প্রবাস জীবনের দুদশক পার হয়ে গেছে, কত দ্রুত সময় চলে যায়। যে কোন কারনেই হোক এই ২১ বছরে কম করে হলেও ১২ বার দেশে আসা হয়েছে … আসা যাওয়ার এই ব্যয় সঞ্চয়ের দিকে গেলে হয়তো অনেক বদলে যেত জীবন। যাক সে সব কথা এ নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নেই … আমি কখনো বড় লোক হতে চাইনি, এখনো না। জীবন চলে গেলেই হয়।
দেশে আসার সময় আমার একটা অভ্যাস হচ্ছে কাছের এবং এমন কি দূরের মানুষের জন্য কিছু নিয়ে আসা যাকে আমরা গিফট বলে থাকি। এই গিফট দেওয়া নিয়ে আমার কিছু মজার অভিজ্ঞতা আছে।
আমার সেই সব কাছের বা দূরের মানুষদের একজন একবার বললেন “এসব তো এ দেশেই পাওয়া যায়।”
কিন্তু আমি উনাকে কি করে বোঝাই টাকায় বাঘের চোখ কেনা গেলেও, কেনা যায় না এমন অনেক কিছু আছে ? আমার আন্তরিকতাটুকু উনার চোখে পড়ে না। আবার এমন কিছু প্রোডাক্ট আছে সেই গুলো এই বাংলাদেশে বিক্রী হবে না। যেমন জাপানের Sony/Toshiba/Hitachi কোম্পানী জাপানে যে TV বিক্রী করে তা বাংলাদেশে করে না। গ্রামীন UNIQLO যে সব কাপড় বাংলাদেশে বাজারজাত করে তা জাপানে পাওয়া যায় না।
পরের বার আবার উনার কাছে আমার গিফট নিয়ে গেলে উনি যে গল্পটা বললেন তা শুনে আমি থ …। উনার অন্য এক আত্নীয় নাকি বলেছেন বিদেশ থেকে যে সব গিফট নিয়ে আসে তা নাকি Bargain Sale এর সময় কেনা। হোক না ক্ষতি কি? কিছু কিছু কথা আছে যা কখনো বলতে নেই।
এবার আসি আবার অন্য ধরনের কাছে বা দূরের মানুষের কথা। উনারা গিফটটি হাতে পাওয়ার পর জানতে চাইবেন এর দাম …। আবার আর কেউ পরীক্ষা করবেন প্রোডাক্টটি কোন দেশের তৈরী। Made in China হলে তো উনাদের কাছে এটি খুব সস্তা বলে মনে হবে। (পৃথিবীর নামী দামী ব্রান্ড গুলোর ৮০ ভাগই তৈরী হয় চীনে, আমাদের দেশের EPZ এ উৎপাদিত পণ্য বাংলাদেশে কিনতে পাওয়া যায় না)। হয়তো এই কারনেই আমার এক ইউরোপ প্রবাসী আত্মীয় আমার মায়ের জন্য বাংলাদেশের স্থানীয় বাজার থেকে গিফট কিনে বিদেশ থেকে পাঠানো বলে চালিয়ে দিলেন কদিন আগে … । মায়ের কাছে শুনে হাতে নিয়ে প্রোডাক্টিতে বাংলাদেশী দোকানীর হাতে লেখা বিক্রয় মুল্যের কোড দেখি আর নিশ্চিত হই প্রোডাক্টটি দেশ থেকেই কেনা এবং প্রোডাক্টটি কোন দেশের তৈরী লিখা নেই শুধু ইউরোপের এক কোম্পানীর নাম ঠিকানা লেখা, জানি না কেন এই মিথ্যাচার। হয়তো বা আমরা Made in… খুঁজি বলেই।
আমরা যখন বিদেশে কোন জিনিস কিনি তা কোন দেশের তৈরী তা দেখি না, আমরা ব্রান্ড দেখি …। আর উনারা Made in …দেখেন। কেনার পর কতো বার আবিস্কার করেছি সেটা বাংলাদেশে তৈরী। বেশ কয়েক বছর আগে জাপানের Sony কোম্পানীর এক নির্বাহীর ইন্টারভিউ তে বেশ মজার কথা শুনেছিলাম উনি যা বলেছিলেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায় … “আমরা একই প্রোডাক্ট বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তৈরী করি, ইউরোপের অধিবাসীরা ডিজাইন দেখেন, মধ্য প্রাচ্যের লোকজনের এমন প্রোডাক্ট তৈরী করতে হবে তা যেন ওজনে ভারী হয়। আবার ভারতের জন্য হলে তাতে খুব জোরে শব্দ হয় ( ভারত, বাংলাদেশ সহ আফ্রিকার অনেক দেশেই যেখানে সেখানে অনেক শব্দে গান শোনার অভ্যাস আছে )।”
তারপরও আমি প্রতিবারই কিছু না কিছু নিয়ে আসি হাতে তুলে দেওয়ার সময় ভাবতে থাকি এবার তিনি কি বলবেন ?
জাপানীদের কাছ থেকে একটা জিনিস শিখেছি, উনারা তর্ক করেন না, বক্তৃতা বা বিতর্কে জাপানীরা খুবই কাঁচা। উনারা মাঝে মাঝে কারো কথা শুনে বিতর্কে না গিয়ে বলেন “তাই”। আর এই “তাই” শুনে আমার মত বাঙ্গালীদের ধারনা হতে পারে তিনি আমার কথার সায় দিচ্ছেন বা মেনে নিছেন। আসলে কিন্তু মোটেই তা নয়। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রচেষ্টা। আমিও এখন উনাদের মত বিতর্কে না গিয়ে “তাই ” বলার চেষ্টা করি, যদিও তা মাঝে মাঝে সম্ভব হয় না (হয়তো বাংলাদেশী বলেই অহেতুক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ি )।
জীবনের কোন অভিজ্ঞতাই ফেলনা নয়।
এপ্রিল ২০১৫।