ট্যাগ আর্কাইভঃ ইসিয়াকের গল্প

করোনার প্রাদুর্ভাবে দিনগুলিতে মাকে নিয়ে জরির ভাবনা

জোহরা সবসময় আচার আচরনে একজন চঞ্চল উচ্ছল প্রকৃতির মানুষ। শত দুঃখের মাঝে তার মুখে সর্বদা হাসি লেগে থাকে যেন। কোন দুঃখই তাকে মনে হয় সেভাবে স্পর্শ করতে পারে না। একসময় স্বামী সন্তান নিয়ে ভরা এক সংসার ছিলো তার। হাসি আনন্দ গান স্বপ্ন সোহাগ সবই ছিলো সেখানে। কোন কিছুর কমতি ছিলো না ।

যদিও প্রায় সব পরিবারের মতো ই শ্বাশুড়ীর সাথে ছিলো না তার বনিবনা তবু ও স্বামীর সাথে তার সম্পর্ক খুব একটা খারাপ ছিলো না। বউ শাশুড়ীর যুদ্ধে বিভিন্ন কলাকৌশল প্রয়োগ করে সে বেশ দাপটের সাথে টিকে ছিলো সংসারে। কিন্তু দিন সবার সমান যায় না। সুখের পরে দুঃখ আসে। জীবনের পালাবদলের খেলায় আসিফ সাহেব এর হঠাৎ পরিবর্তন আসে, সংসারের প্রতি তার টান কমে আসে একসময়। সময় মতো সে বাড়ি ফেরে না। কারো সাথে সে ঠিকমতো কথা বলে না। যাও বা বাড়িতে আসে যা না তাই করে সে। সবার সাথেই উল্টা পাল্টা আচরন শুরু করে সে।

দু একবার গায়ে পর্যন্ত হাত তোলে জোহরার। এমন বিপরীত আচরণে ঘাবড়ে যায় জোহরা। প্রথম প্রথম সে কারণ ধরতে পারে না তারপর কাছের একজনের বুদ্ধিতে খোঁজ লাগায় সে, খোঁজ খবর করে জোহরা জানতে পারে যে তার স্বামী অন্য একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। মেয়েটি অল্প বয়সী এবং সুন্দরী, এই খবরে জোহরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। প্রথমে সে খবরটা ভুয়া ভেবে উড়িয়ে দিতে চায়। বিশ্বাসই করতে চায় না। কিন্তু তাতে করে সত্য বদলায় না।

প্রবল আত্মবিশ্বাসে জোহরার বারবার মনে হতে লাগলো কোথাও হয়তো তার ভুল হচ্ছে। স্ত্রী সন্তান অন্তপ্রাণ আসিফ এমনটা করতেই পারে না। কিন্তু দিনে দিনে যখন সব পরিষ্কার হয়ে আসে সেই ভুয়া খবরই সত্য বলে প্রকাশিত হয়, তখন সংসারের অশান্তি অন্য এক মাত্রা পায় অচিরেই। আর জোহরা খুব বেশি রকমের ভেঙে পড়ে।

আসলে এই সংসারটাই তার কাছে সব। এদিক ওদিক তার কোথাও আর যাওয়ার জায়গা নেই। কি হবে এখন? বাবা আছে কিন্তু সংসারে মা নেই। বাবা আবার বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। সেই সংসারে তার অন্য ছোট ছোট ভাই বোনগুলো অসহায় হয়ে টিকে আছে সে খবর তার কাছে অজানা নয়। এইরকম পরিবেশে তার দুসন্তান সহ তার ফিরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। পৃথিবীটা তার কাছে হঠাৎ অন্ধকার হয়ে আসে।

তার এমন দুরবস্থা দেখে শাশুড়ী যে খুব খুশি তা বোঝা যায় স্পষ্ট। তার মুচকি মুচকি হাসি, টিকা টিপ্পনী, বাস্তুচ্যুত হবার ভয়ে জোহরা সব হজম করতে লাগে চুপচাপ। কি বা করার আছে তার। দুটো ছেলে মেয়ে নিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতে তো সে পারবে না। লেখাপড়াও সেভাবে সে শেখেনি। শেখেনি বললে ভুল হবে। জোহরার লেখাপড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো। তার বরাবর শখ ছিলো লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করবে না কিছুতেই কিন্তু আসিফের মা পিছনে ফেউ হয়ে লেগে বিয়েটা করিয়েই ছাড়লো। আর চাহিদা ফুরাতেই তাকে এখন রাস্তার পথ দেখিয়ে দিতে দ্বিধা করছে না।

আসলে সুন্দর রুপ হচ্ছে অনেক সময় মেয়েদের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ায়। সেই ব্যাপারটা যে কতখানি সত্য তা এখন জোহরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে। তারপর অনেক ঝড় বয়ে গেলো তার জীবনে। শেষ আশ্রয় বলতে বাবার বাড়িতে ই তাকে উঠতে হলো একরকম বাধ্য হয়ে। কি বা করার ছিলো তার। এরকম কোন কঠিন পরিস্থিতিতে তাকে পড়তে হবে। সেটা সে কোনদিন কল্পনাও করতে পারেনি।

সেই সংসারে অজস্র অপমান হজম করে দিন অতিবাহিত হলো কিন্তু সুখের মুখ সে আর কোন দিনই দেখলো না। এর মধ্যে আরো বড় আঘাত এলো তার জীবনে। একমাত্র ছেলেটি তার স্কুলের ফিরতি পথে দূর্ঘটনায় মারা গেলো। সেই থেকে জোহরা বেগম আর হাসে না।

কারো সাথে আর তেমন কথাও বলে না। পৃথিবীর সবটুকু তার যেনো দেখা হয়ে গেছে। সে তো কবেই মরে যেতো শুধু মাত্র একমাত্র মেয়ে জরির জন্যই বেঁচে আছে জিন্দা লাশ হয়ে। সুখ সাধ স্বপ্ন আশা বলতে জরিই এখন সব। বাপের সংসারের ঠাঁই ও একসময় ফুরিয়ে এলো জোহরার। নিজের ভাই সৎভাই সবার যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। ভাগ্য ভালো ততদিনে জরি পড়াশোনা করতে করতে সরকারী প্রাইমারী ইস্কুলের একটা চাকরী জুটিয়ে ফেলল নিজের যোগ্যতায়।

এবং খুব শিঘ্রী তার একটা ভালো বিয়ে হয়ে গেলো। এর অবশ্য একটা কারণ আছে কারণ বাঙালি সমাজে বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো মেয়েদের খুব একটা ভালো বিয়ে হয় না। জরির হয়েছে।কারণ সে অতি রুপবতী একটা মেয়ে তার উপরে সুশিক্ষিত এবং চাকুরে।

জোহরার ও দিন ফিরে আসে। সে সরাসরি জরির কাছে না থাকলেও জরির বেতনের টাকায় কাছাকাছি এক ফ্লাটে এক রুম নিয়ে একা বাস করতে শুরু করে। জরি তাকে নিয়মিত দেখা শোনা করে হাজার কাজের ফাঁকে। যদিও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ব্যাপারটাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। তাতে জরির কিছুই যায় আসে না। মা ই তার কাছে সব। সে সারাজীবন দেখেছে মা তাদের জন্য কি পরিমান অপমান গঞ্জনা সহ্য করেছে, কিভাবে নিজের বাপের বাড়িতে দাসীর মতো খেটেছে সারা দিন রাত।

জোহরা জীবন এই পর্যায়ে এসে সব কিছু ভালোই চলছিলো একরকম।
জীবনে কারো পথই একেবারে মসৃণ নয় কখনোই। একথাটা জরি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানে। আর বউ এর মা কে কোন পরিবারই মেনে নেবে না সে যতই সোনার ডিম পাড়া রাঁজহাস হোক না কেন। সে কথা সে ভালো করেই জানে। তাতে সে তাদের দোষ ও দেখে না। তার স্বামীও নিপাট ভদ্রলোক। সে বেশ সুখী বলতে গেলে।

তবে আজকাল জরির মায়ের জন্য খুব চিন্তা হয়। চিন্তা যে শুধু মায়ের জন্য হয় তা কিন্তু নয়, সবার জন্যও হয়, এমনকি নিজের জন্যও। করেনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাব সারা বিশ্ব ব্যাপি। তার ঢেউ বাংলাদেশে ও এসে লেগেছে। কি যে হবে।

প্রথমে স্কুল কলেজ বন্ধ হলো তারপর অঘোষিত লকডাউন। নানা গুজব সত্য মিথ্যার ভেদাভেদ করা একরকম কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার বাংলাদেশে গত দুদিন কোন করোনা ভাইরাসের রুগি নেই। এটা কি করে সম্ভব সেটা কিছুতেই মেলাতে পারে না জরি, অন্য অনেকের মতো। এক্ষেত্রে মায়ের জন্য তার চিন্তাটা আরো বেশি প্রকট হয়। মা তো শ্বাসকষ্টের রোগী, মা কি পাবে তার সুচিকিৎসা যদি এসময়ে কোন উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। পত্রিকায় ,ফেসবুকে তো কত লোমহর্ষক খবর আসছে। পড়তেই তার গা হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। কোনটা গুজব কোনটা সত্যি কে জানে! কি আছে ভবিষ্যত তাই বা কে জানে। আল্লাহ যেন মাফ করে সেটাই সবার প্রার্থনা। একমাত্র ভবিষ্যতই ভালো বলতে পারবে সামনে কি আছে?

