ট্যাগ আর্কাইভঃ প্রেমের গল্প

সম্পর্কটা ভুল ছিলো [১]

বাসে যেতে যেতে হঠাৎ চোখে চোখ পড়ে গেলো মেয়েটির। মনে হলো আমার দিকে সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চিনি কি আমি তাকে? আমি তাকাতেই সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো অনত্র। আপাদমস্তক ইসলামী পোষাকে ঢাকা, শুধু চোখ দুটো দেখা যায়। এত মায়া মায়া দৃষ্টি যে কি আর বলবো আমার চোখ দুটো খুব সহজেই আটকে গেলো তার দিকে। আবার ফিরে তাকাতেই আমার চোখে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। মনে মনে ভাবলাম পরিচিত না হয়ে যায়না। কিন্তু মেয়েটি কে ? ঠিক ধরতে পারলাম না। আবারো তাকালো মেয়েটি, কয়েক সেকেন্ড মাত্র, মেয়েটি চোখ সরিয়ে নিলো। ভাবলাম ওর সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু বাসে প্রচন্ড ভীড়। কিছু বলার আগেই মেয়েটি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলো্। মনটা সারাদিন খচখচ করতে লাগলো। সত্যি কি আমি ওকে চিনি? কে মেয়েটি? আমার দিকে অমন গভীর দৃষ্টিতেই বা তাকিয়ে ছিলো কেন? কিছু কি বলতে চায়?
এরপর অনেক কটা দিন পার হয়ে গেছে। প্রতিদিনের ব্যস্ততায় আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম স্বাভাবিক নিয়মে। চলতি পথে প্রতিনিয়তই তো মানুষের জীবনে কত ঘটনা ঘটে। কে আর কয়টি মনে রাখে। আমিও এই সামান্য এই সামান্য ঘটনা ভুলে গেলাম স্বাভাবিক নিয়মে।

বেশ অনেকদিন পরের কথা আমি গেছি মার্কেটে একটা চটি কিনবো বলে। বর্তমান চটি জোড়া ছিড়ে গেছে বেশ অনেকদিন হলো। কোনরকমে জোড়া তালি দিয়ে চালাচ্ছিলাম আজ আবারো ছিড়ে যাওয়াতে নতুন একজোড়া কেনার সিদ্ধান্ত নিলাম। একটু হেঁটে লিবার্টি সু এর দোকানে ঢুকতেই দেখলাম সামনের সারিতে বসে জুতো পছন্দ করছে একটি মেয়ে। কেন জানি মেয়েটির মুভমেন্টে চোখ আটকে গেলো। আমি দাড়িয়ে পড়লাম্। সেই মেয়েটি না ?
হ্যাঁ সেই তো, বেশ কাকতালীয় ব্যাপার। অপেক্ষা করলাম, মেয়েটির মুখ আজ ভালো করে দেখতে ই হবে। জানতে হবে কেন সে ওইদিন ওভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো।
কিছু সময় যেতেই মেয়েটি তার কাজ শেষ করে মুখ তুলে চাইলো।
আর মুখ তুলে চাইতেই একেবারে চোখাচোখি আমার সাথে। আমি ও একটু ও সময় ব্যয় না করে হড়গড়িয়ে বলে ফেললাম,
-মাফ করবেন আপনার নামটা জানতে পারি প্লিজ?

মেয়েটি কেমন যেন একটু বিচলিত হলো। স্বাভাবিক ভাবে সে বেশ ঘাবড়ে গেল মনেহয়। একটু অপ্রস্তুত হলো বই কি।অন্তত তার চেহারায় তা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ইতস্তত করে আনত নয়নে বলল,
– আপনি কে? আপনাকে তো আমি চিনি না। অপরিচিত কাউকে আমার নাম বলবো কেন?

