্ট ধলুকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে বসে আছে রাস্তার পাশে। ধলুর মায়ের দুটো চোখ শুধু এদিক-সেদিক খুঁজাখুঁজি। আমিও যাচ্ছিলাম একই রাস্তা দিয়ে। ধলু আমার সাথে রিকশায়। ধলু দূর থেকেই ওর মাকে দেখে কেঁউকেঁউ শুরু করে দিলো। ধলুর গলার কেঁউকেঁউ আওয়াজ ধলুর মায়ের কানে যেতেই, ধলুর মা এক দৌড়ে আমার রিকশার সামনে। হারানো সন্তানকে গর্ভধারিণী মা কাছে পেয়ে কি যে করবে, তার কোনও দিশামিশা নেই। এক লাফে আমার রিকশায় উঠে ধলুকে আদর করতে লাগলো। ধলুও গত ৭দিন পর মাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। আমি ধলুর গলায় বাধা বেল্টের সাথে লোহার শিকল খুলে দিয়ে ধলুকে রিকশা থেকে নামিয়ে দিলাম। ধলু মায়ের সাথে নাচতে নাচতে মহল্লার এক বাড়ির চিপায় চলে গেল। আমি আমার চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গেলাম নিজের অফিসে।

এরপর অফিসে যাওয়া আসার সময় মাঝে মাঝে ধলুর মায়ের সাথে ধলুকে দেখতাম। ধলু বলে ডাক দিলেই এক দৌড়ে আমার সামনে চলে আসতো। আমার পা ওর জিহবা দিয়ে চাটত। ওর সামনের দুই পা দিয়ে আমার পায়ে ঘষা দিতো। কেঁউকেঁউ করে খাবার চাইতো। সাধ্যমত খাবার কিনে দিতাম, মা ছেলে বসে বসে মনের আনন্দে খেতো। আবার কয়েকদিন ধলুকে দেখা যেত না। তখন নিজের কাছেও ভালো লাগতো না। মনো হতো, অনেকদিন ধরে কোনোএক প্রিয়জনকে দেখছি না। অফিসে যাওয়া আসার মাঝেই শুধু ধলুকে খুঁজতাম। পেতাম না! আবার হঠাৎ করে একসময় দেখা হয়ে যেতো। তখন ধলুর সাথে অল্প কিছুক্ষণ চলতো কথাবার্তা, ভালোবাসা আদানপ্রদান।


আমার সেই ধলু। যেই ধলুকে খুব ছোট থাকতে আমার বাসায় ৭ দিন রেখেছিলাম। আজ কয়েকদিন ধরে ও আর আমার পিছু ছাড়ছে না। মাত্র ৭দিনের ভালোবাসা ধলু আজও ভুলতে পারছে না। কিন্তু জীবের সেরা অনেক মানুষেই তা মনে রাখে না।

এভাবে ধলু আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো। একসময় ধলুর মা’কে কে বা কারা মেরে ফেললো। ধলু হয়ে গেল এতিম, আর ঠিকানাবিহীন পথের কাঙ্গাল। এখানে ক’দিন, সেখানে ক’দিন। বাপ ছাড়া, আর মা মরা ধলু তখন কোথাও গিয়ে শান্তি পায় না। ধলু যেখানেই যায়, সেখানকার দায়িত্বে থাকা অন্যসব কুকুরের আক্রমণের শিকার হতে হয়। তখন ধলুর কাছে আমার বাসা ছিল অচেনা। ছোটবেলার চেনা বাসা এখন আর ধলু চেনে না। ধলু শুধু আমাকেই খুঁজে বেড়ায়। সমতে আমাকে পায়, সমতে পায় না। ধলুর সাথে আমার দেখা হয়ে গেলে প্রথমেই এক লাফে আমার বুকের উপর ওর সামনের দুটি পা রেখে আমাকে চুমু দিতে চাইবে। এমন কয়েকবার চেষ্টা করবে। তারপর আমার পা ওর মুখের ভেতরে নিয়ে কামড়ানোর অভিনয় করবে। আমার হাতে কামড়ানোর ভাব করবে। অথচ ওর মুখের ভেতরে থাকা একটা দাঁতের আঁচড়ও লাগাবে না। ওর এরকম অভিনয় দেখে মানুষের ভয়ে হায় হায় করতে থাকে। কিন্তু ওর প্রতি আমার কোনও ভয় ছিল না। আমি জানি, ওর এরকম ভাব হলো আমাকে আহ্লাদ করা।