অন্য পৃথিবী

জামিলা বিবির খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায় তার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসছে। আগে অনেকটা সময় সে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে পারতো ইদানিং ক্ষুধা লাগলেই তার চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে আসে। মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে। আরো বেশি সময় গেলে কখনো কখনো গা হাত পা থরথরিয়ে কাঁপে। দিনে দিনে শরীরটা আরো বেশি ভেঙে পড়ছে সেটা সে নিজেই বুঝতে পারে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এটাই হয়তো নিয়তি।

সেই কবে কবে স্বামীটা মারা গেল। রিকশা চালাতো লোকটা। একটা একসিডেন্টের পর এক রকম ভুগে ভুগে ই মারা গেলো। সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। দু একটা ওষুধ সেখান থেকেই দিয়েছে ঠিকই কিন্তু বাকী গুলো খুব একটা জোগাড় করতে পারেনি তারা। তো রোগ সারবে কি করে। তখন থেকেই জামিলা বাসায় কাজ নিয়ে নিয়েছিলো। খাওয়াটা কোন রকম জুটতো, ওষুধ জোটেনি ঠিক মতো। সন্তান ছিলো না তাদের। লোকে বলতো আটকুঁড়ে। স্বামীর মৃত্যুর পর আস্তে আস্তে জামিলা বিবি ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার দেখায়নি কোনদিন। সে সুযোগই হয়নি।
দিন গড়িয়ে এক সময় ঝুপড়ি ছেড়ে রাস্তায় আশ্রয় নেয় সে বাধ্য হয়ে। কবে কবে যে এতো সব ঘটনা ঘটে গেলো জামিলা বিবি আর মনে করতে পারে না ইদানিং। আজকাল প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই মনে করতে পারে না।

বয়সের ভারে নুব্জ্য তার দেহ। আজকাল তার প্রায়ই মনে হয় মৃত্যু হলে বুঝি মুক্তি মিলবে।
সত্যি কি মুক্তি মিলবে?
কে জানে ?
গতকাল থেকে পথে লোকজন নেই বলতে গেলেই চলে। এই শহরে পিঁপড়ার চেয়ে লোক বেশি। কিন্তু অবাক কাণ্ড লোকজন হঠাৎ সব কোথায় গেলো? যুদ্ধ বাঁধলো নাকি ? লোকজন কি সব পালাইছে? সে কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারলো না। কোথাও তো কোন গুলি পটকার আওয়াজ নাই। কে জানে কি হয়েছে। কেউ জিজ্ঞেস করলে কোন উত্তর পায় না। যাকগে যাক তার অত দরকার নাই। একটু পেট ভরলে ভালো একটা ঘুম দিতো সে। গতরাতে ক্ষিদার জ্বালায় ঠিক মতো ঘুম আসেনি।

টুকটুক করে সে একটা গলির মধ্যে ঢুকলো, খাবারে সন্ধান করতে হবে। এত কষ্টের জীবন তবু তার আরো অনেক বছর বাঁচার শখ! বাঁচতে হলে খাদ্য চাই, এইটুকু জামিলা বিবি ভালো বোঝে। সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে যেতে মন চায় না কিছুতেই। এই সুন্দর পৃথিবীতে যে কত কিছু দেখার আছে!

বাড়িটা চারতলা। কলিংবেল গুলো সব নিচে গেটের কাছে সাজানো আছে। তবে একটু উঁচুতে, ঠাঁই নিতে একটু কষ্ট হলো তার। জামিলা বিবি অনেকবারের চেষ্টায় কলিং বেলের বাটনে চাপ দিলো। একবার দুইবার তিনবার…..
দোতলার ব্যালকনি দিয়ে মহা বিরক্ত হয়ে কেউ একজন ঝাঁঝালো গলায় জানতে চাইলো, এই কে?
-আমি গো মা ?
-কি চাও ?
-মাগো খুব ক্ষিদা পাইছে?
ওপাশ থেকে আরেকটি মুখ দেখা গেলো, এই লোকটি মনে হয় এই বাড়ির কর্তা। জামিলা বিবি বড্ড কাতর হয়ে বলল,
-আম্মাগো, বাপজান কিছু যদি খাইতে দিতা। খুব ক্ষিদা পাইছে।
-তোমার বাড়ি ঘর নেই? লক ডাউন চলছে তুমি জানো না।
-লক ডাউন? সেইটা আবার কি?
-যাও এখন বাসায় যাও না হলে কিন্তু পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে। লোকটি বলল।
-বাসা থাকলে কি আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম গো বাবা।
মেয়েটি তার স্বামীর উপরে একটু রেগে উঠলো,
-এই তুমি ভেতরে যাও তো, খামাখা ভয় দেখাচ্ছো, গরীব মানুষ আহারে। বয়স্ক তো, কাজ করতে পারে না।
লোকটি বলল,
-খাবার তো দেয়া যাবে না। কিসে দেবে?
জামিলা বিবি সব শুনে বলল,
-আমি খাওন শেষে গেলাস পেলেট সব মাইজা দিমু মা।
-না না অতটা রিস্ক নেয়া যাবেনা, তুমি টাকা নাও। খাবার কিনে খাও। এমনিতে করোনা ভাইরাসের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছি।
এবার মেয়েটি বলল, এক কাজ করি, জরির মা তো আসবে না আজকে, গতকালের খাবার গুলো শুধু নষ্ট হবে, ফ্রিজে তো আর জায়গা নেই যে ঢুকাবো, পলিথিনে করে ওকে কিছু খাবার দিয়ে দেই। জরির মা তো কোন কোন সময় এভাবেই খাবার নিয়ে যায়।

মেয়েটি অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কিছু খাবার নামিয়ে দিলো দড়ির মাধ্যমে, ঝুলন্ত প্যাকেটের ভিতরে। জামিলা বিবি আস্তে আস্তে খাবারটা বের করে নিলো। তারপর অনেক অনেক শুকরিয়া জানালো, মন ভরে আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করলো্ কিন্তু পরক্ষণে কিছু কথায় তার মনটা বেশ ভারী হয়ে গেলো। এই দুনিয়ার মানুষগুলো খুব একটা ভালো না। যাক সে যাক তার পেট ভরলেই হলো। কে কি বলে অত কি দরকার।

লোকটি মনে হয় বেশি সতর্ক সে বলল,
– এবার কি করবে প্যাকেটে তো হাত দিয়ে স্পর্শ করেছে। যদি ওর শরীরে করোনা ভাইরাস থেকে থাকে। মানা করে দিলেই তো হতো। তুমি না সব সময় বেশিবেশি। এই সব কি আমাদের দায়িত্ব? দেশে সরকার আছে তারা দেখুক, আমাদের এতো কি? তারপর কিছু একটা দিয়ে লোকটা দড়িটা কেটে দিলো প্যাকেট সহ, যেনো ওটা এখন করোনা ভাইরাসে পরিপূর্ণ।

জামিলা বিবি ওখানে বসেই দু পা ছড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। তার না আছে ভয় না আছে ডর। আসলে সে তো জানেই না করোনা ভাইরাস কি?

জয়নব এখন কোথায় যাবে?

জয়নবের স্বামী জয়নবকে ছেড়ে চলে গেছে আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগে। সেই সব দিনগুলোর কথা ভাবতেই এখনো গা শিউরে ওঠে তার। সে এক চরম ক্রান্তিকাল, হঠাৎ করে ছোট্ট ছোট্ট দুটো দুধের বাচ্চা নিয়ে নিষ্ঠুর পৃথিবীর মুখোমুখি হয় সে। সেইসব দিনগুলোর কথা জয়নব কোনদিনই ভুলতে পারবে না। যদিও সে ভুলতে চায় বারবার। কে আর দুঃখের দিনের কষ্টের দিনের কথা মনে রাখতে চায়।

তখনকার কথা ভাবলে এখনও গা মাথা ঝিমঝিম করে। কি কষ্টের সেইসব দিনগুলি যে কিভাবে পার করেছে তা একমাত্র আল্লাহই জানে। তখন দুনিয়াটাকে তার শুধু মনে হতে কবরের মতো আঁধার। যদিও সে কোনদিন কবরের কঠিন আঁধার দেখেনি তবে অমাবস্যার রাতে চোখ বন্ধ করে কবর কবর খেলা সে অনেকবার ই করেছে বড় ভাইজানের সাথে।

একা নয় সে সাথে দু দুটো বাচ্চা, না আছে আয়, না আছে রোজগার। ঘর ভাড়া, খাওয়া খরচসহ কত না খরচ কি দিয়ে সে কি করবে? কে তাকে কাজ দেবে? কে দেখবে এই দুধের শিশু দুটো। ছোট্ট দুটো দুধের শিশুর কান্নায় পরিবেশ আরো ভারি করে তুলতে লাগলো প্রতিটা মুহুর্ত। নিজে না হয় না খেয়ে থাকতে পারে কিন্তু এই বাচ্চাদের মুখের আহার সে কোথা থেকে জোগাড় করবে? কে তার সহায় হবে? কি যে কঠিন অবস্থা। কি করে আর বোঝাবে।কাকেই বা বোঝাবে? ভিক্ষা ছাড়া মনে হয় উপায় নাই। কিন্তু সামর্থ মানুষকে কি কেউ ভিক্ষা দেয়?

যদিও ততদিনে এই পোড়া শহরে তার অবস্থান বছর চারেক হয়ে এসেছে, তবুও পথ ঘাট কিছুই চেনে না সে। যে কটাদিন সে বাইরে কোথাও গেছে সাথে ছিলো তার স্বামী। সে কোন পথ ঘাট চেনার প্রয়োজনও বোধ করেনি। মজনু মিয়ার উপরে ছিলো তার অগাধ বিশ্বাস। শহরে আছে কি গ্রামে সেটা নিয়েও তার মাথা ব্যথা ছিলো না কোনো। ছোটবেলা থেকেই তার ছিলো ভাত কাপড়ের কষ্ট। এখন সেটা আর নাই এটুকুতেই সন্তুষ্টি তার। ঘর সামলাতে আর রান্নাবান্নাতে সময় কেটে গেছে নিরন্তর। অন্য কথা ভাববার সময় কোথায়। সেই সাথে ছিলো স্বামীর গভীর ভালোবাসা। সব ঝুপড়িতে মারপিটের আওয়াজ আসতো প্রতিদিন ই শুধু মজনু মিয়া তার গায়ে কোনদিন হাত তোলেনি। ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে অন্তর।

জয়নব খুব অল্প বয়সে প্রেমে পড়ে মজনু মিয়ার। গ্রামের স্কুলে যাবার পথেই দেখা হতো রোজ। মজনু মিয়া বরাবর ই কথার বেশ পটু। যাকে বলে চোখে মুখে কথা। খুব সহজে জয়নবকে ভুলিয়ে ভালিয়ে একদিন শহরে নিয়ে চলে আসে। বাপ বলতে বাপ ছিলো না আর মা তো সৎমা। অভাবের সংসারে তার কথা কেই বা ভাববে ? জয়নব চলে আসাতে বরং তারা খুশিই হয়েছে। একটা মুখতো কমলো। পথের কাঁটাও দুর হলো। বাস্তব সত্য বড় নির্মম।