-সে ঠিক আছে, তবে আমার কেন যেন আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে।
মেয়েটি বেশ কেটে কেটে উত্তর দিলো,আপনাকে আমার একটুও চেনা লাগছে না। স্যরি।
আমি মরিয়া হয়ে জানতে চাইলাম,
আচ্ছা চেনা হোক বা অচেনা নামটা জানাতে দোষ কি?
-আচ্ছা নাছোড়বান্দা তো আপনি ,পথ ছাড়ুন। আমায় যেতে হবে।
আমি আহত হৃদয়ে পথ ছেড়ে দিলাম।লোকজন খেয়াল করছে।অন্যকোন রকম পরিস্থিতি হোক আমি ও তা চাই না। বিচিত্র ভাবনায় মনটা হঠাৎ বিক্ষিত হয়ে গেলো।

মেয়েটিও আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অকস্মাৎ জোরে ছুট লাগালো এক নিমেষে। এরকম পরিস্থিতি হতে পারে আমি কখনো কল্পনা করতে পারি নি । মেয়েটির আচরণ বড়ই অদ্ভুত।
সেলসম্যান মনে হলো আমার প্রতি চরম বিরক্ত হয়েছে ।সে বিরক্তি নিয়ে জানতে চাইলো আমার কি লাগবে।
ততক্ষণে আমার কিছু কেনাকাটা করার ইচ্ছাটাই উবে গেছে। আমি বিহ্বল হয়ে শুধু মেয়েটির পথের পানে চেয়ে রইলাম।কে মেয়েটিি ?এমন লুকোচুরি খেলছে কেন সে আমার সাথে? কি চায় সে? নাকি কিছুই চায় না। সব আমার মনের কল্পনা।
নাহ! ভুল তোআমার হবার কথা নয় । শুধু শুধু মেয়েটিকে চেনাই বা লাগবে কেন?আমার তো এমন হয় না। নিশ্চয় এ আমার ভুল নয়্।
বারবার মন বলছে আমি মেয়েটিকে চিনি, আমি অবশ্যই এই মেয়েটিকে চিনি।কিন্তু কিছুতেই এই মেয়ের সাথে স্মৃতিগুলো মনে করতে পারছিনা। কোথায় যেন দেখেছি …কোথায়?
চটি না কিনেই বাড়ি ফিরে এলাম তাড়াতাড়ি। মনটা আজ প্রচন্ড অশান্ত।বারেবার স্মৃতির ডায়েরী উল্টে পাল্টে একাকার ,কে মেয়েটি?আমি সাধারণত সিগারেট খাই না ।আজ সিগারেট ধরলোম একের পর এক। হেড অফিস বার কয়েক উকি ঝুকি মারলেও আমাকে বিরক্ত করলো না। সে সবসময় আমাকে ভালো বোঝে।অকারণ জ্বালাতন সে কখনো করে না।বারান্দায় হাটাহাটিতে রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো।কখন জানি দুচোখ জুড়ে গভীর ঘুম চলে এলো্ নিজেই জানি না ঘুম ভাঙলো অনুপমার হাঁকডাকে।

ভালোবাসার গল্পঃ নাম তার মধুরিমা


শীত যাই যাই করেও যাচ্ছেনা, এরকম আবহাওয়াতে আমার বেশ লাগে। চতুর্দিকে আলো ছড়িয়ে প্রবল প্রতাপে সূর্য উঠে গেছে। আজ বসন্তের প্রথম দিন। আমি গুটিগুটি পায়ে খোলা ছাদে এসে দাঁড়ালাম। বাবা ফিরে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। সকালের ট্রেন ধরবার তাড়া ছিলো। মনটা আমার ভীষণ রকমের খারাপ। আমি কোনদিন বাবা মাকে ছাড়া কোথাও একলা একলা থাকিনি, এই আঠারো বছরের জীবনে। স্বাভাবিক ভাবেই আমার চোখ বারবার শুধু ছলছল করে উঠছে অকারণ অভিমানে।