অনেকক্ষণ এমন অভিনয় করার পর পাউরুটি, নাহয় বিস্কুট ওকে দিতেই হবে। তাও আবার মাটিতে দিলে ধলু রাগ করে অনেকক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকে। তখন আমি বুঝতে পারতাম ঝিম ধরার মানে কী? ঝিম ধরার মানে হলো, খাবার সরাসরি ওর মুখে ফিকে না দিয়ে মাটিতে দিলাম কেন! তাই ওর ঝিম ধরা। তারপর একটু একটু করে ওর মুখ বরাবর ফিকে দিলে খপ খপ করে ক্যাচ ধরে খেতে থাকে। এভাবেই ধলুর সাথে প্রায় দুইবছর রাস্তা-ঘাটে, পাড়া-মহল্লায় দেখাশোনা, আর ভালোবাসার লেনাদেনা। কিন্তু ধলুকে একদিনও সাথে করে বাসায় নেই না। কারণ, ধলু বাসা চিনে গেলেই ও আর বাসা ছাড়তে চাইবে না। এতে নতুন করে সৃষ্টি হবে আরেক জ্বালা। যেই জ্বালা গত হয়েছে অনেক আগেই। সেটা আবার নতুন করে না জ্বালাতে চেয়ে ধলুকে আমি বাসায় নেই না।

একদিন দুপুরবেলা অফিস থেকে আমি বাসায় ফিরছিলাম। পথিমধ্যে ধলুর সাথে আমার দেখা। দোকান থেকে পাউরুটি কিনে খাওয়ালাম। বললাম, ‘তুই এখন অন্যদিকে চলে যা, আমি বাসায় যাবো।’ না, আমি কিছুতেই ধলুকে আড়ালে রেখে বাসায় আসতে পারছি না। উপায়ান্তর না দেখে ইচ্ছা না থাকা সত্বেও ধলুকে সাথে করে নিয়ে আসলাম বাসায়। বাসায় তখন নিজের ধার্মিক গিন্নী ভাত খাচ্ছিল। গিন্নী ধলুকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘এইডা আবার লগে কইরা কারে নিয়া আইলা?’ বললাম, ‘এইডা আমার সেই ধলু! যেই ধলুকে তগো জ্বালায় বাইত তুনে খেদাইয়া দিছি, হেই ধলু। দেখ, আমার ধলু অহনে কত বড় অইয়া গেছে গা।’

আমার কথা শুনে গিন্নী কিছু না বলে চুপচাপ খাওয়াদাওয়া করে আমাকে খাবার দিলো। আমি আমার খাবার থেকে দুমুঠো ভাত একচিমটি লবণ, আর অল্প একটু মাছ দিয়ে মেখে ধলুকে দিলাম। ধলু মনের অনন্দে খেলো। আমিও খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পরে ঘুম থেকে উঠে দেখি ধলু নেই। ধলু কোথায় যেন চলে গেছে। ধলুকে না পেয়ে চিন্তামুক্ত হলাম, আবার চিন্তাও করতে লাগলাম! চিন্ত হলো, কোথায় গিয়ে আবার কোন কুকুরের সাথে ঘেউঘেউ করে লেগে যায়, সেই চিন্তা। কিন্তু না, ধলু ওর নিজের ধান্ধায়ই, অন্য কোথাও চলে গেছে। সেই যাওয়ার কয়েকদিন আর ধলুর সাথে আমার দেখা হয়নি। তবে আমি রাস্তায় হাঁটাচলার মাঝে ধলুকেই শুধু খুঁজি। কিন্তু ধলুর দেখা নেই।


আজ কয়েকদিন ধরে আমার ভাড়া বাসার সামনে ধলু এভাবেই সারা রাত শুয়ে থাকে। ছবিটি ৯/১১/২০১৯ ইং তারিখ রাতে তোলা।