প্রথমদিকে মজনু মিয়ার ব্যবহার তাকে এই ঝুপড়ির পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে বেশ খানিকটা সহায়তা করে। আসলে ভালোবাসা অন্যরকম জিনিস। ছোট বেলা থেকেই সৎমায়ের সংসারে ভালো মুখ সে কোনদিন পায়নি। বাবা তো আরেকজন। কোনদিন একটাকার লেবেনচুস ও কিনে দেয়নি। ভালোবাসা ভালোমুখ তো দুরের কথা। মজনু তাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিলো। এজন্য তো শত চেষ্টা করেও মজনু মিয়াকে এক ফোঁটা গালি দিতে পারে না সে।

ডাইনি রাবেয়ার জন্যই তো মজনু মিয়া বিবাগী হলো। ওর কথা মনে হলেই জয়নব আগে একপ্রস্থ গালি দিয়ে নেয়। কিছু অভিশাপও দিতে ভোলে না্। এছাড়া কি বা করার আছে তার। গালাগালি অবশ্য সে গ্রাম থেকে শিখে আসেনি, এখান থেকেই শিখেছে। যত রকমের গালাগালি খিস্তি খেউড় আছে, সব এই বস্তির লোক জানে। শেখা কোন ব্যপার না। প্রথম প্রথম এইসব গালাগালি শুনে সে দুই হাতে কান চেপে ধরতো। ছি ছি কি সব ভাষা! মানুষ এতো নোংরা কথা কিভাবে বলতে পারে! তারপর আস্তে আস্তে সব সহ্য হয়ে গেছে।

কিন্তু রাবেয়াকে নিয়ে যখন মজনু মিয়া দেশান্তরি হলো তখন আপনা আপনি এই সব খিস্তি খেউড় বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে। কোথেকে এলো জয়নব তা নিজেও জানে না। টানা কয়েকদিন সে মুখ চালালো অদৃশ্যের উদ্দেশ্যে। সে কি একটা অবস্থা! যে না দেখেছে সে বলতে পারবে না। সে সময় জয়নব ছিলো একটা ঘোরের মধ্যে। ভালো মন্দ ভেদাভেদ কোন কিছুই কাজ করতো না তার মাথায়।
এতে অবশ্য জয়নবের লাভই হয়েছে আর কিছু না হোক সে মনে খানিকটা শান্তি পেয়েছে। না হলে সে তো মরেই যেতো কষ্টে। মনের কষ্ট বেরিয়ে এসেছে মুখের ভাষায়। তা সে যতোই অশ্লীল হোক না কেন।

ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘর সারিবদ্ধভাবে পর পর। প্রত্যেক ঝুপড়িতে ছয় থেকে আটজনের সংসার। রান্না বাড়া সব ঝুপড়ির সামনে। গ্রামের মেয়ে সে, শহরের হালচাল তার কাছে বিচিত্র লাগে। এখানকার মানুষগুলো তার চাইতে ও বিচিত্র। আর কিছু না হোক খোলামেলা পরিবেশে সে মানুষ। এতো গাদা গাদি করে সে বাধ্য হয়ে ই থাকে। মজনু মিয়া কত আশার বানী তাকে শোনাতো। একটু ফোঁটা জমি কিনবে দুজনে। তাদের নিজের বাড়ি হবে। বাচ্চারা সাহেবদের ইস্কুলে পড়বে।
সব মিথ্যা! সব মিথ্যা করে দিয়ে মজনু মিয়া রাবেয়াকে নিয়ে কোন অজানায় হারিয়ে গেলো কে জানে? কি করে এতো সহজে ভুলে গেলো তাকে? কি করে পারলো? ভাবতেই চোখে হড়হড়িয়ে জল চলে আসে জয়নবের।
মজনু মিয়াকে সে কিছুতেই দোষ দিতে পারে না। আসল বেয়াদব তো ওই রাবেয়া। হারামজাদিরে কোন দিন যদি সে সামনে পায় তবে সে আগে ওর চুলের গোছা ধরে মনের মতো করে ঘুরিয়ে ছাড়বে। ছাড়বে ই। ভাবতে ভাবতে আরেক প্রস্থ সে গালি দিয়ে ওঠে।

ভালোবাসা সবসময় এমনই হয়, ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা সাময়িক বিলুপ্ত করে দেয়। জয়নবের চোখও সেই রকম অন্ধই ছিলো। মজনু মিয়ার ভালোবাসার আড়ালের শয়তানি সে ধরতে পারেনি। মজনু মিয়া তার সাথে কখনো বেইমানি করতে পারে। একথা অবশ্য এখনো বিশ্বাস করে না জয়নব। সব দোষ সে রাবেয়ার ই দেয়। আরে পুরুষ মানুষ তো একটু গা বাওয়া স্বভাবের ই হয়। তাই বলে তুই এতো প্রশ্রয় দিবি? কেন রে অভাগীর ঘরের অভাগী। দুনিয়ায় কি আর যুবক ছেলে চোখে পড়েনি। মজনু মিয়ারেই পড়লো।কার সুখের ঘর ভাঙতে হলো!

পৃথিবীটা যতটা নিষ্ঠুর মনে হয় আসলে ততটা সে নিষ্ঠুর বা অবিবেচক নয়। শুন্যস্থান বরাবরই পুরণ হয়ে আসে। যেমন দুখের পরে আসে সুখ। এক্ষেত্রে সুখ না হলেও স্বস্তি কিছুটা হলে ও এলো।

পাশের ঝুপড়ির রাহাতন। খুব ঝগড়াটে টাইপের মহিলা। কথায় কথায় দ্বন্দ ফ্যাসাদ তার লেগেই থাকে। বলা চলে বেশির ভাগ সময় সেই দ্বন্দ ফ্যাসাদের মুল কারণ হয়, যে কেউ তাকে তার আচরণে বিরক্ত হয়। অবশ্য সবাই তাকে ভয়ও পায় তার কিন্তু একটা মারাত্মক গুন ও আছে। যা অত্যন্ত মানবিক, যে তার মনের নাগাল পায় সেই বোঝে আসলে সে কেমন মানুষ।মনটা তার কত বড়। আসলে পোড় খাওয়া মানুষ বরাবরই একটা শক্ত গোছের হয়। কলহ প্রিয় হয় খানিকটা। অন্তত এই ধরনের বস্তির পরিবেশে এই টাইপের অনেক মানুষ নিত্য চোখে পড়ে। যারা অন্যের বিপদে জান প্রাণ দিয়ে দেয়।

সেই রাহাতন যেন ত্রাণ কর্তা হয়ে এলো জয়নবের জীবনে। জয়নব ও তার মাসুম বাচ্চার জন্য জীবন লড়িয়ে দিলো নিঃস্বার্থভাবে। যেনো আল্লাহর তরফ থেকে এলো কোন মহামানবী। জয়নব কোনদিনও ভুলবে রাহাতনের কথা। পুরো দুই মাস তিনজনের সংসারের ভার নিয়ে নিলো সে নিঃস্বার্থ ভাবে। তারপর কাজ খোঁজা, কাজে গেলে বাচ্চাদের দেখাশোনা করা। সব দায়িত্ব নিয়ে নিলো নিজ কাঁধে।
সেই থেকে জয়নব অল্প খায় অল্প পরে কিন্তু আল্লাহর রহমতে বেশ ভালো আছে।

মানুষ বেশির ভাগ সময় ভাবে এক, হয়ে যায় আরেক। দিন এনে দিন খেয়ে ভালোই চলে যাচ্ছিলো জয়নবের। বস্তির কিছু উঠতি পোলাপানের কিছু ঝামেলা বাদে অন্য কোন ঝামেলা ছিলো না তেমন একটা। রাহাতনের অবিরাম সমর্থন তার জীবনটা নিরবিচ্ছিন্ন ভালোই চলছিলো বলা যায়।
প্রতিদিন যেমন কাজে যায় তেমনই রাহাতনের কাছে ছেলে মেয়ে দুটোকে রেখে কাজে বের হলো জয়নব। এখান থেকে ফিরতে ফিরতে এগারোটা বেজে যাবে তার পর অন্য আরেকটা বাসা। তিনটা নাগাদ ফিরে আসে সে বাড়িতে প্রতিদিন সব কাজ শেষে। ছেলে মেয়ে দুটোও বেশ শান্ত ,এইটা কপালের জোর বলতে হবে, না হলে কি যে হতো আল্লাহ ই জানে।

ইদানিং রাস্তা ঘাটে বড্ড লোকজন কম দেখা যায়। জয়নব শুনেছে করোনা নামে কি একটা অসুখে নাকি মানুষ ঠুস ঠাস করে মরে যাচ্ছে। কে জানে আল্লাহ কি রোগ দিলো। রাহাতনের পরামর্শে কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলা শিখে নিয়েছে সে। গতকাল বস্তিতে কিছু লোক এসেছিলো তারাও অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে। সাবান মাস্ক এসব দিয়ে গেছে।

এতো সব কথা শুণে তার যে ভয় একেবারে করেনি তা কিন্তু নয়। কিন্তু ভয় পেয়ে বাড়ি বসে থাকলে তো আর তিন তিনটা পেট চলবে না। তাই সে নিয়ম মেনেই কাজেই বেরিয়েছে। মুখে থুতু এলেও তা গিলে ফেলছে। হাতে পরিষ্কার সুতি কাপড় রেখেছে। ট্যিসু কেনার টাকা তার নাই । মুখে সে একেবারে হাত দিচ্ছে না। ছোট দুটো বাচ্চার জন্য হলেও তাকে ভালো ভাবে বাঁচতে হবে।

এর মধ্যে কাছাকাছি পথ চলতি একজন জোরে হেঁচে উঠতেই সে বিরক্ত চোখে তাকালো। পাগলা ব্যাটারে মনে হয় এখনি দুই গালে দুই থাপ্পর মেরে দেই্। অনেক মানুষ আছে বোঝালেও কিছু বোঝে না। পাগল ছাগল একেকটা। বাচ্চা দুটোর জন্য ইদানিং তার খুব চিন্তা হয়। তার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে ওদের কি হবে?
বাসাটা চারতলাতে। জয়নব মনিভাবীর দেওয়া গতদিনের দুখানা ট্যিসুর একখানা দিয়ে তিন তলার কলিংবেল টেপে ধরে। অন্য ট্যিসুখানা সে গেট লক খোলার জন্য রেখে দেয়। অনেকক্ষন হয়ে গেলেও সাড়া শব্দ না পেয়ে একটু অবাক ই হয় জয়নব। তবে বেশ কিছুক্ষণ পরে অবশ্য দড়িতে চাবি ঝুলিয়ে দেয় মনি ভাবি। সবাই মনে হয় ঘুমাচ্ছিলো, কি করে যে এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমায় কে জানে?
সব নিয়ম মেনে জয়নব বাসায় প্রবেশ করতেই মনি ভাবী গম্ভীর মুখ দেখে সে একটু থমকে দাঁড়ায়। কি হলো আবার? সে প্রশ্ন করে..।
-কিছু হয়েছে ভাবি? মনটা খারাপ?
-না কিছু হয়নি? আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো জয়নব।
-কি বলেন ভাবী, একটা কেন, একশো কথা জিজ্ঞেস করেন? কি হয়েছে?
-এই কাজটা চলে গেলে কি তোর খুব সমস্যা হবে।
জয়নবের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো এসব সে কি শুনছে? আর কাজ চলে যাবে মানে কি? সে তো সর্বসাকুল্যে দুটো বাসাতে কাজ করে।