ছাদের উপর কবুতরের বাসার মতো ছোট্ট এক কামরার ঘর, একটা খাট, ছোট্ট একটা পড়ার টেবিল ও একটা আয়না। এই হলো আমার বর্তমান নিবাস। এই শহরে আমি এই প্রথম এসেছি, আশেপাশের কোনকিছু আমি চিনি না যদিও এর আগে কোন শহরে আমার থাকা হয়নি তবে এখন থেকে আমার শহুরে জীবনের শুরু বলতে হবে। সবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সরকারী কলেজে চান্স পেয়ে পড়তে এসেছি গ্রাম থেকে। কাছাকাছি গ্রাম বলে প্রথমে ভেবেছিলাম রোজ গ্রাম থেকেই আসা যাওয়া করবো। কিন্তু নিত্য জার্নি করে ক্লাস করা এবং ফিরে এসে পাঠে মন বসানো একেবারেই অসম্ভব আর এতে করে প্রচুর সময় ও নষ্ট হচ্ছে। তাই বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে শহরে রেখে পড়াবেন। এই বাড়িওয়ালা বাবার বন্ধু। খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু। মা প্রথমে একটু আপত্তি করলেও পরে চোখের জল মুছে মেনে নিয়েছেন এই শর্তে যে প্রত্যেক সপ্তাহে বাড়ি আসতে হবে। বাবা বরাবরই শক্ত গোছের মানুষ তাকে কখনো কোন বিষয়ে ভেঙে পড়তে বা কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু আজ ফিরে যাবার কালে তাকে অন্য রুপে দেখে আমার মনটা আরো বেশি বিষণ্নতায় ভরে গেল। বার বার কেবলি চোখ ভিজে উঠলো। শেষ বেলায় বলা কথাগুলো বার বার মনের ভেতর খচখচ করে বাজতে লাগলো।

পানি খাবেন?
হঠাৎ চিকন সুরের কণ্ঠে মেয়েটি জানতে চাইলো্। আমি নিজেকে দ্রুত সামলে নিলাম। এই সময়ে কেউ ছাদে আসতে পারে এটা ভাবতে পারিনি। চোখের জল মুছলেও গলাটা ভার ভার ভাবটা থেকে গেল ঠিকই। বেশ রাগ হলো<
– না খাবো না, তুমি কে?
-আপনি কাঁদছেন?
-কই? কে বলল?
-আপনার কি ক্ষিদে পেয়েছে? মা লুচি আর আলুর দম করছে। আমার মায়ের হাতের লুচি আলুর দম বিখ্যাত। খাবেন?
আচ্ছা জ্বালাতন হলো দেখছি এই মেয়ে তো বড় বেশি কথা বলে। বেশি কথা বলা মানুষ আমার একদম ভালো লাগে না্। আমি প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম।
-তুমি কে? কি চাও? কোথায় থাকো?
মেয়েটি হিহি করে ঝনঝনিয়ে হেসে উঠলো। বাবা একসাথে এতো প্রশ্ন?
-আমি মধুরিমা। হি হি হি…. মধু বলতে পারেন।
-ঠিক আছে মধুরিমা তুমি এখন যাও্। আমি এখন ব্যস্ত আছি।
-আমি চলে গেলে আপনি বুঝি কাঁদতে বসবেন? কান্নাকাটি করা বুঝি ব্যস্ততা? আচ্ছা ছিঁচকাদুনে তো আপনি, আশ্চর্য!
-শোন মেয়ে তুমি কে আমি জানিনা, তবে আমি স্পষ্টভাষী। তোমাকে আমি একটা কথা পরিষ্কার জানিয়ে রাখি। আমি অন্যের ব্যপারে নাক গলানো একেবারে পছন্দ করি না। বুঝেছো?
-ঠিক আছে বুঝলাম। যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন ছিলো।
-কি?
-আপনার নাম কি? মানে কি নামে ডাকবো আপনাকে?
-আমাকে ডাকাডাকির এত প্রয়োজনই বা কি? তুমি যাও।
-বলুন না এমন কেন আপনি?
-কোন নাম নেই।
-তাই কি হয়! নাম ছাড়া মানুষ আমি এই প্রথম দেখলাম। আচ্ছা ঠিক আছে আমি যদি আপনাকে মিষ্টার স্পষ্টভাষী বলে ডাকি আপনার আপত্তি নেই তো?

