“ভালবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন, তবে কেন মিছে ভালবাসা”।
‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ বইয়ের উৎসর্গপত্রে হুমায়ন আহমেদ গুলতেকিনকে লিখেছিলেন এসব কথা। বাদল দিনের সে কদম ফুল এক সময় বাসি হয়ে যায়। সময়ের স্রোতে ভালবাসার মানুষ একসময় পর হয়ে যায়।স্বার্থ পূরন হলে ভালবাসায় চিড় ধরে, ক্লান্তি আসে। যে জীবন জীবনের জন্য, মানবতার জন্য কাজ করে; সেই জীবন হারিয়ে যাওয়ার মতো দুর্ভাগ্যজনক ও বেদনাদায়ক বড় ঘটনা বোধকরি আর নাই। আপন-পর, আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিতের গন্ডি এক্ষেত্রে থাকে না। শোক সাগরে সকল মানুষকেই ভাসায়।এখন আমি ক্লান্ত , অবসন্ন। নিঃসঙ্গতা আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ হয়ে উঠেছে। একটা নীরব আত্মবিশ্বস্ত নৈকট্য ছিল আমাদের দুজনের মধ্যে সেটা কেন যেন আজ প্রশ্নের মুখোমুখি। হয়তো এটা আমার ব্যর্থতা, না হয় অবহেলা। কিন্তু তার কর্তব্য সে পালন করে যাচ্ছে কোন কিছু দাবী না করে। জানিনা কেন ? হয়তো এটা তার দায়বদ্ধতা। কে যাবে ব্যাখ্যা করতে নিজের ভেতরের অবস্থানটিকে ? আমার অবস্থান আমার ভিতরই থাক। কেন অন্যের কাছে নিজের টোটাল সত্তার স্বরূপকে নগ্নভাবে উৎঘাটন করতে যাব ? কী দায়ে ? কিসের প্রয়োজনে ? সব দায় আর প্রযোজন তো আজ প্রায় শেষ। তবে কেন নিজকে বড় করে জাহির করা ? নিজের রুচি ও চরিত্রের বাইরে জীবনে কখনো কিছু করিনি। করার চেষ্টাও করিনি, করতে গিয়েও করতে পারিনি। সব সময় নিজের কথা না ভেবে পরিবারের শক্ত অবস্থান দাড় করাতে নিজকে নিজের স্ত্রী সন্তানকে অধিকার বঞ্চিত করেছি। রাজনীতিতে নিজের অবস্থান তৈরী করেছি কিন্তু সেটা নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারিনি। রাজনৈতিক সুফল আমি ভোগ করতে পারিনি। যারা আমার খ্যাতি যশ ব্যবহার করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত তারা আমাকে আজ কেউ চিনতে চায় না।অবিশ্বাস্য খ্যাতি ও ব্যস্ততা আমাকে আমার স্ত্রী সন্তানদের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। আমার স্বভাবগত উদ্যোগহীনতাও একটা কারণ বটে। আমি নিজকে আমার পরিবারের মধ্যে কখনোই সীমাবদ্ধ রাখিনি। তাই বার বার পরিবার থেকে কষ্ট পেয়েছি।শত কষ্টের মাঝে একজন আমাকে আগলে রেখেছে তার প্রেমময়ী স্পর্শ আমার মৃত্যুমুহূর্তকে পুষ্পময় করে রেখেছে। খুব কম মানুষের জীবনে এ দুর্লভ সৌভাগ্য জোটে। এ নারী আমাকে দুই হাত ভরে দিয়েছে তার সমস্ত কিছু উজার করে। চিরকাঙ্ক্ষিত অনুভূতি কখনো ব্যক্ত করেনি, আমিও বুঝার চেষ্টা করিনি। এত অঢেল পাওয়া ক’জন এর নসিবে জোটে ?
ভালবাসার অপূর্ব অনুভূতি কখনো বুঝতে পারিনি। রাজনীতিতে ব্যস্ত সময় পাড় করতে গিয়ে নারীর চিরন্তন ভালবাসা কখনো বুঝা হয়নি, তবে কাউকে যে ভাল লাগেনি তা নয়, ভাল লাগলেও রাজনীতির ক্যারিয়ার নষ্ট হবে বিধায় সেভাবে কাউকে জীবনে জড়াতে পারিনি। এ নারীকে না পেলে বোধহয় জীবনের খানিকটা অপূর্ণতা রয়েই যেত। আমার স্ত্রী কর্মাসের ছাত্রী তাই অঙ্কে ভাল ছিল কিন্তু মাঝ বয়সে এসে তার জীবনের জটিল অঙ্ক মেলাতে পারছে না। জন্ম মুহূর্ত থেকে একটা মেয়ে অবচেতন মনে বুঝতে শুরু করে সে মেয়ে মানুষ। সে অপরের অধীন। পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার তার নেই। জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে হয়তো বাবা-ভাই, স্বামী নয়তো ছেলে। এ পরাধীনতার অন্তরালে থাকতে থাকতে একসময় নিজের বিবেকের স্বাধীনতাটুকুও সে হারিয়ে ফেলে। জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। কিন্তু নারী সংসারে, সমাজে যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।কখনো নিজের ইচ্ছায়, কখনো পরিবারের চাপে, কখনো সমাজের নিষ্পেষণে। এটা প্রত্যেক নারীর একটা অপ্রাপ্তি।সবচেয়ে কাছের মানুষ যারা আমাকে সাহায্য করার কথা ছিল, দুঃসময়ে আমার পাশে থাকার কথা ছিল, আমার বাচ্চাদের মাথায় ভরসা আর নির্ভরতার হাত রাখার কথা ছিল, স্বার্থের টানাপড়েনে তারা নিজেদের রং বদলিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে।তারপরও আমি নিজেকে ভাগ্যবঞ্চিত মনে করি না। আমি এখনও সুস্থ আছি, এখনো বেঁচে আছি। এ জীবনে আমার পাওয়া অনেক। এই যে এত মানুষের ভালোবাসা, কষ্টের সময় পাশে থাকা, কজনের ভাগ্যে জোটে। তাই পৃথিবীর কাছে আমার কোনো অনুযোগ নেই, আক্ষেপ নেই। প্রকৃতির নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে। এ নিয়মের আবর্তেই হয়তো কাছের মানুষ দূরে চলে যায় আর দূরের মানুষ কাছে। আমি একা একা বসে আছি। কিছুক্ষন আগে ইফতার করেছি, নামাজ পড়ার পর শরীরটা ক্লান্ত লাগায় অফিসে যাওয়া হলো না।ভাবনার কক্ষ পথে কেবল এ নারীর মুখ ভেসে উঠতে লাগল।
এক জীবনে মানুষ অনেক কিছুই পারে না। কিন্তু এ নারী তা পারছে এবং করছেও তিনি স্নেহময়ী বধূ, মমতাময়ী মা, দায়িত্বশীর শিক্ষাগুরু, স্বামীর প্রতি দায়িত্বপালনকারী সফল স্ত্রী। সে আমার প্রেমময়ী, প্রেরণাদায়িনী, শক্তিদায়িনী। এ নারী আমার কতটা প্রভাব ও কর্মকৌশলতার সাথী তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করা আমার পক্ষে সত্যিই দুরহ। এ নারী আমার জীবনে এসে আমার পরিবার, সংসার এবং আমার গৃহাভ্যন্তরে এমন একটি পরিবেশ তৈরী করে রাখছে যার উপর নির্ভর করে দুর্গমগিরি, দুস্তর পারাবার পাড়ি দিতে পারা যায়।
চলবে ……..