-হ্যাঁ ভাবী কাজ না করলে খাবো কি?
কিন্তু জয়নব আমি তো তোমাকে আর কাজে রাখতে পারছি না। করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে। তুমি হয়তো জানো। তার উপরে তুমি থাকো বস্তিতে। তোমার ভাই তোমাকে ছাড়িয়ে দিতে বলেছে। অবশ্য তোমার এই মাসের বেতনের পুরো টাকাটাই পাবে। আশা করি সমস্যা হবে না।
সব তো সিদ্ধান্ত মনি ভাবী নিয়েই নিয়েছে। এতে তার আর কিবা বলার থাকবে। আসলে গরীবের আল্লাহ ছাড়া কেউ নাই। তার খানিকটা ভয় করতে লাগলো। এবার বুঝি না খেয়েই মারা যেতে হবে। সামনে কি হবে কে জানে? আরেকটা বাসা আছে সেটাও হয়তো ছাড়তে হবে।তারপর?
অনেকেই গ্রামে ফিরে যাচ্ছে? সে কোথায় যাবে ? কোথায়?

একজন রিকশাওয়ালা

আজ কদিন ধরে বেশ ঠান্ডা লেগেছে। মৌসুমের এই সময়টা আমার ঠান্ডা জ্বর প্রবল রুপে দেখা দেয়। ভোরের আযানের সাথে সাথে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। প্রাতঃকৃত সেরে ওযু করতেই হাঁচি শুরু হয়ে গেলো। মারাত্মক অবস্থা,সেই সাথে নাক দিয়ে ঝরছে কাঁচা পানি। মধ্যে এই ঠান্ডার জ্বালাতন বেশ দমন ছিলো, ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন নাকে নাকি মাংস বেড়েছে, পলিপাস না কি একটা রোগ।

আমি দরিদ্র মানুষ সারা বছরই খেটে খাই। দিন আনি দিন খাওয়া যাকে বলে। থাকি বস্তির ঝুপড়ি ঘরে।পাঁচজনের সংসার এই বাজারে এক জনের আয়ে চালানো খুবই মুশকিল। সেই জন্য জামিলাবিবি স্বেচ্ছায় দুটো বাসা বাড়ির কাজ নিয়েছে। বাসা দুটো ভালো । মাসিক বেতন সহ রোজা সহ দুই ইদে প্রচুর সাহায্য সহযোগিতা পাওয়া যায়। জামিলা খুব ভালো মেয়ে।
মেয়ে বলা ভুল এখন সে বউ মানুষ। আমার মিষ্টি বউ। মাঝে মাঝে আমাদের রোমান্টিক সময়ে তাকে মিষ্টিরাণি বলেও ডাকি।
এত অভাব তবু তার কোন অভিযোগ নেই। হাসিমুখে সে সব সময় সংসার সামলায়। কখনো একটু অভিযোগ জানায় না।
নিয়মিত সে খুব ভোরে উঠে বাচ্চাদের কিছু সময় পড়িয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে
নাস্তাপানি রেডি করে স্কুলে পাঠায়। আমি অবশ্য তার আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই ।
সকাল সকাল না গেলে ভালো রিকশা হাতছাড়া হয়ে যায়। লক্কর ঝক্কর রিকশা টানতে জীবন শেষ হয়ে যায়, মটরের রিকশায় অবশ্য আরাম আছে। কিন্তু পৌরসভা থেকে মটরের রিকশা বেআইনি ঘোষনা করেছে।তাই জন্য ইদানিং কষ্ট বেশি করতে হচ্ছে।

বয়স হয়ে যাচ্ছে, পরিশ্রমের কাজে এখন সহজে হাফ ধরে যায়। কি আর করা এভাবেই কাটাতে হবে জীবন। তিন ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করে তুলতে হবে।
জামিলার খুব শখ ছেলে মেয়েগুলোকে লেখা পড়া শেখাবে। সে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছে। অভাবের জন্য তার আর পড়াশোনা করা হয়নি। তার নিজের শখটা সে ছেলেমেয়ের মাধ্যমে পূরণ করতে চায়। আমিও নিজের জীবন দিয়ে বুঝি পড়ালেখা ছাড়া গতি সত্যিই নাই। বাকী আল্লাহর ইচ্ছা।
মধ্যে একটা বছর সর্দি বেশ কম ছিলো। বলা যায় দমন ছিলো।আমি শুনেছি পলিপাস রোগ হোমিওপ্যাথিতে ভালো হয়। রোগ অবশ্য ভালো হয়নি কিন্তু দমন থাকলে শরীরে একটু আরাম পাওয়া যায়। কিন্তু টাকার অভাবে বেশ কটা দিন আর ওষুধ খাওয়া হয়নি। এখন কি একটা অবস্থা। রোগটা আবার ফিরে এসেছে।
আজ অবশ্য বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ। করোনা না কি একটা ভাইরাসের জন্য স্কুল বন্ধ। আমি ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। জামিলা বিবি ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক…….ঘুমন্ত জামিলা আর বাচ্চাদের মুখ দেখে মনটা শান্তিতে ভরে গেলো। ওদের জন্য ই তো এসব কষ্টকে কষ্ট মনে হয় না।
হাঁটতে হাঁটতে আমি রিকশা গ্যারেজে এসে পৌছলাম।
রহিম মিয়া আমার হাঁচি দেখে বললেন,
-কিগো মিয়া কি বাধাইলা। এতো হাঁচি দাও কেন?
-আবার সর্দি লেগেছে। কি যে জ্বালা। এই রোগ আমার যাবেনা।
-রিকশা নিবা নাকি?
-হ্যাঁ রিকশাতো লাগবেই।
-যেই হাঁচি মারতেছো। লোকে কি তোমার রিকশায় উঠবে?
-দেন দেখি? পেট তো আর বসে থাকবে না।
-দেখো জমা কিন্তু মাফ নাই। আমিও জানি জমা মাফ নাই।
আমি রাজি হয়ে বিসমিল্লাহ বলে রিকশা নিয়ে বের হলাম। আজ মনে হয় রাস্তা ঘাটে লোকজন কম। তবে আল্লাহর রহমতে প্রথমে একটা দুরপাল্লার যাত্রী পেয়ে গেলাম। শ’খানেক দেবে।
ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে পথ চললাম।
এর মধ্যে দু একবার হাঁচি দিতেই ভদ্রলোক বেশ কাঁচুমাচু করে তাকালেন।
আমি মাথা ঘুরিয়ে আশ্বস্ত করে বললাম, ভাইজান ভয় পাবেন না আমার নাকে পলিপাস, অন্য কিছু না, তাই এই হাঁচি।
ভদ্রলোক কোন কথাই বললেন না। হয়তো আলাপ বাড়াতে রাজি নয়।
রিকশা থেকে নামার আগে বললেন তুমি একটু ডাক্তারের কাছে যাও টেষ্ট করিয়ে নাও। তোমার লক্ষণ ভালো না। এখনই তুমি বাসায় ফিরে যাও। তোমার রাস্তায় থাকা ঠিক না। আমি কথা না বাড়িয়ে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম।
অনেকটা বেলা হয়ে গেছে। আজ রাস্তায় অনেক কম লোক চলাচল করছে। ভাড়া তেমন নাই। তার উপর হাঁচির জন্য তিন/চারটা প্যাসেঞ্জার হাত ছাড়া হয়ে গেলো। মনটা খুব খারাপ, রহিমচাচা ঠিকই বলেছেন এখনও জমার টাকাটা ঠিক মতো উঠেনি। গরীবের কেউ নাই।
গরীবের আছে শুধু দুঃখ আর কষ্ট।
আমি কিভাবে এই সন্দেহ দূর করবো তাই ভাবতে ভাবতে আবার রিকশা টানতে লাগলাম। এবার হাঁচি আসলেও চেপে গেলাম। তবুও প্যাসেঞ্জারের দেখা নাই। এই শহর তো এমন খাঁ খাঁ কোনদিনই করে না। কি এমন হলো? সত্যি কি দূর্যোগ আসছে। সবার মনটা খুব মনমরা। দুপুর রোদে শুধু বারবার চোখের সামনে জামিলাবিবি আর বাচ্চা তিনটার মুখ ভেসে উঠতে লাগলো।
আহা আমার যদি এখন কিছু হয়ে যায় তাহলে ওদের কি হবে?
মনে মনে শুধু বলতে লাগলাম. আল্লাহ তুমি রহমানের রহিম তুমি দুনিয়া থেকে এই করোনা ভাইরাস তুলে দাও। তুমি সব পারো আল্লাহ। তুমিই ভরসা।

সম্পর্কটা ভুল ছিলো [৪]

হঠাৎ করে নিজেকে কেমন যেনো বোকা বোকা লাগছে। ছোট বোন চারু বার বার উঁকি ঝুঁকি মারছে আমার ঘরে। আমার গতিবিধি লক্ষ করছে। হয়তো মায়ের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করতে নেমেছে। বিরক্তিকর। সুযোগ মতো পেয়ে আমি একবার চোখ কটমট করে তাকাতে ভয় পেয়ে চলে গেলো। আমি জানি সে মোটেও চলে যায়নি। শুধু একটু সাবধানী হয়েছে মাত্র। খুব চালাক প্রকৃতির মেয়ে সে।

আমাকে সে ঠিকই নজরে রাখবে। চারুর মাতৃভক্তি ও প্রবল। মায়ের কথা সে সবসময় অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তিন ভাই বোনের মধ্যে সে ই সবচেয়ে বেশি মায়ের ভক্ত।

মন টা আজ খুবই বিক্ষিপ্ত। সকাল থেকেই যা যা ঘটেছে তাতে করে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সকাল সকাল কার মুখ দেখে ঘুম ভেঙেছিলো কে জানে। দিনটাই আজ মাটি।

হঠাৎ করে মায়ের আচরণ আজকে এমন হয়ে গেলো কেন? কি এমন হয়েছে? বলা নেই কওয়া নেই দুম করে বিয়ের প্রস্তাবই বা জোগাড় করলো কোথা থেকে কে জানে? যতই ভালো প্রস্তাব হোক। ভালো করে জানা নেই শোনা নেই অমনি বিয়ে। ব্যপারটা কেমন যেন খাপ ছাড়া লাগলো আমার কাছে। মা অভাবের জ্বালায় সবকিছু নিয়ে বেশি টেনশন করে সেটা আমি জানি কিন্তু তার এই লোভী রূপ আমায় আহত করল। সমস্ত যুক্তি বোধ বুদ্ধি সব হারিয়ে ফেলেছে বলে আমার মনে হলো।

স্ত্রীর সম্পদে আমি কখনো ধনী হবার পক্ষপাতি নই। মনের মিল না হলে অধিক রুপবতী দিয়ে জীবন কাটানো যাবে কি? বিয়ে দুটি মানুষের সারাজীবনের ব্যপার। এতো তাড়াহুড়োর কি আছে?