মনে মনে ভাবলাম কড়া করে দুচার কথা শুনিয়ে দেই। বলবো বলে যেই প্রস্তুতি নিয়েছি পেছন ফিরে দেখি হাসতে হাসতে নুপূরের ছন্দ তুলে মধুরিমা দৌড়ে চলে গেল। এতক্ষণ রাগ হলেও কিছুক্ষণ পর সব রাগ গলে জল হয়ে গেল। হঠাৎ কেমন মায়া মায়া লাগলো্ এতো কড়া করে না বললেই পারতাম। রাগের মাথায় এতক্ষণ খেয়াল করিনি এখন চোখে ভাষা ছবিতে মেয়েটির মুখটি খুব মিষ্টি লাগলো্, মনে মনে ভাবলাম মধুরিমা নামটি মন্দ নয়। আবার এলে ঠিকঠাক ভাব করে নেব। যা কড়া ডোজ দিয়েছি আবার এলে হয়!

ভালোবাসার গল্পঃ তুমি আমায় ডেকেছিলে অনেকদিনের পরে

এখন বেলা তিনটা বেজে দশ। অপেক্ষার প্রহর গুলো সবসময় দীর্ঘ ও বিরক্তিকর হয়। কিন্তু আজ কেন জানি আমার একটুও বিরক্ত লাগছে না। নীলা বলেছিলো সে আড়াইটায় আসবে। সে কখনো দেরী করেনা অন্তত এর আগে কখনো তার বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ করার সুযোগ পাইনি। আধা ঘন্টা লেট। আমি পার্কে বসে আছি তো আছি।

একসময় এই পার্কে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়েছি। সময় দারুণ কেটে যেতো্ কিন্তু এখন এক ধরনের অস্বস্তি হচ্ছে। সব সময় পার্ক প্রেম করার জন্য একটা প্রধান স্থান হিসাবে কাজ করে। তবে এখন সময় বদলেছে যুগ ও বদলেছে। বর্তমান ছেলেমেয়েরা প্রেম করার কৌশলও বদলেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে সময়ের সাথে সাথে। তবে দিনশেষে পার্কের প্রেমপর্ব চলছে ঠিকই।
পার্কের সারিসারি ফুলের মাঝে ফটো তোলার ধুম পড়েছে খুব। ঝিলের ফুটেছে লাল পদ্ম। সেই পদ্মকে ব্যকগ্রাউন্ডে নিয়ে চলছে সেলফি তোলার মহা হিড়িক। অতি উৎসাহী কিছু যুবক তো আরো এক কাঠি উপরে, সেলফি আরো আকর্ষনীয় করার জন্য গিয়ে দাড়িয়েছে একেবারে ঝিলের ধারে। পা হড়কালেই কেল্লাফতে। সেলফি একেবারে পানিতে!