ইদানীং কয়েকদিন ধরে ধলু আমার অবস্থান করা জায়গাগুলোতে চুপ করে বসে থাকে। আমাকে দেখা মাত্রই হাউমাউ করে আমাকে ঝাপটে ধরে। চুমু দিতে চায়। রুটি বিস্কুট খায়। আমার আগে-পরে বাসায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকে। এখন আর ধলুকে কিছুতেই বাড়ি থেকে বিদায় করতে পারছি না। ধলুও বাসা ছাড়ছে না। এখন ঝামেলাটা হয়ে গেল বাড়তি ঝামেলা। দুইদিন আগে খুব ভোরবেলা একটা রিকশা করে ধলুকে নিয়ে গেলাম বাসা থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে, কিল্লার পুল নামক স্থানে। সেখানে ধলুকে নামালাম। দোকান থেকে একটা পাউরুটি কিনে ওর সামনে দিলাম। আমি আবার রিকশা চড়ে যখন বাসায় ফিরছিলাম, ধলু আমার রিকশা ফলো করে রিকশার পেছনে পেছনে দৌড়াতে লাগলো। আমার রিকশা যেদিকে, ধলুও সেদিকে দৌড়াচ্ছে। এভাবে প্রায় দেড় কিলোমিটার দৌড়ে পাঠানটুলি রেললাইন দিয়ে আসার সময় সেখানকার চার-পাঁচটি কুকুর ধলুকে অ্যাটাক করে ফেললো। আমি বাসায় চলে এলাম। কিন্তু ভালো লাগছিল না। ধলুর জন্য মনটা খুবই খারাপ লাগছিল। কয়েক ঘণ্টা পর ভাবলাম, ধলু আর ফিরবে না। আমি আপাতত জ্বালা মুক্ত হলাম।

কিন্তু না, জ্বালা মুক্ত আর হতে পারিনি! যেই জ্বালা, সেই জ্বালাই কপালে রয়ে গেল। ধলু সন্ধ্যাবেলা বাসায় হাজির হলো। আমি তখন অফিসের কাজে মার্কেটে। বাসা থেকে ফোন আসলো, ‘হ্যালো, আম্নের কুত্তা ধলু বাসায় আইয়া বইয়া রইছে। যদি বাড়ির মাইনষের পোলাপানগো সমস্যা অয়, তয়লে মাইনষের লগে কি কাইজ্জা করুম?’ তাততাড়ি কইরা আইয়া কুত্তা সামলান।’ কাজ ফেলে রেখেই বাসায় আসলাম। আমাকে দেখেই ধলু লাফ দিয়ে আমার বুকের পর উঠে আমাকে চুমু দিতে চাইল। আমি ওর প্রতি রাগ হয়ে আমার সাথে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসলাম। দোকান থেকে পাউরুটি কিনে খাওয়ালাম।ধলুকে দোকানে রেখেই, আমি আবার চলে গেলাম অফিসের কাজে।

রাত দশটার সময় বাসায় এসে দেখি, আমার বাসার সামনে ধলু শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ধলুকে দেখে বাড়ির ফ্যামিলি বাসার মানুষের পেঁনপেঁনানি শুরু হয়ে গেছে। এসব দেখে শুনে এখন সিদ্ধান্ত নিলাম দুই একদিনের মধ্যে নৌকা করে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে নিয়ে রেখে আসবো। এছাড়া আর কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছি না। কারণ, আমি নিরুপায়! শহরে ভাড়া বাসায় ধলুকে কিছুতেই রাখতে পারছি না!

কুকুরের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা

আজ একটি অবহেলিত প্রাণী কুকুরের ভালোবাসার গল্প শোনাবে। তো গল্পটি প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত কেউ পড়বেন কি? পড়লেই বুঝতে পারবেন, মানুষের প্রতি ওদের কত ভালোবাসা! মানুষ যদি কয়েকদিন একটি কুকুরকে আদর-যত্ন করে খাওয়ায়, তো কুকুরটি জীবিত থাকা অবস্থায় সবসময় তা মনে রাখে। তা কোনও একসময় কুকুরটি পাগল হয়ে গেলেও মনে রাখে। পাগল হয়ে যাওয়া কুকুরটি অন্তত ভালোবাসার মানুষটিকে ঠিকই চিনতে পারে। কোনও সময় কামড়ায় না, আঘাতও করে না। তাহলে শুনুন আমার বাস্তব জীবনে একটি কুকুরের ভালোবাসার গল্প।