মনের মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগলো অনবরত। সুলেখার কথা ভাবতেই মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠছে। সুলেখাও আমার সাথে এত বড় বেঈমানী কি করে করল। কি দরকার ছিলো এই ছলনার। আমি ঠিক করলাম সুলেখাকে ভুলে যাবো ।যত কষ্টই হোক না কেন, অন্তর জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায় যাক, আমায় সুলেখাকে ভূলে যেতে হবে। এক সাথে দুটো সম্পর্ক কখনো ই কারো মঙ্গল ডেকে আনবে না। সবদিক বাঁচাতে আমাকে বরং নতুন জীবনেই মানিয়ে নেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।নানা কথা ভাবতে ভাবতে একটু তন্দ্রা মত এসেছিলো।কাছের মসজিদে এশার আযান হচ্ছে।

ঠিক তখনই গাড়ীর হর্ণের বিকট আওয়াজে তন্দ্রা ছুটে গেলো। চারু এসে জানালো নতুন আত্নীয়রা চলে এসেছে। পোশাক পরে মা তৈরি হতে বলেছে। কিছুক্ষণ পরে এক ফাঁকে মাও এসে একটু সাজগোজ করার তাগাদা দিয়ে গেলো। মা আর বোনের ব্যস্ততা দেখে আমার হাসি পাচ্ছে। যেহেতু আমি ঘর অন্ধকার করে শুয়ে ছিলাম। উঠে আলো জ্বাললাম। মনের কষ্ট মনেই রাখতে হবে। সুলেখাকে ভূলে যেতে হবে। সুলেখার স্মৃতি ভুলে যেতে হবে। আমার ইচ্ছে না করলেও মায়ের কড়া হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার আপ্রাণ চেষ্ট করলাম। কিন্তু কেন যেন বার বার সুলেখার কথা, তার ছবি,তার হাসি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো। বুকের কষ্ট গুলো দলা হয়ে গলায় এসে জমা হলো। জগতের এই অবাঞ্ছিত রূপকে আমার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি মা আবারও ফিরে এলেন,
-ঘরের মধ্যে এখনো কি করছিস। তৈরি হয়ে নে।
-মা এতো ব্যস্ত হবার কি আছে? একটু সময় নাও।
-না সময় নেওয়া যাবে না। সুমিতার মামা বিদেশ থেকে এসছেন উনি ব্যস্ত মানুষ। উনার ব্যস্ততা আছে, উনি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যাবেন। তিনি চান যাবার আগে বিয়েটা হয়ে যাক। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।ওনারা অপেক্ষা করছে।
-সব তো সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছো, এখানে আমার আর কি দরকার?
-বেশি বুঝতে চেষ্টা করো না। সব তোমার ভালোর জন্য করা হচ্ছে। বাড়ি ভর্তি লোকজন আমি চাইনা তুমি এতো লোকের মধ্যে কোন নাটক করো।
-ঠিক আছে মা তুমি নিশ্চিত থাকো আমি কোন কিছু করবো না। প্রমিজ। দয়া করে এখন বিরক্ত করো না।
-মা চলে গেলেন। যাবার আগে যথারীতি তাড়া দিয়ে গেলেন।

মা যখন আমার কোন কথাই শুনবে না বলে ঠিক করেছে তখন সেই কথা ভাবতেই আমার মনের মধ্যে এক তীব্র অভিমান জমা হলো। বড় আপা নিজের ইচ্ছায় বাড়ি ছাড়লো অজানা অচেনা ছেলের হাত ধরে। আমাদের কথা একটুও ভাবলো না। নিজেরটাই শুধু ভাবলো। মা বাবা দুজনের মনেই এর জন্য কষ্ট সহ অপমান বোধের এক গভীর ক্ষত এখনো জ্বলজ্বল করছে। আমি ঠিক করলাম আমি আর তাদের দুঃখের কারণ হবো না। আজ আর নিজের কথা ভাববো না। জীবনে যা হবার হবে।

সুলেখাও ছলনার আশ্রয় নিয়ে, নিজের অবস্থান গোপন করে, আমাকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে চরম কষ্ট দিয়েছে। নারী জাতির প্রতি মনটা কেমন যেন বিষিয়ে উঠলো্। যদিও এটা ঠিক না একজনের দোষে সমগ্র নারী জাতিকে দোষী ভাবা ঠিক না। তবুও মনের আকাশে কত কথাই না ভেসে বেড়াতে লাগলো। সুমিতাও কি এমন হবে? শুধু নিজের কথাই ভাববে ? কি হবে বিয়ে করে শুধু দুখ কষ্টের মধ্যে নিজেকে টেনে নিয়ে আমি বুঝতে পারছি মা এসে বকবে আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
তবু আবারো ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে সুলেখার চিন্তা এলো। এমন কেন হচ্ছে বুঝতে পারছিনা। যাকে আমি ভুলতে চাচ্ছি সে কেন বারবার আমার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে?

আচ্ছা বিবাহিতা মেয়েদের দেখলে তো খানিকটা চেনা যায়। সুলেখার মধ্যে তো তেমন কোন চিহ্ণ দেখা যায়নি। গিয়েছে কি? আমার চোখে তো পড়েনি। নাকি প্রেমে আমি অন্ধ হয়ে গেছিলাম। আমি কি বোকা!
আমি তো ততটা বোকা নই, সুলেখার কোন সাজ-পোষাকে দৈহিক আচরণে তাকে বিবাহিতা মনে হয়নি। নাকি হয়েছে। সুলেখা যদি বিবাহিতা হয় তাহলে আমার প্রথম প্রেম পরকীয়ায় কলঙ্কিত হয়েছে।
ছিঃ! সুলেখা ছিঃ! আমার সাথে এমনটা কিভাবে করতে পারলো। এই নষ্ট কলঙ্কিত মেয়েটাকে আমার জীবনের ডায়েরি থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। ফেলতেই হবে।

তাছাড়া একজনের সংসার ভাঙার অধিকার আমার নেই আমি মনে মনে ঠিক করলাম সুলেখার সাথে আর দেখা বা যোগাযোগ কিছুই করবো না। সে থাকুক তার মতো। যদিও এই সিদ্ধান্ত নিতে আমার বুকটা হু হু করে উঠলো তবু আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। আমি অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর সুলেখার সাথে কোন ক্রমেই যোগাযোগ করবো না।

পরের সপ্তাহে আমার বিয়েটা হয়ে গেলো। বেশি ধুমধাম নয়, সামান্য কিছু আয়োজনে। আত্মীয় স্বজন সকলে ধন্য ধন্য করতে লাগলো আমার বউকে দেখে। সারা দুপুর বিকেল সুমিতা আমার সাথে থাকলেও কথা বলার সুযোগ খুব একটা হলো না। তবে তাকে আচার আচরণে খারাপ মনে হলো না। প্রথম দেখায় যে কেউ সুমিতাকে খুব পছন্দ করবে। নিপাট নিরীহ দেখতে একটা মেয়ে সুমিতা। রূপে তেমন আহামরি না হলেও কথাবার্তায় বাচনভঙ্গীতে অত্যন্ত সাবলীল। অনেক সহজে সে যে কারো সাথে মিশে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। নববধুরা খুব একটা কথা বলে না কিন্তু সুমিতা বেশ কথা বলছে। সুযোগ বুঝে দুএকবার সে আমাকে খোঁচা ও মেরেছে। আমি খনিকটা অবাক।