-সরি অপূর্ব দেরী করে ফেললাম। মিষ্টি কণ্ঠের আহ্বানে আমার দৃষ্টি ঘুরে গেল চকিতে।
নীলা দিকে তাকাতেই আমার মনটা ভরে উঠলো। এতো সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে কি আর বলবো। আমি মুগ্ধতা নিয়ে অনেকদিন পরে নীলাকে দেখছি। সাধারণ সাজে এসেছে সে। তবু কি অপরূপ। নীল শাড়ীতে তাকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে। একেবারে নীল পরী যেন। এত সুন্দর কি করে হয় মানুষ। আমি স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে হাতখানা বাড়িয়ে দিলাম।
-এসো।
কিন্তু নীলা হঠাৎ যেন থমকে গেল, বলল,
-ঠিক আছে, বসছি।
নীলা আমার পাশে বসলো। দূরত্ব রেখে সতর্ক একটা ভঙ্গী বজায় রেখে। মনটা একটু ভার হয়ে গেল আমার। অথচ আহা কি সব দিন ছিলো সেই সব। এই ঝিলের পাড়ে কত ঘনিষ্ট সময় কাটিয়েছি দুজনে। বাদাম কিনতাম, এর বেশি সামর্থ্য ছিলো না। ভাগাভাগিতে বাদাম পর্ব চলতো আর সাথে কতই না অকারণ কথকতা। পৃথিবীতে সুন্দর দিনগুলো খুব তাড়াতাড়িই হারিয়ে যায়।

স্মৃতির সেই দিনগুলো আজো অমলিন। এই তো সেদিনের কথা তুমুল প্রেম পর্বের মধ্যে হঠাৎ একদিন নীলা জানালো বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য প্রচুর চাপ দিচ্ছে, তুমি কিছু একটা করো্।

আমি তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছি। পড়াশোনা শেষ হতে সময় লাগবে। তারপর চাকুরী বা অন্যকিছু। কি করলে কি হবে ভাবতেই দিশাহারা অবস্থা এর মধ্যে খবর পেলাম নীলার সৎবাবা আমাদের ব্যপারে সব জেনে গেছে, নীলাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়না আর। কিছুদিনের মধ্যে নীলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। আন্তরিকতা থাকা সত্বেও আমি নীলার বিয়ে ঠেকাতে পারলাম না কিছুতেই। বাড়িতে অসুস্থ মাকে রেখে পালানোর কথাও ভাবতে পারলাম না। নীলা এভাবেই হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে।
-কি ভাবছে? কেমন আছো?
আমি হেসে বললাম,
-যেমন রেখেছো।
নীলা মাথা নিচু করে ফেলল, বলল,
-তুমি হয়তো আমাকেই দোষ দেবে সারাজীবন!
-দোষতো দেইনি নীলা?
-তাহলে এখনো বিয়ে করনি কেন?
-মন থেকে সাড়া পাইনা যে?
-এটা কোন কথা হলো?
হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরাতে আমি বললাম,
– ডেকেছো কেন?
-তুমি আমার একটা উপকার করবে অপূর্ব?
কণ্ঠের কাতরতায় আমার বুকটা কেঁপে উঠলো নিমেষে। অচেনা চিনচিনে ব্যথায় মনের অলিন্দে কিসের যেন অনুরনন খেলে গেল। নীলা আমার কাছে কিছু চাইছে। আমি দেবনা তাই কি হয়! হয়েছে কখনো।
আমি গভীর দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বললাম,
-কি হয়েছে নীলা?কোন সমস্যা?
নীলা খানিক ইতস্তত করলো যেন, তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে? গভীর কোন সমস্যায় না পড়লে সে কখনো আমার দ্বারস্থ হতো না তা ঠিকই বুঝতে পারলাম। আমি অভয় দিয়ে বললাম,
-তুমি তোমার সমস্যা আমাকে মন খুলে বলতে পারো নীলা কোন সঙ্কোচ করো না। নীলা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। সে খুব ব্যস্ততার সাথে হড়গড়িয়ে বললো,
-তুমি আমার একটা উপকার করবে অপূর্ব?
-কি বলো?
-আমার একটা কাজ চাই, যেকোন কাজ। খুব দরকার। বিশ্বাস কর।
-এভাবে বলছো কেন নীলা? দাবি নিয়ে বলো, আমাকে বুঝি এখন পর মনে হয়?
-জানো তো লেখাপড়াটা সেভাবে করতে পারিনি। পারবে কি তুমি আমায় একটা চাকরি খুঁজে দিতে? একটু সাহায্য করো প্লিজ। আমি আর পারছি না। ঘরে প্যারালাইজ স্বামী। দুই বাচ্চা আরো সাথে অসুস্থ শ্বাশুড়ী…….তুমি যদি একটা চাকরি খুঁজে দাও। তো আমার পরিবারটা বেঁচে যায়।
-ওভাবে বলো না নীলা। আমি তো সবসময় তোমারই প্রিয়তমা। খুব বলতে ইচ্ছা করলো। খুব কিন্তু কথাগুলো মুখে এলেও বাণী হয়ে ফুটে বের হলো না কিছুতেই। অন্য রকম দ্বিধা বা সন্কোচ সময় মানুষের সম্পর্ককে জটিল করে দেয়।