আমরা সকলেই জানি যে, প্রতিবছরই ভাদ্র-আশ্বিন আর কার্তিক মাসে কুকুর বাচ্চা প্রসব করে। সেসময় শহরের মহল্লার রাস্তায় কুকুরের ছোট ছোট বাচ্চা দেখা যায়। তখন এসব কুকুরের বাচ্চাগুলোকে রক্ষণা- বেক্ষণের অভাব হয় না। মহল্লার অনেক শিশু কিশোররা এঁদের দেখভাল করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে ফেলে। বাচ্চাগুলোকে সেবা-যত্ন করার প্রস্তুতি নিয়েও নেয়। কেউ কুকুরের বাচ্চাগুলোর গলায় রশি বেঁধে টানে। কেউ কোলে- পিঠে করে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। বাচ্চা কুকুরটি অন্তত কয়েকদিন নিজের হেফাজতে রাখার জন্য অনেক রকমের চেষ্টাও করে। কয়েকদিন খুবই আদর-যত্ন করে রাখেও।

নিজ বাড়ির সামনে থাকা একটা কুকুরের যদি পাচ- ছয়টি বাচ্চা থাকে, তো বাড়ির পাচ- ছয়টা ছেলে- পেলেদের মধ্যে তা ভাগাভাগি হয়ে যায়। এটা আমার, ওটা তোমার! কেউ কারোরটা ধরতে বা ছুঁতে পারবে না। একে অপরেরটা ধরলেই, লেগে যায় হট্টগোল হুলস্থুল! মানে– মারা-মারি, ধরা-ধরি, আর ঝগড়া।

কুকুরের বাচ্চা নিয়ে ছোটবেলা এমন ঝগড়া- ঝাঁটি নিজেও অনেক করেছি। যখন ছোট ছোট ছেলে- পেলেদের কুকুরের বাচ্ছা নিয়ে এমন আদর আহ্লাদ দেখি, তখন আমরও শখ হয় বাচ্চাগুলোকে কোলেকাঁখে নিতে। কিন্তু পারি না লোকলজ্জার ভয়ে, আর মানুষের নানারকম কথার কারণে। তবুও থেমে থাকার পাত্র আমি নই। কোলে- কাঁখে নিয়ে না বেড়ালেও, চোখে চোখে আদর করি, খাবার দেই, কাছে ডাকি।

একদিন একটা কুকুরের সাদা রঙের মাঝে কালো ছাপওয়ালা বাচ্চা দেখে লোভ আর সামলাতে পাড়লাম না। বাচ্চাটিকে নিয়ে গেলাম বাসায়। বাসা বলতে নিজের বাপ-দাদার কেনা বাড়ির বাসা নয়! ভাড়াটে বাসা! মানে– যেই বাড়িতে ভাড়া থাকি, সেই বাড়িতে থাকা বাসায়।

এদিকে কুকুরের বাচ্চাটির জন্য ওর মা কুকুরটি প্রতিদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, কাঁদে, ঘেউ ঘেউ করে। মা কুকুরটি বাচ্চার শোকে একরকম পাগলের মতো হয়ে গেল। তা আমি দেখি, বুঝি! মা কুকুরটিকে কাছে ডাকি। বিস্কুট অথবা পাউরুটি খেতে দেই! কিছু খায়, আবার অন্যদিকে চুপ-চাপ চেয়ে থাকে। খাবার শেষ না করেই পাগলের মতো আবার ছুটতে থাকে। এসব আমি আমার অফিসের সামনে যেখান থেকে কুকুরের বাচ্চাটিকে নিয়ে গেছি, সাখানে কুকুরের বাচ্চার মায়ের এরকম অবস্থা দেখতে পাই। তা দেখে নিজের কাছেও খারাপ লাগে। তারপরও কুকুরের বাচ্চাটি পোশ মানানোর জন্য আমার খুবই ইচ্ছা হচ্ছিল।