একটু রাত হতেই মা বললেন, বাবু যা ঘরে যা ঘুমিয়ে পড় গে যা। অন্যদিন হলে কিছু মনে করতাম না কিন্তু আজ বেশ লজ্জা লজ্জা লাগলো। চারু মিচমিচ করে হাসতেই আমি চোখ পাকালাম কিন্তু তাতে সে একটুও ভয় পেলো বলে মনে হলো না। খিলখিল করে হাসতে লাগলো। আমি একরকম পালিয়ে ঘরে চলে এলাম।
ঘরে ঢুকতেই সুমিতা বলল, এতো দেরী হলো যে আমি তো কতক্ষণ হলো অপেক্ষা করছি। কি করছিলে।
-না মানে গেস্ট ছিলো তো তাই ।
– ও এখন বুঝি ঘুম পেয়েছে তা্ই এসছেন? তাই তো?
-আমি এতো সকালে ঘুমাইনা।
-ও ভালো। আমিও সকাল সকাল ঘুমাইনা। যাক গল্প করা যাবে। বসুন।
এ মেয়েটি দেখছি অনেক বেশি ফটফটিয়া। নতুন বউ এত চোখে মুখে কথা বলতে পারে জানা ছিলো না। আমি বললাম,
-তোমায় কিন্তু দেখতে বেশ।
-বাহ এত ভালো করে কখন দেখলেন। আচ্ছা আপনার নাম অলক, তাই তো? অলক মানে কি?
-অলক মানে কুঞ্চিত চুল। তোমাকে বেশ লক্ষী টাইপ দেখতে!
-অতি ভক্তি কিন্তু চোরের লক্ষণ।
-আচ্ছা তুমি তো বেশ চটপটে একটা মেয়ে প্রেম ট্রেম করোনি? লাভ ম্যরেজ না করে এরেন্জ ম্যরেজ করলে যে?
-আপনিও তো লাভ ম্যারেজ না করে ……. যা হোক রাতে পানি টানি খেলে ওই ওখানে রাখা আছে।
-আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম না কিন্তু?
-ছেলে দেখলে ভয় লাগে তাই প্রেম ট্রেম করিনি।
-তুমি …ছেলে দেখলে ভয়?! আমায় দেখেও কি ভয় লাগছে?
-জানি না বুঝতে পারছি না। তবে খুব লজ্জা লাগছে।
-তোমার কথাবার্তায় কিন্তু সেরকম মনে হচ্ছেনা। যাক লজ্জা পাওয়া ভালো। ভয় পেলে সমস্যা।
-কি রকম?
-এই যেমন তোমায় একটু ছুঁয়ে দিলাম যদি ভয় পাও তাহলে তো চেঁচাবে। চেঁচালে মান সম্মান আর থাকবে?
-আমি মোটেও ওরকম হ্যাবলা ভ্যাবলা টাইপ মেয়ে না।
-আমি কি তোমায় একটু স্পর্শ করতে পারি।
-আপনার কি আমায় খুব স্পর্শ করতে ইচ্ছা করছে।
-এ আবার কেমন কথা ? করছেই তো।
-তাহলে বাতি নিভিয়ে দিয়ে আসুন, এসে আমায় স্পর্শ করুন।
আমি বাতি নিভিয়ে দিলাম। ঝুম অন্ধকার। ঘরটা আমার পরিচিত কিন্তু সুমিতা কে কোথাও দেখছি না মানে ওর সাড়া শব্দ পাচ্ছি না।
-সুমিতা তুমি কোথায়?
হালকা হাসির শব্দ এলো।
-কি হলো?
-আমার একটা প্রশ্ন ছিলো?
-কি প্রশ্ন?
-আচ্ছা সুলেখাকে বিয়ে করলে না কেন?
হঠাৎ আমি থমকে গেলাম, মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো, তুমি কি সুলেখাকে চেনো? কিভাবে?
হঠাৎ সব কেমন যেন চুপচাপ। কোন আওয়াজ নেই কিছুক্ষন পরে সুমিতা গম্ভীর হয়ে বলল,
-রাত অনেক হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ো। আমার ঘুম পাচ্ছে।
মনটা হঠাৎ ভার হয়ে গেলো। কি বলবো বুঝতে পারছি না। একটু বিব্রত ও লজ্জিত ও হলাম কিন্তু আরো অবাক হলাম ভেবে এই মেয়েটি সুলেখার কথা জানলো কি করে। আমাদের প্রেম তো এত ফাটাফাটি টাইপের না যে লোক জানা জানি হয়ে অন্যরকম অবস্থা। আর এসব জানার পরও এই মেয়ে তবে আমাকে বিয়েতে রাজী হলো কেন? না করে দিতেই পারতো। আবার জানলেও চেপে যেতে পারতো। অন্তত আজ এসব কথা কি তোলা খুবই জরূরী ছিলো? কি চায় মেয়েটি? সুমিতার আচরণ গুলো কেমন যেন সন্দেহ লাগলো আমার কাছে…….

সম্পর্কটা ভুল ছিলো [৩]

মা হঠাৎ করে এমন একটা প্রস্তাব দেবে আমার কল্পনাতেও ছিলো না। মায়ের প্রস্তাবের উত্তরে কি বলবো কি করবো আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। আর মায়ের কথার অবাধ্য ও আমি কখনো হইনি। মায়ের অগোচরে ও আমি কখনো কিছু করিনি। যা বাকি ছিলো বলার সেটাও আমি বলে দিয়েছি এখন। বলে দিয়েছি যে আমি সুলেখাকে ভালোবাসি।

ঘটনার আকষ্মিকতায় আমি হতবিহ্বল। এতো রকমের মজার মজার খাবার, তবু গলা দিয়ে একটু খাবার নামলো না। কথাও যেন হারিয়ে গেলো মুখ থেকে। পুরো পৃথিবীটা যেন দুলে উঠলো হঠাৎ করেই। মনের মধ্যে থাকা স্বপ্ন গুলো ভেঙে গেলো টুকরো টুকরো হয়ে। আরো আঘাত পেলাম আমার অবাধ্যতায় মা বিষ খাবে জেনে।

বরাবরই আমার মা খুব বেশি পরিমান জেদী। আমি জানি কথার নড়চড় হলে তিনি সত্যি সত্যি একটা কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন। মা যে এমন কথা বলতে পারেন আমি অবশ্য কোনদিন কল্পনাও করতে পারিনি। নানা চিন্তায় মাথা ধরে গেল মুহুর্তে। মায়ের ডাকে আবার সংবিত্ ফিরে পেলাম।
-কি হলো, কি চলছে মনের মধ্যে,কি এত ছাইপাশ ভাবছিস?
আমি মাথা নাড়লাম।
-ওসব উলটা পালটা মেয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। ওসব মেয়েদের আমি খুব চিনি। সব খোঁজ খবর আছে আমার কাছে। তোর জন্য যার কথা ভেবেছি সে অতি রুপসী গুণবতী। একসাথে রাজকন্যা ও রাজত্ব সব পাবে। সারাজীবন রাজার হালে থাকতে পারবে।
-মা,আমার রুপসী গুণবতী মেয়ে চাই না। রাজকন্যা ও রাজত্ব ও চাই না।
-এখন তুমি মোহে আছো। আমার কথা এখন তেতো লাগছে। মোহ দিয়ে জীবন চলে না। সুযোগ সবসময় আসে না। আর যেনো আমি তোর ভালোই চাই। আর শোন কি চাই আর কি চাইনা সে আমি বুঝবো।
অনেক কষ্ট করেছি সারা জীবন এবার একটু সুখের মুখ দেখতে চাই্। উলটা পালটা কিছু করলে তোর খবর আছে এই বলে দিলাম। আমি কিন্তু আবারো বলছি, বিষের বোতল কিন্তু আমার কাছেই আছে।
বার বার এক কথা শুনে আমার অস্বস্তি ও বিরক্তি দুটোই আরো বেড়ে গেলো। মাকে কেমন জানি লোভী মনে হলো। অভাব হয়তো মানুষকে বদলে দেয়। নাকি এসবই বাস্তবতা!
আমি অস্ফুষ্ট স্বরে বললাম,
-মা তুমি চুপ করো। আমার এসব শুনতে ভালো লাগছে না।
-কেন ? চুপ করবো কেন? আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?
আমার আর ভালো লাগছিলো না। আমি খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলেই ফেললাম
-ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে। এবার একটু থামো। এসব অশান্তি আমার আর ভালো লাগছে না।
-সন্ধ্যাবেলা বাড়ি থাকবি। লোকজন আসবে।
কেন ভালো কিছু কোন সময়ই আমার সাথে হয়না ? বুকের মধ্যে কেমন যেন খাঁ খাঁ করতে লাগলো। চোখ ফেটে পানি আসতে লাগলো। সুলেখাকে যে আমি কথা দিয়েছি তার দুঃখ কষ্টে আমি সবসময় তার পাশে থাকবো। কখনো তার হাত ছাড়বো না্। কখনো না। সব কি তবে মিথ্যে হয়ে যাবে। হায় হায় আমি তো মিথ্যাবাদী হয়ে যাবো সুলেখার কাছে। কি ভাববে মেয়েটা? এত দুঃখী! ওর দুঃখগুলো কে ঘুচাবে? এই দুঃখী মেয়েটার সাথে আমি পথ চলতে চেয়েছিলাম। সারাজীবনের সঙ্আগী হতে চেয়েছিলাম। আমি পাশে না থাকলে, ও তো কচুরিপানার মতো ভেসে যাবে।
বিকালে একটু বের হলাম।মায়ের বারণ সত্তেও বের হলাম। সুলেখা আসবে। মা কি বুঝলো কে জানে গজগজ করতে লাগলো।

সঠিক সময়ে সুলেখা এলো। অন্যদিন সুলেখার চোখ মুখ সদা ঝলমল করে ওঠে আমায় দেখে। আমার সাথে সঙ্গটা সে উপভোগ করে তবে আজ তার চোখ মুখ কেমন যেন ম্লান দেখাচ্ছে। দূর থেকে দেখেই বুঝতে পারলাম। অনেক কান্নাকাটি করেছে সে। কি হয়েছে সুলেখার? তার সৎ বাবা তাকে কিছু বলেছে? বা অন্য কেউ?
প্রথমেই জানতে চাইলাম এত বিষণ্ন কেন দেখাচ্ছে তাকে? কি হয়েছে তার?
চুপ করে রইলো সে। অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো সে। আমার হাতটা ধরে অনেকক্ষণ বসে রইলো চুপচাপ। তারপর তাকালো আমার দিকে। কি যে অসহায় দৃষ্টি আমি উতলা হয়ে জানতে চাইলাম
-কি হয়েছে সুলেখা কোন সমস্যা? কথা বলছো না কেন?
সুলেখা কোন কথা বলল না আবারো চুপচাপ। কোন কোন নীরবতা ভয়ঙ্কর উদ্বেগ তেরী করে। ধৈর্যের বাঁধকে ভেঙে ফেলে। কোথায় আমি আমার সমস্যার কথা বলতে এসেছি আর এখনতো দেখি সুলেখার এ অবস্থা। উফ! ভয়ঙ্কর সমস্যার আবর্তে জড়িয়ে যাচ্ছে যেন আমার এ জীবন। কঠিন সময় আসছে সেটা খানিকটা হলেও উপলব্ধি করলাম।
যা হোক সুলেখা যখন বলবেনা তখন আমি শুরু করলাম আমার সমস্যার কথা। আমি জানালাম আমার দম বন্ধ করা পরিস্থিতির কথা। অনেকক্ষণ আমরা চুপচাপ হাত ধরা ধরি করে বসে রইলাম। এবার হয়তো সুলেখা কিছু বলবে কিন্তু না সুলেখা চুপ করে রইলো কিছুই বলল না। কেন যেনো সুলেখা কিছু বলতে চা্ইলো না। বিকেল ফুরিয়ে আসছে বাড়ি ফিরতে হবে। আসার সময় সুলেখা খুব কান্নাকাটি শুরু করলো আমি তাকে অনেক করে বোঝালাম বললাম, আরে বাবা এখনই এতো ভেঙে পড়ছো কেন? এখনো অনেক সময় আছে কথাবার্তা প্রাথমিক পর্যায়ে তুমি খালি খালি চিন্তা করছো। দেখবে ঠিক ব্যপারটা আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো। তোমার কি হয়েছে তাই বলো।
এবার সুলেখা আমার হাতটা টেনে ধরে বসালো, বলল,
-তোমাকে বলা হয়নি এমন কিছু কথা আজ তোমাকে বলবো বলেই এসেছি। কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা।
-কি কথা? যা আমি জানি না। কি বলবে? আমি সুলেখার চোখে চোখ রাখলাম।
সুলেখা হঠাৎ স্পষ্ট উচ্চারণে বলল,
-আমি তোমার সাথে মিথ্যা বলেছি ।
-কি মিথ্যা বলেছো?
-তুমি আমায় ক্ষমা করো।
-আগে বলো তুমি কি মিথ্যা বলেছো?
-না থাক তুমি আঘাত পাবে।
-আমি আঘাত পাবোনা তুমি বলো। বলো তুমি তোমার কি হয়েছে?
সুলেখা চোখ বন্ধ করে ফেলল তারপর ঢোক গিলে কোন রকমে বলল,
-আমি…..আমি বিবাহিতা !!!!!!! আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছি। সত্য গোপন করেছি।
নিজের কান কে যেন বিশ্বাস করতে পারলাম না। এসব কি হচ্ছে আমার সাথে ?