এর কিছুদিন পরে নীলার একটা চাকরি হয়ে গেল। আমার সুপারিশেই হলো্ অবশ্য। তারও বেশ কিছুদিন পরে একদিন ভাবলাম খোঁজ খবর নেই একটু নীলার। ফোন দিলাম। অপর প্রান্ত থেকে জানালো সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। সম্ভবত নীলা নাম্বার বদলেছে। মনটা খারাপ হলো যেন। তারপরে মনকে বোঝালাম নীলা হয়তো জীবনের বাস্তবতায় অতি সাবধানী হয়ে উঠেছে। সেটাই স্বাভাবিক।

এরপর আর কোনদিন আর নীলার সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি কিন্তু তবু হঠাৎ অচেনা নম্বরে কল এলে আমি ঠিকই রিসিভ করি। কে জানে কোনদিন হয়তো আমাকে নীলার প্রয়োজন হলেও হতে পারে। তখন যদি সে আমাকে না পায়…

ভালোবাসার গল্পঃ এক বরষার দিনে হঠাৎ দেখা ইরাবতীর সাথে

ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে গত রাত থেকে। দীর্ঘ বর্ষার আলামত। অনবরত বৃষ্টির ছোঁয়ায় সমস্ত চরাচর ভিজে একাকার। চিরচেনা প্রকৃতির এই হঠাৎ বদল মনে বেশ অন্যরকম দোলা দেয়।

ভালো লাগে বর্ষার সদ্য স্নাত স্নিগ্ধ প্রকৃতি। ভালো লাগে আকাশ, খোলা মাঠ, জল টলমল পুকুর, ভেজা সবুজ ঘাস ও লতা পাতা। এই সময় প্রকৃতিকে বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। মনের গতি প্রকৃতিও কেমন যেন বদলে যায়। কাব্যকথার জলছবিতে ভরে ওঠে।

আমার একলা জীবনে আমি প্রায় বেড়াতে বের হই প্রাকৃতিক এই নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করার মনোবাসনায়। রাস্তায় গাড়ির চাপ থাকে কম, মোটামুটি জনশূন্য রাস্তাঘাট। ইচ্ছা মতো হেঁটে চলে এক অন্য রকম অনুভুতির প্রকাশ খেলা করে যায় মনের অলিন্দ জুড়ে। ভালো লাগলে সাথে থাকা ক্যামেরায় টুপটাপ ছবি তুলতে কখনো ভুল করিনা। চারপাশটা দেখি খুব নিবিড়ভাবে, ভেজা কাক,শালিক………… আজ মনে হলো কিছুদিন আগে কলেজপাড়ার দীঘিতে অনেক লাল শাপলা ফুটতে দেখেছিলাম। সেই ছবি তুললে কেমন হয়। টুপটাপ জল গড়িয়ে পড়ছে পাতায় আর ফুলে। সেই ছবি ফ্রেমে ধরার আশায় নানা ভাব কল্পনায় একটু বেখেয়ালই ছিলাম মনে হয়। হঠাৎ সড়গড় কথায় আমি চমকে উঠলাম।