বাচ্চাটি ছিল খুবই সুন্দর, দেখতে বিদেশি কুকুরের বাচ্চার মতো। বাসায় নেওয়ার সাথে সাথেই লেগে গেল হট্টগোল আর গণ্ডগোল। আমরা হিন্দু বলে কথা! ধর্মের আচার- বিচারের আর শেষ নেই, তাই। ছিঃ ছিঃ, রাম রাম, ঠাকুর ঠাকুর ইত্যাদি সহ আরও কত কী! তবু কারোর ছিঃ ছিঃ, আর রাম রামের দিকে ফিরে তাকালাম না। কুকুরটিকে বাসার দরজার সামনে একটা রশি দিয়ে বেধে রাখলাম। এরমধ্যেই নিজের গিন্নির সাথেও লেগে গেলো বাকবিতণ্ডা। গিন্নি বলে, “নিজে পায় না জায়গা, কুত্তা আনে বাগা।” গিন্নি ছাড়াও আ-কথা কু-কথা বলার মতো বাড়িতে থাকা ভাড়াটিয়ারা তো আছেই।

যদি কুকুরের বাচ্চাটি এই বাড়িতে থাকে, তো কারোর ঘরে যেতে পারবে না। কারোর শরীরে ঘেঁষাও লাগতে পারবে না। রোদে শুকানোর জন্য তারে ঝুলিয়ে রাখা কাপড়েও লাগতে পারবে না। কাপড়ে কুকুরের ছোঁয়া লাগলেই, সেই কাপড় আমাকে আবার ধুইয়ে দিতে হবে। কারণ, এঁরা অশুচি কুকুর বা কুত্তা। সবসময় ময়লা আবর্জনায় থাকে বলে, ওরা নাকি সবসময় নাপাকই থাকে! তাই এদের প্রতি আমাদের যতো অবহেলা, আ-কথা, কু-কথা আর ঘৃণা।

তারপরেও আমি থামছি না। সব ভাড়াটিয়াদের সবরকম কথা আর শর্তাবলী মেনে নিয়ে শুরু করে দিলাম, বাচ্চাটিকে সুন্দরভাবে রাখার ব্যবস্থা। দিনে এবং রাতেরবেলা বাচ্চাটি রাখার নির্দিষ্ট জায়গাও ঠিক করে ফেললাম। বাজার থেকে বাচ্চাটির জন্য সেম্পু-সহ গলার বেল্ট আর ঘণ্টাও কিনে নিয়ে গেলাম। কুকুর বা কুত্তার বাচ্চাটির (ধলু) নামও রাখে দিলাম। ওর নাম এখন ধলু। ধলু বলে ডাকলে কুকুরের বাচ্চাটি আমার দিকে টগবগ করে চেয়ে থাকে। ও বুঝে গেছে যে, ওর নাম ধলু! তাই ধলু নাম কেউ উচ্চারণ করলেই কুকুরের বাচ্চাটি কেও মেও শুরু করে দেয়।

আবার বাড়ির কয়েকজন ব্রাহ্মণ টাইপের ফ্যামিলি বলা-বলি করতে লাগলো, “বাড়িওয়ালার কাছ থেকে অনুমিত না নিয়েই বাড়িতে কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এসেছে। যেমন ওর নিজের বাড়ি!” এসব কথা আমি না শুনলেও আমার গিন্নি শুনে আমাকে শাসাতে লাগলো। গিন্নি বলতে লাগলো, “কুকুরের বাচ্চাটি যেখান থেকে এনেছ, ঠিক সেখানেই দিয়ে আসো! নাহয় তোমার একদিন কি আমার একদিন। ভাড়াটিয়া বাড়িতে কুকুর বা গরু ছাগল লালন-পালন করতে হলে, বাড়িওয়ালার অনুমিতর প্রয়োজন হয়। তা কি তুমি জানো না? আর যদি এখানে এই বাড়িতে কুকুর রাখতেই হয়, তো আগে বাড়িওয়ালার অনুমিত নিয়ে নাও!”
গিন্নির কথামত আমি বাড়িওয়ালার কাছ থেকে বাচ্চাটিকে রাখার জন্য অনুমিতও নিয়ে নিলাম। এখন আমাকে আর ঠেকায় কে? শুরু করে দিলাম এর পরিচর্যা। আর সময় অসময় এর দেখাশুনা।