সম্পর্কটা ভুল ছিলো [২]

অনুপমা যখন হাঁক ডাক করে অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি ছিলাম স্বপ্নের ঘোরে। সেই স্বপ্নের ঘোরে আমি যেন ফিরে পেলাম আমার হারানো অতীত। যাকে আমি সযতনে পাথর চাপা দিয়ে রেখেছি দীর্ঘ অনেকগুলো বছর। যাকে আমি ভুলতে চেয়েছিলাম অনেক যত্ন করে। মাঝে মাঝে কোন কোন স্মৃতি ফিরে এলে বিব্রত হতে হয়, হৃদয় আহত হয়। আমিও তেমনি আহত হলাম আবারো। কিন্তু অতীতকে কি করে অস্বীকার করবো?
সাল তারিখ কত ছিল ঠিকঠাক মনে নেই এই মুহুর্তে, তবে ঘটনাগুলো একে একে মনে পড়ে গেলো স্পষ্ট। যেন কোন চলচ্চিত্রের ভাসমান চিত্রকথা।

আমাদের পরিবারটি ছিলো গতানুগতিক মধ্যবিত্ত পরিবার। যা উপার্জন তার বেশি ব্যয়। বাবার ছিলো প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি। বেতন যা পান তাতে সংসার চলে না। মায়ের নিত্য ঘ্যানঘ্যান ,ঝগড়া ঝাটি চলতেই থাকে। নানান অশান্তিতে নিমজ্জিত পরিবার। মাঝে মাঝে মনে হয় এই পরিবার থেকে দূরে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। তবে কখনোই চলে যাওয়া হয় না অবশ্য। কি এক অদৃশ্য টানে দিন শেষে ফিরে আসতাম বার বার।

বড় দুই বোনের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আমার লেখাপড়ার খরচ। বোনেদেরও লেখা পড়ার খরচ আছে। মায়ের ওষুধ বাবার চোখের চিকিৎসা খরচ। সাথে সংসারের খরচ তো আছেই। কি এক তালগোল অবস্থা। নুন আনতে পানতা ফুরায় আরকি।

তখন আমি বিয়ে অনার্সএ পড়ি। পড়াশোনার ফাঁকে কটা টিউশনি করি। এই সল্প টাকা থেকে আবার মাকে কিছু টাকা দেই আর নিজের বাজে খরচের জন্য রাখি বাকি টাকা। সেখান থেকে বোনেরা আবার কিছু ভাগ বসায়। আমিও না দিয়ে পারি না। হাজার হলেও বোন, ওদেরও চাওয়া পাওয়ার জগতটা অত্যন্ত সীমিত। অল্পতে খুশী থাকে সবসময়। খুব লক্ষী টাইপের মেয়ে। কিছু চাইলে আমি না করি না একটু আবদার মেটাই। অভাবের সংসারে তাদের কোন বায়না বা আবদার কোন দিনই পূরণ হয় না তেমন একটা।

এসবের মধ্যে মা প্রায় ঘ্যান ঘ্যান করে, একটা চাকরি বাকরি জুটাতে পারি কিনা। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করাটা আমার জন্য জরুরী। মাকে সেটা বোঝালে ও মানতে চান না কিছুতেই। সংসারের হাল ধরতে তাগাদা দেন বারবার। অনুযোগের সুরে বলেন বাবার সাথে ঝগড়াঝাটি করতে করতে তিনিও ক্লান্ত, তিনি আর পারছেন না। আমার অনেক দায় দায়িত্ব আছে। বোনেদের বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে। আমার উচিত সংসারের হাল ধরা ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি শুনি আর অসহায় বোধ করি। দুচোখে অন্ধকার দেখি। মানুষের জীবনটা এতো কঠিন কেন? কেন এতো অভাব। এসব ভেবে ভেবে মাঝে মাঝে মাথা ধরে যায়। কুল ও পাই না সমাধান ও পাই না। অতিরিক্ত চিন্তায় পড়াশোনায় মন বসানো দায় যেতে লাগলো।

যাহোক নানা ঝামেলার মধ্যেও আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। পরীক্ষাটাও মোটামুটি ভালো দিলাম। কিছুটা অবসর সময় এলো আমার জীবনে এবং হঠাৎ করে আশ্চর্য সুন্দর এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লাম।

মেয়েটির নাম সুলেখা। একদিন পার্কে বসে আছে একা একা সে। কেন বসে আছে তা অবশ্য জানিনা, কিন্তু কিছু উটকো ছেলে বিভিন্ন কমেন্ট করছে তাকে নিয়ে। সেটি আমার নজর এড়ালো না। মেয়েটি বেশ ভয় পাচ্ছে বোঝা গেলো। সময়টা যদিও বিকেল। আমি কি মনে করে এগিয়ে গেলাম। জানতে চাইলাম কেমন আছেন? এমনটা কেন করলাম নিজেই জানিনা। যদিও মেয়েটির আমার পূর্ব পরিচিত নয় তবু কেন যেন সানন্দে সাড়া দিলো পাশে বসতে আহ্বান করলো। উটকো ছেলেগুলো কেটে পড়লো শিঘ্রী। আমি চলে আসতে উদ্যত হলে মেয়েটি বললো চলে যাচ্ছেন যে বসুন। আজ আপনি আমার অনেক উপকার করলেন। সেই শুরু…..।

ইদানিং নিজের কাজ হয়ে গেলেও আমি কখনোই ঠিক সময়ে বাসায় যাই না। এদিক ওদিক থাকি। বিশেষ করে বাসার কাছাকাছি পার্কটাতে বসে সময় কাটাই না হয় গল্পের বই পড়ি। মায়ের ঘ্যান ঘ্যান অসহ্য মাত্রায় বেড়েছে।

সুলেখাও ও আমার মতো অভাবী পরিবারের। সৎবাবার সংসারে থাকে। অনেকগুলো ভাইবোন। বাবার বাজে ব্যবহার। তার নানা কষ্টের কাহিনী আমি শুনি আর আপ্লুত হই তার দুঃখ কষ্টে। আস্তে আস্তে তার প্রতি এক গভীর মমতা অনুভব করতে লাগলাম। তাকে না দেখলে। কথা না বললে মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা অনুভব করলাম। তাকে নিয়ে নানা দুঃচিন্তা হতে লাগলো। তাকে ছাড়া অন্য সময়গুলোতে কিছু ভালো লাগতো না। কেন এমন হতো কে জানে? একে কি প্রেম বলে?

আমার মধ্যে উলটাপালটা কি জানি কি দেখলো জানি না। মায়ের ঘ্যান ঘ্যান আরো বেড়ে গেলো। বাসার পরিবেশ ক্রমশ আরো অসহ্য হয়ে উঠলো। আমাদের অবাক করে দিয়ে এর মধ্যে বড় বোন অজানা অচেনা এক ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেল। পাড়া প্রতিবেশিরা আমাদের প্রায় এক ঘরে করে দিলো। নানা কথা শোনাতে লাগলো উঠতে বসতে।নরকের মতো পরিবেশ তৈরি হলো বাসায়।

তারপরেও ভালোই চলছিলো একরকম যদিও মায়ের কানে আমার প্রেমের কথা পৌছে গেছে ইতিমধ্যে কিন্তু আমি ডোন্ট কেয়ার টাইপের ভাব দেখাই। এত সাহস কোথায় পেলাম জানিনা। সবকিছু সরাসরি অস্বীকার করি। আমি খুব খেয়াল করে দেখেছি আমার কপালে কোন সুখ স্থায়ী হয় না। কোন ভালো আমার জীবনে থাকে না। পোড়া কপাল আর যাকে বলে।

এবারও আমার এই ছোট্ট সুখটুকু স্থায়ী হলো না। এক সকালে সুলেখা জানালো তার বিয়ে ঠিক করেছে তার সৎবাবা। পাত্র বেশ বড় ব্যবসায়ী। আমি তো চিন্তায় পড়ে গেলাম। পালিয়ে বিয়ে করবো সে সাহস বা যোগ্যতা আমার নাই। আবার বাড়িতে এসেও দেখলাম আরেকটি দুঃসংবাদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম।

দুপুরে ভাত খেতে বসেছি যথারীতি মা খাবার বেড়ে দিতে লাগলেন। আমি মুখ বুজে প্রতিদিনকার মতো খাচ্ছি কারণ মায়ের সাথে ইদানিং আমার সম্পর্ক ভালো না। তাই আমি মায়ের সাথে খুব প্রয়োজন ছাড়া কথা বলি না। মা ই একতরফা ঘ্যান ঘ্যান করেন। আমি আগে মুখ চালালেও এখন আর কোন উত্তর দেই না খানিকটা গা সওয়া হয়ে গেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো মা আজ আর কোন ঘ্যান ঘ্যান করছে না। খুবই মিষ্টি স্বরে কথা বলছেন। আরো অবাক হয়ে দেখলাম আমার প্রিয় সব তরকারী রান্না হয়েছে। মায়ের মন ভালো দেখে আমি সাহস করে বললাম,বাসায় কি কেউ আসবে?