-আরে তুই?এখানে এই বৃষ্টিতে কি করছিস।
প্রথমে বুঝতে পারলাম না সামনের মানুষটি কে? সে নারী নাকি পুরুষ। কারণ পুরোদস্তুর রেইনকোটে মোড়ানো মানুষটাকে সহসা ঠাওর করা আমার জন্য কিছুটা দুষ্কর মনে হলো্।
অকস্মাৎ বিষ্ময়ে আমি কিছুটা নির্বাক তাকিয়ে রইলাম।
-কণ্ঠটি আবার ঝনঝনিয়ে উঠলো,
-কিরে ভ্যাবলা কান্তর মতো হাঁ করে তাকিয়ে আছিস কেন? চিনতে পারছিস নাে ? এত সহজে ভুলে গেলি আমায়?

হঠাৎ ধুলোর রাশি ঝড়ো হাওয়ার মতো উড়িয়ে নিয়ে গেল যেন স্মৃতিপটের উপর থেকে। নিজের অজান্তে মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো,
-আরে ইরা তুই? এখানে? এখানে কি করে? কি করছিস?
-আরে বাবা এতো প্রশ্ন উত্তর একসাথে কি করে দেবো? তবে ভালো লাগছে তুই আমাকে চিনতে পেরেছিস্ দেখে।
-কি যে বলিস তোকে কি করে ভুলবো তবে তোকে তোর বর্তমান অবস্থায় চেনা কষ্ট। একেবারে চিকনি চামেলী হয়ে গেছিস তার উপরে রেইনকোট পড়ে অদ্ভুতুড়ে অবস্থা। তবে তোর বিখ্যাত কণ্ঠ আমাকে চিনতে সাহায্য করেছে। একেবারে মার্কা মারা হা হা হা।
-তারপর কেমন আছিস দোস্ত?
-ভালো বেশ ভালো। তবে তুই এই শহরে ? দেখে একটু অবাক হচ্ছি।
-আছি তো অনেকদিন। আমার পোষ্টিং এখানেই।
শুনে বেশ অবাক হলেও ভালো লাগলো এতদিন বাদে ইরার দেখা পেয়ে। কথায় কথায় জানা হলো, শোনা হলো অনেক কিছু। ইরা জানালো তার এখনো সংসার করা হয়নি নানা ব্যস্ততায়। আমি বেশ অবাক হলাম। সে আরো জানতে চাইলো চারুলতা, দীপা, আলেয়া সহ আরো অনেকের কথা। আমি বললাম কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ নাই। তবে ইরা চাইলে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়া যেতে পারে। একথা শুনে ইরার সেকী হাসি হাসতে হাসতে ইরা বললো
-আচ্ছা একসাথে এতোগুলো মেয়েকে কীভাবে তুই ম্যানেজ করতিস বলতো? এটা কিন্তু আমার কাছে এখনো সেইরকম রহস্যময় লাগে। তোর ওই বিশ্ব প্রেমিক ইমেজ হি হি হি।

আমি হেসে সপাটে মনের কথা বলে দিলাম গড়গড়িয়ে, আচ্ছা তুই যে একজন মেয়ে এতো ছেলে তোর মতো রূপসীর পিছনে লাইন লাগিয়ে ঘুরঘুর করতো, তোর জন্য ফিদা ছিলো। এমনকি আমি পর্যন্ত। তুই কারো প্রেমে পড়লি না কেন?
হঠাৎ করে পরিবেশটা গম্ভীর হয়ে গেল যেন। ইরাবতীর চোখটা ছলছল করে উঠলো। সে আমার হাতের উপর হাতটা রেখে বলল,
-দেখা যখন হলো, সব কথাই হবে। তুই কেমন আছিস অপূর্ব?