তারপরও ঘরে বাইরে চলছে কুকুর নিয়ে ঝগড়া। নিজ ঘরেও ঝগড়ার শেষ নেই। কুকুরের বাচ্চাটিকে ছুঁলেই, আমাকে স্নান করে ঘরে ঢুকতে হবে। নাহয় মহাবিপদের সম্মুখীন হতে হয়! ঘরে এটা ছুঁতে দেয় না, ওটা ধরতে দেয় না। এমন আরও নিয়ম-কানুন! তবুও ধৈর্য ধরে সবকিছু সুন্দরভাবে চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে পাচ- ছয়দিন পার করে দিলাম।

এভাবে ছয় থেকে সাতদিনের মধ্যেই বাচ্চাটির চেহারা কেমন যেন পালটে গেল। বাচ্চাটি এখন দেখতে ঠিক বিদেশি এক বিশেষ জাতের কুকুরের মতো হয়ে গেল। শরীরের পশমগুলো হয়ে গেল লম্বা লম্বা। আর সাদা রঙের মাঝে ঝলকানো কালো দাগগুলো যেন ফুটে উঠেছে। এখন যে-ই দেখে, সে-ই বাচ্চাটির দিকে চেয়েই থাকে। প্রতিদিন সকালবেলা কুকুরের বাচ্চাটিকে সাথে নিয়ে রাস্তায় বের হলেই, অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “দাদা, এই বিদেশি কুত্তার বাচ্চাটি কোত্থেকে এনেছেন?”
আমি প্রশ্নকারী ব্যক্তিদের সাথে আর মিথ্যা বলতে পারিনি। সত্য কথাই বললাম, “এটা বিদেশি কুত্তার বাচ্চা না, এটা দাদা এদেশি।” আমার কথা শুনে অনেকেই আমাকে বলে, “আপনিতো ভাড়া থাকেন! তো বাচ্চাটিকে আদর- যত্ন করে রাখবেন কোথায়? তারচেয়ে বরং এটা দাদা আমাকে দিয়ে দেন।”

আমি কারোর কথায় আর কান দিলাম না। যতদিন রাখতে পারি ওকে নিজের হেফাজতেই রাখবো। এটা ছিল আমার মনের কথা, আর নিজের সিদ্ধান্ত। খটকা কিন্তু বেধে যায় বাড়ির ভাড়াটিয়াদের সাথে। আর নিজ ঘরের গিন্নির সাথে। অনেক সময় এই কুত্তার বাচ্চাটা নিয়ে, কারণে অকারণে প্রতিদিনই বাড়ির ভাড়াটিয়াদের আমার এবং আমার গিন্নির ঝগড়া করতে হয়। এই ঝগড়া- ঝাঁটির কারণে, আমি (ধলু) কুকুরের বাচ্চাটিকে আর আমার কছে রাখতে পারলাম না। কাউকে দিয়েও দিলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম, যেখান থেকে এনেছি, ঠিক সেখানেই ওর মায়ের কাছে নিয়ে ছেড়ে দিবো।

যেই কথা সেই কাজ! একদিন সকালবেলা দোকান থেকে একটা পাউরুটি কিনে এনে ধলুর সামনে দিলাম। ধলু আমার দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে সামান্য রুটি খেয়ে চুপ করে বসে রইল। আমিও ধলুর সামনে বসে ধলুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, “ধলু, আজ তোকে তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাবো। আজ থেকে তুই তোর মায়ের কাছেই থাকবি। আজ থেকে তুই মুক্ত! তোর গলায় আর বেল্ট বাধা থাকবে না। তোর জন্য আর কারোর সাথে আমার ঝগড়াও বাধবে না। এই বাড়ির আর কারোর মহাভারত অশুদ্ধও হবে না।”

ছবিতে আমার সেই ধলু। এখন ধলু অনেক বড় হয়ে গেছে। থাকে আমার অফিসের সামনের মহল্লায়। আমি রোজ যেই রাস্তা দিয়ে অফিসে আসি, সেই রাস্তায় ও আমর জন্য অপেক্ষায় থাকে। সকালে ওকে অন্তত দুটি বিস্কুট না দিয়ে আর অফিসে যাওয়া যায় না। আমার ভালোবাসা ধলু আজও মনে রেখেছে। কিন্তু অনেক মানুষেই মনে রাখে না।