– না কেন?
-এতো রকম রেধেছো?
-বাহ আমি কি তোর জন্য একটু ভালো কিছু রাঁধতে পারিনা! আমি এতোই খারাপ।
-সে কথা বলছি না মা। অনেকগুলো টাকা খরচ করলে তো তাই মাসের শেষ।
-আজ তোর জন্মদিন। মনে আছে?
-ও তাই বুঝি এতো আয়োজন।
-তোরা মনে করিস আমি তোদের কোন খেয়াল খবর রাখিনা। তোদের প্রতি আমার কোন দায় দায়িত্ব নাই। আমি তোদের দেখতে পারিনা। সেই একজন তো কার না কার হাত ধরে কেটে উঠলো, একবারো আমদের কথা ভাবলো না। আমাদের সম্মানের কথা ভাবলো না। মানুষ এখন যা নয় তাই বলাবলি করে। আমার আর ভালো লাগে না। এই সংসার আমার কাছে বিষের মতো। শুধু অভাব আর অভাব। তোর কবে যে একটা চাকরি হবে সেদিন যদি একটু অভাবটা কমে। মায়ের চোখ ভিজে আসে। মায়ের কথায় আমার ও মনটা হু হু করে ওঠে।

– আমি চেষ্টা করছি মা।
-খোকা, আমি বলি কি আমার একটা কথা ছিলো। তুই যদি আমার একটা কথা মানিস।
-কি কথা?
-আমি তো সব বুঝি তোর একটা চাকরি দরকার। বিয়ের বয়সও হয়ে গেছে। ঘরে এখনো একটা বোন, তোর চাইতে আমার চিন্তা বেশি। তোর জন্য একটা ভালো প্রস্তাব আসছে। খুব ভালো প্রস্তাব। তোর চাকরি বিয়ে ছোটবোনের বিয়ে সব সমাধান হয়ে যাবে। যদি তুই হ্যাঁ বলিস।
আমার লজ্জা পাওয়া উচিত কিন্তু আমি লজ্জা পেলাম না। জানতে চাইলাম কে প্রস্তাব দিলো্।
–তুই কি আমার কথা শুনবি? তুই নাকি কার সাথে ঘুরে বেড়াস। এক চোখ না অনেক চোখেই দেখেছে। একজন বললে আমি বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এতজনের কথা অবিশ্বাস করবো কেমন করে।
-মা সুলেখা খুব ভালো মেয়ে।
আমি এক দমে বলে ফেললাম। আমি জানি এখন না বললে আর কোনদিন বলতে পারবো না।
মা আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলো। তার মুখে একরাশ হতাশা ও অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্ট। মাকে কোনদিন এমন রূপে আমি দেখিনি। আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। মা মুখ শক্ত করে বলল,
-তুই যদি অন্য কোন চিন্তা মাথায় আনিস তবে আমি বিষ খাবো। বিষ আনিয়ে রাখছি।
মায়ের কথায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার গা হাত পা কাঁপতে লাগলো।

ভালোবাসার গল্পঃ তুমি আমায় ডেকেছিলে অনেকদিনের পরে

এখন বেলা তিনটা বেজে দশ। অপেক্ষার প্রহর গুলো সবসময় দীর্ঘ ও বিরক্তিকর হয়। কিন্তু আজ কেন জানি আমার একটুও বিরক্ত লাগছে না। নীলা বলেছিলো সে আড়াইটায় আসবে। সে কখনো দেরী করেনা অন্তত এর আগে কখনো তার বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ করার সুযোগ পাইনি। আধা ঘন্টা লেট। আমি পার্কে বসে আছি তো আছি।

একসময় এই পার্কে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছি। সময় দারুণ কেটে যেতো্ কিন্তু এখন এক ধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। সব সময় পার্ক প্রেম করার জন্য একটা প্রধান স্থান হিসাবে কাজ করে। তবে এখন সময় বদলেছে যুগ ও বদলেছে। বর্তমান ছেলেমেয়েরা প্রেম করার কৌশলও বদলেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে সময়ের সাথে সাথে। তবে দিনশেষে পার্কের প্রেমপর্ব চলছে ঠিকই।
পার্কের সারিসারি ফুলের মাঝে ফটো তোলার ধুম পড়েছে খুব। ঝিলের ফুটেছে লাল পদ্ম। সেই পদ্মকে ব্যকগ্রাউন্ডে নিয়ে চলছে সেলফি তোলার মহা হিড়িক। অতি উৎসাহী কিছু যুবক তো আরো এক কাঠি উপরে, সেলফি আরো আকর্ষনীয় করার জন্য গিয়ে দাড়িয়েছে একেবারে ঝিলের ধারে। পা হড়কালেই কেল্লাফতে। সেলফি একেবারে পানিতে!

-সরি অপূর্ব দেরী করে ফেললাম। মিষ্টি কণ্ঠের আহ্বানে আমার দৃষ্টি ঘুরে গেল চকিতে।
নীলা দিকে তাকাতেই আমার মনটা ভরে উঠলো। এতো সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে কি আর বলবো। আমি মুগ্ধতা নিয়ে অনেকদিন পরে নীলাকে দেখছি। সাধারণ সাজে এসেছে সে। তবু কি অপরূপ। নীল শাড়ীতে তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। একেবারে নীল পরী যেন। এত সুন্দর কি করে হয় মানুষ। আমি স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হাতখানা বাড়িয়ে দিলাম।
-এসো।
কিন্তু নীলা হঠাৎ যেন থমকে গেল, বলল,
-ঠিক আছে, বসছি।
নীলা আমার পাশে বসলো। দূরত্ব রেখে সতর্ক একটা ভঙ্গী বজায় রেখে। মনটা একটু ভার হয়ে গেল আমার। অথচ আহা কি সব দিন ছিলো সেই সব। এই ঝিলের পাড়ে কত ঘনিষ্ট সময় কাটিয়েছি দুজনে। বাদাম কিনতাম, এর বেশি সামর্থ্য ছিলো না। ভাগাভাগিতে বাদাম পর্ব চলতো আর সাথে কতই না অকারণ কথকতা। পৃথিবীতে সুন্দর দিনগুলো খুব তাড়াতাড়িই হারিয়ে যায়।

স্মৃতির সেই দিনগুলো আজো অমলিন। এই তো সেদিনের কথা তুমুল প্রেম পর্বের মধ্যে হঠাৎ একদিন নীলা জানালো বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য প্রচুর চাপ দিচ্ছে, তুমি কিছু একটা করো্।

আমি তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি। পড়াশোনা শেষ হতে সময় লাগবে। তারপর চাকুরী বা অন্যকিছু। কি করলে কি হবে ভাবতেই দিশাহারা অবস্থা এর মধ্যে খবর পেলাম নীলার সৎবাবা আমাদের ব্যপারে সব জেনে গেছে, নীলাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়না আর। কিছুদিনের মধ্যে নীলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আন্তরিকতা থাকা সত্বেও আমি নীলার বিয়ে ঠেকাতে পারলাম না কিছুতেই। বাড়িতে অসুস্থ মাকে রেখে পালানোর কথাও ভাবতে পারলাম না। নীলা এভাবেই হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে।
-কি ভাবছে? কেমন আছো?
আমি হেসে বললাম,
-যেমন রেখেছো।
নীলা মাথা নিচু করে ফেলল, বলল,
-তুমি হয়তো আমাকেই দোষ দেবে সারাজীবন!
-দোষতো দেইনি নীলা?
-তাহলে এখনো বিয়ে করনি কেন?
-মন থেকে সাড়া পাইনা যে?
-এটা কোন কথা হলো?
হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরাতে আমি বললাম,
– ডেকেছো কেন?
-তুমি আমার একটা উপকার করবে অপূর্ব?
কণ্ঠের কাতরতায় আমার বুকটা কেঁপে উঠলো নিমেষে। অচেনা চিনচিনে ব্যথায় মনের অলিন্দে কিসের যেন অনুরনন খেলে গেল। নীলা আমার কাছে কিছু চাইছে। আমি দেবনা তাই কি হয়! হয়েছে কখনো।
আমি গভীর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললাম,
-কি হয়েছে নীলা?কোন সমস্যা?
নীলা খানিক ইতস্তত করলো যেন, তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে? গভীর কোন সমস্যায় না পড়লে সে কখনো আমার দ্বারস্থ হতো না তা ঠিকই বুঝতে পারলাম। আমি অভয় দিয়ে বললাম,
-তুমি তোমার সমস্যা আমাকে মন খুলে বলতে পারো নীলা কোন সঙ্কোচ করো না। নীলা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে খুব ব্যস্ততার সাথে হড়গড়িয়ে বললো,
-তুমি আমার একটা উপকার করবে অপূর্ব?
-কি বলো?
-আমার একটা কাজ চাই, যেকোন কাজ। খুব দরকার। বিশ্বাস কর।
-এভাবে বলছো কেন নীলা? দাবি নিয়ে বলো, আমাকে বুঝি এখন পর মনে হয়?
-জানো তো লেখাপড়াটা সেভাবে করতে পারিনি। পারবে কি তুমি আমায় একটা চাকরি খুঁজে দিতে? একটু সাহায্য করো প্লিজ। আমি আর পারছি না। ঘরে প্যারালাইজ স্বামী। দুই বাচ্চা আরো সাথে অসুস্থ শ্বাশুড়ী…….তুমি যদি একটা চাকরি খুঁজে দাও। তো আমার পরিবারটা বেঁচে যায়।
-ওভাবে বলো না নীলা। আমি তো সবসময় তোমারই প্রিয়তমা। খুব বলতে ইচ্ছা করলো। খুব কিন্তু কথাগুলো মুখে এলেও বাণী হয়ে ফুটে বের হলো না কিছুতেই। অন্য রকম দ্বিধা বা সন্কোচ সময় মানুষের সম্পর্ককে জটিল করে দেয়।

এর কিছুদিন পরে নীলার একটা চাকরি হয়ে গেল। আমার সুপারিশেই হলো্ অবশ্য। তারও বেশ কিছুদিন পরে একদিন ভাবলাম খোঁজ খবর নেই একটু নীলার। ফোন দিলাম। অপর প্রান্ত থেকে জানালো সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। সম্ভবত নীলা নাম্বার বদলেছে। মনটা খারাপ হলো যেন। তারপরে মনকে বোঝালাম নীলা হয়তো জীবনের বাস্তবতায় অতি সাবধানী হয়ে উঠেছে। সেটাই স্বাভাবিক।

এরপর আর কোনদিন আর নীলার সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি কিন্তু তবু হঠাৎ অচেনা নম্বরে কল এলে আমি ঠিকই রিসিভ করি। কে জানে কোনদিন হয়তো আমাকে নীলার প্রয়োজন হলেও হতে পারে। তখন যদি সে আমাকে না পায়…