এমন আবেগঘন পরিবেশে আমার দুচোখ ভিজে গেলো যেন ঘোর বরষায়। মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বললাম। আমি ভালো নেই ইরাবতী। একটুও ভালো নেই।

প্রিয় প্রিয়তমেষু পাখির বিয়ে

সিগারেটের আগুনে ঠোঁটের নীলাভ উষ্ণ আবরণে ছোঁয়াচে সুপ্ত মাংসপেশিগুলো কালচে বর্ণ ধারণ করছে। যার কালি দিয়েও হতো প্রিয়তমেষু পাখির কয়েকটি ছবির স্কেচ তৈরি করা যাবে নিমিষেই। নতুবা মাথার চারপাশের সাদা চুলগুলোয় কালো কালির প্রলেপ দেওয়া যাবে হরহামেশাই। হয়তো তখন পৃথিবীর অগুনিত পর্বতের মানুষেরা বলবে – হিমু পাগল হয়ে গেছে। আসলেই তো হিমু পাগল হয়ে গেছে।

গত কয়েকমাসে হিমুকে হন্যে হয়ে চাকরি খোঁজার লোভ লালসায় ক্ষুধার্ত ছিন্নমূল মানুষের মতো লেগেছে। মনে হচ্ছিল – সামনে যা পাবে কোনরূপ সাড়াশব্দ না করে সোজাসুজি ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু, তবুও কি কোন নিস্তার আছে। ছিন্নমূল এ জীবন সস্তার ভিড়ে আরও অনেক পথভ্রষ্ট কিংবা পথিকের সাড়াশব্দ দেখে পায়ের তালু থেকে কলিজা অবধি শুকিয়ে যায়। যেখানে চাকরি পাওয়াটা আর কঠিন।

শেষমেশ হিমুকে শুধু শুনতে হলো বকুনিঝকুনি। ওর লেখার বিষয়বস্তুকে নিয়েও কটাক্ষ করে ডাস্টবিনের স্তুপে সুস্পষ্টভাবে সংস্পর্শে ফেলে দেওয়া হলো।
প্রিয় প্রিয়তমেষু পাখির আঘাতটা চাবুক হয়ে দেহের কাহিনিতে তখনই লেগেছিল হিমুর। সহ্যশক্তির অপার সৌন্দর্যে রক্তবমি হলেও, চোখের ভীড়ে ভীড়ে অশ্রুসজল গড়াগড়ি করলেও কোনকিছু বলার সাহস জোটেনি।

বাসস্ট্যান্ডে ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোর বাতির ছায়াতলে রোজ সন্ধ্যায় সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে ধস্তাধস্তি জাবরদস্তি হয় হিমুর। আবার কখনো সন্ধ্যে বুড়োর সাথে সন্ধ্যে তারার হিসেব কষতে কষতে রাত অবধি জেগে থাকার বাহানা খুঁজে পাওয়া অবচেতন হিমুকে প্রায়শই অজ্ঞান রূপে ছাঁদের উঠানে পরে থাকতে দেখা যায়।
হিমু হাসপাতাল থেকে ফিরেছে দিন তিনেক হলো। ডাক্তার বলেছিল সিগারেট ছাড়তে কিন্তু সিগারেটের তীব্র নিন্দার নেশার ছোবলে পরে পরে আরও বেশি ঋণাত্মক সূচকে নেমে এসেছে।
মাস তিনেক পরে রপার সাথে হিমুর কথা হলো –
– হ্যালো, হ্যালো।
– হিমু চুপ করে শুনছে (কোন সাড়াশব্দ নেই)।
– হ্যালো, কি হলো কথা বলবে না?
– হুমম, বলো।
– কেমন আছো?
– জ্বি, ভালো আছি।
– আমি কিন্তু তোমার খবরাখবর রাখি।
– ও আচ্ছা। খুশি হলাম। আর কিছু…।
– জ্বি, আরও অনেক কিছু। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
– হুম, অবশ্যই।
– আচ্ছা, এখনো কি সিগারেট…?
– না।
– খুশি হলাম জেনে। অবশেষে আমার একটি কথা রাখলে।
– না, তোমার ধারণা ভুল।
– মানে?
– তুমি চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন গাঁজা খাই।

ছবিঃ সংগৃহীত