বাসা থেকে বের হয়ে ধলুকে নিয়ে একটা রিকশা চড়ে আমার অফিসের দিকে যাচ্ছি। অফিসের সামনেই থাকে ধলুর মা কুকুরটি। অফিস থেকে একটু সামনে রাস্তার পাশে ধলুর মা কুকুরটি বসে রিকশার দিকে চেয়ে আছে। চলন্ত রিকশা থেকেই ধলু ওর মাকে দেখে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দিলো। ধলু গলার ওয়াজ ওর মায়ের কানে পৌঁছা মাত্রই, ওর মা দৌড়ে সামনে আসতে লাগলো। আমি রিকশাওয়ালা ভাইকে বললাম,”ভাইজান আপনার রিকশা এখানে থামান!” রিকশা থামতে দেরি, ধলু রিকশা থেকে লাফ দিতে আর দেরি করেনি। ওর মা কুকুরটিও সামনে এসে ধলুকে চুমাইতে লাগলো। ধলুও ওর মাকে চুমাইতে লাগলো। এভাবেই অনেকক্ষণ চলছিল মনের আনন্দে মা ছেলের লাফা-লাফিও। আমি রিকশায় বসেই অনেকক্ষণ দেখলাম! এরপর ধলু আমার দিকে একনজর চেয়ে ওর মায়ের সাথে লাফাতে লাফাতে এক বাড়ির চিপায় ঢুকে গেলো। আমি দুই চোখের জল ফেলতে ফেলতে আমার অফিসে চলে গেলাম।

এরপর থেকে ধলু আস্তে আস্তে হাতে-পায়ে বড় হতে লাগলো। আমিও অফিসে আসা-যাওয়ার মাঝে ধলুকে ফলো করি। খাবার কিনে দেই। আদর করি। ধলুও যেসময় যেখানেই আমাকে দেখে, সামনে আসে। ঘেউ ঘেউ করে মনের ভাব প্রকাশ করে। খাবারের আবদার করে। না দেওয়া পর্যন্ত সামনেই বসে থাকে। দোকান থেকে রুটি অথবা বিস্কুট কিনে দিলে খায়! সাথে ওর মা কুকুরটিও খায়। আমার সামনে অন্য কোনও কুকুর দেখামাত্র ঘেউ ঘেউ করে তাড়িয়ে দেয়। অন্য কুকুরগুলো যাতে আমাকে কামড় না দিতে পারে, তাই ও ঘেউ ঘেউ করে আমার সামনে থাকে অন্য কুকুরদের তাড়িয়ে দেয়। বর্তমানেও ধলু যেন আমার খুবই আপন। আমাকে দেখা- শোনার দায়দায়িত্বই যেন ধলুর উপর ন্যস্ত! আমি যতক্ষণ পর্যন্ত অফিসে থাকি, ধলু আমাকে সবসময় ওর চোখে চোখেই রাখে। যাতে আমার কোনরকম ক্ষতি না হয়। অফিস থেকে বের হলেই ধলু লেজ নেড়ে আমার সামনে আসে। চোখে চোখ রাখে। খাবার চায়! তাই আমাকে ধলুর সময় অসময়ের আবদার রাখতেই হচ্ছে।

রাতে যতক্ষণ আমি আমার অফিসে থাকি, ধলু আমার অফিসের সামনেই শুইয়ে থাকে। বাসায় ফেরার সময় অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত আরও কয়েকটি কুকুর সাথে নিয়ে আমাকে আগাইয়া দেয়। ওর এই ডিউটি খাবার দিলেও করে, না দিলেও করে। আমার সাতদিনের ভালোবাসা আজও ধলু ভুলতে পারেনি। আর একটা মানুষকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছরও সাথে রেখেছি, খাওয়াইয়াছি। শেষতক মনে রাখেনি। মানুষটির সময় আর সুযোগ পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথেই, পেছনের কথাগুলো ভুলে গিয়েছে। অথচ আমার সাতদিনের ভালোবাসা ধলু আজও ভুলতে পারেনি। অনেক বড় হয়েও, সেই ভালোবাসা ওর মনে রেখে নিঃস্বার্থে আমাকে ভালোবেসে যাচ্ছে। অথচ অনেক মানুষই তা মনে রাখেনি।